মানস নাথ
উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হলেন গোরক্ষনাথ মন্দিরের পীঠাধীশ্বর ও মহন্ত যোগী আদিত্যনাথ। কে এই যোগী? খবরের কাগজে নিউজ চ্যানেলে তো অনেক কিছুই ভেসে আসছে…। জানেন কি কিছু, এই যোগী সম্প্রদায় এবং গোরক্ষনাথ মন্দির ও মঠ সম্বন্ধে?
নেপাল সীমান্তবর্তী উত্তর প্রদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হল গোরক্ষপুর। সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে থাকা নাথ সম্প্রদায় এবং নাথপন্থী যোগীদের অন্যতম প্রধান তীর্থকেন্দ্র হল এই শহরের গোরক্ষমঠ। যোগী গোরক্ষনাথের ধুনি এখনও প্রজ্জ্বলিত এই মঠে। তার নামেই শহরের নাম। শহরের আর একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের নাম গীতা প্রেস। ভারতবর্ষে রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই এই মঠের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আধুনিক ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই মঠ প্রথমে কংগ্রেসের সাথেই ছিল। গুরু গম্ভীরনাথ ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় হিন্দু ধর্মীয় মহন্ত। তিনি ছিলেন কাশ্মীরের মানুষ। ১৯১৭ সালে তাঁর মৃত্যুর পর মহন্ত হন ব্রহ্মনাথ। ১৯৩২ সালে যোগী ব্রহ্মনাথের প্রয়াণের পর এই মঠের মহন্ত হন দিগ্বিজয়নাথ। সেন্ট অ্যান্ড্রুজ কলেজ থেকে স্নাতক লন টেনিসের ভক্ত এই দিগ্বিজয়নাথ ভারতীয় রাজনীতির এক বিতর্কিত চরিত্র।
১৯২২ সালে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে গান্ধীজীর নন কো-অপারেশন মুভমেন্টে যোগ দেন তরুণ সন্ন্যাসী দিগ্বিজয়নাথ। কিন্তু তাঁর উপস্থিতিতেই চৌরিচৌরাতে ২৩ জন পুলিশকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়। গ্রেফতার হন দিগ্বিজয়নাথ। যার ফলশ্রুতিতে গান্ধীজী আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। তখন থেকেই তীব্র গান্ধীবিরোধী তিনি। ১৯৩২ সালে মহন্ত হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সাভারকর তাঁকে ১৯৩৭ সালে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভায় যোগদান করান। দেশ স্বাধীন হবার পরে পরেই মহাত্মা গান্ধীকে হুমকি দিয়ে জেলেও যেতে হয় তাকে। ১৯৪৯ সালে এই দিগ্বিজয়নাথের হাত দিয়েই নতুন করে রাম জন্মভূমি আন্দোলন শুরু হয়। অযোধ্যায় টানা ন’দিন রামচরিত মানস পাঠের পর দশম দিন বাবরি মসজিদে ঢুকে রাম সীতার মূর্তি বসিয়ে দিয়ে আসেন এই যোগী!
দিগ্বিজয়নাথ পরবর্তীকালে ভোটে জিতে সাংসদ হয়েছিলেন। ১৯৬৯-এ তাঁর মৃত্যুর পর মহন্ত হন অবৈদ্যনাথ। তিনিও টানা বহু বছর সাংসদ ছিলেন। ১৯৯৮ সালে নিজের লোকসভা আসনটি তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন শিষ্য আদিত্যনাথকে। সেই থেকে টানা পাঁচবারের সাংসদ বর্তমানে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এই যোগী সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী। তার মানে দেখা যাচ্ছে স্বাধীন ভারতে গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতির মধ্য দিয়েও এই যোগী সন্ন্যাসী সম্প্রদায় গোরক্ষপুর ও উত্তর প্রদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তাদের জনপ্রিয়তা ও প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছে। যদিও আধুনিক উন্নয়নমুখী ভারতের কাছে যোগী আদিত্যনাথ হল উগ্র হিন্দুত্ববাদের মুখ। মধ্যযুগীয় চেতনার প্রতীক। নগরমুখী ইন্ডিয়ার সাথে সনাতন ভারতবর্ষের এই ফারাক দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। তার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক এই যোগী সম্প্রদায় কী ও কারা।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় নেপাল থেকে বেশ কিছু পুঁথি উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। তা তিনি “হাজার বছরের পুরনো বাংলা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা” নামে প্রকাশ করেন। বাঙালি বৌদ্ধ ও শৈবতান্ত্রিক সিদ্ধেরা অপভ্রংশে সাধনসম্বন্ধীয় যে সকল পদ রচনা করতেন তা ‘দোহা’ নামে পরিচিত। সুনীতিবাবু এই দোহাগুলোকেই বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম রূপ বলে বলেছেন। এই পদের অন্যতম রচয়িতা লুইপা বা মীননাথ বা মৎস্যেন্দ্রনাথ। এই লুইপা এবং মীননাথ যে এক ও অভিন্ন ব্যাক্তি এই নিয়ে পণ্ডিতেরা একমত হয়েছেন। মীননাথকেই এখনও পর্যন্ত নাথযোগী সম্প্রদায়ের আদিগুরু হিসেবে চিহ্নিত করা গেছে। পরবর্তীকালে ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচী নেপাল থেকে মীননাথ রচিত আরও কিছু পুঁথি উদ্ধার করেন। বাংলাদেশের সাথে নাথযোগীদের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ থাকায় নাথপন্থার অনেক পুঁথি বাংলায় রচনা করা হয়। মীননাথ বাঙালী ছিলেন এই কথাই মনে করা হয়। বৌদ্ধযুগের সিদ্ধ ও সাহিত্যের সাথে নাথেদের নাম যুক্ত হয়ে পড়ায় ভ্রান্তিবশত অনেকেই তাদের বৌদ্ধযোগী ভাবতেন, অনেকের ধারণা ছিল তারা জৈন থেকে পরবর্তীকালে হিন্দু হয়েছেন কিন্তু আসলে তাঁরা ছিলেন শৈব। মীননাথ বা মৎস্যেন্দ্রনাথ নেপালে শৈবধর্ম প্রচার করতে যান। তিনি শৈবযোগী হলেও নেপালি বৌদ্ধদের মধ্যে চতুর্থ বোধিসত্ত্ব রূপে উপাস্য হন। তাঁর শিষ্য এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাথযোগী গোরক্ষনাথ। নেপালের মুদ্রায় তার নাম অঙ্কিত হয় এবং পশুপতিনাথ তূল্য সম্মান তিনি নেপালি হিন্দুদের মধ্যে পান। গোরক্ষনাথের নামেই ভারতের বিভিন্ন জায়গায় মঠ এবং মন্দির আছে। কলকাতা এবং বাংলার অনেক জায়গাতেও আছে। গোরক্ষপুর শহরটিও তারই নামানুসারে। বাংলা ভাষায় গোরক্ষ রচিত পদ পাওয়া যায় না। গোরক্ষ রচনাবলী হিন্দি সাহিত্যের মূল উৎস স্বরূপ ধরা হয়। এই গোরক্ষনাথকে কালিঘাটের কালিমন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা বলে অনেকেই মনে করেন। মীননাথ ও গোরক্ষনাথকে দশম শতাব্দীর যোগী বলে মনে করা হয়। তার আগের যোগীদের সম্বন্ধে তেমন কিছু তথ্য পাওয়া যায় না। বৌদ্ধধর্মের পতনের যুগেই নাথধর্মের বা নাথপন্থার অভ্যুদয় বলে মনে করা হয়।
নাথধর্ম সেই সময়ে সমগ্র ভারত ছাড়িয়ে কাবুল অবধি বিস্তার লাভ করেছিল।
হিংলাজ হল বর্তমান পাকিস্তানের বালুচিস্তানে অবস্থিত একটি শৈব তীর্থক্ষেত্র। কথিত আছে দক্ষযজ্ঞের সময় সতীর শরীরের একটি অংশ ওখানে পড়ে। এটি শৈবদের এবং শৈব ধর্মের প্রচারক যোগীদের অন্যতম প্রধান তীর্থস্থান। এই তীর্থ করার পর দক্ষিণ বাহুতে যোনিচিহ্ন আঁকার যোগ্যতা অর্জন করা যায়। যা সন্ন্যাসী এবং নাথপন্থী যোগীদের কাছে খুব সম্মানের।
১৩৮২ খ্রিস্টাব্দে এক নাথযোগী ধর্মনাথ বালুচিস্তানের হিংলাজ থেকে এসে তৎকালিক কচ্ছপ্রদেশ বা বর্তমান গুজরাটে একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই মঠের নাম ধীনোধর মঠ। দিল্লিতে তখন মুসলিম তুঘলক রাজাদের শাসন। এই ধর্মনাথ হঠযোগী হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কথিত আছে দ্বাদশ বৎসর মস্তকোপরি দণ্ডায়মান থেকে সাধনা করে তিনি অসীম ধৈর্যের পরিচয় দেন। ধীনোধর অর্থে সহিষ্ণুতার ধারক।
নাথযোগীদের আর এক মহন্ত ছিলেন চৌরঙ্গীনাথ। যার আশ্রমের উল্লেখ পুরনো কলকাতার অনেক তথ্যে পাওয়া যায়। চৌরঙ্গীনাথের আশ্রম থেকেই স্থানটির নাম বর্তমানে চৌরঙ্গী হয়েছে। এইখানে নাথযোগী হিসেবে আমাদের পরিবারের সম্বন্ধে দু-চার কথা বলে নিই। পারিবারিক ইতিহাস এবং প্রবাদ থেকে যা জানা যায় আমাদের আদি গৃহ এবং বাস্তু ছিল এই চৌরঙ্গীনাথের আশ্রমের নিকটেই। জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের রায়ত ছিলেন তারা। সাবর্ণদের কাছ থেকে সুতানুটি, গোবিন্দপুর, কলকাতা এই তিনটি গ্রাম কিনে নেওয়ার পর দুর্গ নির্মাণের জন্য বর্তমান ময়দান সংক্রান্ত এলাকাতেও ইংরেজরা জমি অধিগ্রহণ করে। সাবর্ণ রায়চৌধুরীর পরিবার তখন এখান থেকে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলোকে বড়িশা এবং জোড়াসাঁকোতে পুনর্বাসন দেন। সেই থেকে আমাদের পরিবার বড়িশা অঞ্চলের বাসিন্দা।
বর্তমানে নাথযোগীরা হিন্দু বা বলা ভাল ব্রাহ্মণ্যধর্মের মূলস্রোতে মিশে গেলেও বহু অঞ্চলে এখনও যোগীপাড়া বা যোগাশ্রম আছে। সেখানে কালি শিবের মাঝে গোরক্ষনাথের মূর্তিও পূজিত হয়। বাঙালি নাথযোগীদের মধ্যে মঠ বা গোরক্ষনাথের প্রভাব এখন আর তেমন দেখা যায় না। নাথপন্থীদের বারোটি শাখা আছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এদের দ্বাদশপন্থ বলে। দ্বাদশ বৎসরান্তে মহাকুম্ভতে বিভিন্ন শাখা থেকে এদের কার্যনির্বাহক নির্বাচন হয়। তারা মঠ পরিদর্শন এবং মোহান্ত নির্বাচন করেন। এই দ্বাদশপন্থীরা নিজেদের কানফাট্টা বলে পরিচয় দেন। তন্ত্র এবং যোগ সাধনায় সিদ্ধির স্তরে পৌছালে কানের লতি চিরে তারা কুণ্ডল ধারণ করেন। তার মানে তারা মুখের নয়, অন্তরের কথাও শোনার প্রজ্ঞা অর্জন করেছেন। প্রবাদ যে এই যোগীরা শুধু মানুষ নয় পশুপাখি, জীবজন্তু, গাছপাথরের মনের কথাও শুনতে পান। তাই গ্রামাঞ্চলে গবাদি পশুর মঙ্গলের জন্য তাদের ডাকা হত। বর্তমান মহন্ত আদিত্যনাথের গোসেবা আর গোরক্ষা সমিতি গড়ার পেছনে এর প্রভাব থাকতে পারে। তবে মহন্ত দিগ্বিজয়নাথের পর থেকে এই নাথপন্থার মূল শাখাটি ক্রমেই ব্রাহ্মণ্যধর্মের মূলস্রোতের সাথে মিশে যেতে শুরু করেছে। মৎস্যেন্দ্রনাথ গোরক্ষনাথদের হাতে মূলত গোঁড়া ব্রাহ্মণ্য সমাজের বিরোধিতা করে যে ধর্ম একসময় সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ, জৈন, সুফি ফকির, আউল বাউল সবার জন্যই তার দ্বার খোলা ছিল। গোরক্ষমঠ আদতে ছিল সুফি-বাউল, হিন্দু-মুসলমানের মিলনস্থল। সেখান থেকে আজকের মহন্ত যোগী আদিত্যনাথের গোরক্ষমঠ রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল। নাথপন্থার আলাদা চিহ্ন সেখানে প্রায় বিলীন।
এই ভারতবর্ষকে খুব কম লোকই চেনেন। জানার চেষ্টা আরও কম মানুষ করেন। কিন্তু এনারা আছেন। সনাতন বিভিন্ন পথ-মত-ধর্মের গোষ্ঠীগুলোকে হিন্দুত্বের ছাতার তলায় আনার চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। হিন্দু কী এবং কে, এ এক বিচিত্র জটিল প্রশ্ন এই দেশে। আসলে যা ছিল নিজেকে খোঁজা, আজ তা হয়ে গেছে তার রাজনৈতিক পরিচয়।
এই প্রসঙ্গে তিনটি মূল্যবান বইয়ের খোঁজ দিয়ে অশেষ উপকার করেছেন ফেসবুকের বন্ধু অভীক সরকার। বইগুলি হল ‘নাথপন্থ’, কল্যাণী মল্লিক, বিশ্বভারতী; ‘নাথ সম্প্রদায়ের ইতিহাস’, ঐ; ‘নাথধর্ম ও সাহিত্য’, প্রফুল্লচরণ চক্রবর্তী, নর্থ বেঙ্গল প্রেস। এছাড়া বিভিন্ন সংবাদসূত্র এবং ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি।