Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আলোর পথযাত্রী— মঙ্গল ধাওয়ালে

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 

মঙ্গল ধাওয়ালের নাম শুনেছেন? কিংবা সিয়া শেলারের নামটা কি চেনা চেনা লাগছে? ওমা, একি! ডাইনে বাঁয়ে ঘনঘন ঘাড় নাড়ছেন কেন? তার মানে শোনেননি, তাই তো? ভালই হয়েছে। শুনলে আমার এই লেখায় নজর না দিয়েই স্রেফ আঙুল নেড়ে তাকে হয়তো খারিজ করে দিতেন। আসলে আমি মাত্র কিছুদিন আগে এই দুজনের কথা শুনেছি, পড়েছি আর জেনেছি দৈনিক সংবাদপত্রের সূত্রে। এদের কথা জেনে শ্রদ্ধায় মাথা আপনাআপনি নুয়ে পড়েছে। তখন থেকেই ভাবছিলাম আপনাদের কাছে এই দুজনের কথা পৌঁছে দেব। তেমন ইচ্ছে নিয়েই আজ স্ক্রিনের ওপর কথার জাল বিছাচ্ছি।

মঙ্গল ধাওয়ালে আর সিয়ার কথা জানতে হলে আমাদের যেতে হবে মহারাষ্ট্রের পুনেতে। সেখানকার আন্দ গাঁওয়ের অটল‌ওয়াড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একমাত্র শিক্ষিকা হলেন শ্রীমতী মঙ্গল ধাওয়ালে আর সিয়া শেলার হল স্কুলের একমাত্র ছাত্রী। অবাক হচ্ছেন? আর‌ও অনেক অনেক কথা যে এখনও বাকি! সরকারি পরিসংখ্যান জানাচ্ছে পুনে জেলার ৩৬৩৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে অটল‌ওয়াড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো একল স্কুলের সংখ্যা হল ২১টি। গোটা রাজ্যে এমন একল বিদ্যালয়ের সংখ্যা ঠিক কতগুলো সেই তথ্য অবশ্য জানা নেই। পুনে জেলার পার্বত্য অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত দুর্গম অংশেই এমন স্কুলগুলো ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে।

 

অটল‌ওয়াড়ির স্কুলের বরাবরই এমন হা-পড়ুয়া দশা ছিল না। আন্দ গাঁওয়ের এই বসতিতে একসময়ে প্রায় ৪০টি পরিবার বসবাস করত। সামান্য কিছু খেতিবাড়ি আর গাই-বকরি পালন করেই তাদের কোনওরকমে দিন গুজরান করতে হত বেশ কষ্ট করে। কিন্তু একসময়ে এইসব কাজেও টান পড়ায় বাধ্য হয়ে লোকজন বাপ-পিতামহের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যায় পুনে, পিরাঙ্গুট অথবা জেলারই অন্য কোনও আস্তানায়। গ্রাম ফাঁকা হতেই অটল‌ওয়াড়ির পাঠশালার ঘরগুলোতে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হল এক-এক করে, স্কুলের জমি জুড়ে বেড়ে উঠতে লাগল লম্বা লম্বা ঘাস আগাছা আর বুনো লতাপাতার ঝোপ, স্কুলের ক্লাসঘরগুলোকে আগলে রাখা উঠোন ঢাকা পড়ল অযত্নে ইচ্ছেমতো বাড়তে থাকা আগাছার সবুজ চাদরে। ভেঙে পড়া গেট, স্কুলের দেওয়ালে জমা শ্যাওলা আর বুনো লতাপাতার অন্তরাল, পরিসর জুড়ে বিরাজমান কোলাহলবিহীন সন্নাটা— এক প্রাণহীন হানাবাড়ির কথা মনে পড়িয়ে দেয়। রসিকা, সিয়ার সামান্য বড় দিদি, তার পুরনো স্কুলের পাশ দিয়ে যেতে এখন রীতিমতো ভয় পায়। বোনের মতো সেও ছিল একলা পড়ুয়া। সে জানে এভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কতটা কঠিন! এখন তাদের ছোট্ট গ্রামটিতে মাত্র দশ ঘর বাসিন্দা। স্কুলে যাওয়ার মতো কেউ বিশেষ নেই। গাঁয়ের বাসিন্দা বলতে কিছু বয়স্ক অসমর্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, স্কুলে যাওয়ার কোনও তাড়নাই নেই তাঁদের। একটু বড় হ‌ওয়ায় রসিকা বুঝতে পারে গ্রামের জনশূন্যতা কীভাবে ক্রমশ তাদের জীবনের চলতি সুযোগসুবিধাগুলোকে বন্ধ করে দিতে বাধ্য করছে।

অটল‌ওয়াড়ির স্কুলের একটি মাত্র ঘরে এখনও চলে পঠনপাঠনের প্রক্রিয়া। দিদিমণি মঙ্গল ধাওয়ালে রোজ আসেন স্কুলে। আসেন ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে। সপ্তাহের ছটি কর্মদিবসের প্রতিটা দিন তিনি হাজির থাকেন তাঁর কর্মস্থলে। গত জুলাই মাসে বদলি হয়ে এসেছেন এখানে বছর চল্লিশের এই শিক্ষিকা। সতেরো বছরের শিক্ষিকাজীবনে এমন একল স্কুলের দায়িত্ব পালন এই প্রথম। তাঁর স্বামীও শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত। বাড়িতে দুটি সন্তান রয়েছে তাঁর। মেয়েটি বড়। বছর বারো বয়স তার। পড়ে ক্লাস সেভেনে। মেয়ে বাবার সঙ্গে স্কুলে যায়। ছেলের বয়স পাঁচ‌। সে এখন বাল‌ওয়াড়িতে যায়। মঙ্গল অটল‌ওয়াড়িতে আসার পথে ছেলেকে সেখানে নামিয়ে দিয়ে আসে। বেলা দুটোয় মেয়ের স্কুল ছুটি হয়। ফিরতি পথে সে-ই ভাইকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। এভাবে সংসারের টুকিটাকি সব কাজ ঠিকমতো মিটিয়ে প্রতিদিন নিজের স্কুটিতে চেপে স্কুলে আসেন মঙ্গল ধাওয়ালে। কেননা তিনি জানেন তাঁর পথ চেয়ে বসে আছে আরও একটি ছোট্ট শিশু— সিয়া শেলার। সেও যে তাঁর সন্তানসমা।

গ্রামে ঢুকেই স্কুটারের হর্ন বাজান মঙ্গল। প্রায় জনশূন্য নিস্তব্ধ গ্রামের বাতাসে সতর্ক সাইরেনের আওয়াজ হয়ে তা ছড়িয়ে যায়। নিজের বাড়িতে অপেক্ষমান সিয়া চঞ্চল হয়ে ওঠে সেই শব্দে।

“আই, আনি আজি আইল্যা আহেত।”— মা! দিদিমণি এসে গিয়েছেন। তৈরি হয়েই ছিল সিয়া। গুছিয়ে রাখা ব্যাগ আর জলের বোতল কাঁধে নিয়ে সে স্কুলের দিকে ছুট লাগায়। সরিতা, সিয়ার মা, ঘরের কাজ ছেড়ে মেয়ের পিছু নেন। সরিতা জানেন এই যুগে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া, পড়াশোনা শেখাটা কতটা জরুরি, কতটা প্রয়োজনের। সমর্থ— সিয়া, রসিকার ভাই— দিদি আর মায়ের পিছন পিছন চলতে শুরু করে। সেও যে দিদির সঙ্গে বসে পড়বে ব‌ই নিয়ে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই মেতে উঠবে পড়া পড়া খেলায়।

এতটা পথ স্কুটি চালিয়ে এসেও জিরোবার এতটুকু ফুরসৎ নেই দিদিমণি মঙ্গল ধাওয়ালের। কাঁধের ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ‌ হাতড়ে হাতড়ে বের করে আনেন স্কুলের ক্লাসঘরের চাবির গোছা। ব্যাগটা টেবিলের ওপর রেখেই কাপড়ের আঁচলটাকে কোমরে গুঁজে ঝাঁটা হাতে ঘর ঝাঁটাতে লেগে পড়েন মঙ্গল। কখনও কখনও সরিতা দিদিমণিকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই ঝাড়ু দিয়ে ঘরটা পরিষ্কার করে দেন। মঙ্গল আপত্তি করেন। সরিতা সে বারণ শোনেন না।

সার সার বন্ধ অন্ধকার ঘরের মধ্যে এই ঘরেই জ্বলে ওঠে আলো— জ্ঞান, চেতনা, বোধ, বিশ্বাস আর শিক্ষার উজ্জ্বল অমলিন আলো। নীরব নিথর অটল‌ওয়াড়ির স্কুলের একল ক্লাসঘরে তিরতির করে ব‌ইতে থাকে প্রাণের স্পন্দনধারা। ব্যাগ ব‌ই নিয়ে গুটিগুটি পায়ে হাজির হয় সমর্থ। দিদির পাশে সেও বসে পড়ে। মঙ্গল আপত্তি করেন না। কেননা তিনি বোঝেন ফাঁকা ক্লাসঘরে নির্বান্ধব সিয়ার পক্ষে পড়াশোনায় মন বসানো কতটা কঠিন।

ঘরে আলো নেই। ইলেকট্রিক বিলের টাকা না মেটানোয় স্কুলের বিদ্যুৎসংযোগ কবেই কেটে দেওয়া হয়েছে। সিয়া সরিতা হাত লাগায় ঘরের নড়বড়ে হয়ে যাওয়া জানালাগুলো খুলতে। মঙ্গল একটুখানি ধাতস্থ হতেই শুরু হয় সিয়ার পঠনপাঠনের পর্ব।

কেমন ছাত্রী সিয়া? এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে জেনে বেশ গদগদ হয়ে ওঠেন মঙ্গল। “নিজের ছাত্রী বলে বলছি না, সিয়া খুব বুঝদার ছাত্রী। একবার বললেই ও সবকিছু চটপট ধরে নিতে পারে। অথচ এই সিয়াই প্রথম প্রথম দিদিমণির সামনে একেবারে বোবা হয়ে থাকত। কোনও কথা বলত না, কোনও প্রশ্ন করত না। প্রশ্ন করলে উত্তর দিত না। সত্যি কথা বলতে কি আমি তো অটল‌ওয়াড়ি থেকে ট্রান্সফার নেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেছিলাম। বাড়িতে আমার স্বামীর সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেই তিনি আমাকে গোটা পরিস্থিতিকে সিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবার কথা বললেন। সত্যি বলতে কি আমি আগে সেভাবে ভাবিনি। আমার ছাত্রীর জায়গায় গিয়ে সিয়াকে বোঝার চেষ্টা করতেই বরফগলার ইঙ্গিত মিলতে শুরু করল। জুলাই মাসে আমি এখানে কাজে যোগ দেওয়ার আট দিন পরে সিয়া আমার সঙ্গে প্রথম কথা বলল। ওই মুহূর্তটাকে আমি চিরকাল মনে রাখব। আসলে শিশুরা হল ফুলের কুঁড়ি। তাই পাঁপড়ি খুলে নিজেকে মেলে ধরতে ওদের খানিকটা সময় লাগে। সেই সময়টুকু ওদের না দিলে চলবে কেন?” ভাবছি এই দরদি মন কজনের থাকে?

 

সিয়া এখন তার দিদিমণির জন্য অপেক্ষা করে থাকে। হোক না একল স্কুল, স্কুলের পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে বেশ মানিয়ে নিতে পেরেছে সে। এখন প্রায় প্রতিদিনই ছোটভাই সমর্থ তার সাথী হয়ে স্কুলে যায়। ভাইয়ের বয়স এখন তিন বছর। যেহেতু তাদের গ্রামে কোনও অঙ্গন‌ওয়াড়ি কেন্দ্র নেই তাই সমর্থ দিদির সঙ্গে স্কুলে যায়। এভাবেই অনেক নতুন জিনিস শিখে ফেলেছে সে। বাড়িতে পৌঁছে দুই দিদির পাশাপাশি সেও রীতিমতো পড়তে বসে পড়ে।

সারাদিন কীভাবে কাটে দিদিমণি মঙ্গল ধাওয়ালে আর ছাত্রী সিয়া শেলারের স্কুলযাপনের পর্বটি? পরিচিত পারিবারিক আবহে যেভাবে মা আর মেয়ের দিন কাটে ওদের দিন‌ও সেভাবেই আনন্দে কেটে যায়। মঙ্গল জানেন এখানে এই একল স্কুলে তিনি যতটা দিদিমণি তার থেকে অনেক বেশি তিনি সিয়ার মা, বোন, বন্ধু, নিভৃত বাসের একান্ত সহচরী। একনাগাড়ে ব‌ইয়ের বাঁধা কথা আউড়ে গেলে সিয়া ক্লান্তি বোধ করবে, পড়াশোনার আগ্রহ যাবে কমে। তাই চেনা গতের লেকচার ছেড়ে মঙ্গল তাঁর ছাত্রীর সঙ্গে গল্প করেন, কখন‌ও ক্লাসঘরেই চলে এক্কাদোক্কা খেলা, কখন‌ও দুজনে মিলে গেয়ে ওঠেন গান, টিফিনের সময় বাক্স খুলে চলে টিফিন ভাগাভাগির খেলাও। এটা কিন্তু একদিনের বিষয় নয়, ঘড়ি মিলিয়ে নিত্যদিন চলে ক্লান্তিহীনভাবে আলোর পথে অভিযাত্রা।

এদেশের শিক্ষা নিয়ে যাঁরা হাজারো পরিকল্পনা করেন, তাঁরা নিশ্চয়ই অটল‌ওয়াড়ির মতো এই একল স্কুলের কথা ভাবেন না। ক্লাস্টার স্কুলের ব্যবস্থা হলে কি সিয়ার সমস্যা মিটবে? মঙ্গল ধাওয়ালে তেমনটা মনে করেন না। ক্লাস্টার স্কুলের ধারণাটা অবশ্যই ইতিবাচক তবে আন্দ গাঁওয়ে এমন ব্যবস্থা চালু হ‌ওয়া অসম্ভব। এই স্কুল তুলে দিয়ে যদি দূরের কোনও ক্লাস্টার স্কুলে সিয়াকে পাঠানো হয় তাহলে তাকে পড়াশোনাকে আলবিদা জানাতে হবে। সেটা নিশ্চয়ই কাম্য নয়।

কথায় কথায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। দূরের পাহাড়ের ঢালে দিনান্তের সূর্যদেব পাটে বসার আয়োজন করতেই মঙ্গল ধাওয়ালে তাঁর বাড়িতে ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করেন। প্রতিদিনের মতো সরিতা এসেছেন মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পড়ন্ত বিকেলে দিগন্তরেখায় রঙের খেলায় মেতে ওঠেন অংশুমালি দিবাকর। যাওয়ার আগে মঙ্গল, সিয়া আর সরিতার কানে কানে যেন বলে যান—

ও আলোর পথযাত্রী
আসে রাত্রি,
এখনি থেমো না।

চরৈবেতি, চরৈবেতি, চরৈবেতি।

 


*এই প্রতিবেদনটি লেখার জন্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই। এই খবর প্রথমে তাঁরাই প্রকাশ করেন। ছবিগুলো পত্রিকার জন্য তুলেছেন পবন খেঙরে। তাঁর কাছেও অশেষ ঋণী।