সরিতা আহমেদ
নবিদিবসের জমায়েত নিয়ে মাঝেমধ্যে পুলিশের পারমিট নেই, ট্রাফিকের হ্যাঙ্গাম আছে বলে যেসব অভিযোগ আসে, তা পার্ক স্ট্রিটের ভিড়ের ক্ষেত্রে আসে না। কারণ রসুলের উম্মতদের (অনুসারী) মধ্যেই তাঁর জন্মদিন পালন নিয়ে এতরকমের বিরুদ্ধমত রয়েছে, যাতে বিভেদের বার্তা স্পষ্ট। এছাড়াও প্রথম ভিড়টা কার্যত একটি বিশেষ ধর্মানুসারীদের সৃষ্ট। এই ভিড়টি বিধর্মীদের বর্জন করার বার্তা দিয়ে কার্যত হাদিস-কোরানের কেতাবি উৎসব হয়ে রয়ে গেছে। কিন্তু পার্ক স্ট্রিটের দ্বিতীয় ভিড়টি কেক, সুরা ও সান্টার উপহারবার্তায় জাতধর্মনির্বিশেষে সবাইকে সামিল করে আক্ষরিকভাবেই ‘সর্বজনীন’ হতে পেরেছে
প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর এলে পার্ক স্ট্রিটের ভিড় দেখে একটা প্রশ্ন সামাজিক মাধ্যমে ঝড় তোলে— “সান্টা টুপি সবার, কিন্তু ফেজ টুপি নয় কেন?”
জবাবে ইউটিউবে ওয়াজের লিঙ্ক পাঠানো চলে যাতে হুজুরগণ ‘চিল্লাইয়া কন্’— “সবই দ্বিনি এছলামের নবি। খেস্টান, ইহুদি বলে কিসু নাই।”
কিন্তু যুক্তিবাদী ও অনুসন্ধিৎসু মনকে ‘কিসু নাই’ বলে আড়াল করা চলে না, বরং প্রশ্নটা নিয়ে ভাবার অবকাশ সত্যি আছে কিনা তার চর্চা চলে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদি জনজাতির মধ্যে থেকে যে দুই ভিন্ন ধর্মবিশ্বাস-শাখার জন্ম তারা হল— খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম। একেশ্বরবাদের নিয়ম অনুসারে দুই ধর্মই দুজন নবি বা পয়গম্বর দ্বারা প্রচারিত হয়। ইসা নবি বা জেসাস বা যিশু এবং হজরত মহম্মদ।
দুইজনই নাকি ঈশ্বরের প্রেরিত দূত বা ঈশ্বরের সন্তান। মানবকল্যাণের উদ্দেশ্যেই নাকি দুই পুত্রের মর্ত্যে আগমন এবং বিশ্বজুড়ে দুই বৃহৎ ধর্মমতের সৃষ্টি। তাহলে ভারতের মতো সর্বধর্মবাদী দেশে যেখানে হিন্দু-মুসলিম আদিকাল থেকেই পড়শি হিসেবে বসবাস করে এসেছে, সেখানে মাত্র তিনশো বছর আগে ভারতে আসা গোরা খ্রিস্টান সাহেবদের উৎসব এত জনপ্রিয় হয়ে গেল কী করে? পূর্বপরিচিত পড়শি হওয়ার সুবাদে নিয়ম অনুযায়ী তো পুজোআচ্চার দেশে জনপ্রিয়তার দিকে ঈদের স্থান দ্বিতীয় হওয়া উচিত। কিন্তু গোটা ডিসেম্বর মাসে মাত্র একটা তারিখকে ঘিরে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্মিলিত হওয়ার চিত্র আমরা দেখি গোটা দেশজুড়ে, কই বছরে দুটো ঈদের তারিখে সেই চেহারা তো দেখি না!
তাহলে ফেজ টুপির সর্বজনীন হয়ে ওঠায় বাধা কোথায়?
ব্যক্তিগতভাবে কোনও ধর্মমতেই আস্থা না থাকার জন্যই বোধহয় বিশ্বাসীদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বিভাজনের সূক্ষ্ম রেখাটা দেখা যায়।
প্রধান বাধা হচ্ছে বার্তায়। নবি মুহাম্মদ সৃষ্ট ধর্ম আগাগোড়া অমুসলিমদের এড়িয়ে চলা, ত্যাগ করা, প্রয়োজনে হত্যা করার পরামর্শ দেয়। সেখানে অন্য ধর্মবিশ্বাসে আস্থা-রাখাদের সামিল করার কোনও ইনক্লুসিভ বার্তা নেই। যদি তাঁরা ধর্মান্তরিত হয় তবেই তাদের জন্য রসুল-সৃষ্ট ধর্ম ইনক্লুসিভ হবে। ফেজ টুপি একটা বিশেষ ধর্মের পরিচায়ক, ঠিক যেমন বোরখা বা হিজাব। এই পোশাক অন্যকে নিজের সঙ্গে সামিল করার বার্তা দেয় না, বরং ভিড়ের মধ্যে নিজের জাতিকে আলাদা করে চেনায়।
অন্যদিকে ইসা নবির জন্মদিন পালনের চেয়েও বেশি ম্যাটার করে বরফের দেশ থেকে স্লেজ গাড়িতে চেপে আসা লালজামার সান্তাবুড়ো। ঈশ্বরের দূত যদি নবি হন, তবে ইসা নবির দূত এই সান্তা। যার একটা আকর্ষণীয় চেহারা আছে, যার ঝুলিতে আছে বাচ্চা-বড়, ছেলে-মেয়ে সব্বার জন্য উপহার, আর এই উপহার যেহেতু জাতধর্ম দেখে বণ্টন করা হয় না— তাই আবালবৃদ্ধবণিতার বাজার ধরতে লাল টুপি কয়েক কদম এগিয়ে।
এরপরে আসছে, কেক বনাম সেমুই।
মধ্যযুগ থেকেই কেকের সঙ্গে বড়দিনের এক অদ্ভুত সম্পর্ক। ঈদের রোজা রাখার মতোই খ্রিস্টমাস্-ইভে উপবাস রাখার চল, সেই উপবাস ভাঙার অন্যতম খাদ্য হিসেবে বহুদিন থেকেই সুলভ হল— কেক। এটি শুধু যে বড়দিন উপলক্ষে খাওয়া হয় তাই না, পুরো Twelve night festival জুড়েই অর্থাৎ ২৪ ডিসেম্বরের খ্রিস্টমাস্ ইভ্ থেকে থেকে ৫ জানুয়ারি অবধি কেক খাওয়ার রীতি আছে। বড়দিনের উৎসবে খ্রিস্টমাস ক্যারোলের সঙ্গে নাচ ও মদ্যপানের সঙ্গে চলে ‘টুয়েলভ নাইট-কেক’ খাওয়া, যার সঙ্গে এক রাতের জন্য রাজা-রানি হওয়ার মজাদার একটা খেলার প্রচলনও ছিল। “The man who finds the bean in his slice of cake becomes King for the night, while the lady who finds a pea in her slice of cake becomes Queen for the night.” এই যে খানাপিনার মধ্যে নর-নারী সকলকে সামিল করার মধ্যে দিয়ে একটা উৎসব পালনের রীতি, এতেই কেক ইউনিভার্সাল হয়ে উঠল।
সেখানে রোজার মাসের হালিম বা অন্যান্য মুঘলাই খাদ্য জাকারিয়া স্ট্রিট ইত্যাদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল, আপামর জনতার রান্নাঘরে পৌঁছাতে পারল না তার আভিজাত্য কিংবা বনেদিয়ানার দোহাইয়ে। ঈদের সিমুইও তাই। সহজে রান্না ও খাওয়া যায় বলে সারাবছর সিমুই অনেক বাড়িতেই থাকে, তবে খ্রিস্টমাস-কেকের মতো উৎসবের খাদ্য হিসেবে তকমা তার জুটল না। যেটা হয়তো বাংলার পিঠে-পুলির ভাগ্যে জুটেছে। এর কারণ প্রধানত ইনক্লুসিভ হওয়ার বার্তার অভাব, ফলে সেখানে জনগণ নিজেদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেলাতে পারে না। ঈদের দিন বিধর্মী অতিথিকে যতই ফিরনি-সেমুই-বিরিয়ানির দাওয়াত দেওয়া হোক, তা ক্ষণিকের। ডানহাতের কাজ মিটলে আনন্দের আর কোনও উপকরণ হাতে থাকে না। যেটা টানা দশ-বারো দিন ধরে চলা বড়দিনের উৎসবে কেক বেক্ থেকে অন্যদের মধ্যে বিলিবণ্টন অথবা গিফট দেওয়ার ক্ষেত্রে আছে। সঙ্গে চলে চার্চের মধ্যে প্রবেশের সুযোগ।
অন্য কারণ হল কট্টরতা। রসুলের উম্মতেরা প্রতিক্ষেত্রে এত বেশি বিধিনিষেধ মেনে চলার ফতোয়া দিয়েছে যাতে উৎসবে সামিল হওয়াতে সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের অনাগ্রহ বা ভীতি তৈরি হয়েছে।
অনেকে প্রশ্ন তোলেন যে, স্কুল স্কুলে বড়দিনের উৎসব পালিত হয়, নবিদিবস বা ঈদের উৎসব কেন নয়? খুব সোজা উত্তর হল— বড়দিনের যে সহজ-সরল চেহারাটা কচিকাঁচারা ধরতে পারে, চিনতে পারে এবং সাজতে পারে, সেই চেহারা ঈদ বা নবিদিবস তাদের দিতে পারেনি। যে বাচ্চাটি পাড়ার ফাংশানে জন্মাষ্টমীতে কেষ্টঠাকুর সাজে, সেই বাচ্চাই Go-As-You-Like খেলায় ক্রুশবিদ্ধ খ্রিস্ট সাজে কিংবা বড়দিনে লালজামার সান্টা সাজে। সুতরাং বাজার তাদের সেই সাজের উপকরণ জোগান দিতে পারে। চাহিদা থাকলেই জোগান থাকবে।
কিন্তু ঈদ বা নবিদিবস কি সে সাজসজ্জার অনুমতি দেয়? এই ‘যেমন খুশি সাজো’-তে একেশ্বরবাদী ইসা নবির ফলোয়ারগণ যিশু অথবা মেরি-মা সাজার জন্য (রসুল নবির রক্ষাকারীদের মতো) কারও দিকে চাপাতি হাতে তেড়ে যায় না।
এছাড়া আছে তারিখের গরমিল। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রতিবছর বড়দিন যে নির্দিষ্ট তারিখে পালিত হয়, ঈদ বা নবীদিবস সেরকম নির্দিষ্ট তারিখ দিতে অপারগ। উৎসবের মধ্যে অনিশ্চয়তা কাম্য নয়।
এরপর আসছে দৃষ্টিনন্দন রুচিবিন্যাস। বড়দিন উপলক্ষে চার্চগুলি যেভাবে ডিজের শব্দদূষণ ছাড়া স্রেফ আলোর মালায় সেজে ওঠে, যিশুর জন্মকে ঘিরে নানা গল্পগাছাকে বিভিন্নভাবে তুলে ধরে, যেভাবে তারা স্বাগত জানায় জাতি-ধর্ম-লিঙ্গনির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষকে— সেই সুযোগ কি ঈদের মসজিদ বা ইদগাহ্ আমাদের দেয়? অথচ ঈদের জাঁকজমকে আজকাল প্যান্ড্যাল নির্মিত হয় যেখানে গাঁক-গাঁক করে দিবারাত্র ডিজের তাণ্ডব চলে। অনেক জায়গায় হুজুরদের ওয়াজ মাহফিলেও চলে এই শব্দদানব। অথচ রসুল প্রবর্তিত ইসলামে গানবাজনা মাইকের ব্যবহার ইত্যাদি নিষিদ্ধ বস্তু! এই দ্বিচারিতা ছাড়াও ইসলাম মসজিদে মেয়েদের ঢোকা নিষেধ, বিধর্মীদের ঢোকা নিষেধ, পোষাকবিধি নিয়ে একগোছা ফতোয়া উৎসবের দিনেও শিথিল করে না— ফলে সর্বজনীন হওয়া তো দূরস্থান, উৎসবের আয়েশি মেজাজটাই নিয়মের ফাঁসে রুক্ষ হয়ে যায়।
হয়তো এইসব কারণেই নবিদিবসের জমায়েত নিয়ে মাঝেমধ্যে পুলিশের পারমিট নেই, ট্রাফিকের হ্যাঙ্গাম আছে বলে যেসব অভিযোগ আসে, তা পার্ক স্ট্রিটের ভিড়ের ক্ষেত্রে আসে না। কারণ রসুলের উম্মতদের (অনুসারী) মধ্যেই তাঁর জন্মদিন পালন নিয়ে এতরকমের বিরুদ্ধমত রয়েছে, যাতে বিভেদের বার্তা স্পষ্ট। এছাড়াও প্রথম ভিড়টা কার্যত একটি বিশেষ ধর্মানুসারীদের সৃষ্ট। এই ভিড়টি বিধর্মীদের বর্জন করার বার্তা দিয়ে কার্যত হাদিস-কোরানের কেতাবি উৎসব হয়ে রয়ে গেছে।
কিন্তু পার্ক স্ট্রিটের দ্বিতীয় ভিড়টি কেক, সুরা ও সান্টার উপহার বার্তায় জাতধর্মনির্বিশেষে সবাইকে সামিল করে আক্ষরিকভাবেই ‘সর্বজনীন’ হতে পেরেছে।
আবারও জানিয়ে দিই, আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনও নবির ফলোয়ার নই। আপাদমস্তক ধর্মহীন মানুষ। কিন্তু ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এই বিজ্ঞাপনী ভাষায় আর পাঁচজনের মতোই নানা অফার খুঁজি। আমার ধর্মাচরণ ওই ডিসকাউন্টের অফারেই সীমাবদ্ধ। তখন এই বাজারি উৎসব পর্যবেক্ষণ করেই বুঝতে পারি অন্যান্যরা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজার ধরতে পারলেও রসুল নবির ধর্ম কেতাবের গণ্ডি পেরিয়ে কার্যত বাজার ধরতে পারেনি, ফলে এই উৎসবে সামিল হওয়ার বার্তা দিতেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
নিষেধের তালিকা যত দীর্ঘই থাকুক, টিকে থাকতে গেলে যুগের সঙ্গে বিশ্বায়নে সামিল হতে হবে। উৎসবের কারবারিরা সবাই জানে, এই বিশ্ব একটা খোলা বাজার, যেখানে আবেগ থেকে বিশ্বাস সব কিছুই বিক্রির সামগ্রী যদি ঠিকমতো বাজারের ব্যাকরণ জানা থাকে, আর বাজার তাকেই গ্রহণ করে যার মধ্যে সবাইকে নিয়ে চলার ক্ষমতা আছে। সুতরাং ধর্ম যার যার থাকুক না কেন, কিন্তু উৎসবকে ‘সবার’ হয়ে উঠতে গেলে নিষেধ ও বর্জনের বার্তাগুলি ত্যাগ করতে হবে।
*মতামত ব্যক্তিগত