Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

‘পৃথিবী প্রবীণ আরও হয়ে যায় মেরুজিন নদীটির তীরে’

‘পৃথিবী প্রবীণ আরও হয়ে যায় মেরুজিন নদীটির তীরে’ | দেবকুমার সোম

দেবকুমার সোম

 

সকাল? ভোররাত? না কি এখনও আলো ফোটেনি? বেলা হয়ে গেছে বুঝি খুব? মেঘে ঢাকা আকাশ? সময় সম্পর্কে সব মিথ কি তবে ভেঙে যাচ্ছে তার? যেমন তার নাকের ব্যবহার ফুরিয়ে গেছে গত চারদিন? আধো-অন্ধকারে দুজন সাদা পোশাকের মহাকাশচারী তার ঘরে ঢোকেন। সঙ্গে তাঁদের অক্সিজেন সিলিন্ডার আর হুইলচেয়ার। তাঁরা তার নাক থেকে খুলে দেন গত কদিন ধরে ঘরে লাগানো ইলেকট্রিক অক্সিজেন মেশিনের নল। তার রুগ্ন শরীরটাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেন চেয়ারে। লিফটের দরজা টেনে নেন তাঁরা ভেতর থেকে। নেমে যেতে থাকেন আলো-ছায়ার নিচে।

হুইলচেয়ার স্ট্রেচার হয়ে গেলে সে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখে। বিবর্ণ সূর্যগোলক। পাখিহীন ফ্যাকাশে নীল আকাশ। আশপাশের ছাদ থেকে বিপজ্জনক ঝুঁকে পড়া নারী-পুরুষের মুণ্ডু সে দেখে। তার বেঁটেখাটো নিতান্ত সাধারণ শরীরটা টেনে নেন কেউ অ্যাম্বুলেন্সের পেটের ভিতর…

 

খ.

…চারপাশে হুটোপাটি। অবিরত পায়ের আওয়াজ। তার মাথার কাছে স্যালাইন বটল। নাকে অক্সিজেন নল। কে যেন পেটে একটা ছুঁচ ফোটান। তীব্র নয়। আরামদায়ক। ইনসুলিন। ঘুম-ঘুম। ঘুম-ঘুম খুব। ঠিক তার পাশের বেডের রুগীটি তরুণী। সুন্দরী। অথচ বিষাদ। অথচ অসুখের মলিনতা ঢেকে নিয়েছে তার স্নিগ্ধতা। মেয়েটির মুখে অক্সিজেন মাস্ক। বেমানান। বড় বেমানান।

তার প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া চোখের পাতা কেউ টেনে খুলতে চান? তরুণী মহাকাশচারী। প্রীতিময়। বড় মায়াময় তাঁর হাতের ছোঁয়া।

…ঘুম… ঘুম… ঘুম ভেঙে যায় ফের। একটি স্ট্রেচারে এখন পাশের বেডের মেয়েটিকে কারা যেন তুলে নিচ্ছেন। এটা এমার্জেন্সি ওয়ার্ড? এখনও তার অ্যাডমিশন পাকা নয়? মেয়েটি বোধহয় ভোরের দিকে এসেছে? এখানে কি বহুক্ষণ প্রতীক্ষায় থাকা দস্তুর? …ঘুম… ঘুম…

—কিছু খাবেন?
—হুঁ?
—কিছু খাবেন?

কেউ কি তাকে জিজ্ঞেস করছেন? সেই তরুণী নার্স। নরম স্বর। সে ঘাড় নাড়ে না। ডানহাতের শিরায় চ্যানেল। কোনও ইঞ্জেকশন চলছে। ব্যথাহীন তার অনুভূতি…। তার পাশের বেডে এখন একজন নতুন মানুষ। বুড়োটে গড়ন। ক্ষয়াটে চেহারা। অথচ স্বাভাবিক। সাবলীল। বেমানান। মানুষটার যেন কথা বলার একটা লোক চাই। কাউকে দিতে হবে তাঁর আত্মপরিচয়।

—আমার বাড়ি বালিতে। বালি চেনেন? বালি? গঙ্গার ওপারে। আমি ভাল আছি। আমার কিছু হয়নি। বালির একটা নার্সিং হোমে ছেলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল তিনদিন আগে। ছেলে এখানে থাকে না। আমেদাবাদে। ইঞ্জিনিয়ার। খুব বড় চাকরি। খুব বড়। আমাকে ছেড়ে দেবে বলুন? আমার তো কিছু হয়নি?

 

গ.

চাঁদ-জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে করিডোর। কোথাও কি ভূমিকম্প হচ্ছে? না কি তার শরীর ক্রমশ পাতালে প্রবেশ করছে? পাতালে কেন? মাথার ওপর সিলিংটা সরে সরে যাচ্ছে। তার পায়ের কাছে কে এই মেয়েটি? সকালের সেই নার্সটি? মহাকাশচারী পোশাকে ঢাকা তাঁর গোল মুখ? স্ফীত স্তনের আদল? ঘর-ঘর করে কে যেন দরজা খুলে দেয়? ঠান্ডা কোনও এক প্রান্তরে তাকে আনা হল কেন? চারদিকে ফিসফাস। মহাকাশচারীরা ঘুরেফিরে চলেছেন। কাক-জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে রসাতল। এক-একটা উড়ন্ত পর্দা পেরিয়ে সে ঢুকে যাচ্ছে— ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছে আরও গভীরে। আরও গভীরে। এখন কটা বাজে? রাত আড়াইটে? এবার সে বেড পেল? নিজের একটা স্থায়ী ঠিকানা? জাঁক করে বলার মতো একটা ঠিকানা? আইসিইউ তিনশো বারো?

তার শিয়রে কে দাঁড়িয়ে? মা? তার প্রথম প্রেমিকা? যিনি তাকে ছেড়ে চলে গেছেন আড়াই বছর আগে? মা কি? এমন তো কত রাতে স্বপ্নের মধ্যে তার মা তাকে ডাক দেন। মিটিমিটি হাসেন। ইশারা করেন। পরদিন ফের রোদঝলমলে দিন। ব্যস্ত শহর কলকাতা। টাই-ব্লেজার-ড্রাইভার…। টার্গেট আর অ্যাচিভমেন্টের জিগ্‌স পাজল।

 

ঘ.

এখন দিন বুঝি? বাইরে কি খুব রোদ? কলকলিয়ে উঠেছে পৃথিবী? তার চারপাশে ব্যস্ত চলাচলে সাদা রঙের মহাকাশচারীর দল। ডাক্তার। নার্স। অ্যাটেনডেন্ট। কী আপদ! তিনশো এগারো নম্বর বেডে যে সেই বালিনিবাসী বাচাল বুড়োটা। লোকটা কেন চিৎকার করছেন? পুরুষ অ্যাটেনডেন্টরাও যেন পেরে উঠছেন না বুড়ো হাড়ের কাছে। তাঁর খুব কাশি উঠছে। শুকনো কাশি। মনে হচ্ছে ফুসফুস দুটো ছিঁড়ে মুখ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে… ডাক্তার… নার্স…? প্লিজ… প্লিজ…।

—এ কী, আপনার ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ সব পড়ে আছে? সকাল থেকে কিছুই খাননি কেন?

সে চোখ খুলে দেখে আবছায়া। তার সামনে মহাকাশচারী এক নারীশরীর। গলার স্বরে বোঝা যায় অল্পবয়সি। মনিটরে তার নজর যায়। চোখ কেঁপে যায়। সব, সবকিছু কেমন আবছা… আবছায়া…

 

ঙ.

নিঝুম নিশ্চুপ কিছু একটা গড়িয়ে যাচ্ছে পাথরের মেঝেতে। গড়িয়ে যাচ্ছে রাত। হেলে পড়ছে চাঁদ। মাঝে কিছু দারুণ ছোটাছুটির আওয়াজ কানে বেজেছিল। এখন তিনশো এগারো নম্বরের বাচাল বুড়ো মানুষটা ঘুমিয়ে গেছেন। এখন যেন শিশুর মতো শান্ত তিনি। সারা শরীর সাদা কাপড়ে কেউ ঢেকে দিয়েছে।

—কিছু খাবেন? মুখের কাছে ঝুঁকে এসেছে কোনও এক মহাকাশচারীর মুণ্ডু। কেবল মুণ্ডু। মেয়েলি কণ্ঠ।
—জল।

চাঁদের আলোর মহিমা কবে সে বুঝেছে তেমন? কেবল ভোগ করেছে। চাঁদের পেছন পেছন ছুটে ছুটে পার হয়বি কালীদহ— বেনোজল…। পায়ের সামনে কে ও? কে তুমি? সাদা পোশাকে গোপন করতে চাইছ নিজেকে? তোমার ডানা দুটো কই? তোমার জন্য, দেখো। এই দেখো আমি অক্সিজেন মাস্ক, পালস অক্সিমিটার, মনিটর, চ্যানেল, স্যালাইন বটল সব সাজিয়ে বসে আছি। কোথায় তোমার ঘোড়া দুটো? ডুবুরির পোশাক? আমার পায়ের কাছে কে তুমি?

 

চ.

ক্যালেন্ডারের দিন পালটে যায়। তিনশো এগারোয় এখন নতুন রুগী।

 

ছ.

ধীরে ধীরে চেতনার ভেতর থেকে সে সাড়া দিতে পারে। মনে হয় পুকুরের জঠরে কাদা, লতাগুল্ম, শামুকের খোলে জড়িয়েমড়িয়ে আছে সে। চোখের ওপর ভেসে উঠছে আলোর সর। জলের স্তরের ভেতর থেকে কেউ যেন জোরে জোরে ডাকছে। …তারপর ফের মেঘগর্জন কিংবা ভূমিকম্প। অথবা দুটোই। সিলিংয়ে সিলিং বদল হতে থাকে। তাকে নিয়ে দুজন মহাকাশচারী এখন কোথায় যাচ্ছেন?

রেডিও অ্যাকটিভ রুম। স্ট্রেচার থেকে তার শরীর তুলে ধাতব টেবিলে তাঁরা শুইয়ে দিলেন। তার বুকের ওপর নেমে এল ক্রমে বিশাল একটা বাক্স। স্বয়ংক্রিয়। ফের উঠে যায়। ফের ঘর-ঘর মেঘগর্জন। সিলিঙে সিলিং বদল হতে থাকে।

 

জ.

কাশির টানে বুক ফেটে যেতে থাকে। এখন তার আর সেই আচ্ছন্ন ভাব তেমন নেই। এখন সে একটু একটু বুঝতে পারে তার শরীরে ইনসুলিনের ছুঁচ ফোটানোর ব্যথা। কখন তার টেম্পারেচার নেন মহাকাশচারীর দল। কখন একজন কাপ্তান টাইপের লোক এলে বাকিরা ঘিরে ধরেন তাঁকে। তিনি দূর থেকে তাকে দেখেন। ইশারা করেন। চলে যান পাশের কিংবা তার পাশের বেডে। আশপাশের বহু বেডের মানুষ বদল হল। কেউ গেল হুইলচেয়ারে চেপে। কারও মুখ চাপা পড়ল সাদা কাপড়ে। এখন সময় মেনে তার শরীরের সুগার, বিপি, পালস মাপা হয়। সে মুখ তুলে দেখতে পায় মনিটারে সেসব অতি প্রয়োজনীয় শারীরবৃত্তীয় মাপজোক। কাশির টানে বুক ফেটে যেতে থাকে। খিদেহীন। ঘুমহীন। মাথার চারপাশে ঘোলাটে অন্ধকারে কাশির বেগে বেদম হয়ে একসময় সে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়লে তার মাথার কাছে এসে দাঁড়ান ডানাহীন ঈশ্বর। তাঁর ডানা দুটো কেটে নিয়েছে যারা তারা কি জানে ডানা ছাড়াও তিনি ঈশ্বর?

এক সন্ধের দিকে একজন অল্পবয়সি মহাকাশচারী নারী ব্যস্ত হয়ে তার কাছে ছুটে আসেন। এই নিন ভিডিও কলে আপনার বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলুন। এই নিন। তাঁর মোবাইলে তখন ফুটে উঠেছে তার স্ত্রীর মুখ। মুখে তাঁর বানানো হাসি। বড় বেমানান। এই হাসিতে উদ্বেগ, মলিনতা খেলা করে। ছেলের মুখ উদ্ভাসে। সে তেমন সুপটু নট নয়। জীবনের ঘাটে-ঘাটে সবে তার নাও ভেড়ানো শুরু হয়েছে।

—কাল তোমাকে বাড়ি নিয়ে আসব। শুনতে পারছ? কাল তোমাকে ছুটি করিয়ে নিয়ে আসব। তার স্ত্রী ক্রমাগত একই কথা, একই কথা… জলের মতো একই কথা বলতে থাকেন। একই কথা।

 

ঝ.

ঘরের বিছানায় শুয়ে সে। আধুনিক ফ্ল্যাটের অ্যাটাচড বাথরুম। ইউরিন মাপার পট। পালস অক্সিমিটার। পোর্টেবল সুগার আর বিপি মেশিন। ডায়েরি। সময় মেনে নিজের স্বাস্থ্যপরীক্ষা সে নিজেই শিখে গেছে বেশ। ডায়েরিতে লিখে রাখে। ঘরের বাইরে থেকে তার বউ খাবার দিয়ে দেন। দিনে একবার বাথরুমে ঢুকে তার কাপড় কাচেন। ঘর মোছেন। বাসন মেজে দেন। মোবাইল ফোন এখনও তার কাছছাড়া।

তার বউ মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাভস নিয়ে তার কাছে চলে আসেন। বিপজ্জনক কাছে। স্বকৃত দূরত্ব যেন জোর করে ভেঙে দিতে চান এই নারী। এই নাও পেন। সে হাতে তুলে নেয় তার প্রিয় মঁ ব্লা ফাউন্টেন পেন।

—শুনলাম কোভিডের পর মানুষ নাকি পালটে যায়। পালটে যায় তার হাতের লেখা। অনেকদিন হল তুমি কিছু লেখো না। টেস্ট করে দেখো…

 

ঞ.

পৃথিবী আরও প্রবীণ হয়ে যায় মিরুজিন নদীটির তীরে
বিবর্ণ প্রাসাদ তার ছায়া ফেলে জলে।
ও-প্রাসাদে কারা থাকে? কেউ নেই—
সোনালি আগুন চুপে জলের শরীরে
নাড়িতেছে— জ্বলিতেছে— মায়াবীর মতো জাদুবলে।

সে-আগুন জ্বলে যায়— দহে নাকো কিছু,

সে-আগুন জ্বলে যায়
সে-আগুন জ্বলে যায়।