Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ডাইনি নিগ্রহ : কুসংস্কার, ক্ষমতাতন্ত্র ও ইতিহাস

ডাইনি নিগ্রহ

দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য

 

লেখক ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি”-র সাধারণ সম্পাদক। বিগত আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি যুক্তিবাদী চিন্তা ও আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে উপস্থিত রয়েছেন। ধর্মান্ধতা-অলৌকিকতা-কুসংস্কার ও ওই ধরনের নানা বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিবাদ করেছেন, তদন্ত করেছেন, লেখালিখি করেছেন। তবে, সুনির্দিষ্ট ইস্যুকে অতিক্রম করে তাঁর লেখালিখি স্পর্শ করে যায় যুক্তি ও বিজ্ঞানের ভিত্তিস্বরূপ নানা গভীর তত্ত্বগত প্রশ্নকেও। তিনি ও তাঁর সংগঠনের সহকর্মীরা শহরে গ্রামে গঞ্জে অসংখ্য অলৌকিক’ গুজবের উন্মোচন করেছেন, কয়েক হাজার কুসংস্কারবিরোধী অনুষ্ঠান করেছেন, ধর্মীয় বুজরুকদের আইনিভাবে অভিযুক্ত করেছেন, যুক্তিবাদী বই-পত্রিকা-ক্যালেন্ডার-অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন। স্বভাবতই, তাঁদের কণ্ঠস্বর গুরুত্ব পেয়েছে প্রচারমাধ্যমেও। অযুক্তি ও অবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে লেখকের বহুসংখ্যক রেডিও-কথিকা সম্প্রচারিত হয়েছে, দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রতিবাদী বক্তব্য ও বিশ্লেষণ। তাঁর লেখনী বিশেষভাবে সক্রিয় থেকেছে বিজ্ঞানের ভেক ধরা অবিজ্ঞান ও অযুক্তির মুখোশ খুলতে।

 

অতি সাম্প্রতিক একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক।

গত অক্টোবর মাসের গোড়ার দিকে বাঁকুড়া জেলার পাত্রসায়র অঞ্চলের প্রশাসনের তরফ থেকে জরুরি খবর এল, সেখানকার এক গ্রামে এক পরিবারকে ডাইনি অপবাদ মাথায় নিয়ে ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে গ্রাম ছাড়তে হয়েছে, তাদের থেকে গ্রামের মাতব্বররা মোটা জরিমানাও আদায় করেছে। এ ব্যাপারে খবর করতে গিয়ে নিগৃহীত হয়েছেন ‘যুগশঙ্খ’ দৈনিকপত্রের  সাংবাদিক অভিজিৎ অধিকারী। অতএব, যুক্তিবাদী সমিতি থেকে আমাদের ছুটে যেতে হবে, গ্রামের মানুষজনকে বোঝাতে হবে যে অলৌকিক বলে কিছু হয় না, আর ডাইনিরা মানুষের খারাপ বা ভাল কিছুই করতে পারে না। কাজেই, স্রেফ মিথ্যা কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে কারও ওপর এইভাবে অত্যাচার করাটা খুবই অন্যায়, আর সেইসঙ্গে বোকামিও বটে। আমাদের বাঁকুড়ার কর্মীরা সেদিন জরুরি কাজে বাইরে গিয়েছিলেন, কাজেই খবর পেয়ে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে হাজির হতে হল যুক্তিবাদী সমিতির বাগনান শাখাকে, সেই গ্রামের মানুষের সামনে হাতে কলমে ঘটিয়ে দেখাতে হল ‘অলৌকিক’ বলে দাবি করা নানা কেরামতি, সরবরাহ করতে হল তার পেছনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও। গ্রামের মানুষ মন দিয়ে শুনলেন, সবই বুঝলেন। উত্তপ্ত পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হল, গ্রামছাড়া পরিবার ঘরে ফিরল, অত্যাচারকাণ্ডের মূল কুশীলব গ্রেপ্তার হল, প্রশাসন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। গণমাধ্যমে ভালোভাবেই এল সে খবর, সবাই জানলেন কুসংস্কার-চালিত নিগ্রহের এক ঘটনার সফল মোকাবিলার কথা।

তবে কিনা, ঘটনা আসলে এইরকম একটা দু’টো মাত্র নয়, আর বেশিরভাগ ঘটনাতেই প্রশাসন বা আমাদের মতো সংগঠনেরা হস্তক্ষেপ করার আগেই যা ঘটার ঘটে যায়। একটি গণনা অনুযায়ী ভারতে ১৯৯৫ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে ডাইনি সন্দেহে হত্যার ঘটনা ঘটেছে আড়াই হাজার, এর মধ্যে অবশ্য যারা ডাইনি সন্দেহে অত্যাচারিত ও নিগৃহীত হয়েছে কিন্তু খুন হয়নি তাদের হিসেবটা ধরা নেই। বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, ওড়িশা, অসম এইসব রাজ্যগুলোতে এমন ঘটনা অহরহই ঘটে চলেছে, চলেছে পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালেও। পিছিয়ে নেই আমাদের সোনার বাংলাও। পশ্চিমে বাঁকুড়া-পুরুলিয়া-মেদিনীপুর এবং উত্তরে জলপাইগুড়ি-মালদা-দিনাজপুর সন্নিহিত এলাকায় বিশেষত চা বাগান অঞ্চলে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে মাঝে মাঝেই ঘটে থাকে ডাইনি সন্দেহে অত্যাচার অপমান ও নিগ্রহের ঘটনা। হয়ত এইসব ঘটনা কখনও সখনও গণমাধ্যমে আসে, কিঞ্চিৎ হইচই হয়, পুলিশ-প্রশাসন একটু নড়েচড়ে বসে, কিন্তু অভিযুক্তরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পার পেয়ে যায়।

এটা ঠিক যে গ্রামে-গঞ্জে শিক্ষা-দীক্ষা-সামর্থ্যে পিছিয়ে থাকা মানুষজনের মধ্যেই সাধারণত এর প্রকোপ দেখা যায়, কিন্তু “শহরে ওসব হয় না” ভেবে আত্মপ্রসাদ সহকারে বসে থাকা কঠিন। দু’হাজার চোদ্দ সালের একেবারে শেষদিকে গণমাধ্যমে একটি খবর নজর কেড়েছিল — টালিগঞ্জের এক বস্তিতে এক বৃদ্ধাকে ডাইনি সন্দেহে নিগ্রহ করা হয়েছে। আমি নিজে সেখানে গিয়ে ঘটনাটির তদন্ত করেছিলাম, ‘গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির’-র (এ পি ডি আর) সাথে একযোগে। ওই বস্তিতে একটি পরিবারের এক অতি অল্পবয়স্ক বাবা-মার শিশুকন্যা অনেক রাত্রে ওই বৃদ্ধাকে নির্জনে একান্তে সাদা শাড়ি পরে পুজো-আর্চা জাতীয় কিছু একটা করতে দেখে, এবং অজানা কোনও কারণে খুব ভয় পেয়ে গিয়ে তারপর থেকেই অত্যন্ত অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। ওই বৃদ্ধা স্থানীয় পৌরসভার সাফাইকর্মী, বেশ বলিয়ে কইয়ে। বস্তিবাসীর কাছে নিজেকে তন্ত্র-মন্ত্রে পারদর্শী বলে দাবি করে সমীহ আদায় করতে তিনি ভালবাসতেন, এবং নানা ছোটখাটো রোগে ওরা তাঁর কাছে এলে ‘ওষুধ’-ও দিতেন। ফলে, তিনি যখন অলৌকিকভাবে রোগ সারাতে পারেন, তখন চাইলে তিনি যে অলৌকিকভাবে ‘মন্দ’-ও করতে পারেন, স্বল্পশিক্ষিত ও আতঙ্কতাড়িত বস্তিবাসীদের পক্ষে সে ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা মোটেই অসম্ভব হয়নি। ফলে, ওই নিষ্পাপ শিশুকন্যার পেছনে ভূত লেলিয়ে দেওয়ার অভিযোগে তাঁরা সমবেতভাবে ওই বৃদ্ধার বাড়িতে চড়াও হয়ে তাঁকে শাসান এবং সামান্য শারীরিক নিগ্রহও করেন। গণমাধ্যমে খবর বেরনোর পর পুলিশ এলে তাঁরা ভয়ে চুপচাপ হয়ে যান, কিন্তু চাপা ক্রোধ ও ক্ষোভের প্রকাশ চলতেই থাকে। ঘটনাটি খুঁটিয়ে জেনে মনে হয়েছিল, ওই ছোট্ট মেয়েটি হয়ত কোনও শিশুসুলভ কারণে হঠাৎ ভয় ও তদ্‌জাত ‘শক’ পেয়ে থাকতেই পারে, কিন্তু সেই সঙ্গে তার সম্ভবত কোনও মানসিক সমস্যাও আছে। ইচ্ছে থাকলেও মেয়েটির সাথে কথা বলা যায়নি, কারণ তাকে দূরে কোথাও এক আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমরা তাঁদের পরোক্ষে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম তন্ত্র-মন্ত্রের অসারতার কথা, এবং মেয়েটিকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধও রেখেছিলাম। আমাদের কথা তাঁরা বেশ ধৈর্য ধরে যথেষ্ট মনোযোগ সহকারেই শুনেছিলেন সেদিন। আধুনিক চিকিৎসা তাঁদের কাছে অতি ব্যয়সাপেক্ষ বলে মনে হতে পারে আন্দাজ করে স্বল্প খরচে চিকিৎসার রাস্তা বাতলে দেবার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলাম, কিন্তু তাঁরা আমাদের ফোন নম্বর নিয়ে রাখলেও আর যোগাযোগ করেননি। অন্য সূত্রে খবর নিয়ে জেনেছি, ওই সমস্যা ওখানে আর হয়নি। তবে, ছোট্ট মেয়েটির যথাযথ ও যোগ্য চিকিৎসা না হলে অদূর ভবিষ্যতে আবারও নানা সমস্যা হতে পারে, এই ভেবে আজও খানিক অস্বস্তি ও আশঙ্কায় ভুগি।

 

প্রশ্ন হল, এ ধরনের ঘটনা আদৌ ঘটে কেন, সমাজবিজ্ঞান সে সম্পর্কে কী বলে। আসব সে সব কথায়, তার আগে আসুন সংক্ষেপে একটু দেখে নিই ডাইনি শিকারের ইতিহাস ও ভূগোল। আর তারও আগে চট করে ভেবে নিই, ‘ডাইনি’-র সংজ্ঞাটা কী, অর্থাৎ, ঠিক কোন কোন বৈশিষ্ট্য ‘ডাইনি’-র লক্ষণ বলে বিবেচিত হতে পারে।

তার মোদ্দা কথাটা অবশ্য আমরা সকলেই জানি। এক ব্যক্তি (সাধারণত নারী), যাকে তাঁর নিজের আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশীরা ‘অশুভ শক্তির’ অধিকারী বলে বিশ্বাস করে, এবং সন্দেহ করে যে সে তাঁর ওই অলৌকিক ‘ক্ষমতা’-র সাহায্যে প্রতিবেশীদের ক্ষতি করছে। যেমন, পাশের বাড়ির কচি বাচ্চাটির মধ্যে রোগ সৃষ্টি করছে, গাছের সবজি/ফসল শুকিয়ে দিচ্ছে, পোষা গরুটির দুধ কমিয়ে দিচ্ছে, বা পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে বিকৃতি আমদানি করছে, এইসব আর কি। তার ফলেই তাঁর ওপর প্রতিবেশীদের রাগ ও ঘৃণা, তাঁকে ভিটেমাটি ছাড়া করার উদ্যোগ, মোটা জরিমানা আদায় করা, এমনকি মারধোর ও হত্যা। আমরা একটু মোটাভাবে জানি, এই সন্দেহভাজনটিই ‘ডাইনি’ বা ডাইন বা ডান বলে চিহ্নিত হয়ে থাকে, তবে তার ভেতরকার নানা সমাজ-সাংস্কৃতিক খুঁটিনাটি এবং তার পেছনকার কার্যকারণ-জালটি বিষয়ে হয়ত আমরা তত বেশি অবহিত নই। এই ততটা-না-জানা বিষয়গুলোর ওপরেই সমাজবিজ্ঞানীরা আলো ফেলতে চেয়েছেন, প্রবেশ করতে চেয়েছেন সমস্যার গভীরে, যা নিয়ে এখানে যৎসামান্য দু’য়েকটি ইঙ্গিত দিতে চাইব।

এ সম্পর্কে আমাদের মধ্যে আগের অনুচ্ছেদে বলা যে জনপ্রিয় ধারণাগুলো কাজ করে, তাতে মোটাদাগের একটা সত্যি অবশ্যই আছে। মানে, ব্যক্তিবিশেষের ওই বিশেষ ‘শক্তি’ ও তার প্রয়োগে প্রতিবেশীর ক্ষতি সংক্রান্ত বিশ্বাসগুলোর বাস্তব অস্তিত্ব আছে, সে বিশ্বাসের বিষয়বস্তু যতই মিথ্যে আর অযৌক্তিক হোক না কেন। কিন্তু বিষয়টির নানা খুঁটিনাটির কথা হিসেবে ধরে সেগুলোর পরিশ্রমসাধ্য যুক্তিসম্মত বিশ্লেষণ করে যদি একটা সুসঙ্গত সামগ্রিক ধারণায় পৌঁছতে চাই, তাহলে দেখতে পাব, সেখানে বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতিতে পার্থক্য আছে, অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ডাইনির ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র-লক্ষণ গুরুত্ব পায়। ভারতের সাওঁতাল সমাজ, আমেরিকার নাভাজো আর দক্ষিণ আফ্রিকার বান্টুদের মধ্যে ডাইনি সংক্রান্ত রীতিনীতি বিশ্বাস আর ক্রিয়াকলাপের নকশায় যে বিচিত্র নানা তফাৎ থাকবেই, সে নিয়ে নিশ্চয়ই কোনও কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ প্রশ্ন তুলবেন না। বিভিন্ন স্থান ও কালের মানব-গোষ্ঠীর মধ্যে কোথাও ডাইনিরা মূলত মেয়ে, কোথাও তারা মূলত ছেলে, কোথাও ছেলে বা মেয়ে দুইই হতে পারে, কোথাও তারা নিশাচর, কোথাও দিবাচর, কোথাও তারা দলে বা গোষ্ঠীতে জোটবাঁধা, কোথাও একাকী। কোথাও তারা শুধুই ‘মানসিক ইচ্ছাশক্তি’ দিয়ে কাজ সারে, আবার কোথাও হয়ত নির্দিষ্ট কোনও আচার পালনের জন্য নির্দিষ্ট ভৌত উপকরণ ব্যবহার করে।

আবার, সাধারণ তুকতাক বা জাদুটোনার সাথেও ‘ডাইনিগিরি’-র এক রকমের পার্থক্য করা হয়, যদিও এখানেও সংস্কৃতিতে সংস্কৃতিতে প্রভেদ আছে। বলা হয়, যারা তন্ত্র-মন্ত্র-তুকতাক শিখে নিয়ে তা প্রয়োগ করে তারা হচ্ছে ‘সোরসরার’ বা জাদুকর (বা মায়াবী বা কুহকী বা গুনিন ইত্যাদি), আর যাদের ভেতরে জন্মগত অলৌকিক ক্ষমতা আছে তারা হল গিয়ে ‘উইচ’ বা ডাইনি (সব সময়ে এ প্রভেদ স্বীকার করা হয় না, এবং অনেক সময়ই এ দু’টোকে প্রায় সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়)। তবুও, এত সব জটিলতা ও ধোঁয়াশা সত্ত্বেও কালচারাল অ্যানথ্রোপোলজি বা সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের গবেষকরা ডাইনি সংক্রান্ত ধ্যানধারণা ও বিশ্বাসের দুটি আবশ্যিক উপাদানের কথা বলেন। এক, ধর্মের মতোই অলৌকিকতা-নির্ভর হওয়া সত্ত্বেও ডাইনির নিজের গোষ্ঠীরই ‘মেনস্ট্রিম রিলিজিয়ন’ বা মূল স্রোতের ধর্ম থেকে ‘ডেভিয়্যান্ট’ বা বিপথগামী হিসেবে তার এক স্বতন্ত্র অবস্থান, এবং দুই, বিপথগামী হিসেবে তার এই স্বতন্ত্র অবস্থান চিহ্নিত করার প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্তর্নিহিত এক নৈতিক বিচার। মূলস্রোতের দেবতার কাছে যে বলি দেওয়া হয়, তাতে নাকি গোষ্ঠীর মঙ্গল। আর ডাইনির একান্ত গোপন আচারের অঙ্গ হিসেবে যে বলি, তার মধ্যে আছে লোভী ব্যক্তির অসঙ্গত ও সমাজ-অননুমোদিত কোনও অভীষ্ট সিদ্ধির আকাঙ্ক্ষা।

ডাইনি-তন্ত্র-মন্ত্র-তুকতাক এইসব জিনিসে বিশ্বাস ও তার চর্চা অতি প্রাচীন, এবং পৃথিবীব্যাপী। এশিয়া আফ্রিকা ইউরোপ সব জায়গাতেই প্রাচীন গ্রন্থে ডাইনি আর তুকতাকের প্রসঙ্গ আছে। ভারতীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্র, যা নাকি ‘বেদ’-এর অন্যতম অঙ্গ, তা  অলৌকিক তন্ত্র মন্ত্রের উল্লেখে ভরপুর। মনিয়ের উইলিয়ামসের বিখ্যাত সংস্কৃত অভিধান অনুযায়ী, ‘ডাকিনী’-দের কথা (ডাইনি শব্দটি যা থেকে এসেছে) পাওয়া যায় ভাগবতপুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ, মার্কণ্ডেয়পুরাণ ও কথাসরিৎসাগর নামক গ্রন্থে। তারা দেবী কালীর অনুচরী, মাংসভুক। ব্যাবিলন সভ্যতার বিখ্যাত হাম্মুরাব্বির অনুশাসনে পাওয়া যায় ডাইনিবিদ্যার কথা, পাওয়া যায় প্রাচীন মিশরীয়, গ্রিক ও রোমান সভ্যতাতেও। রোম সাম্রাজ্যে গণহারে ডাইনি পোড়ানোর ঘটনাও পাওয়া যায়। উভয় বাইবেলেই ডাইনি প্রসঙ্গ আছে। তবে, আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ইউরোপের ইতিহাসের কুখ্যাত ও ভয়ঙ্কর ডাইনি পোড়ানোর ঘটনাগুলো (আনুমানিক চল্লিশ থেকে ষাট হাজার) কিন্তু প্রাচীন বা মধ্যযুগে ঘটেনি, ঘটেছিল আধুনিক যুগেরই গোড়ার দিকে। চোদ্দশো সাতাশি সালে দুই জার্মান পাদরি ‘মালিয়ুস মালফিকারুম’ (বাংলা অনুবাদ হতে পারে “ডাইনিদের শায়েস্তা করার হাতুড়ি”) নামে এক বই লেখেন। কীভাবে ডাইনির লক্ষণ চিনতে হবে থেকে শুরু করে কীভাবে তার ওপর অত্যাচার চালাতে হবে পর্যন্ত সবকিছুরই নৃশংস বর্ণনা সেখানে ছিল, এবং ওই বইটিই পরবর্তী কয়েকশো বছর ধরে ডাইনি নিধনের গাইডলাইন হয়ে দাঁড়ায়। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত রমরমিয়ে চলেছিল কুৎসিত কুসংস্কার-প্রণোদিত এইসব ভয়ঙ্কর কাণ্ড।

বর্তমানে উন্নত দেশগুলোতে এই ধরনের বিশ্বাস ও চর্চা আজ আর নেই, যদিও ডাকিনীবিদ্যা-নির্ভর নানা ছোট ছোট কাল্ট-ধর্ম বেশ ফ্যাশনের মতো হয়ে উঠেছে, তার মধ্যে উদ্ভটতা আর অযৌক্তিকতা থাকলেও নৃশংসতা বা অপরাধমূলক কার্যকলাপ সেভাবে নেই। আফ্রিকা-এশিয়ার নানা দেশে অবশ্য আজও এর প্রবল দাপট। আমাদের দেশের কথা ওপরে বলেছি, কম যায় না আমাদের পাশের দেশ নেপালও। প্রতি বছরই ডাইনি শিকারের গুচ্ছ গুচ্ছ খবর পাওয়া যায় আফ্রিকার ক্যামেরুন, ঘানা, জাম্বিয়া, সিয়েরা লিওন, কেনিয়া, তানজানিয়া এইসব দেশ থেকেও। আজকাল প্রায় সব দেশেই ডাইনি শিকার নিষিদ্ধ, কিন্তু অন্তত দুটো দেশে আজও সরকারি আইনবলেই ডাইনি শিকার হয় — সৌদি আরব ও ক্যামেরুন। আর, ইসলামিক স্টেটের জঙ্গীরা ডাইনিবৃত্তির অভিযোগে দু’জনের মুণ্ডু কেটেছে, এমন খবর নেট ঘাঁটলে পাওয়া যায়। ভারতের মধ্যে ওড়িশা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় এসব রাজ্যে ডাইনি শিকারের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট আইন আছে, অসম আর রাজস্থানে এমন আইন বানাবার প্রস্তাব এসেছে। কথা চলছে কেন্দ্রীয়ভাবেই এমন আইন তৈরি করবার। মহারাষ্ট্রে সামগ্রিকভাবে ধর্মীয় ও তন্ত্রমন্ত্রভিত্তিক সমস্তরকম বুজরুকি ও নৃশংসতার বিরুদ্ধেই আইন আছে, তার পরিসর আরও বড়, এবং ডাইনি শিকারের বিষয়টিও তার মধ্যেই ধরা আছে। পশ্চিমবঙ্গেও এমন আইন তৈরির চিন্তাভাবনা করছেন আইন-বিশেষজ্ঞ ও যুক্তিবাদী আন্দোলনকর্মীরা, নির্দিষ্ট প্রস্তাব গেছে আইন কমিশনে।

কিন্তু, কেন ঘটে এইসব অদ্ভুত ঘটনা? গবেষকরা ভেবে দেখেছেন, অলৌকিক অদৃষ্ট শক্তির প্রতি বিশ্বাস, যুক্তি-অতিক্রমী কোনও এক জাদু-দৃষ্টিতে এ জগতকে দেখা — এই মূল কারণ তো এর পেছনে আছেই, কিন্তু তার সাথে আছে এই বাস্তব জগতের নানা বাস্তব টানাপোড়েনও। ব্যক্তিগত শত্রুতা, বয়স্কা একাকিনীকে সরিয়ে তাঁর সম্পত্তি দখলের গোপন অভিপ্রায়, ডাইনি অপবাদ দিয়ে অর্থ আদায়ের লোভ, অজানা রোগ বা মড়ক বা ফসল না হওয়ার দায় কারও ওপর চাপিয়ে মানসিক শান্তিলাভ, কিঞ্চিৎ উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং যূথবদ্ধভাবে কারুকে ‘স্কেপগোট’ বানিয়ে দরিদ্র ক্লেশকর জীবনের একঘেয়ে টেনশন থেকে সাময়িক রিলিফ, কিম্বা মানসিক রোগজাত অদ্ভুত আচরণকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যানধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা। তাই এটা বোধহয় এক অনিবার্য সিদ্ধান্ত যে, এর বিরুদ্ধে কড়া আইন ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ছাড়াও প্রয়োজন দরিদ্র প্রান্তিক মানবগোষ্ঠীর উন্নতিসাধন, তাদের সামনে আধুনিক শিক্ষা-চিকিৎসা-পেশা-অর্থনীতি-রাজনীতিতে অংশগ্রহণের রাস্তা খুলে দেওয়া।

তবে, কখনও আবার ডাইনি শিকারের হিড়িকের পেছনে থাকতে পারে আরও বৃহৎ কোনও সামাজিক-ঐতিহাসিক কার্যকারণ, যেমনটি সম্ভবত ছিল আধুনিক যুগের গোড়ায় ইউরোপের সেই বীভৎস ডাইনি-নিধনকাণ্ডের আড়ালে। নারীবাদী তাত্ত্বিকেরা অনেকে বলতে চেয়েছেন, ওই সময় যে সমস্ত পরিবার-বিচ্ছিন্না একাকী নারীদেরকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে শিকার করা হত তারা আসলে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া পারিবারিক গণ্ডিবদ্ধ ভূমিকা থেকে সরে এসে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতাকেন্দ্রের প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠেছিল, তাই পুরুষতন্ত্রের কর্তাদের তরফে এই অত্যাচার, তাদেরকে শেষ করে দেবার চক্রান্ত। তবে, ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদ মার্ভিন হ্যারিস সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে ইঙ্গিত করেছেন আরও গূঢ় এক কারণের দিকে। তাঁর বক্তব্য, ওই নারীরা সমাজের ক্ষমতাকেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ করার মত বিরাট কিছু মোটেই করে উঠতে পারেনি, তাদেরকে শিকার করার কারণটি বরং আরও অনেক বেশি সহজ — সমাজ-বিচ্ছিন্নাদের শিকার করলে সামাজিক প্রতিরোধের সম্ভাবনা অনেক কম থাকবে। তা, সে নয় হল, কিন্তু এ দিয়ে তো আর আসল প্রশ্নের সমাধান হল না। তাদেরকে ধরে ধরে অত্যাচার করলে প্রতিরোধের সম্ভাবনা কম বলেই সমাজের কর্তারা বিনা কারণে তা করতে উৎসাহিত হবেন, এটা কেমন কথা? এ ব্যাপারে মার্ভিন হ্যারিসের বক্তব্য খুবই চমকপ্রদ। তিনি বলতে চান, ক্ষমতাভোগী চার্চ ও জমিদারতন্ত্রের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে যে কৃষক বিদ্রোহের আবহাওয়া ত্রয়োদশ শতক থেকেই ক্রমশ ঘনিয়ে উঠছিল সমগ্র ইউরোপ জুড়ে, ডাইনি শিকারের হিড়িক ছিল তারই বিরুদ্ধে একটি ধূর্ত চাল, তার ওরিয়েন্টেশন-টি ঘেঁটে দেবার চক্রান্ত । সেই সময় ইউরোপের আনাচে কানাচে অসংখ্য আঞ্চলিক নেতা গজিয়ে উঠেছিল, যাদের বক্তব্য ছিল, যিশুখ্রিস্ট আসলে গরিবদেরই উদ্ধারকর্তা, কারণ ঈশ্বর আসলে শুধু গরীবদেরই ভালবাসেন। তাই শীঘ্রই আবির্ভূত হবেন এক নতুন অবতার, যিনি অত্যাচারী অভিজাতকুলকে নিকেশ করে সব সম্পদ গরীবদের মধ্যে বেঁটে দেবেন, পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্যের অবতারণা করবেন। কাজেই, চার্চের সাথে নানা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছিল বিদ্রোহী কৃষকেরা, স্থানীয়ভাবে ঘন ঘন বাধছিল যুদ্ধ। এইভাবে যখন সমাজের এক বড় অংশের আক্রমণের বর্শামুখ ঘুরছে চার্চ ও জমিদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে, তখনই ডাইনি-ভীতির হিড়িক তুলে চার্চ সাধারণের কাছে বার্তা দিতে চাইল, তোমাদের আসল সমস্যা চার্চ নয়, আসল সমস্যা হল পাশের বাড়ির সন্দেহজনক একাকী মহিলাটি, যে তার অশুভ শক্তিবলে নিঃশব্দে তোমার সর্বনাশ করছে। আর, সে সমস্যা সমাধানের জন্য তোমাকে সেই চার্চের কাছেই আসতে হবে। ইতিহাস সাক্ষী, চার্চের এই উদ্দেশ্য ভালোভাবেই সফল হয়েছিল।

আজ তাই ইতিহাসের দিকে ফিরে চাইলে আমরা বুঝতে পারি, কত দীর্ঘ বন্ধুর পথ আমরা পেরিয়ে এসেছি। সে কথা ভেবে অবাক লাগে, বিষণ্ণ হই, আবার কোথাও একটু ভরসাও পাই বোধহয়। অনেক আঁধারই তো আমরা সরিয়েছি, বাকিটাও পেরে যাব নিশ্চয়ই। কী বলেন বন্ধু, পারব না?