রোচিষ্ণু সান্যাল
দুদিনের একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে গেল বছরের শেষ আর শুরুতে। হিরণ মিত্রর বিশাল লম্বা লম্বা ছবি, মানে ক্যানভাসের রোল কেটে লম্বা লম্বা ফালি করে কাটা প্রায় ১০ ফুট লম্বা কিছু ছবি ঝুলিয়ে দেওয়া হল মধ্য হাওড়া শহরের একটা ঘেটো টাইপ নটোরিয়াস এলাকা কালীবাবুর মইচ্ছের বাজারে
হিরণ মিত্র। শিক্ষিত বাঙালির রোম্যান্টিসিজমের আরেক নাম। হিরণ মিত্র ছবি আঁকে। এদিকে আবার বাঙালি ছবি আঁকাটা খুব একটা বোঝে না। তাই তার পেছনে খরচাও করে না। এই যেমন প্রত্যেক শিক্ষিত বাঙালি ছোটবেলায় অপূর্ব সব আঁকায় সমৃদ্ধ রাশিয়ান ছোটদের বই কিনলেও সেগুলো হারিয়ে ফেলে, এরকম আরও উদাহরণ দেওয়া যায় যে বাঙালি পাকেচক্রে ছবি হাতে পেয়ে গেলেও তা উপভোগ করতে পারে না। এটা একপ্রকার অভিশাপ বলা যায়। তবে বাঙালি নেহাত বইটা পড়তে ভালবাসে, আর সেটার পেছনে, মানে বই কিনে ভালই খরচা করে। এটাকে বরং বঙ্গবাসীর একটা বিলাসিতা বলা যায়। আর গান শুনতেও ভালবাসে বাঙালি, আগে তো রেকর্ড, ক্যাসেট বা সিডি কিনে ভালই খরচা করত, কিন্তু সেই খরচটা আপাতত বেঁচে গেছে। অথবা হয়তো বইয়ের খাতেই ব্যয় হচ্ছে। এদিকে আমরা দেখি ছবিআঁকিয়ে বাঙালি শিল্পীরা হয় প্রবাসী পত্রিকার পাতায় বড়লোকের টেবিলে বা লেডি রাণুর স্নেহের ছায়ায় লালিত হত, যার থেকে সাধারণ মানুষের দূরত্ব ছিল বা আছে প্রায় একটা আকাশগঙ্গা। এখন প্রশ্ন হল তাহলে হিরণ মিত্র তো ছবি আঁকে, সে কি করে শিক্ষিত বাঙালির নয়নের মণি হয়? আর সব ছবিআঁকিয়ে-রা নয় কেন? র্যান্ডমলি দুটো নাম করেই বলি শিল্পী অতীন বসাক বা শিল্পী তাপস কোনার এঁরা বাঙালির রোম্যান্টিসিজম নন কেন? হিরণ মিত্র লোকটায় কি এমন মধু আছে?
এইসব প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজে নেব, তার আগে যে দুদিনের একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে গেল সেটা বলি। হিরণ মিত্রর বিশাল লম্বা লম্বা ছবি, মানে ক্যানভাসের রোল কেটে লম্বা লম্বা ফালি করে কাটা প্রায় ১০ ফুট লম্বা কিছু ছবি ঝুলিয়ে দেওয়া হল মধ্য হাওড়া শহরের একটা ঘেটো টাইপ নটোরিয়াস এলাকা কালীবাবুর মইচ্ছের বাজারে। পাঠকের হয়তো মনে থাকবে অতীতে আমরা দেখেছিলাম এই কালীবাবুর বাজারেই প্রখ্যাত ঘেটো সমাজবিরোধী মাছ-স্বপন খুন হয়েছিলেন। এই মৎস্যের বাজারটি চালায় একটি সিন্ডিকেট। দৈনিক কোটি টাকার লেনদেন হয় এই বাজার থেকে। তো এইখানেই ঝুলিয়ে দেওয়া হল হিরণ মিত্রের লম্বা লম্বা স্ক্রোল ছবি। সেই ছাদ থেকে ছবি ঝুলছে, ছাদ মানে টিনের উঁচু ছাদ, ঘাড় তুলে তুলে ছবি দেখতে হবে। এই ছবি ঝোলানোর আইডিয়া ও সাহস পুরোটাই হাওড়া জোনাকি নাট্যদলের কর্ণধার বিশ্বজিৎবাবুর মস্তিষ্ক ও বুকের পাটা প্রসূত। আর ৮০ বছর বয়সী শিল্পী সেই তালে তাল দিয়ে দুদিন ধরে হাওড়ায় থেকেই গেলেন বিশ্বজিৎবাবুর বাড়িতে আর সারা রাত ধরে আড্ডা মেরে আবার সকাল ৮টায় চলে যাচ্ছেন মাছের বাজারে থিকথিক ভিড় আর রক্তের মধ্যে দিয়ে। রোজ গিয়ে বসছেন, প্রত্যেকের পোর্ট্রেট এঁকে দিচ্ছেন, প্রত্যেকের আবদার মেটাতে ছবি তোলাচ্ছেন, সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। সস্তার বেসনের জিলিপি, দুধ-চা আর ফুলুরি নির্দ্বিধায় খেয়ে চলেছেন। যে দুদিন হিরণদার ছবি ঝোলানো হল সেই দুদিন আবার বছরের প্রথম ও শেষ দিন, এই দুদিনে শিল্পী টলি ক্লাব যেতে পারতেন, লন্ডনে নিজের মেয়ের বাড়িতে কাটাতে পারতেন, নিদেনপক্ষে পরিবারের সঙ্গেই তো কাটানো উচিত ছিল। তা না, মাছের বাজারে ছবি ঝোলানোর আনন্দে সব অগ্রাহ্য করে হাওড়ার মতন একটা ঘেটো শহরে থেকেই গেলেন। বাহা রে বাহা, কী রঙ্গ! আমি, এই যে এটা লিখছি, আমিও রঙ্গপ্রিয় মানুষ। এ তামাশা কে ছাড়ে? হুতোমের পরে তো দীর্ঘদিন বাঙালি এই রংতামাশা ভুলেই গেছে। তাই আমিও দুবেলা হাজিরা দিলাম মাছের বাজারে। ছবিতেই দেখবেন, আপনারা না গিয়েও কেমন রোমাঞ্চিত হবেন। আর যখন ছবিগুলি দেখবেন তখন একটা সাজেশন দিয়ে দিই, দেখবেন ছবিগুলো লাল ধূসর কালো এই তিন রঙে আঁকা। ছবিগুলো তো দেখছেনই, তার সঙ্গে নিজের নিজের পাড়ার মাছের বাজারের লম্বা লম্বা মেঝেগুলোকে ভাববেন, সেই স্যাঁতসেঁতে জোলো, মাছের রক্ত আঁশ নাড়িভুঁড়ি কানকো পটকা, গুটখার প্যাকেট, সিগারেটের টুকরো নিয়ে সেই মেছো রাস্তাটাকে, দেখবেন পুরো মিলে গেছে। মাছবিক্রেতারা তো এই কাণ্ড দেখে অবাক। ওঁরা ছবি বুঝতে পারছেন না, কিন্তু আঁশবটিতে সারা বছর একঘেয়ে মাছকাটার মধ্যে দুদিন যেন কিরকম অন্যরকম কেটে গেল। ওঁরা চাইছেন আবার হোক। যাঁরা মাছ কিনতে আসছেন চোখের সামনে আখাম্বা ছবিগুলো মাথায় ঠেকে যাওয়াতে হাঁ করে ওপর দিকে তাকিয়ে ফেলে ভুলাভালি মাছ কিনে ফেলছেন, এর মধ্যে কোনও হাই সোসাইটির মেয়েকে সিগারেট খেতে দেখে পাকা মাছকাটুনি নিজের আঙুল কেটে ফেলছেন, আচমকা স্বর্গ থেকে একজন সুন্দরী ভদ্রমহিলা এসে হিরণদাকে চুমু খেয়ে গেলেন, মাছের পোঁটা খেয়ে বড় হওয়া কুকুরীরা ছেলেদের জিন্সের প্যান্টের গন্ধ শুঁকছে। সে এক যেন হুতোমি গোল বেঁধেছে হাওড়ার কালীবাবুর মাছের বাজারে। সব মোচ্ছবেরই শেষ হয় আগামী বছর আবার হবে বলে, তাই আজকে পয়লা জানুয়ারি ২০২৪-এ হিরণদার প্রেমিকা পুত্র আর পুত্রবধূ এই তিনজনে এসে হিরণদাকে জোর করে মাছের বাজার থেকে উঠিয়ে নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। শিল্পী হিরণ মিত্রকে ভরসা নেই, আর একদিন এখানে থাকলেই হয়তো আঁকা ছেড়ে ৮০ বছর বয়সে আঁশবটিতে মাছ কুটতেই বসে যেতেন।
এই হল ব্যাপার। আর বই বা গান কেনা বাঙালির কাছে হিরণ মিত্র কেন প্রিয় সেটা আর লিখতে ইচ্ছে করছে না।