ইন্দ্রনীল মজুমদার
বিএন গোস্বামীর পরে শিল্পের ইতিহাস আর রাজসভার ইতিহাস বা এটেলিয়ারের ইতিহাস রইল না। তার নাম ধাম পুত্র ভ্রাতা আর নিজের কুটির নিয়ে শিল্পী সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। এটেলিয়ার তার ছিল না। এতদিন তারই তৈরি দুনিয়া কাঁপানো মন্দির, মসজিদ, বিহার, ভাস্কর্য আর চিত্রপটের আড়ালে সে ছিল ব্রাত্য, অজ্ঞাতকুলশীল, নিম্নবর্ণ। ভারত-শিল্পের ঐতিহ্যই ছিল তাই
ভারতের অনুচিত্রমালা তো ছোট ছোট রূপকথাই। ক্ষুদ্রতমকে জানতে জানতেই তো আজকের বিজ্ঞান পৌঁছে গেছে সৃষ্টির আদিকণিকায়। পাহাড়ি ও রাজপুত চিত্রমালা নিয়ে তাঁর যুগান্তকারী কথামালায় অগ্রণী ভারতপথিক আনন্দ কেন্টিশ কুমারস্বামী লিখেছিলেন না, “…a magic world where all men are heroic, all women are beautiful, passionate and shy; beasts both wild and tame are the friends of and flowers are conscious of the footsteps of the bridegroom as he passes by.” রূপকথার মতো সেইসব স্মল থিংসের গড যদি হন কুমারস্বামী, তবে তার দৈবী আলাপে সেই ছয়ের দশকের শেষ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত আমাদের মুগ্ধ করে রেখেছিলেন যিনি তাঁর নাম বিএন গোস্বামী— যে নামে তাঁর ডাক পড়ত বিশ্বজুড়ে অগণিত সম্মাননায়; পদ্মশ্রী আর পদ্মবিভূষণ খেতাব তো ছিলই। তাঁকে হারিয়ে আমরা হারালাম পাণ্ডিত্যে গম্ভীর এক আর্ট ক্রিটিককে নয়। হারালাম খুব কাছে বসা এক গল্পকারকে যিনি দেখিয়ে দিচ্ছেন ছবি— একটা একটা করে, চিনিয়ে দিচ্ছেন এক-একজন শিল্পীকে। সাথে সাথে এক ভারতবর্ষ যার অধিষ্ঠান রাজসভায় নয়, পাহাড়ের এক-একটা অখ্যাত গ্রামে।
পাহাড়ি শৈলীর চিত্রমালাই শুধু নয়। কত কিছু নিয়ে যে কাজ করেছেন লিখে গেছেন অবিশ্রান্তভাবে। প্রকাশিত শেষ বই conversations এই ঘোরাঘুরিরই ঝলক। এক গভীর শ্রদ্ধার্ঘ্য কুমারস্বামীর প্রতি। তার সাথে সাথেই আসছে ক্যালিগ্রাফি থেকে ম্যানুস্ক্রিপ্ট ট্র্যাডিশান, পুরনো ম্যাপ, ছবি আঁকার কাগজ থেকে দক্ষিণি মলমল। ভারতের টেক্সটাইল নিয়ে এত ভালবাসা বলেই আমেদাবাদের বিখ্যাত ক্যালিকোর টেক্সটাইল মিউজিয়ামের অধ্যক্ষ আমৃত্যু। চন্ডীগড় ললিতকলা অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যানও ছিলেন। ১৯৬৮ সালে মার্গ পত্রিকায় আমরা পেয়েছিলাম পাঞ্জাব হিলস-এর আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া লেখা— Pahari painting: the family as the basis of style। নামেই বোঝা গেল বিএন-এর নজর কোনদিকে। এই প্রসঙ্গ উঠবে পরে। এরপর আর ফিরে দেখা নেই। Sikh art, Indian manuscript tradition, ছবিসহ The spirit of Indian painting— close encounters with 101 great works (1110-1900)। এর থেকেই বোঝা যায় তিনি ঢুকতে চাইছেন এক একটা ছবির গভীরে, প্রথাগত শৈলী বিভাজনে নয়। ফিরে আসছেন তাঁর প্রিয় পাহাড়ি স্কুলের ছবিতে বিশেষত গুলের কাংড়া। দুটো পথপ্রদর্শনের কাজ— Nainsukh of Guler আর Manaku of Guler।
শুরুটা অদ্ভুত। ৫৬ সালের আইএএস। ৫৮ সালে চাকরি ছেড়ে গবেষণায় যোগ দিলেন চন্ডীগড়ে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিষয় Kangra valley painting of the lower Himalayas। এক বন্ধুর দেওয়া উপহার পেয়েছিলেন এমএস রনধাওয়ার Kangra valley painting। তাতেই আচ্ছন্ন হয়ে প্রশাসকের পদ ত্যাগ। তাঁর জমা দেওয়া থিসিসের পরীক্ষক হিসাবে প্রশংসা করলেন দুই দিকদর্শী ভারতপথিক— এএল ব্যাশাম আর উইলিয়াম আর্চার। তারপর ইতিহাস। দীর্ঘকাল কাংড়ায় স্থিতি আর পাহাড়ি টাকড়ি লিপির পাঠ। ঘাঁটছিলেন অসংখ্য জমির দলিল— শিল্পী কে, কোথায় বাড়ি. কোথায় গেল এইসব। পৌঁছে গেলেন হরিদ্বার। পান্ডাদের ভাণ্ডার থেকে ঘাঁটলেন তাঁদের রাখা পারিবারিক কুলজি, মাদলাপঞ্জি। বেরিয়ে এল গুলের গ্রামনিবাসী পণ্ডিত সেউ-এর বংশধারা আর তাই দিয়েই লেখা হয়ে গেল কাংড়া শৈলীর মানচিত্র আর তার জয়যাত্রার ইতিহাস। গুলের, বাশোলী, কাংড়া, গাড়োয়াল পর্যায়ক্রমে। নাম, গ্রাম, জমিজিরেত নিয়ে উঠে এল পাহাড়ি চিত্রমালার শিল্পীরা, গুলের কাংড়া কলমের দিকপাল শিল্পীদের নামের বংশলতিকা ও তাঁদের তথ্য যতটুকু পাওয়া যা্য়। আগে পাহাড়ি অনুচিত্র আলোচনায় এই কাজ এভাবে করা যায়নি। গুলেরের পণ্ডিত সেউ ও তাঁর পরিজনের একটি তালিকা নিচে দেওয়া হল। এটি মার্গ পত্রিকা থেকে পাওয়া। অবশ্যই পথ দেখিয়ে গিয়েছিলেন কুমারস্বামী, আর্চার, রণধাওয়া ও কার্ল জামশেদ খান্ডেলওয়ালা। সেই ইতিহাসের প্রেক্ষাপটেই বিএন হাজির করলেন ব্যক্তিশিল্পীকে।
বিএন গোস্বামীর পরে শিল্পের ইতিহাস আর রাজসভার ইতিহাস বা এটেলিয়ারের ইতিহাস রইল না। তার নাম ধাম পুত্র ভ্রাতা আর নিজের কুটির নিয়ে শিল্পী সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। এটেলিয়ার তার ছিল না। এতদিন তারই তৈরি দুনিয়া কাঁপানো মন্দির, মসজিদ, বিহার, ভাস্কর্য আর চিত্রপটের আড়ালে সে ছিল ব্রাত্য, অজ্ঞাতকুলশীল, নিম্নবর্ণ। ভারত-শিল্পের ঐতিহ্যই ছিল তাই। বিএন তুলে আনছেন এক অজানা কাংড়াচিত্রীর চিঠি। সে কাংড়ার প্রাণপুরুষ মহারাজ সংসারচাঁদকে লিখছে সে এখন কর্মহীন, ফিরে আসতে চায় তার নিজের কুটিরে কাংড়ার কোলে। এই সংসারচাঁদকে নিয়ে একটি অসামান্য মনোগ্রাফ উপহার দিয়ে গেছেন রণধাওয়া। বিএন-এর নজর ছবির দিকেও। বোঝো, ছবিটাকে বোঝো। জানো, শিল্পীকে জানো। কোন দরবারে কে জানার আগে জেনে নাও কে, কেন, কোথা থেকে এল। তাঁর পথেই প্রাণ পেল কত নাম— সেউ, মানাকু, নয়নসুখ, ফাত্তু, গদ্দু, নিক্কা, রণঝা, হরকু, গুরশাই, রুঘু, পুন্নু। এই ধারাটাই পুনর্বাসন দিল শিল্পীদের। ইতালিতে জর্জিও ভাসারি এই কাজটাই করেছিলেন রেনাসাঁ পেন্টার্সদের নিয়ে। ভারতে তা হয়নি। আজও উনিশ শতকের দু-একজন ছাড়া বাংলার টেরাকোটা মন্দিরের স্থপতি, শিল্পী, কারিগরদের নাম আমরা জানি না। শুধু জানি তারা অন্ত্যজ ছিল। ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায় এদেরই বিশ্বকর্মা বলেছেন।
তাই বলছিলাম এইসব অখ্যাত গডস অব স্মল থিংস-এর জয়যাত্রা বিএন-এর লেখায়, কথায়। রাজকীয় উষ্ণীষ আর ঐশ্বর্য নয়, গরিবের ঘরগেরস্থালি— যেখানে রং আসে ফুলপাতা থেকে, কাপড়ে আসে দেশের তুলো, পুঁথি লেখা হয় ঘরের কালিতে, নাচে হাতের মুদ্রার জন্য সিঁদুর, উৎসবে ছবি ফুটে ওঠে দেওয়ালে। বিএন গোস্বামীকে আমরা মনে রাখব ওইসব ছোটখাটো দেবতারই আলাপচারীর জন্য। মেরা ভারত মহান।