অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
আমরা রাইখস্ট্যাগের অগ্নিকাণ্ড দেখিনি। সনাতন ফ্যাসিজম অথবা নাৎসিদের সেই কিংবদন্তি-সম উত্থানকেও কখনওই স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিনি। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় পড়ে আসা সেই বিবরণ, যে অসম্ভব বাস্তবতার সঙ্গে আজ স্বদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা অনুভব করছি ও করে চলেছি— এই উপলব্ধি কেবলই হাড়হিম আতঙ্কের জন্ম দেয়
“এত প্রশ্ন কেন!”
যথাযথ মন্তব্যই সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে ছুড়ে দিয়েছেন মথুরার মাননীয় সাংসদ। শীতকালীন অধিবেশনে ১৪২ জন বিরোধী সাংসদ সাসপেন্ডের ঘটনায় সংবাদমাধ্যমের তরফে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে, পালটা প্রশ্নের মাধ্যমেই সাংসদ হেমা মালিনী এই বিষয়ে তাঁর মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। তাঁর বক্তব্য সাসপেন্ড হওয়া সাংসদেরা “বড্ড বেশি প্রশ্ন করেন”— বোধহয় দেশের নতুন ‘গণতন্ত্রে’র পক্ষে তা সত্যই ক্ষতিকর ও প্রতিবন্ধক। নয়া ভারতে দাঁড়িয়ে, এই নয়া শাসনব্যবস্থার ‘বাধ্য’ নাগরিক হিসেবে, গণতন্ত্রের নতুনতর এই পাঠ হজম করাটাই বোধকরি এখন আমাদের তরফে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। এই গণতন্ত্রে অতিরিক্ত প্রশ্ন করা পাপ, সে-কথা চিন্তারও অধিকার নেই কারও। কোনও এক বিরোধী সাংসদের কথায় “ওয়ান নেশন, নো কোয়েশ্চেন” নীতিতেই এখন নির্ধারিত হবে এ-দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ।
শীতকালীন অধিবেশনে এই গণহারে সাংসদ সাসপেন্ডের ঘটনায় শুরুতেই কিছু তথ্য দেখে নেওয়া যাক। মোদি-শাহের ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে যে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক লড়াইয়ের মঞ্চ ক্রমশ তৈরি হতে চলেছে (যদিও তার অস্তিত্ব এখনও যথেষ্টরূপেই জায়মান ও অনিশ্চিত), সেই ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সদস্য দলগুলির ক্ষেত্রে যদি এই মুহূর্তের হিসেব নেওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে ৫৪৩ আসন বিশিষ্ট লোকসভায় জোটভুক্ত দলগুলির মোট সংসদ সদস্য রয়েছেন ১৪২ জন। চলতি শীতকালীন অধিবেশনে এর মধ্যে ৯৫ জনকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। ২৫০ আসন বিশিষ্ট রাজ্যসভায়, বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের দলগুলির তরফে সংসদ সদস্য রয়েছেন ১০১ জন। তার মধ্যে ৪৬ জনকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। অর্থাৎ দুই কক্ষ মিলিয়ে মোট ২৪৩ জন বিরোধী সাংসদের প্রায় ৬০ শতাংশ অর্থাৎ ১৪১ জন সদস্যকে চলতি অধিবেশনে বলপূর্বক অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হচ্ছে না। এছাড়াও এর মধ্যে একাধিকজনের বিরুদ্ধে সংসদীয় স্বাধিকার ভঙ্গের অভিযোগ এনে সরকারের তরফে প্রিভিলেজ কমিটিতে যাওয়া হয়েছে। যার অর্থ, সেই সব সদস্যদের উপর আরও দীর্ঘমেয়াদে শাস্তি আরোপের সম্ভাবনা রয়েছে। প্রিভিলেজ কমিটি বা এ-ধরনের কমিটির তরফে ঠিক কতখানি নিরপেক্ষ তদন্ত করা হয়, সাম্প্রতিক মহুয়া মৈত্রের সাংসদ পদ খারিজের ঘটনাতেই তা স্পষ্ট।
‘তোতা-কাহিনি’র নিন্দুকের মতো এখানে মন্তব্য করতে চাইব, ‘মালিক’ আদানির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা মাত্র, যে কায়দায় রাহুল গান্ধি ও মহুয়া মৈত্রের সাংসদ-পদ খারিজ করা হয়েছিল— সেই বিশ্রী নজির থেকে কোনওভাবে দৃষ্টি ঘোরানোর উদ্দেশ্যেই কি এই গণ-সাসপেনশনের পরিকল্পনা? যাতে কেউ আর এ কথা বলতে না পারে, কেবল মালিকের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুললে পরেই সেবক-সাহেব সাসপেনশনের হুকুম দেন। এ-কথা যে সত্য নয় একেবারেই। এখন থেকে সাহেব ও তাঁর বশংবদ সহচরকুলের ইচ্ছেতেই মাননীয় সদস্যদের সংসদে থাকা, বা না-থাকা নির্ভরশীল। আদালত থেকে শুরু করে প্রশাসন, রাহুল অথবা মহুয়ার সাংসদ পদ খারিজের ঘটনায় গণতন্ত্রের দুই প্রধান স্তম্ভকেই, কতখানি নির্লজ্জভাবে সাহেবের সরকার ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, সে কথা স্পষ্ট প্রতিষ্ঠিত হয়।
সরকারি সিদ্ধান্ত-বিবরণী থেকে যেটুকু উঠে আসছে তাতে এ-কথা বলাই যায়— চলতি শীতকালীন অধিবেশনে সংসদ ভবনে বহিরাগত কিছু মানুষের ঢুকে পড়া, ও সেই সূত্রে নয়া সংসদ ভবনে সাংসদদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টিকে নিয়ে যথাযথ ও সময়োচিত উদ্বেগ প্রকাশের কারণেই এতজন সাংসদের বিরুদ্ধে একতরফা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হল। তাঁদের প্রধান অপরাধ নয়া সংসদ ভবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা, ও সেই সূত্রে সাহেব ও সহচরের— অর্থাৎ কিনা প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মোদি-শাহের সংসদে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দাবি করা। সংসদীয় নিরাপত্তার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দফতরের তরফে সামান্যতম বিবৃতি দেওয়ার বিষয়েও যদি এই সূত্রে অনীহা দেখা যায়, তবে সেই বিষয়টিকে জনতার সামনে নিয়ে আসা কি এতটাই অপরাধমূলক? নাকি গণতন্ত্রের পক্ষেও তা এতখানিই বিপজ্জনক?
এবারে আসা যাক ‘হামলা’র প্রসঙ্গে। বিষয়টিকে দু-দিক থেকে দেখা উচিত। সংসদীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে নিঃসন্দেহে এই বহিরাগত হানাদারির ঘটনা উদ্বেগজনক। প্রধান কারণ হল এই ‘হানাদারি’ চলেছে ১৩ ডিসেম্বর— ২২ বছর আগের এই দিনেই, ২০০১ সালে পুরনো সংসদ ভবনে রক্তাক্ত জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। যে ঘটনার স্মৃতি এখনও আমাদের স্মরণে রয়েছে। বিশেষ এই দিনটিকেই ‘হামলা’র উদ্দেশ্যে বেছে নেওয়া, আদৌ তা গুরুত্বপূর্ণ, নাকি কেবলই তা এক কাকতালীয় সমাপতন মাত্র— এই বিষয়ে সুনিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। অন্যদিকে, যেভাবে সংসদ কক্ষে ঢুকে পড়া যুবকেরা ভিজিটার্স গ্যালারি থেকে একলাফে একেবারে সাংসদদের নির্দিষ্ট আসনের উপরেই এসে পড়লেন, ও তৎপরবর্তী সময়ে সংসদকক্ষের প্রায় যে-কোনওদিকে দৌড়ে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখালেন— তাতে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিরাপত্তার বিষয়ে যথেষ্টই উদ্বেগের কারণ রয়েছে। এছাড়াও যেভাবে সংসদকক্ষের অভ্যন্তরে স্মোক বম্বিং করা হল, সদস্যেরা তো বটেই, এমনকি সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তারক্ষীরাও যেভাবে কিছু সময়ের জন্য কার্যত নীরব দর্শকের ভূমিকায় পর্যবসিত হলেন, এই প্রত্যেক ঘটনাই নয়া সংসদ ভবনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা-বিষয়ক অনেকগুলি খামতিকে সামনে নিয়ে আসে।
এর বিপরীতে আমরা যদি ‘হামলাকারী’দের চরিত্র ও সেই ‘হামলা’র পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু সংসদ সদস্যের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া বা আচরণকেও লক্ষ করি, সে-ও বোধকরি এক অদ্ভুত সত্যকেই সামনে নিয়ে আসবে। এখনও অবধি ‘হামলাকারী’দের পরিচয় যতটুকু জানা গিয়েছে, তাতে এটুকু পরিষ্কার যে তারা প্রত্যেকেই এদেশের ‘শিক্ষিত বেকার’ শ্রেণির বিপুল জনসংখ্যার সদস্য। কাজেই তারা যে প্রশ্নগুলি সংসদে চিৎকার করে তুলতে চেষ্টা করেছিল, সেগুলির মধ্যে দিয়ে দেশের বিরাট এক জনসংখ্যার স্বাভাবিক ও সমকালীন প্রশ্নগুলিই কিন্তু প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। সে-কারণে রাহুল গান্ধি যে বিবৃতির মাধ্যমে এই হামলার কারণ হিসেবে বেকারত্বের সমস্যা ও মোদি-সরকারের আমলে দেশের বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক অবস্থাকে নির্দেশ করেছেন, তার প্রতি সমর্থন জানানো ভিন্ন আর কোনও উপায় দেখছি না। এ কথাও স্পষ্ট, ‘হামলাকারী’দের আচরণে কোনও ব্যক্তিগত হিংসা বা ব্যক্তি বা সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের কোনও নির্দিষ্ট উদ্যোগই কিন্তু একবারের জন্যও পরিলক্ষিত হয়নি। পরিবর্তে, বেশ কিছু সাংসদ যেভাবে সংসদকক্ষের ভিতরেই ‘হামলাকারী’দের কার্যত গণধোলাই দিতে উৎসুক হয়ে উঠেছিলেন, তাতে মোদি-সরকারের আমলে ‘গণধোলাই’-এর শিল্পটি যে কতখানি সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছে— তা-ই আরও একটিবার প্রতিভাত হতে পারল। ওয়াকিবহাল মানুষেরা এই হামলার পরবর্তীতে এমনও সংশয় প্রকাশ করেন যে, এই ‘হামলা’র ঘটনাকে কারণ হিসেবে ব্যবহার করে মোদি-শাহের সরকার ভবিষ্যতে সংসদ ভবনে সাংবাদিকদের গতিবিধির উপরেও কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপের রাস্তায় হাঁটবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল সরকারের উদ্দেশ্য আরওই কুটিল ও একইসঙ্গে উদ্বেগের।
‘হামলা’র পরে পরেই বিরোধী সাংসদ সদস্যদের একের পর এক ‘প্রশ্ন তোলা’র অভিযোগে অভিযুক্ত করে মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে মোদি সরকারের তরফে ১৪২ জন সাংসদকে চলতি অধিবেশন থেকে বহিষ্কার করা হল। তৎপরবর্তীতেই কেবল আমরা শাসক বা সরকারের আদত কৌশল সম্পর্কে আন্দাজ পেলাম। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিক হিসেবে মোদি-শাহের সমালোচনা অথবা বিজেপির বিরুদ্ধে নাগরিক আন্দোলন অনেক কাল ধরে চলছে, কিন্তু যে-ধূর্ততায় তারা কার্যত দেশের প্রশাসন ও সংবিধানকে অবধি হেলাফেলার বস্তুতে পরিণত করেছে— রাজনৈতিক ক্ষমতার পট-পরিবর্তন হলেও, সে সব ক্ষতচিহ্নেরা দীর্ঘমেয়াদে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখবে ও যন্ত্রণার অনুভূতি সঞ্চার করবে।
উপসংহারের কাছাকাছি এসে এবারে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়েরই একটি পূর্বোক্তি দিয়ে সম্পূর্ণ বিষয়টি দেখতে চাইব। এনআরসি আন্দোলনের সময় মাননীয় অমিত শাহ বলেছিলেন, “আপ ক্রনোলজি সমঝিয়ে”— অর্থাৎ কিনা আরএসএসের মতাদর্শ মেনেই মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন দেশভাগের কালানুক্রমিক (অথচ উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিকৃত) ইতিহাস। সাংসদ সাসপেন্ড ও তার পরবর্তী কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, এইবারে না-হয় মাননীয় সাহেব ও তার সহচরকেও সেই ‘কালানুক্রম’ অথবা ক্রনোলজিকেই স্মরণ করানো যাক।
এই বছরেরই বাদল অধিবেশনে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে ইন্ডিয়ান পেনাল কোড, কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিওর ও তারই সঙ্গে ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট, পুরনো এই তিনটি আইনের বিকল্প হিসেবে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা, ও ভারতীয় সাক্ষ্য বিল সংসদে আলোচনার জন্য পেশ করা হয়। বিল তিনটি এর পরবর্তীতে নির্দিষ্ট সিলেক্ট কমিটিতে যায় ও সেখানে ‘বিস্তারিত’ আলোচনা-র পর হঠাৎই গত ১২ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের তরফে সংসদে বিবৃতি দিয়ে জানান বিল তিনটিকে আপাতত সরকার ফিরিয়ে নিচ্ছে এবং বেশ কিছু সংশোধন-সহ পুনরায় মাননীয় সদস্যদের বিবেচনার জন্য নতুন আকারে পেশ করছে। এই ঘটনা ঘটে ১২ ডিসেম্বর। ১৩ ডিসেম্বর সংসদে ‘হামলা’র ঘটনা ঘটে। ১৮-১৯ ডিসেম্বর, সোম ও মঙ্গলবারের অধিবেশনে বিরোধী সাংসদদের বিরুদ্ধে গণ-সাসপেনশনের অভিযান চালানো হয়। ২০ ডিসেম্বর কার্যত বিরোধী-শূন্য লোকসভায় পাশ হয়ে যায় তিনটি ন্যায় সংহিতা বিল। এছাড়াও, চলতি অধিবেশনেই বিরোধী-শূন্য রাজ্যসভাতেও সরকারের তরফে বিল তিনটিকে পাশ করিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রাচীন ঔপনিবেশিক আইনের পরিবর্তন, শাস্তির পরিবর্তে মানুষের সুবিচার-প্রাপ্তিকে সুনিশ্চিত করা— নতুন তিনটি ন্যায় সংহিতা বিলের ক্ষেত্রে এমন অনেক সুমিষ্ট প্রতিশ্রুতির কথা শাসকের তরফে ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হলেও, আদতে আইন বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন শীঘ্রই কার্যকর হতে চলা নতুন এই তিনটি আইনের মাধ্যমে, আদতে সাধারণ নাগরিক এমনকি সংবাদমাধ্যমের উপরেও সরকারি নজরদারি চালানোর বিষয়টি অনেকাংশে সহজ হয়ে আসবে। এমনকি ব্রিটিশ কোড অনুযায়ী কুখ্যাত দেশদ্রোহ আইনটিকে তুলে দেওয়ার কথা বলা হলেও, আদতে সামান্য দু-চারটি শব্দ মাত্র পালটিয়ে সেটিকেও কার্যত অক্ষত অবস্থায় ন্যায় সংহিতার অংশ হিসেবে রেখে দেওয়া হয়েছে। গায়ের জোরে বিরোধী-শূন্য আইনসভায় এমন দমনমূলক ও অভিসন্ধিমূলক বিতর্কিত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিল যেভাবে এই অধিবেশনে পাশ করানো হল, তাতে আমাদের পবিত্র সংসদীয় ঐতিহ্যের উপর যে বেশ বড় একটা কালো দাগ পড়তে পারল, সে কথা বলাই যায়। এই কারণেই বোধহয় সরকারের তরফে বিরোধী রাজনীতিক তথা সাংসদদের গণ-সাসপেনশনের প্রয়োজন ছিল।
আমরা রাইখস্ট্যাগের অগ্নিকাণ্ড দেখিনি। সনাতন ফ্যাসিজম অথবা নাৎসিদের সেই কিংবদন্তি-সম উত্থানকেও কখনওই স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিনি। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় পড়ে আসা সেই বিবরণ, যে অসম্ভব বাস্তবতার সঙ্গে আজ স্বদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা অনুভব করছি ও করে চলেছি— এই উপলব্ধি কেবলই হাড়হিম আতঙ্কের জন্ম দেয়।
এর পরবর্তীতেও যদি ফ্যাসিজমের এই দানবের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনীতিকেরা তো বটেই, সর্বোপরি দেশের জনগণ হিসেবে আমরাও ভোটবাক্সে একজোট হতে না পারি— তাহলে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেওয়ারও আমাদের কোনও যোগ্যতা থাকবে না। সত্যিই আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে থাকব— নাকি একনায়কতন্ত্রী সাম্প্রদায়িতার পথেই আমাদের ভবিষ্যৎ– চব্বিশের আসন্ন নির্বাচনে, ভোটাধিকার-প্রাপ্ত নাগরিক হিসেবে আমাদেরই ব্যক্তিগতভাবে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। সত্তর বছরের স্বাধীনতায়, আদতে আমরা সত্যি করেই গণতান্ত্রিক অথবা ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে উঠতে পেরেছি কিনা, প্রজাতন্ত্রের প্রতিই বা কতখানি বিশ্বাস আমাদের— চব্বিশের নির্বাচন আমাদের এমন অনেকগুলি অপ্রিয় প্রশ্নেরই সামনে সরাসরি দাঁড় করাতে চলেছে।
*মতামত ব্যক্তিগত