Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভাস্কর শ্রী গোপীনাথ রায় (১৯৫৩-২০১৭)

গোপীনাথ রায়

শুভব্রত মৌসুমী

 

 

প্রয়াত ভাস্কর শ্রী গোপীনাথ রায়ের কন্যা মৌসুমী রায় ও তার স্বামী শুভব্রত নন্দী, দুজনেই নবীন প্রজন্মের দুই অত্যন্ত পরিচিত শিল্পী ও শিল্পশিক্ষক। গোপীনাথ রায়ের কাজ ও সেই কাজের পেছনের মানুষটিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তাঁরা। প্রয়াত ভাস্করের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধানিবেদন কেবল এক শিল্পীকেই স্মরণ করা নয়, সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে একসঙ্গে নিবিড় করে পাওয়ারও এক শিল্পময় পথ।

 

 

 

প্রখ্যাত জাপানি কবি ফুজিয়াবা নো কিনতো (966-1041 A.D.) প্রকৃতি নিয়ে লিখেছিলেন–

Though the sound
of the cascade
long since has ceased
We still hear the murmur
of its name.

সত্যিই তাই। প্রকৃতির প্রতিটি রূপ কিন্তু জীবিত। স্থবির হয়েও চঞ্চল। প্রয়াত ভাস্কর গোপীনাথ রায়ের সমস্ত জীবন এবং কাজে এই প্রকৃতি তার অত্যন্ত সংবেদনশীল বিন্যাস নিয়ে পরিব্যাপ্ত।

যোগেন চৌধুরি বলেছিলেন, “গোপীনাথের হাতে পড়ে প্রতিটি নীরস পাথর হয়ে ওঠে এক অনবদ্য সংবেদনশীল কবিতা। যা আমাদের মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নেয়।”

আমি শ্রী গোপীনাথ রায়কে চিনি প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ওঁর কাজের মাধ্যমে। ব্যক্তিগত চেনার শুরু গত তিনবছর, ২০১৪ থেকে। আমার সহধর্মিণী মৌসুমী শ্রী গোপীনাথ রায়ের কন্যা। আর নিজেও একজন সেরামিক স্কাল্পটর, বাবার সুযোগ্য মেয়ে।

ওর কাছেই শোনা যাক গোপীনাথ রায়ের সম্পর্কে বেশ কিছু মর্মস্পর্শী কথা।

আমার বাবা

আমি যখন ছোট ছিলাম আমরা হাওড়ার শিবপুরে থাকতাম। ওখানেই ছিলাম ২০০৫ পর্যন্ত। ২০০৬ থেকে পাকাপাকিভাবে আমরা কলকাতার বাসিন্দা হয়ে যাই। ওই হাওড়ার বাড়িতে একতলায় বাবার স্টুডিও ছিল। আর আমরা থাকতাম দোতলায়। বাবা তখন বি এড কলেজের শিক্ষক। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায়। কখনও বাঁকুড়া, কখনও মেদিনীপুর, কখনও বর্ধমান, কখনও হাওড়া। বদলির চাকরি। সপ্তাহান্তে বাড়ি ফেরা। বাবা বাড়িতে থাকত ওই দুদিন, সারাদিন স্টুডিওতে কাজ করত। আর রাতে বাবার কাছে আমি শুনতাম রূপকথা, কল্পবিজ্ঞান আর শিল্পচর্চার গল্প। কিছুটা বুঝতাম, আর কিছুটা বুঝতাম না।

বাবা ছিল কাজপাগল, এমনকি বদলির চাকরি হওয়া সত্ত্বেও যেখানে বাবা ছিল সেখানে সেখানেই খুঁজে বেড়াত ভালো মাটি কোথায় পাওয়া যায়। সে সন্ধান পেলেই তা জোগাড় করে শুরু করে দিত কাজ, ওই অফিস কোয়ার্টারে। এখানে একটা মজার কথা বলি। বাবা কাজে এতটাই বুঁদ হয়ে থাকত যে, কে কোথায় আছে কোনও হুঁশ থাকত না। যেমন হাওড়ায় বাবার স্টুডিওতে রাত প্রায় দুটো অবধি বাবা কাজ করত। সেই সময়ে আমাদের হাওড়া বাড়ির একতলায় কয়েকটি পরিবার ভাড়া থাকত। তার মধ্যে একটি গুজরাতি পরিবার বাবার স্টুডিওর ঠিক সামনে থাকত। রাত তখন দুটো। বাবা তখন অ্যালুমিনিয়াম শিটের ওপর ‘ঢেউ’ নিয়ে কাজ করছে। ওই ফ্ল্যাট অ্যালুমিনিয়াম শিটকে পিটিয়ে পিটিয়ে ‘ঢেউ’-এর আকার দিচ্ছে। এই টেকনিককে বলে repousse পদ্ধতি। প্রচণ্ড আওয়াজ হচ্ছে, সবাই অতিষ্ঠ, সবার ঘুম মাথায় উঠেছে। কিন্তু বাবা নিজের কাজ করে চলেছে। একনিষ্ঠ হয়ে, চারপাশের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে…। সত্যিকারের শিল্পীরা বোধহয় এরকমই হয়।

বাবা বলত যখন কোনও শিল্পী একনিষ্ঠভাবে কাজ করতে করতে এমন একটা স্তরে গিয়ে পৌঁছয় তখন আর কোনও effort দিতে হয় না। তখন কাজটা এমনি এমনি হয়ে ওঠে। পূর্ণতা লাভ করে। মহৎ শিল্পগুণে সমৃদ্ধ হয় সৃষ্টি। আর এ শুধুমাত্র সম্ভব হয় practice, practice আর practice-এর মাধ্যমে। নাওয়া, খাওয়া, ঘুম সব ভুলে।

এভাবেই দিনের পর দিন কাজ করেছে বাবা। এমনকি দূরে দূরে যেখানে বাবার পোস্টিং ছিল সেখানে যা যা কাজ করত সব কিছু বয়ে নিয়ে এসে কলকাতায় এগজিবিশন করত। বাবাকে আমি প্রচণ্ড স্ট্রাগল করতে দেখেছি। টিন পেটানো, কাঠ কাটা, পাথর ভাঙা, এইসব কী যে করত ছোটবেলায় অতটা বুঝতাম না। কিন্তু আস্তে আস্তে বড় হতে হতে এগুলো একটু একটু করে বুঝতে শুরু করলাম আর বাবার সঙ্গে মাটি ঘাঁটাও শুরু হল। তৈরি করতে লাগলাম মাটির হাতি, ঘোড়া, কুকুর, বেড়াল এইসব। বাবা দেখিয়ে দিত। তখন আমার বয়স পাঁচ-ছ বছর। বাবার এগজিবিশন দেখা শুরু তারও অনেক আগে থেকে, মায়ের কোলে চেপে।

পরবর্তীকালে যখন আমি আর্ট কলেজে পড়াশোনা শুরু করি তখন বুঝতে পারি যে ওই পাঁচ-ছ বছর বয়সেই বাবা আমাকে মাটির কাজ দেখাতে দেখাতে আমার মধ্যে শিল্পচেতনার বীজ বুনে দিয়েছিলেন। সেই অর্থে বলতে গেলে বাবা আমার প্রথম শিক্ষাগুরু।

বাবার কাজের মধ্যে প্রকৃতির সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম রূপ অত্যন্ত সংবেদনশীলতা নিয়ে ধরা পড়ে, যে কারণে বাবার ভাস্কর্যকে প্রখ্যাত শিল্পী যোগেন চৌধুরী পাথরের কবিতা বলেছেন। এবং এটাই বাবার কাজের বিশেষ গুণ, এবং এর জন্যই বাবা বিখ্যাত। শুধু পাথর নয়, বিভিন্ন মাধ্যম, যেমন মেটাল, ফাইবার, কাচ, কাঠ, প্লাস্টিক প্রায় সব মাধ্যমেই বাবা অত্যন্ত সাবলীলভাবে কাজ করেছে। প্রায় গোটা শিল্পীজীবনটাতেই বিভিন্ন ধরনের এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করে গেছে। ভাস্কর্যের টেকনিকাল খুঁটিনাটি, যে কোনও মিডিয়াম নিয়ে পড়াশোনা ছিল সর্বোচ্চ মানের যা খুব কম শিল্পীর মধ্যে থাকে।

শুধু প্রকৃতি নয়, সঙ্গীতও ছিল গোপীনাথ রায়ের খুব প্রিয় বিষয়। বাবা বলত মিউজিক হল সবচেয়ে বিমূর্ত, যার কোনও আকার নেই, যা দেখা যায় না শুধু অনুভব করা যায়। সেই বিমূর্ত অনুভূতিকে বাবা প্রকৃতির সঙ্গে মিশিয়ে কখনও বা বাদ্যযন্ত্রের বিমূর্ত মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছে।

বাবা বলত ভালোলাগা বা ভালোবাসার কোনও নির্দিষ্ট কারণ হয় না। কাজের প্রতি সেই ভালোলাগা ও ভালোবাসার জোরেই দীর্ঘ এগারো বছর কিডনির অসুখের সঙ্গে লড়াই করে বাবা কাজ করে গেছে। এগারো বছর ধরে সপ্তাহে তিনদিন করে ডায়ালিসিসের ফলে যে শারীরিক যন্ত্রণা তা বাবা কখনও মনে স্থান দিত না, বলত শিল্পী হতে গেলে মনকে যত্ন করতে হয়, বাঁচিয়ে রাখতে হয় বিভিন্ন ঝড়ঝাপটা থেকে। এর ফলে দুরারোগ্য কিডনির অসুখে আক্রান্ত হয়েও বাবাকে কখনও মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে দেখিনি। ২০শে সেপ্টেম্বর হসপিটালে ভর্তির দুদিন আগে পর্যন্ত সম্পূর্ণ দাপটের সঙ্গে তার একক প্রদর্শনীর জন্য কাজ করে গেছে। বাবার চলে যাওয়ার পর তার নির্ধারিত দিনেই যে প্রদর্শনী হয়েছিল।

আজ গোপীনাথ রায় নেই। কিন্তু রয়ে গেছে অজস্র মুগ্ধ করা কাজ যা পরবর্তী প্রজন্মকে শেখাবে, ভাবাবে এবং উদ্বুদ্ধ করবে।

উপসংহার

আপনারা শুনলেন মৌসুমীর কাছে ওর বাবার কথা। আরও অনেক কথা বলা হল না, যা পরে বলা যাবে সময় পেলে। আসলে গোপীনাথ রায়ের মতো ভাস্কর-শিল্পী খুবই কম জন্মান, যারা বদলে দেয় দেখার চিরাচরিত অভ্যেস। ভাস্কর্য দেখার চোখটাই বদলে দিয়েছিলেন তিনি। ভাস্কর্য মানেই যে শুধুমাত্র বিশাল বিশাল পাথর খোদাই বা কাঠখোদাই নয়, তা যে একটা দশ ইঞ্চি বাই দশ ইঞ্চি পাথরের টুকরো দিয়েও করা যায় তা দেখিয়েছেন উনি আর শিল্পরসিকেরা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছেন। ভাস্কর্যকে কবিতার রূপ দিয়েছেন একের পর এক কাজে।

একটা ছোট্ট ঘটনা – তখন আমার আর মৌসুমীর বিয়ের এই বছরখানেক পর ২০১৬তে কোনও একদিন সন্ধেবেলা ওদের বাড়ি গেছি – আমরা দুজনেই, যেমন যাই মাঝেমধ্যে। গিয়ে দেখি উনি সোফায় বসে। সামনে কাচের সেন্টার টেবিল। তার ওপর একটা সাদা সাবুর পাঁপড়ের প্যাকেট খোলা। কিছু পাঁপড় টেবিলে ছড়ানো। বিভিন্ন ধরনের গঠন, এক একটা পাঁপড়ের টুকরো এক এক রকম দেখতে। উনি ওই ছোট ছোট বিভিন্ন ধরনের পাঁপড়ের টুকরোগুলো বাঁ হাতে ধরে ডান হাতে ড্রইং করছেন। বললাম, কী করছ এটা? উনি বললেন – দেখো দেখো পাঁপড়গুলোর form আর shape – কী ইন্টারেস্টিং। ভাবছি কিছু কাজ করব এই formগুলোকে নিয়ে। তাই বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে স্টাডি করছি।

এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা আমার। বহুদিন আগে রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন – “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শীষের ওপর/একটি শিশিরবিন্দু।

আর সেদিন আবার সেটাই প্রমাণ করলেন শ্রী গোপীনাথ রায়। শিল্পসৃষ্টির জন্য সবসময় মনটাকে তৈরি রাখতে হয়। মন শিল্পের আয়না। আসলে আমার মনে হয় যেখানে বিজ্ঞানের শেষ সেখানে দর্শনের শুরু, যেখানে দর্শন শেষ হয় সেখানেই শুরু শিল্পের। যে যাত্রাপথ অনন্ত, যার কোনও শেষ নেই। সেই যাত্রাপথের অনন্ত যাত্রী ছিলেন শ্রী গোপীনাথ রায়।