অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘স্বয়ং’ এই উদ্ধারকাজের তদারকি করছেন। উদ্ধার-মুহূর্ত আসন্ন বলে মনে হলেই আলোকচিত্রী ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে তিনি যে নিজেই সুড়ঙ্গপথের বাইরেটায় এসে দাঁড়াবেন, তাও বোধ করি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সেই নির্লজ্জ নাটককেও মেনে নিতে রাজি, যদি-বা তার বিনিময়ে অন্তত এই ৪১ জন মানুষকে অক্ষত, সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করে আনা চলে
চামোলি, কিন্নৌর, উত্তরকাশী— চারধাম প্রকল্পের অন্ধকার যেন কিছুতেই আর পিছু ছাড়ছে না। দশদিন সময় অতিক্রান্ত। এখনও দীপাবলির ভোর থেকে আটকে পড়া ৪১ জন শ্রমিক উত্তরকাশীর বালকোট-সিলকিয়ারা সুড়ঙ্গে উদ্ধারের জন্য অসহায় অপেক্ষায় রয়েছেন। এরই মধ্যে দীপাবলি কেটেছে। কেটে গিয়েছে বিশ্বকাপ। উৎসবের ‘মরসুম’ ফুরোলে সরকারের তরফে বিবৃতি দিয়ে সংবাদমাধ্যমকে অনুরোধ করা হয়েছে “দয়া করে বিষয়টিকে নিয়ে ‘অহেতুক রোমাঞ্চকর’ প্রচার চালাবেন না।” সোজা কথায় ‘সেনসেশনালাইজ’ করবেন না। যদিও মোদি-ভক্ত মিডিয়ার তরফে প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই সংবাদকে ‘সেনসেশনালাইজ’ করে ফেলার যে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি আমরা দেখেছি, এমন কোনও আহ্বানই অন্তত বিশেষ এই ঘটনার নিরিখেও তাদের সংবাদ-পরিবেশনের ক্ষেত্রে তেমন কোনওরকম সদর্থক/গঠনমূলক প্রভাব ফেলতে পারবে বলে মনে করছি না।
চারধাম প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক আজকের নয়। হিমালয়ের মতো ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর এক ভূমিরূপে যে চূড়ান্ত অপরিকল্পনায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের তরফে একের পর এক ‘বিকাশমূলক প্রকল্প’ আত্মপ্রকাশ করে চলেছে, তারই ফলশ্রুতি হিসেবে আমরা একের পর এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে চলেছি। যে বালকোট-সিলকিয়ার সুড়ঙ্গে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে, আমরা বরং দেখতে চেষ্টা করি বাস্তবে রূপায়িত হলে, সেই প্রকল্পের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ তথা তীর্থযাত্রীদের ঠিক কতখানি সুবিধা হতে পারত? তথ্য বলছে প্রায় ১৩৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সুড়ঙ্গপথ একবার কাজ শুরু করতে পারলে, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রীর মধ্যবর্তী দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার কমে আসত। এর ফলে তীর্থযাত্রীদের ক্ষেত্রে প্রায় ৪৫ মিনিট অবধি সময় সাশ্রয় হতে পারত। এখানেই বিচার করা যাক, হিমালয়ের অমন পার্বত্য অঞ্চলে— ৪৫ মিনিট সময় সাশ্রয়ের জন্য ১৩৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এমন একখানি সুড়ঙ্গপথ নির্মাণ ঠিক কতখানি যুক্তিযুক্ত? মনে রাখতে হবে শাস্ত্র-অনুযায়ী হিমালয়ের যতই প্রাগৈতিহাসিক/দৈবিক অস্তিত্ব থাকুক না কেন, বয়সের দিক থেকে এই পর্বতমালা আদতে নবীন ও এখনও অবধি তা উচ্চতায় বর্ধমান। কাজেই সেখানকার মাটি ও পাথরের চরিত্র, নিচেকার চ্যুতিরেখা বা বিভিন্ন প্লেটগুলির মধ্যে হঠাৎ ঠোকাঠুকি লেগে সাম্প্রতিক সুড়ঙ্গ বিপর্যয়ের মতো এমন একেকটি বিপদ ঘটে যাওয়ার যে চিরকালীন সমস্যা, সেই সমস্ত দরকারি বিষয়ে ওয়াকিবহাল না হয়েই বিরাট এমন একেকটি পাহাড় খোঁড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা, অথবা পাহাড় এফোঁড়-ওফোঁড় করে সুড়ঙ্গপথ বানিয়ে ফেলা যে চূড়ান্ত হঠকারিতা— সেই অপরিণামদর্শী ঔদ্ধত্যেরই আমরা জবাব পাচ্ছি আজ।
কেবল বিকাশেরই ঔদ্ধত্য নয়, হয়তো-বা এরই সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অর্থনীতি অথবা সোজা কথায় দুর্নীতিরও কোনও হিসেব। যা এখনও মেলানোর সময় আসেনি। কেবল দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালে হায়দ্রাবাদের কোম্পানি ‘নবযুগ এঞ্জিনিয়রিং’ সংস্থাকে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এই সুড়ঙ্গপথ নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৩৮৩ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ হলেও, নবযুগ এই কাজের জন্য মোট ৮৫৩ কোটি টাকা দাবি করে। এরই সঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন, এই বছরেরই আগস্ট মাসে মহারাষ্ট্রের সমৃদ্ধি এক্সপ্রেসওয়েতে কাজ চলাকালীন ক্রেন ভেঙে পড়ে যখন ১৭ জন মানুষের মৃত্যু হয়, তখন সেই প্রকল্পেরও অন্যতম অংশীদার হিসেবে এই নবযুগেরই নাম উঠে আসে। কাজেই পূর্ব-অভিজ্ঞতার নিরিখে এ-ধরনের কাজের দায়িত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে নবযুগ-এর মতো একটি সংস্থা কখনওই প্রথম বিকল্প হিসেবে উঠে আসতে পারে না। মহারাষ্ট্রের দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অবিলম্বে দেশব্যাপী নবযুগের বাকি সমস্ত প্রকল্পগুলিকেই নতুন করে খতিয়ে দেখার দরকার ছিল বোধহয়।
ইতিমধ্যেই আরও প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, এ-ধরনের সুড়ঙ্গের ক্ষেত্রে সমস্ত সময়ে— এমনকি নির্মাণের সময় থেকেই একটি করে ‘আপৎকালীন বেরিয়ে আসার ব্যবস্থা’ বা ‘এসকেপ প্যাসেজ’ তৈরি রাখা উচিত। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারের তরফে যখন এই সুড়ঙ্গ নির্মাণের নিমিত্তে দরপত্র আহ্বান করা হয়, তখন সেখানেও স্পষ্টভাবে এই ‘এসকেপ প্যাসেজ’ নির্মাণের কথা বলা ছিল। যাতে কোনও কারণে এ-ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে সেই ব্যবস্থার মাধ্যমে আটকে পড়া মানুষদের সঙ্গে সঙ্গে বের করে আনা যেতে পারে। কিন্তু দুর্ঘটনার পরবর্তীতে দেখা যাচ্ছে এই বালকোট-সিলকিয়ারা সুড়ঙ্গ-প্রকল্পে তেমন কোনও ‘এসকেপ র্যুট’ই এতদিন ধরে তৈরি করা হয়নি। খুব সহজভাবেই বিষয়টিকে বোধহয় চুক্তিভঙ্গের সঙ্গে সমান করে দেখা যেতে পারে। যদিও তার ফলে আটকে পড়া যে ৪১ জন শ্রমিক, বা তাঁদের বাড়ির লোকেরাও যাঁরা দুর্ঘটনার পরবর্তীতে এখানে ছুটে এসেছেন, তাঁদের যে চূড়ান্ত শারীরিক ও মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে, তার কথা ভাবলে পরেও একই সঙ্গে ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত হয়ে উঠতে ইচ্ছে হয়। অবাক করার মতো বিষয় হল, এই ঘটনার পরবর্তীতেও আমরা কোনও-না-কোনও সময়ে সেই চারধাম মহামার্গ প্রকল্পকে নিয়েই ‘বিকাশ’ বলে মাতামাতি করতে থাকব।
চামোলি, কিন্নৌর, উত্তরকাশী— এই সবকিছুকে মনে রেখে, অথচ তা থেকে কোনও শিক্ষা না-নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এই চারধাম প্রকল্পেরই এক নতুন অংশ হিসেবে ঋষিকেশ-কর্ণপ্রয়াগ যোগাযোগ প্রকল্প-সহ আরও বেশ কয়েকটি প্রকল্পের বিষয়ে জনতার কাছে নিজেদের তরফে নির্লজ্জভাবে একতরফা ঘোষণা ও প্রচার শুরু করেছে। নতুন এই ঋষিকেশ-কর্ণপ্রয়াগ প্রকল্পের আওতায় পাহাড় ফুঁড়ে নাকি আরও অন্তত ১২টি সুড়ঙ্গ বানানো হবে বলে জানা গিয়েছে। এছাড়াও, সেই সুড়ঙ্গগুলির মধ্যে একটির দৈর্ঘ্য হতে পারে অন্তত পনেরো কিলোমিটার। হিমালয়ের মতো নবীন এক সৃষ্টি, যা কিনা উপমহাদেশের বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশের বৃহত্তর অস্তিত্বের নিরিখেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, এভাবে বারংবার ভৌগোলিকভাবে তাকে ধ্বংস করে চলা— ঠিক কোন আধুনিকতা বা বিকাশের পরিচয় দেয় বুঝি না।
শেষ খবর পাওয়া অবধি দেশ-বিদেশ থেকে নিয়ে আসা যন্ত্রপাতি ও বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে উদ্ধারকাজ এগোলেও, এখনও অবধি সেই ৪১ জনকে পাকাপাকিভাবে উদ্ধার করে কবে সুড়ঙ্গের বাইরে নিয়ে আসা যাবে, সেই বিষয়ে কোনও নিশ্চয়তা নেই। তাঁদের কাছে অক্সিজেন, বাড়ির খাবার, ওষুধ, ইত্যাদি পৌঁছিয়ে দেওয়া গেছে। তাঁদের ছবি তুলে আনার ব্যবস্থা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘স্বয়ং’ এই উদ্ধারকাজের তদারকি করছেন। উদ্ধার-মুহূর্ত আসন্ন বলে মনে হলেই আলোকচিত্রী ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে তিনি যে নিজেই সুড়ঙ্গপথের বাইরেটায় এসে দাঁড়াবেন, তাও বোধ করি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সেই নির্লজ্জ নাটককেও মেনে নিতে রাজি, যদি-বা তার বিনিময়ে অন্তত এই ৪১ জন মানুষকে অক্ষত, সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করে আনা চলে।
*মতামত ব্যক্তিগত