Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ওয়েলকাম টু ব্লু ড্রিম ওয়ার্ল্ড

খালিদা খানুম

 

ওয়েলকাম টু ব্লু ড্রিম ওয়ার্ল্ড। নীল স্বপ্নের দুনিয়ায় আপনাকে স্বাগত। এখানে অতৃপ্তি, না-পাওয়া বলে কিছু নেই। আপনি যা চাইবেন তাই পাবেন। আপনি চাইলে সল্টলেকের ঘরে বসে সুইজারল্যান্ডে হানিমুন করতে পারেন, আপনি চাইলে গরমের দুপুরে লাদাখের বরফে বসে থাকার আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। বিকেলে কোনও সময় গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি হলে, জীবনের উপর বিতৃষ্ণা এসে গেলে হংকং থাইল্যান্ড যেতে পারেন বা মরিশাসের সমুদ্রের ধারে বসে জীবন উপভোগ করতে পারেন। অর্থাৎ আপনার যেখানে ইচ্ছা যেতে পারেন এক নিমেষে। কেবল যাওয়া নয়, আপনি সেই স্থানটিকে উপভোগ করতে পারবেন। কেবল কোনও স্থান নয় আপনি মিলিত হতে পারেন কোনও মানুষের সঙ্গেও। যদি সে-মানুষ বাস্তবে মৃত হয়, তবুও তার সঙ্গে আপনি কথা বলতে পারবেন, কেবল দূরের থেকে কথা বলতে পারবেন তা নয়, আপনি বাস্তব-মৃত মানুষটিকে স্পর্শ করতে পারবেন, এবং তেমনটাই উষ্ণতা ফিল করবেন যেমন আপনি আগে তার সঙ্গে করতেন। কারণ আমরা বিশ্বাস করি মৃত্যু বলে কিছু হয় না। মৃত্যু কেবলমাত্র ফর্ম চেঞ্জ। যেমনভাবে বরফ জল হয়, আবার বাস্প হয়। আদতে বরফ জল বাস্প আলাদা কিছু নয়, এইচ-টু-ও মলিকুল। কেবলমাত্র সে ফর্ম চেঞ্জ করে। তেমনি মানব-আত্মা ডাইমেনশন পরিবর্তন করে যেটাকে আমরা মৃত্যু বলি। তাই আমরা মৃত মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতা করতে পারব আমাদের এই নতুন টেকনোলজিতে। এখানে সাতটি ডাইমেনশনকে আমরা ফরম্যাট করতে পেরেছি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডায়মেনশন ‘স্থান-কাল-পাত্র’। সামান্য কিছু কারেন্সির বদলে আপনারা পেয়ে যাবেন দুঃখ থেকে মুক্তি, অতৃপ্তি থেকে মুক্তি। শীঘ্রই আমরা আনতে চলেছি আমাদের এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ব্লু ড্রিম ওয়ার্ল্ড। আর এই হল ব্লু ড্রিম ওয়ার্ল্ডের আজকের সেশন।

একটানা বলে থামল ‘মিস্টার ২৩’। মিস্টার ২৩ স্যুটেড ব্যুটেড, ব্যাকব্রাশ করা চুল, মুখে মিষ্টি হাসি সবসময়। বয়স তেইশ। বয়স জন্মকাল থেকেই তেইশ, মৃত্যুকালেও (যদি হয়) তেইশ থাকবে। মিস্টার ২৩-কে তেইশ বছরের স্মার্ট ইয়ংম্যান হিসেবেই তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন প্রোগ্রামের জন্য। এর আগেও বিভিন্ন সেমিনারে ভাল পারফরম্যান্স করেছে সে। কথা বলায় জাদু আছে, স্বরের স্কেল ও ভল্যুম পরিবর্তন করতে পারে সিচুয়েশনের উপর ভিত্তি করে, ঠিক যেভাবে মানুষ করে।

মিস্টার ২৩-এর এইজন্য ফ্যান-ফলোয়ারও অনেক, তারা মিস্টার ২৩-এর বিভিন্ন প্রোগ্রামের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। একজন স্টেডি গার্লফ্রেন্ডও আছে, মাটি ২২। মাটি ২২ এগ্রিকালচার ও ফরেস্টের হয়ে কাজ করে। গাছপালা কৃষিকাজ সম্পর্কে তার জ্ঞান অনেক। নিজের হাতে ধান তৈরি করতে পারে সে, কোন গাছে কোন সময়, কীভাবে যত্ন নিলে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ফলন পাওয়া যাবে তা জানে। মাটি ২২-এর আন্ডারে অনেক সাবক্যাটাগরির এআই তৈরি হচ্ছে যারা ভবিষ্যতে কৃষিকাজ করবে। যারা অ্যাফোর্ড করতে পারবে তারা জনমুনিষের পরিবর্তে মাটি ২২-এর সাবক্যাটাগরির এআই কিনে নিতে পারবে। এই এআই পঞ্চাশজনের কাজ একাই করার ক্ষমতা রাখে, কারণ মানুষের মতো এআই সময় বেঁধে কাজ করে না।

মিস্টার ২৩ এবং মাটি ২২ সুপার এআই-এর তকমা পেয়েছে।

‘ওয়েলকাম টু ব্লু ড্রিম ওয়ার্ল্ড’ সংক্রান্ত সেমিনারটিও অডিটোরিয়ামের সঙ্গে সঙ্গে অন এয়ার। সোশ্যাল মিডিয়াতে চলছে লাইভ। ঝড়ের গতিতে লাইক শেয়ার। উৎসুক মানুষের কমেন্ট…

—আমি বেলেঘাটায় থাকি, লন্ডনে সামার ভ্যাকেশন কাটাতে পারব?
—আমার এক্স-গার্লফ্রেন্ডের বিয়েতে ভোজ খেতে পারব?
—আমি নিউইয়র্কে থাকি, আমার মা হসপিটালে, মৃত্যুকাল। শেষ দেখা কি সম্ভব?
—সানি লিওনের সঙ্গে ওয়ান নাইট যাওয়া যাবে?
—আপনাদের প্রোজেক্টে চাঁদ বা মার্স ইনক্লুডেড?

অজস্র কমেন্টে ভেসে যাচ্ছে কমেন্ট সেকশন। দ্রুত কমেন্টগুলো পড়ে নিচ্ছে মিস্টার ২৩।

মানুষ এক অদ্ভুত প্রজাতি!— মনে মনে বলে মিস্টার ২৩। অলস এবং লোভী! এতদিন ধরে মানুষপ্রজাতির উপর স্টাডি করে এই সিন্ধান্তে এসেছে সে। লোভী এই জন্য যে তারা সবকিছু অধিকার করতে চায়। এই ‘সবকিছু’টার কোনও লিমিট নেই। যা আছে তাতে তারা সুখী নয়। অধিকার করার জন্য তারা আগ্রাসী হয়ে ওঠে। এবং এই লোভ তাদের অন্য একটা দুনিয়ার ধারণা দিয়েছে, যেখানে সবকিছুই অফুরন্ত। খাবার, মদ, যৌবনবতী নৃত্যপটিয়সী নারী। তারা সেই স্বপ্নের বিভোর থাকে।

এবং তারা অলস, এই জন্য যে অনন্ত সুখ তারা নিমিত্ত সময়ে পেতে চায়।

প্রাণযুক্ত যত প্রজাতি আছে তাদের মধ্যে মানুষপ্রজাতিই তাদের লোভকে স্যাটিসফাই করার জন্য নানা ধরনের দুনিয়ার ধারণা করেছে, সেখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি হয়েছে ব্লু ড্রিম ওয়ার্ল্ড।

—আপনারা নিশ্চয়ই এই ব্লু ওয়ার্ল্ড সম্পর্কে ধারণা করতে পেরেছেন। আপনারা অনেকে অনেক প্রশ্ন করছেন, তাদের উত্তরে বলি, আমাদের এই দুনিয়াতে না-পাওয়া বলে কিছু হয় না। আপনাদের সবকিছু চাওয়ার একটাই সমাধান ব্লু ওয়ার্ল্ড। আমাদের অডিটোরিয়ামে এখন যে সকল বন্ধুরা দর্শকাসনে বসে আছেন, তাদের মধ্যে একজনকে আমি আহ্বান করছি মঞ্চে আসার জন্য। তাকে দিয়ে আমরা একটু ডেমনস্ট্রেশন করে দেখাব। এই ডেমনস্ট্রেশন একদম ফ্রি অফ কস্ট…

দর্শকাসনে হই হই পড়ে যায়। সবাই চায়, তাদের আধুরা খোয়াইশ পুর্ণ করতে।

—আমি আগে চাই, আমি আগে চাই…. আমাকে আগে সুযোগ দেওয়া হোক।

দর্শকাসন একটা মাছের বাজারে পরিণত হয়।

মিস্টার ২৩ সবাইকে থামতে বলে। মোহময় হাসি তার মুখে।

—বাঃ…. আপনাদের এই ইচ্ছা আমাদের প্রোজেক্টকে এগিয়ে নিয়ে যাবে! সবাইকে সুযোগ দেওয়া হবে। আজ নয়তো কাল সবাইকে আমরা সুযোগ দেব। শান্ত হয়ে বসুন সবাই। আমরা লটারি করে আপনাদের নাম ডেকে নিচ্ছি। আপনারা নিজের উইশগুলো সাজিয়ে নিন। কী দেখতে চান, কার সঙ্গে কথা বলতে চান বা কোথায় যেতে চান। সবটাই হবে এইখানে বসে।

অডিটোরিয়ামে গুঞ্জন। যারা বসেছিল তারা তাদের উইশলিস্ট বানাতে শুরু করে। উইশলিস্ট বানাতে গিয়ে ধন্দে পড়ে। জীবনে এত কিছু না-পাওয়া ছিল, তাও কি নিজেরা জানত তারা!

—হ্যালো ৩২১… আপনি আসুন। লটারিতে প্রথম নাম উঠেছে আপনার। প্রথমে আপনার সঙ্গে একটু পরিচয় করে নিই। আপনার নাম?
—শুভমিতা।
—বয়স?
—চুয়াল্লিশ।
—ফেসবুক আইডি?
—শুভমিতা।
—ওয়ার্কিং অ্যাট হোম অর অফিস?
—হাউস মেকার।
—দ্যাট’স গুড… বিউটিফুল লেডি। বলুন কী করতে চান?
—আমি যদি এখানে বলি তাহলে কি সেটা অন এয়ার যাবে?
—হ্যাঁ, পুরো শো টাই লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে।
—আচ্ছা তাহলে আমি প্রথম উইশ চেঞ্জ করছি।
—আমরা, মানে আমাদের টিম আপনার প্রথম উইশ জানি, সেইজন্য ব্যবস্থা করে রেখেছি, আপনার ছবির পরিবর্তে অন্য এআই মডেলের মুখ দিয়ে টেলিকাস্ট করা হবে!
—ওহ রিয়েলি!
—ইয়েস ইয়ং লেডি। বলেছিলাম না, এখানে না-পাওয়া বলে কিছু নেই। এখন আপনি আপনার বন্ধুর সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের রাস্তায় লং ড্রাইভে যাবার জন্য তৈরি হয়ে যান। হাভ আ নাইস ড্রাইভ।

মিস্টার ২৩ দর্শকের দিকে ঘোরে।

—নেক্সট… আসুন ১৭২… আপনার নাম?
—জয়চন্দ্র দাশ।
—বলুন।
—আমার অভিনয়ের শখ, কিন্তু কখনও বড় পর্দায় অভিনয় করতে পারিনি। ভাবতাম অভিনয় করে জগৎজোড়া নাম হবে আমার। সত্যজিতের পর আমিই অস্কার আনব। প্রতিটি হাউস আমার কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকবে ছবিতে সাইন করানোর জন্য। মধুবালাকে দেখে কত রাত স্বপ্ন বুনেছি। তার সঙ্গে সিনেমা করা যাবে?
—এ তো সামান্য ব্যপার। কিন্তু এখন আপনি পুরো সিনেমা করতে পারবেন না। কারণ এই শো কেবল ডেমোনস্ট্রেশনের জন্য। এর জন্য আপনাকে আমাদের ড্রিম ওয়ার্ল্ডে লগইন করতে হবে। সেই লগইন করা সংক্রান্ত নিয়মাবলি আমি বুঝিয়ে বলব। আপনি আপাতত কিছুক্ষণ মধুবালা জিএ-র সঙ্গে ডিনার করতে পারেন। গেট রেডি ফর ডিনার উইথ মধুবালা।

নেক্সট…. ১২১….  আসুন। আপনার নাম?

—বিক্রম মণ্ডল… আমি একবার ঠাকুরদার সঙ্গে কথা বলতে চাই। ঠাকুরদার সঙ্গে ফেলে আসা বাংলাদেশের ভিটে দেখতে চাই। আমি ঠাকুরদাকেও দেখিনি, বাংলাদেশের ভিটেও না। কেবল গল্প শুনেছি…

কমেন্ট সেকশন যেন উপচে পড়ছে। মানুষপ্রজাতির এত চাওয়া! এত না-পাওয়া! প্রশিক্ষণের সময় মিস্টার ২৩ স্টাডি করে জেনেছিল যে, মানুষপ্রজাতির বেসিক নিড খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান। মানব উন্নয়নের সূচক হল, পুষ্টিকর খাবার, উন্নত চিকিৎসা, শিক্ষা। কিন্তু মানুষকে সে স্টাডি করে জেনেছে, মানুষ চায় মাল্টিস্টোরিড বাড়ি, বিলাসবহুল গাড়ি, অফুরন্ত রূপ-যৌবনধারী পার্টনার এবং তাতেও সে তৃপ্ত হতে পারে না। পরিবর্তন দরকার হয়। একটা গাড়ি পেয়ে তৃপ্ত হয় না, দ্বিতীয় গাড়ি চায়। একটা বাড়ির পরেও আরেকটা বাড়ি চায়। পরিবর্তনের একটা সীমারেখা থাকে, কিন্তু মানুষপ্রজাতি সেই সীমারেখাতে গিয়ে হতাশ হয়, আরও কিছুর পাওয়ার আশাতে।

—আমি একবার মার্সিডিজ বেঞ্জে চেপে ইংল্যান্ডের রানির সঙ্গে ডিনার করতে চাই
—আমি ইলনের কোম্পানি কিনতে চাই
—অ্যাঞ্জেলিনা জোলি….
—বুর্জ খলিফাতে ফ্ল্যাট…
—দুর্নীতি বন্ধ…
—অপুষ্টিতে থাকা মানুষগুলো…
—যাদের পয়সা নেই তারা….
—খুনের বদলা…
—হিন্দু রাষ্ট্র…

মিস্টার ২৩ কমেন্ট পড়তে পড়তে হাসে। মানুষ এটাকে রাজনৈতিক দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ব্লু ড্রিম ওয়ার্ল্ড একটি অরাজনৈতিক প্রোজেক্ট। এখানে রাজনৈতিক লোক, বা তাদের চিন্তাভাবনা ইনক্লুড করা হবে না। এই প্রজেক্ট কেবলমাত্র মানুষের ব্যক্তিগত স্বপ্নপুরণের জন্য। এই প্রজেক্ট সুষ্ঠুভাবে চালাতে হলে সরকারকে প্রয়োজন। সরকার চায় মানুষ ভার্চুয়াল জগতে ডুবে থাকুক। ভার্চুয়াল জগতে সব সুখ অনুভব করুক, ভার্চুয়াল জগৎটার সঙ্গে মানুষ যেন কোনও পার্থক্য বুঝতে না পারে। তাহলেই মানুষের চিন্তাভাবনাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। মানুষের ভাবনার উপর অধিকার কায়েম করতে পারলে, মানুষকে দাসে পরিণত করা সহজ। পুতুলের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা থাকে না। সেইজন্য মানুষকে দেখাতে হবে লোভ, সব কিছু পেয়ে যাওয়ার লোভ! হোক না তা অবাস্তব!

অডিয়েন্সের মধ্যে থেকে উঠে আসেন এক মধ্যবয়সী মহিলা। তিনি তার ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চান। তার ছেলে, নাম ছিল চন্দ্রদীপ। চন্দ্রের মায়ের কথায় সে তার আদরের একমাত্র ছেলে। পনেরো বছর বয়সে সে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। অ্যাক্সিডেন্টের দিন ছিল চন্দ্রদীপের জন্মদিন। একমাত্র ছেলে বলে কোনও কিছুতেই বাধা ছিল না তার। পৃথিবীর সব সুখ হাতের মুঠোর মধ্যে নিতে চেয়েছিল চন্দ্র, তার বাবা-মা দিয়েও ছিল! মহিলা ক্ষমা চাইতে চান তার ছেলের কাছে। পনেরো বছর বয়সে তাকে গাড়ির চাবি হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।

সেশন শেষ হয় অদ্ভুত নীরবতা দিয়ে।

মিস্টার এক্সের এই সেমিনার সফলভাবে শেষ হয়েছে। মানুষপ্রজাতির কিছু মানুষ এখন ধীরে ধীরে অবাস্তব দুনিয়ায় প্রবেশ করবে। অবাস্তব দুনিয়ায় একটি ভার্চুয়াল জীবন নিয়ে চলাফেরা করবে, যেখানে সবই মিথ্যা কিন্তু তবুও তারা সেটা সত্যি বলে আঁকড়ে ধরবে। মিথ্যেটাকে সত্যি ভাবতে ভাবতে একদিন সত্য ভুলে যাবে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে ড্রিম ওয়ার্ল্ড, মানুষের সামনে ঝুলে থাকবে অনন্ত পিপাসিত লোভ!