Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০২৩— কী পেলাম, কী পেলাম না

স্নেহাশিস মুখোপাধ্যায়

 


ব্যক্তিগতভাবে টুর্নামেন্ট থেকে কী কী পেলাম? ভবিষ্যতের ব্যাটিংতারকা রাচিন রবীন্দ্র। একটা আশ্বাস যে, রাহুল দ্রাবিড়ের তত্ত্বাবধানে ভারত ঠিক পথেই এগোচ্ছে। আগামীদিনের জন্য এশিয়ার দ্বিতীয় শক্তি হতে চলা আফগানিস্তান। একটা শিক্ষা যে, বড় টুর্নামেন্টে অস্ট্রেলিয়াকে হাল্কাভাবে নেওয়া পাপ। একটা ধারণা যে, ইংল্যান্ড নিজেদের তরুণ প্রজন্মকে সুযোগ দিলে স্বমহিমায় ফিরবে। পাকিস্তানের ওপর কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে, কিন্তু এক চিলতে রোদ্দুর হতে পারে সাইম আয়ুব-আবদুল্লাহ শাফিক ওপেনিং জুটি। শ্রীলঙ্কা অথৈ জলে। বাংলাদেশ মূর্খের স্বর্গে

 

২০২৩— অন্য অনেকের জন্য স্রেফ ক্যালেন্ডারের আরেকটা বছর। কিন্তু আমাদের মতো ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য? এটা বিশ্বকাপের বছর। টি-টোয়েন্টির দৌলতে বিশ্বকাপ নামক অনুভূতিটার সঙ্গে যদিও আমরা ঘনঘন পরিচিত হতে পারি, তবুও ওয়ান-ডে বিশ্বকাপ মানে এক অন্য রোমান্টিজম। একটা আবেগের চাদর, একটা পবিত্র ভালবাসা, একটা স্মৃতির ক্যানভাস। সচিনের আপারকাটের ছয় থেকে ২৩ মার্চ ২০০৩-এর স্বপ্নভঙ্গ, ক্যারিবিয়ান দ্বীপের দুঃস্বপ্ন থেকে ধোনির শট গ্যালারিতে আছড়ে পড়তেই অকাল দীপাবলি, এক একটা মুহূর্ত হৃদমাঝারে অমলিন। তাই ওয়ান-ডে বিশ্বকাপের জন্য মানসিক প্রস্তুতি জানুয়ারি থেকেই হয়ে গেছিল শুরু। আর বিশ্বকাপ এবার যখন ঘরের মাঠে, উত্তেজনার পারদ যে আকাশছোঁয়া হবে সন্দেহ নেই।

 

এবারের বিশ্বকাপে সরাসরি সুযোগ পেয়েছিল আটটা দেশ। ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান। অভ্যেসবশত শ্রীলঙ্কা লিখে ফেলতে যাচ্ছিলাম। ব্যাকস্পেস মারলাম। কী করব বলুন? শেষ যে-দুবার উপমহাদেশে বিশ্বকাপ হয়েছে, একবার তারা চ্যাম্পিয়ন আরেকবার পরাজিত ফাইনালিস্ট। সনতের বিক্রম, সাঙ্গার কভার ড্রাইভ, ভাসের হালকা লেট সুইং, মুরলির ভেলকি, মাহেলার লেট কাটের জাদুতে মুগ্ধ থেকেছি শৈশব থেকে কৈশোর। সঙ্গে ছিল মালিঙ্গার ইয়র্কার। আজ সে-সব ধূসর অতীত। সেই রাজা নেই, সেই রাজ্যপাটও নেই। বিশ্বকাপের শেষ দুটো স্থান প্রাপ্তির আসর বসবে জিম্বাবোয়ের হারারে শহরে আর সেখানেই ভাগ্য নির্ধারিত হবে একদা বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের। চ্যাম্পিয়নদের? ঠিকই তো। শুধু শ্রীলঙ্কা নাকি! প্রথম দুইবারের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকেও তো আসতে হবে সেই একই মাধ্যমে। কিন্তু শ্রীলঙ্কা নিজেদের কৌলিন্য রক্ষা কোনওমতে করে ভারতের টিকিট পেলেও, শূন্য রইল শাই হোপদের হাত। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছাড়া বিশ্বকাপ!!! কী আর করা যাবে। ক্রিকেটের বিশ্বায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো আইসিসির সর্বনেশে ১০ দলের টুর্নামেন্ট নীতি। হায় আয়ারল্যান্ড, হায় জিম্বাবোয়ে! সিকান্দার রাজা কিংবা পল স্টার্লিংদের হয়তো জীবনের শেষ বিশ্বকাপ আর খেলা হল না। কিন্তু ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল নেদারল্যান্ডসের। যাদের দলের মধ্যে একমাত্র বহু বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধিত্ব করার রুলফ ভ্যান ডার মারউই বাদে কারও অতীতে ভারতে খেলার কোনও অভিজ্ঞতা নেই।

 

কোন ১০ জন বিশ্বকাপ খেলছে ঠিক হওয়ার পরে শুরু হল নিজের নিজের মতো করে সম্ভাব্য সেমিফাইনালিস্ট বাছাই পর্ব। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের পাশাপাশি অনেকেই পাকিস্তানকে রেখেছিলেন। ভারত তখন শ্রেয়স, রাহুল, বুমরার চোটে নাজেহাল। কিন্তু চাকা ঘুরে গেল ১০-১১ সেপ্টেম্বর। এশিয়া কাপে কলম্বোতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সুপার ফোর-এর ম্যাচে ভারত করল ৩৫৬/২, জিতল রেকর্ড ২২৮ রানে। নাসিম শাহ চোটের কারণে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেলেন। আর পাকিস্তান? শাহিন আফ্রিদির অতিরিক্ত আগ্রাসী বোলিং-এর সঙ্গে ভারসাম্য আনতে যে নাসিমকে দরকার ছিল তাঁকে হারাল। ফলাফল? একটা হতশ্রী বিশ্বকাপ পারফরমেন্স। প্রত্যাশিত? অবশ্যই। পাকিস্তান ক্রিকেট টিকে আছে পিএসএল-এর জন্য। ফখর জামান চোট পেয়ে পেশওয়ার গিয়ে পেশওয়ার জালমি সেট আপে থেকে ট্রেনিং করে ফিরলেন। ওরা ক্যাম্প করে, ওরা স্কাউটিং করে। আর পিসিবি? থাক। দলটা প্রথমবার ভারতে এসে একরাশ দুঃস্বপ্ন নিয়ে ফিরল।

 

পাকিস্তান তো প্রত্যাশামতোই করল ফলাফল। তাহলে প্রত্যাশা ছাপিয়ে গেল কে? আফগানিস্তান। এমন কোনও ক্রিকেটপ্রেমী নেই যে আফগানিস্তানের এই দলটার প্রেমে পড়েনি। তিন-তিনটে বিশ্বকাপজয়ী দলকে তারা পরাজিত করেছে। আর পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের? আফগান প্লেয়াররা শেষদিন অবধি ভাববে ওই ম্যাচ কীভাবে হেরেছিল।

 

আফগানিস্তান যদি প্রত্যাশা ছাপিয়ে গিয়ে থাকে, সব প্রত্যাশা জলে দিয়েছে ইংল্যান্ড। কিন্তু কেন হল এমন? প্রথম হচ্ছে বোলিং আক্রমণটা কমজোরি ছিল। এমন কোনও বোলার ছিল না যার কাছে নির্দ্বিধায় যাওয়া যায় উইকেটের আশায়। ক্রিস ওকস শেষ কিছু ম্যাচ বাদে ব্যর্থ, স্যাম কারেন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। টোপলি চোট, গাস আটকিনসন ধারাবাহিক সুযোগ পেলেন না। একসঙ্গে একাধিক ব্যাটার যেন ব্যাটিং করতেই ভুলে গেলেন। কোথাও গিয়ে একটা নেতৃত্বের জায়গাতেও ফাঁক ছিল। প্ল্যানিং, অ্যাপ্রোচ সবকিছুই নার্ভাস ছিল। সঙ্গে বাটলারের নিজের ব্যাটিংও। এমন একটা চক্রে পড়ে রইল যা থেকে বেরোলই না।

 

বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা নিয়ে বিশেষ বলার নেই। এরা প্রত্যাশামতোই খেলেছে। টপ লেভেলে কম্পিট করার জায়গায় আসতে ঢের দেরি। আলাদা করে বলতে হয় ডাচদের কথা। বিশ্বকাপে স্থান অর্জন করা থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হায়দ্রাবাদে নামা অবধি একটাও প্রতিযোগিতামূলক সিরিজ খেলার সুযোগ পায়নি তারা! কিন্তু ফেরেনি খালি হাতে। ফিরেছে একটা বিশ্বাস নিয়ে— যে আমরাও পারি। আর একটা জবাব দিয়ে— যে তোমরা অপরাধী। আমাদের মতো ক্রিকেটখেলিয়ে দেশগুলোর স্বপ্নকে মেরে ফেলার কোনও অধিকার তোমাদের নেই!

 

সেমিফাইনালিস্টদের নিয়ে খুব বেশি করে বলার কিছু নেই। ভারত প্রস্তুতির নিরিখে এই টুর্নামেন্টের শ্রেষ্ঠ দল হয়ে এসেছিল এবং সেটা ফুটিয়ে তুলেছে প্রতি ম্যাচে নিজেদের পারফরমেন্স দিয়ে। কিন্তু ফাইনালে? ভারত যেন ঠিক মহারথী কর্ণ। তার চাকা ফেঁসে গেছিল মাটিতে আর ভারত ফেঁসে গেল পিচে। আর অস্ট্রেলিয়ার মতো দল এই পর্যায়ে ফেঁসে যাওয়া বিপক্ষকে বেঁচে ওঠার সুযোগ দেয় না। সেইজন্যই তারা অস্ট্রেলিয়া। সেইজন্যই তারা বিশ্বত্রাস। সেইজন্যই তারা দুটো ম্যাচ এত কুচ্ছিত হেরে, এত এত প্রশ্ন নিয়েও স্রেফ মানুষ থেকে দৈত্যতে পরিণত হয়ে নিয়ে গেল তাদের ষষ্ঠ বিশ্বকাপ।

 

বাকি দুই সেমিফাইনালিস্টের গল্প তাদের ইতিহাস থেকে ভিন্ন হয়নি। দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলেও সেমির গণ্ডি আরও একবার পেরোতে ব্যর্থ দক্ষিণ আফ্রিকা। আবারও গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যাটিং বিপর্যয়, ক্যাপ্টেনের ক্রমাগত অফ ফর্ম, ট্যাকটিক্যাল ভুল— সব মিলিয়ে তাদের প্রতীক্ষা দীর্ঘায়িত হল।

 

কিউইরা চিরাচরিতভাবে আবারও সেমিতে উঠল। ওদের ইতিহাস বলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলের বিরুদ্ধে ওরা পয়েন্ট হারায় না। এবারও হারায়নি। কিন্তু কোথাও গিয়ে সেমিতে প্রাইম ফেলে আসা বোল্ট-সাউদির ওপর ভরসাটা ভরাডুবি করাল। রোহিত-গিল-কোহলি-আইয়ারদের দুরন্ত ব্যাটিংয়ে তোলা ৩৯৭ মিচেলের অসাধারণ প্রয়াসের পরেও নাগালের অনেক বাইরেও ছিল, আর সন্ধেটা ছিল শামির।

 

ব্যক্তিগতভাবে টুর্নামেন্ট থেকে কী কী পেলাম? ভবিষ্যতের ব্যাটিংতারকা রাচিন রবীন্দ্র। একটা আশ্বাস যে, রাহুল দ্রাবিড়ের তত্ত্বাবধানে ভারত ঠিক পথেই এগোচ্ছে। নকআউট জিততে কী দরকার? সেটা না-হয় অন্যদিন চর্চা হবে। আগামীদিনের জন্য এশিয়ার দ্বিতীয় শক্তি হতে চলা আফগানিস্তান। একটা শিক্ষা যে, বড় টুর্নামেন্টে অস্ট্রেলিয়াকে হাল্কাভাবে নেওয়া পাপ। একটা ধারণা যে, ইংল্যান্ড নিজেদের তরুণ প্রজন্মকে সুযোগ দিলে স্বমহিমায় ফিরবে। পাকিস্তানের ওপর কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে, কিন্তু এক চিলতে রোদ্দুর হতে পারে সাইম আয়ুব-আবদুল্লাহ শাফিক ওপেনিং জুটি। শ্রীলঙ্কা অথৈ জলে। বাংলাদেশ মূর্খের স্বর্গে। শামি ভারতের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বিশ্বকাপ বোলার হয়েও ট্রফি ছুঁতে পারলেন না। ভারত মানেই ফ্ল্যাট পিচ আর ছোট বাউন্ডারি— এই মিথটা অনেকটাই ভাঙল। আর সব শেষে? স্বপ্নে বুক বেঁধে একরাশ হতাশায় শেষ হল ভারতীয়দের বিশ্বকাপ উৎসব।


*মতামত ব্যক্তিগত