Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কুকুর হইতে সাবধান

কুকুর হইতে সাবধান | উন্মেষ মিত্র

উন্মেষ মিত্র

 

কোন বন্যপ্রাণীকে মানুষ প্রথম পোষ মানায়?

উত্তরটা হল কুকুর।

আজ থেকে প্রায় ১২,০০০ বছর আগে বর্তমান ইরাক, জর্ডন, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন অঞ্চলে প্রথম কৃষিকাজ শুরু হয়। তার প্রায় ২০ হাজার বছর আগে মানুষ কুকুরকে পোষ মানানোর কাজ শুরু করে। এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত সব থেকে পুরনো কুকুরের সমাধিটি প্রায় ১৪,২০০ বছর পূর্বের।

এবার প্রশ্নটা হল, মানুষ কুকুরকে কেন পোষ মানিয়েছিল?

এককথায় উত্তরটা হল, Commensalism.

অর্থাৎ দুই ভিন্ন প্রজাতির সহাবস্থান। যেখানে দুই প্রজাতিই কোনও-না-কোনওভাবে লাভবান হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাখি এবং মোষের কথা। মাঠেঘাটে মোষদের লক্ষ করলে দেখতে পাবেন ঘাস খেতে ব্যস্ত মোষদের চারিপাশে, মোষের গায়ে, মাথায় বসে আছে বক, শালিখ বা ফিঙে। ঠুকরে ঠুকরে মোষের গায়ের লোমের ভিতর থেকে খাচ্ছে কিছু। চোখে দূরবীন লাগালে দেখতে পাবেন, মোষের গা থেকে পোকা খাচ্ছে। এতে মোষের শরীর পরিষ্কার থাকছে আর অন্যদিকে এই পাখিদের নিশ্চিন্ত আহারের ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে। সেইরকমই আজ থেকে প্রায় ১৫,০০০ বছর কিংবা তারও আগে আগে কুকুর হয়ে উঠেছিল শিকারী-সংগ্রাহক (Hunter gatherers) মানুষের বিশ্বস্ত সঙ্গী। লাভ হিসেবে মানুষের হয়েছিল, কুকুরের গতি-ক্ষিপ্রতা-ঘ্রাণ শক্তিকে শিকারের কাজে ব্যবহার এবং কুকুর পেয়েছিল নিশ্চিত আশ্রয়, শিকারের অংশ।

এবার প্রশ্নটা হল, বেমক্কা এরকম কুকুরের পোষ মানানো নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছি কেন?

উত্তরটা হল, সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান।

Association of Prevention and Control of Rabies in India (APCRI)-এর তথ্য অনুসারে ভারত প্রতিবছরে প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষকে কুকুরে কামড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে পৃথিবীতে বছরে ১০০ জন মানুষকে কুকুরে কামড়ানোর ঘটনা ঘটলে ৩৬টি ঘটনা ভারতীর ভূখণ্ডে ঘটে। আরও নির্দিষ্ট করে উদাহরণ দিলে বলা যায়, একটি সমীক্ষা অনুসারে দিল্লির সফদরজং হাসপাতাল এবং রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে ৬ মাসে যথাক্রমে ২৯,৬৯৮ এবং ১৮,১৮৩ জন কুকুরের কামড়ে আহত হয়ে এসেছিলেন। ২০১২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ৬,৬৪৪ জন রেবিজে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

লেখক কি সারমেয়-বিরোধী?

উত্তরটা হল, না।

সমস্যা সারমেয় নিয়ে নয়, সমস্যাটা হল মালিকানাবিহীন সারমেয়দের নিয়ে। এই মুহূর্তে এইরকম সারমেয়দের সংখ্যা ভারতে প্রায় সাড়ে তিন কোটি অন্যদিকে পোষ্য সারমেয়দের সংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি। মানুষের বসতির আশেপাশে ঘুরে থাকা এই মালিকানাবিহীন সারমেয়রা শুধুমাত্র মানুষ নয়, এই মুহূর্তে ভারতের বন্যপ্রাণের সামনে অন্যতম প্রধান বিপদ। জম্মু-কাশ্মিরের রাজ্যপাখি ব্ল্যাক নেকড ক্রেন কিংবা রাজস্থানের রাজ্যপাখি গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডের সাম্ভাব্য বিলুপ্তির অন্যতম কারণ এই কুকুরেরা। শুধু পাখি নয়, কচ্ছের মরুভূমিতে বসবাসকারী বিলুপ্তপ্রায় বুনো গাধা কিংবা কৃষ্ণসার হরিণ সহ প্রতিদিন অগুনতি বন্যপ্রাণ শিকার হচ্ছে এই সারমেয় দলের হাতে।

এর কারণ কী?

এক কথায় উত্তর হল, ‘জিন’।

নেকড়েকে পোষ মানিয়ে এবং selective breeding-এর সাহায্য নিয়ে কুকুরের আবির্ভাব। নামে কুকুর হলেও শরীরের ভিতর জিনটি রয়েছে নেকড়ের। তাই মানুষের নাগাল থেকে বেরিয়ে পথে-জঙ্গলে এরা নেকড়েদের মতই দল গঠন করে এবং একেকটি দলের ঠিক নেকড়েদের মতোই এলাকা বিভাজন থাকে। এলাকার দখল নিয়ে দুই দল কুকুরের লড়াই আমরা নিজেদের বাড়ির আশেপাশে সবাই দেখেছি। শিকার করার স্বাভাবিক প্রবৃত্তিও এদের মধ্যে ফিরে আসে। কেউ কেউ হয়তো বাড়ির আশেপাশের কাঠবিড়ালি বা গরুর পিছনে কুকুরের দলকে ধাওয়া করতে দেখে থাকবেন। খাদ্যের অভাবে জঙ্গলের আশেপাশে থাকা কুকুরের দল তাই শিকার করে খরগোশ, হরিণদের। গত ৯ জুলাই গুজরাতের মরবি শহরে বাড়ির সামনে খেলা করার সময় দুই বছরের একটি বাচ্চার ওপর আক্রমণ করে একদল কুকুর। হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।

তাহলে কি আমরা কুকুর ভালবাসব না? ভালবাসব না আমরা কুকুর?

কুকুরকে ভালবাসায় কোনও সমস্যা নেই। প্রাণীজগতে কুকুর আমাদের সবচেয়ে পুরনো বন্ধু। কুকুর ভালবাসলে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে পোষ্য বানানোটাই শ্রেয়। আগেই বলেছি ভারতের প্রায় আড়াই কোটি পোষ্য কুকুর কোনও মারাত্মক সমস্যার কারণ না। কিন্তু কুকুরপ্রেমের নামে রাস্তার কুকুরকে ভাত মেখে খাওয়ানো কিংবা বেড়াতে গিয়ে শখের বসে বিস্কুট খাওয়ানো মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করছে। সুবিধাজনক পরিস্থিতি পেলে জীবজগতের সকল জীবই অত্যাধিক মাত্রায় বংশবিস্তার করতে থাকে। এবং তারপর একটি পর্যায়ে গিয়ে খাদ্যসঙ্কট দেখা যায়। তখন শুরু হয় খাদ্যের জন্য লড়াই। আর খাদ্য সীমাহীন হলে বংশবৃদ্ধিও হয় সীমাহীন। লোটকা-ভলতেরা ইকুয়েশন থেকে প্রকৃতির এই নিয়ম ব্যাখ্যা করা যায়। শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রকৃতির ভারসাম্য। এই কুকুরদের খাওয়ানোর ফলে পশুজগতের ভালর বদলে আখেরে বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হয়। শুধু কুকুর বলে নয়। রাস্তার মাঝে গাড়ি থেকে খাবার বা খাবারের প্যাকেট ফেলে দেওয়ার কারণে বাঁদর থেকে শুরু করে শিয়াল, সেই খাবার খেতে গিয়ে পথদুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় অনেক বন্যপ্রাণের।

এর সঙ্গে শহর-গ্রামাঞ্চলে সবচেয়ে বড় সমস্যা আবর্জনা ব্যবস্থাপনা। দেশের বেশিরভাগ স্থানেই রাস্তার এক পাশে স্তূপাকারে আবর্জনা জমা করা হয়। কেউ কেউ আবার নিজের মর্জিমতো বাড়ির আবর্জনা ফেলে দেন রাস্তাতে। এর ফলে পথকুকুরেরা পেয়ে যায় সীমাহীন খাদ্যভাণ্ডার আর তারপর তাদের বংশ গুণোত্তর প্রগতি হারে বৃদ্ধি পায়।

এসবের ফলাফলে শহর-গ্রামাঞ্চল থেকে হারিয়ে যায় ছোট ছোট নানা প্রাণী, বিলুপ্তির পথে পা বাড়ায় কালো-গলা সারসপাখি কিংবা ডেথ সার্টিফিকেট পায় মরবির দুই বছরের শিশুর পরিবার।

কুকুরপ্রেমী নয়, পশুপ্রেমী হন। আপনার এলাকা, সর্বোপরি দেশের জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসুন।