Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আনন্দ ও বিষণ্ণতার বায়োস্কোপ

অদিতি বসু রায়

 

যে কবিতার বইতে পাতায় পাতায় বর্ষাকাল, বন্ধুত্ব আর নস্টালজিয়া ভেসে থাকে, তার নাম, ‘শিস কাটছে অহিফেন’। কবি অগ্নি রায়ের সাম্প্রতিক কবিতার এই বইটির প্রথম লেখাটি থেকে পাঠক পাড়ি দেন এক আশ্চর্য ম্যাজিক ও নস্টালজিক বাজনার জগতে— সে জগত ভরে থাকে বিসর্জনে, ‘তুমি চলকে যাও আর বাড়াও হাত/ আর মানুষ কই, সব শীতার্ত,/ কত গ্রামভাসি রোজ ডুবছে মন/ তাই টুকরো রোদ দিও শেষপাতে’। এই অন্তিমের রোদটুকু থেকে কে আর পরিত্রাণ চায়! এই নশ্বর জীবনের দুপারের স্মৃতি-কোলাজ যে দীর্ঘ জীবনযাপনের স্বরলিপি লেখে— এই বই বারেবারে তার কথা মনে করিয়ে দেয়। সেখানে স্কুলফেরত ছাতা, সেখানে জলের চাঁদ, সেখানে চলকে যাওয়া রাত— শৈশবের মাঠে পড়ে থাকে। ফিরে যেতে না পারা— মেনে নিয়ে কবি লেখেন, ‘এই মাত্র রোদে শুকোতে দেওয়া কুল চুরি করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছ, এমনভাবে হেসে তুমি যখন সামনে বসলে, আমার পুরনো পাড়ার কথা মনে পড়ে গেল। সেই মালির মাঠ, দোলমঞ্চ আর ঝুলন পূর্ণিমার মাঠে ভূতের গল্প! আমাদের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া সময় উড়তে থাকল চঞ্চল। আমাদের মধ্যে এসে বাঁশি বাজিয়ে গেল কোন কানহাইয়া কৃষ্ণ?’ (কবিতা – অলক্ষ্যগোচর)। এই পংক্তিগুলোর মধ্যে পুরনো দিনের প্রতি আকুতি ফুটে উঠেছে প্রবলভাবে। শিশুকালকে ছুঁয়ে থাকা উপাদানসমূহ মালির মাঠ ও ছেলেবেলার পাড়ার প্রসঙ্গে কবি, ফিরে ফিরে যেতে চেয়েছেন সেই সব অনাবিল উৎসবের দিনে। যেখানে হাতছানি দিয়ে স্থির আছে রংমশালের শিখা, লাটিমের সুতো এবং হারানো পরিজন, ‘সন্ধ্যামণি জুড়ে বাগান ছড়িয়ে আছে/ আর সঙ্গে ছড়াল মায়ের দীর্ঘ কেশভার,/ বারাসাত লোকালে নেমে বাস পালটে ফিরে/ এক কাপ চা ততক্ষণে হয়ে গেছে বাবার’ (কবিতা – আমাদের সন্ধ্যা দুপুর ও রাত)। সেই সব হাফপ্যান্ট ও আহির ভৈরব-এর দিনকাল জলের মতো ভেসে ভেসে এসেছে এই বইয়ের পাতায় পাতায়। নিজের জন্মের দিনটির প্রতি আগ্রহ নিয়ে কবি পেছনে তাকিয়ে দেখেছেন, ‘শীতের জাতক জন্মে গুড়ের উৎসব শুধু/ পায়েসের গন্ধে বান ডাকছে সকাল থেকে/ আশপাশের কার্নিস, গলি, পড়শি জানলার কাছে/ গর্বিত সংবাদের মতো সেই জন্মের ঋণ রয়ে গেছে’। এই জন্মের উত্তরাধিকার বহন করার ডাকনাম যে জীবনযাপন তাই-ই প্রতিফলিত হয়েছে ‘ঋতুচক্র’ নামের কবিতাগুচ্ছতে। আমাদের ছটি ঋতুর পরিচয় লিখিত হয়েছে কবিতা-আকারে। অপরূপ সেই সব আলোকিত লাইন— ‘অন্ধগলির চিলতে বারান্দায় রাখা টবের রুগ্ন গাছও মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দেয়, রাজা এসেছেন’ (কবিতা – বসন্ত)। এই যে রাজার আগমনকে স্বাগত জানানো— এইভাবে সে রুগ্ন গাছ থেকে মরে আসা সম্পর্ককে আলো দিতে এগিয়ে আসে— সে এক অনিবার্য বসন্তকাল। সে বসন্তকাল, রাজা। তার মুকুটে নবপুষ্পদলের সঙ্গে অঙ্কিত থাকে আশার বার্তা। সেই সব অলীক এবং প্রার্থিত ইচ্ছেরা ‘ঋতুচক্র’ নামের গুচ্ছ কবিতার ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে। আছে গভীর রাতের অন্ধকারের কথা। সে সব শীত-গাথা। এ এক এমন হিমের কাল, যেখানে ‘তোমার বুনে দেওয়া মাফলার পাবে বলে গোটা বছর অপেক্ষায় থাকে আতুর টনসিল’। কবিতায় তাঁর এক বিষণ্ণ ফাস্টবোলার হেঁটে যান— শীতকালের বিকেলে অজানা দেশের জোকার আসে। আসে স্বপ্নসুন্দরীরা।

শিস কাটছে অহিফেন | অগ্নি রায় | সিগনেট | ৩৯৯ টাকা

নস্টালজিয়া এই কবিতা-বইয়ের অন্যতম ব্র্যান্ড হলে, এই বইয়ের আত্ম-পরিচয়ে প্রেমের কথাও লেখা থাকতেই হবে। লেখা থাকা দরকার অসুখের দিনকালের কথাও। ‘কোভিড ডায়েরি’ নামের সিরিজটিতে সেই দুনিয়া-বন্ধ করে দেওয়া অসুখের দিনকাল লেখা হয়েছে উদাসীন ভঙ্গিতে, ‘ছুটে যাওয়া সাইরেনের থেকে নির্ঘাত সঙ্গীত নেই, তা বুঝে নিয়েছে জাতীয় সড়ক। এই অনন্ত স্পর্ধাপতনের থেকে পালক সামান্য দূরে যে পাখি ব্যক্তিগত সংবাদের দিকে উড়ে গ্যালো, তার এসবে মন নেই”। সেই সব দিনে, ‘নিঃশ্বাসের দরে’, আস্ত শহর বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। ‘অ্যান্টিভাইরাল রোদ’ তখন ছিল সামান্য। বন্ধ ঘরে, বসতে কেবল শবদেহে ভিড়। মড়কের কালের সত্য-কথন— এই বইয়ের অনিবার্য গ্রহণযোগ্যতা নির্মাণ করে। আর যে অংশটুকু বলার, তা হল— প্রেম। এই বইয়ের প্রথম লেখাটিই তা প্রকাশ করে, ‘তুমি চলকে যাও আর বাড়াও হাত/ আর মানুষ কই, সব শীতার্ত,/ কত গ্রামভাসি রোজ ডুবছে মন/ তাই টুকরো রোদ দিয়ো শেষপাতে’। সেখানে ভিজের চশমা-পরা প্রেমিকার ঝাপসা নজরের প্রতি গভীর মমতায় কবি এগিয়ে গিয়েছেন আরও গহন পথের দিকে, ‘তুমি এলে জোয়ার হবে/ চাঁদের টানে চাঁদ,/ শাড়িও যেমন প্রাচীন হচ্ছে/ আমি দেখেছি দৈবাৎ!/ মঞ্চে তখন হুটোপাটি/ ঝড় আসছে ওই/ শিফন সামলে সে একবার/ পিছনে তাকাবেই…’ (কবিতা – বইমেলার পদ্য)।

শিস কাটছে অহিফেন, এই ফিরে তাকানোর কথা বলে— যেভাবে ফিরে তাকালে পুরনো প্রেম, ছেলেবেলা এবং হারানো অনন্ত করতলে এসে বসে বিষণ্ণতা ও আনন্দের কথা ফিরিয়ে নিয়ে আসে। কবি অগ্নি রায়ের নাজুক কাব্যভাষা ও নীরবতা, বইটিকে এক রঙিন বায়োস্কোপের রূপ দিয়েছে।