Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ছায়াপাখি, এক আকাশের নিচে — পর্ব ৫ (প্রথমাংশ)

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

পরিযায়ী পাখি

এক.

রেখা আয়নার সামনে শাড়ি নিয়ে ওলটপালট খাচ্ছিল। সব সময়ে স্কার্ট কিংবা সালোয়ারে থাকে, শাড়ি শুধু বিশেষ দিনের। পরার কায়দাটা এখনও ভালভাবে রপ্ত হয়নি। মার মতো কিছুতেই হয় না। কোমরের কাছটা ঢিবির মতো হয়ে থাকে। এত সুন্দর শাড়িটা— সবুজ জমির উপর জড়ির ফুল, সঙ্গে লাল ব্লাউজ। ভালভাবে না পরতে পারলে সবটাই মাটি। ব্লাউজের ডিজাইনটা নতুন, মা করিয়ে দিয়েছে। কীভাবে শাড়ির আঁচলটা নিলে ডিজাইনটা দেখানো যাবে বুঝতেই পারছে না। কিন্তু দেখানো যে দরকার সে-ব্যাপারে নিশ্চিত। পারছে কই! অন্য সব ব্লাউজের পিছনে ফিতে থাকে, এইটাতে সামনে। কাটটা এত সুন্দর! কিন্তু জড়ির ফিতেটা টানটান করে বাঁধলে বুকে চেপে বসছে, আবার আলগা করে রাখলে দেখা যাচ্ছে বুকের নরম। বাসনাদি বলছিল সবাইকে এটা মানায় না, কিন্তু তোমার বুকের গড়নটা এত সুন্দর!

সেটা রেখা জানে। শুধু ছেলেদের চোখে নয়, মেয়েদেরও। কেন পিসিরা কী করেছিল! কটাইদার বিয়েতে ওরা সবাই খড়দায়, রেখার তখন সবে সতেরো। মেজপিসি শাড়ি পরিয়ে দেবে। পিসি বলেছিল সায়া ব্লাউজ পরে আমায় ডাকবি। সবে সায়াটা পরে ব্রাটা লাগানোর চেষ্টা করছে, পিসি ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকে এল। সঙ্গে আবার ছোটপিসি। ওরে মেয়ে, কাজের বাড়িতে এত দেরি করলে হয়? বলতে বলতেই মেজপিসির কথা থমকে গেল। ও মা, কী সুন্দর রে তোর বুকের ছাঁদটা, দেখি দেখি। সতেরো বছরের রেখা লজ্জায় মরোমরো। পিসিদের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। বুকের সামনে থেকে না-লাগানো ব্রা এক ঝটকায় সরিয়ে মেজপিসি বলে উঠল, দ্যাখ দ্যাখ মাধু ঠিক বলেছিল, একদম শঙ্খের গড়ন পেয়েছে। ভাগ্যমন্তী মেয়ে আমাদের রেখা, প্রতিমার মতো নিখুঁত বুকের ছাঁচ। তার বুকের গড়ন নিয়ে মা-পিসিদের মধ্যে আলোচনা হয়? রেখার ভীষন রাগ হচ্ছিল। এদিকে ছোটপিসি আর এককাঠি ওপরে। বলে উঠল, যার হাতে পড়বে দিদি, সেও বড় ভাগ্যমন্ত! মেজপিসি অর্থপূর্ণ ভঙ্গিতে ভুরু তুলে বলল, হাতে? দিদা হলে বলত জামাইয়ের লগে ঠিকই হইব, টিইপ্যা টুইপ্যা আরাম হইব। বলতে বলতেই চল্লিশোর্ধ দুই বোনে হেসে উঠল আর কান লাল করে রেখা চেঁচিয়ে উঠেছিল— পিসি তোমরা থামবে?

কিন্তু পিসিদের এই মেয়েলি ফাজলামি তার ভালও লেগেছিল। বড্ড বাধোবাধো ছিল মনে। আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখতে ভালবাসে ছোটবেলা থেকে। সে যে খুব সুন্দর দেখতে সেটা আয়নাও বলে। সামনে থেকে, সাইড ফেসে, ঘাড় ঘুরিয়ে কতরকমভাবে দেখে নিজেকে। আর উদ্ভাসিত হয়। কিন্তু মনে হত তার বুক যেন প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ভারি। ছেলেদের চোখ কি আগে ওদিকেই পড়ে? স্কুলে থাকতে কী লজ্জা পেত এই নিয়ে। তখন মাসির বাড়িতে কলকাতায়। ওখানে মেয়েদের সাজগোজ সবই তার দুর্গাপুরের বন্ধুদের থেকে আলাদা। স্কুলের সাদা ইউনিফর্ম তো কি। সবার কোমরে বেল্টের নিচে একধাপ গুটিয়ে স্কার্ট হাঁটুর দু-ইঞ্চি উপরে। তেমনি কথার ধরন। ছেলেদের নিয়ে যেমন চর্চা, তেমনি এর-ওর বাড়ন্ত শরীর নিয়ে। রেখাকে বন্ধুরা বলত ও নাকি নীতু সিং-এর মতো দেখতে, আর ওমনি নাকি তার বুকের ভার। খুব লজ্জা করত, কিন্তু কারও কোনও রাখঢাক ছিল না কথায়। কমলিকা বলে এক বন্ধু ছিল। এত অসভ্য, রেখার জামার উপর দিয়ে হাত বুলিয়ে বলবে একটু টিপস দাও গুরু, কী এক্সারসাইজ করছ। ছন্দা মেয়েটা আরও ফাজিল! বলে উঠত, ওসব কিছু নয় রে, এক্সপার্ট হাতের কাজ। শুধু সেই শিল্পীর খোঁজটা আমাদের দিয়ে দে রেখা। মেয়েগুলো এত ঠোঁটকাটা, এসব বলে খিলখিল করে হাসত। আর এক বন্ধু তিন্নি, ভাল নাম সুতনুকা। ও বেচারা এইসব আলোচনায় খুব মুখ শুকনো করে রাখত কারণ ওর বুকে কোনও ঢেউ খেলেনি তখনও। কমলিকা এত মুখফোঁড়! বলেই দিত, তুই কিছু কর তিন্নি। না হলে ম্যানচেস্টার হয়েই রয়ে যাবি। সবারই নিজেদের বুকের বেড়ে ওঠার রকমফের নিয়ে চিন্তা থাকত। তিন্নি যদি এক মেরুতে হয় তো, রেখা অন্য। রেখার খুব চিন্তা হত, তার কি সত্যিই একটু বেশি বড়? স্নান করে আয়নার সামনে নিজেকে বারবার দেখত। পিসিদের কথা শুনে বুঝেছিল বন্ধুদের ঈর্ষার যথেষ্ট কারণ আছে। মেজপিসি বলেছিল দ্যাখ, ভগবানের দেওয়া জিনিস। কিন্তু সামলে রাখতে হয়। নয়তো দেখছিস, আমার মতো ঝুলে লাউ। পিসিদের মুখের কোনওদিন রাখঢাক নেই, কী করে যে বলে এমন!

কিন্তু ভগবানের দেওয়া এই জিনিস দেখাবে না ঢাকবে এটাও একটা সমস্যা। শাড়ির আঁচল এখনও মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই ভ্রূভঙ্গি করল রেখা। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছিস কেন, আমার লজ্জা লাগে না বুঝি? আয়নার থেকে কোনও উত্তর আশা করেনি, তার জোগান নিজেই দেয় রেখা। এটা ওর নিত্যদিনের খেলা।

এখনও চলত আরও খানিক যদি না লেখা ঘরে মুখ বাড়াত। দিদি, মা বলছিল আর কখন বেরোবি? বলতে বলতেই থেমে গেল। ওমা, তোকে আজ কী দারুণ লাগছে দিদি!

—তাই? সলজ্জ হাসি ছড়াল রেখার মুখে। এখনও তো শাড়িটাই পরতে পারলাম না। মাকে ডাকতে হবে।
—শাড়িটা ছাড়াই তো বেশি ভাল লাগছে দিদি, মনে কর যেন ঘাঘরাচোলি যেমন হিন্দি সিনেমায় পরে।
—তুই বুঝি খুব হিন্দি সিনেমা দেখছিস? জানিস তোর বয়েসে আমাদের হিন্দি সিনেমা দেখতেই দিত না।

লেখা এই কথাটা যেন কানেই তুলল না। ভাব আজ হীরুদাটা থাকলে কেমন লাট্টু হয়ে যেত। দিদি, তোকে না সবুজ রংটা খুব মানায়। তোর বিয়ের বেনারসিটা সবুজ কিনিস।

—ধুর বোকা। বিয়ের বেনারসি সবসময় লাল হয়, অন্য রঙের পরে না কেউ। না হলে আমি পরতাম সাদা, যেমন বিদেশে বিয়েতে গাউন পরে।
—যাবি তো হীরুদার সঙ্গে বাইরেই, ওখানে গিয়ে আবার গাউন পরে বিয়ে করে নিস দিদি।
—বলিস এসব তোর হীরুদাকে। এমন কিপটে রোজ রোজ একটা চিঠি দেব বলেছিল সেটাও দেয় না।

রেখা বোনকে সবকিছু বলে। হোক না আট বছরের ছোট! লেখা গম্ভীরমুখে নিজের মতামত দিতে ছাড়ে না। মাধুরী কথায় কথায় বলে, বড্ড পাকা হয়ে যাচ্ছিস লেখি। যে বয়সের যা, সব কথায় তোর অত টরটর করার কী আছে রে?

লেখাকে দমানো যায় না। এখনো সোফায় পা গুটিয়ে কোলে কুশন টেনে বসেছে দিদিঠাকরুনের ভঙ্গিতে। দিদি, অনেক ছেলেই নিশ্চয় তোর প্রেমে হাবুডুবু খায়। কীভাবে সামলাস বল না।

রেখা চোখে কাজল টানছিল। লেখার কথায় অবাক হয়ে বড় বড় চোখ করে তাকায়। কেন রে, এখন কি তোর পিছনে ছেলেদের লাইন লাগতে শুরু করেছে? ভাল করে তাকায় বোনের দিকে। সত্যিই বড় হয়ে গেল মেয়েটা। যেহেতু ওদের বয়সের পার্থক্য এত বেশি, ওকে সব সময়ে ছোট ভেবেই দেখেছে। এখন ভাবল হবেই না বা কেন! ক্লাস নাইনে উঠেছে, এই তো বয়স ছেলেমেয়েদের আলুকসালুক তাকানোর।

—তাকালেই পাত্তা দিচ্ছে কে দিদি। বাচ্চা ছেলেগুলো এত বোকা বোকা কথা বলে আর গরুর মতো চেয়ে থাকে আমার বিরক্ত লাগে খুব।

দ্রুত হাতে প্রসাধন সারছিল রেখা। লেখার সঙ্গে একবার কথা বলতে শুরু করলে থামবে না, ও যা বকবক করে। এখন শাড়িটাকে কবজা করতে হবে। শেষ অবধি শাড়ি পরাতে মাধুরীকেই ডাকতে হল।

ঢুকেই মাধুরীর মাথায় হাত। একি রে, এই ব্লাউজটা পরলি কেন?

—কেন, তুমিই তো করিয়ে দিয়েছ মা। এত সুন্দর দেখতে।
—তাই বলে এটা কি দুর্গাপুরে পরার? ছোট জায়গা, লোকে ছি ছি করবে রেখা। আমি এসব করাচ্ছি তোর বিয়ের কথা ভেবে। হীরকের সঙ্গে বিদেশে থাকবি, কখনও তো শাড়ি পরবি। ওখানে এসব মানায়। এখানে এরকম কিছু পড়লে লোকে হাঁ করে তাকাবে, চাই কি দুটো কটু কথাও শুনিয়ে দিতে পারে।
—আচ্ছা মা, তুমি যেন ধরেই বসে আছ হীরক আমাকে বিয়ে করবে। ও বলেছে তোমায়? ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে রেখা। নাকি ওর বাবা মা এসে তোমাকে বলে গেছে?
—না ওর বাবা মা বলেনি কিছু। ওরা এখনও বোধহয় জানে না। কিন্তু তুই তো বলেছিস। আর শোন মায়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। ও যাওয়ার আগে যখন আমাদের বাড়িতে এল, আমি তখনই বুঝেছি। তুই শুধু শুধু বেচারাকে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে ফেরত পাঠালি। নেহাত নীলিমা আমাদের ডাকল বলে দেখা হল আবার।

ব্যস্ত হাতে শাড়ি পড়াতে থাকে মাধুরী। বেশি রাত করে ফেরার দরকার নেই, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসো। আর দ্যাখ আমি আঁচল দিয়ে বুকটা ঢেকে দিলাম, সরে না যেন একদম। এখানে তোমার ব্লাঊজের ডিজাইন দেখিয়ে কাজ নেই, বিদেশে গিয়ে দেখিও। শাড়ি পরিয়ে রেখার থুতনি ধরে মুখটা তুলে ধরে মাধুরী। এমন সুন্দর মেয়েকে বউ করে নিয়ে যেতে কে না চাইবে। আমি গিয়ে নীলিমার সঙ্গে কালই কথা বলবো। হীরুটা এমন লাজুক, নিজের মা বাবাকে বলতেই বছর কাবার করে দেবে।

আজকাল ঘনঘন বন্ধুদের বিয়ে হচ্ছে। গত কয়েক মাসে এই নিয়ে তৃতীয় বন্ধুর বিয়ে। সবার বিয়ে হচ্ছে দুর্গাপুরের বাইরে। দূরে দূরে। অনুরাধা বিয়ে করে চলে যাবে ব্যাঙ্গালোর। ফেব্রুয়ারিতে কাজলের বিয়ে হল। ও এখন বম্বে। সুপ্রিয়া তো বিয়ে করেই চলে গেছে লন্ডন। সবাই ছোটবেলার স্কুলের বন্ধু। অনুরাধা আর সুপ্রিয়া কলকাতাতেও একসঙ্গে কলেজে ছিল। এমনি রেখাও একদিন চলে যাবে বিয়ে করে। বন্ধুদের কাউকে কিচ্ছু বলেনি। তবে কথা হয় এমনিভাবে সবার ছড়িয়ে যাওয়া নিয়ে। ছোটবেলার কত স্মৃতি। এখন বিয়ের বাসরে সবাই মিলে হইচই করছে, এরপর কে জানে কার সঙ্গে আবার কোথায় কবে দেখা হবে। এইসব বিয়ের দিনগুলোতে ওরা তাই চুটিয়ে মজা করে নেয়। গলা জড়াজড়ি করে হাসে, কাঁদে। চোখ ছলছলটা বাড়ি ফেরার সময়ে, বাদবাকি সময়ে শুধুই হিহিহাহা। বিয়েবাড়ি অন্য কারণেও বরাবর ভাল লাগে রেখার। সাজগোজ, জাঁকজমক। এইসব খুব পছন্দ ওর। জীবনটা যেন একটা উৎসব হয়ে ওঠে। ভেসে যেতে ইচ্ছে করে সেই আনন্দে। ভেসেও গেছিল, যদি না আচমকা বীরুদার সঙ্গে মোলাকাত হত।

বীরুদা তার জীবনে এক শনি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভেবেছিল নিজেই সামলাতে পারবে, এখন মনে হচ্ছে মাকে জানানো দরকার। বীরুদার তাকে ভাল লাগে, লাগতেই পারে। এরকম আরও অনেকের লাগে। স্কুলে, কলেজে কত ছেলের কাছ থেকে চিরকুট পেয়েছে রেখা। বেশ কয়েকবার তারা সামনাসামনি এসেও নিজেদের মনের কথা বলেছে। রেখা তাতে রাগ করে না। ছেলেদের তাকে দেখে ভাল লাগবে, লাগেই। এতে সে অভ্যস্ত। এদের দুয়েকজনের সঙ্গে আইসক্রিম ফুচকাও খেয়েছে কোনওসময়, সিনেমা দেখেছে একসঙ্গে। বন্ধু বলে। কিন্তু যখন ভালবাসার কথা উঠেছে, সন্তর্পণে না করে দিয়েছে রেখা। ভালভাবেই। বুঝিয়ে। কেউ একবারে বুঝেছে, কারও বেশি সময় লেগেছে। কেউ দুঃখ পেয়ে একদম সরে গেছে, কেউ মেনে নিয়ে বন্ধুর তালিকায় রয়ে গেছে। কিন্তু বীরুদার কথা আলাদা।

বীরুদা কোনওদিন তার বন্ধু ছিল না। পাড়ার দাদা হিসেবে চেনা। ছোটবেলায় অনেক কিছু একসঙ্গে করেছে, যেমন পাড়ার অন্য ছেলেমেয়ের সঙ্গেও। বীরুদার যে তাকে ভাল লাগে সেটা কি সে বোঝেনি? নিশ্চয় বুঝেছে, কিন্তু পাত্তা দেয়নি। ভাল লাগত না ওকে। অপছন্দ করত ওর দাদাগিরি। কারণে অকারণে কাছাকাছি আসার ফিকির খুঁজেছে। অন্য কোনও ছেলে রেখার সঙ্গে দুটো কথা বললে দাবড়ে দিয়েছে। রেখার সামনে হলে ও বলতে ছাড়েনি। তোমার কী হয়েছে বীরুদা? ওর সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে, আমার ভাল না লাগলে আমি বলব সেটা। তোমাকে কে গায়ে পড়ে গার্জিয়ানগিরি করতে বলেছে।

এমনভাবে আর কেউ কথা বললে বীরুদা তাকে দু ঘা না দিয়ে থামত না। কিন্তু রেখার সঙ্গে ওর সেই জারিজুরি চলে না। সেটা শুধু মেয়ে বলে না। রেখা সেটা জানত, কিন্তু সরাসরি এসে কিছু না বললে কী বলতে পারত রেখা? এমন কি বলা যায় আমি যেখানে যেখানে যাব, সেখানে যেন তোমাকে একদম না দেখি। কারণ মুখে বীরুদা সাদাসাপটা কক্ষনও কিছু বলেনি। অন্তত কয়েকমাস আগে অবধি। আজকাল বীরুদা যুবনেতা। খুব পাখা গজিয়েছে। রেখা কী করে, কোথায় যায় সব কিছুর খবর করে। একগাদা চ্যালাচামুন্ডা আছে, যারা বোধহয় ওকে এইসব খবর দেয়। রাগে গা রি রি করে রেখার। মাস তিনেক আগে একদিন বীরুদা ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, স্কুল থেকে বেরিয়ে শ্যামল ছেলেটার সঙ্গে কোথায় যাচ্ছিলি সেদিন?

রেখা এত অবাক হয়েছিল। আমি আর শ্যামল এক স্কুলে পড়াই, আমার কলিগ। আমি ওর সঙ্গে কোথায় যাব সেটা জেনে তোমার কাজ কি বীরুদা।

—আমাদের সব খোঁজ রাখতে হয়রে রেখা। সবার সেফটি নিয়ে ভাবতে হয়। কিন্তু তোর কথা আলাদা।
—মানে? কীসব বলছ? আমি আলাদাই বা কেন?

বীরুদা থমকে দাঁড়াল। কিছু কিছু লোক থাকে যারা সব কিছু আমার মনে করে চাইতে পারে, চায়ও। পাবেই ধরে নিয়ে সেই চাওয়ায় অহমিকা আর জেদ থাকে। ভালবাসা চাওয়ার মধ্যে যে নরম কমনীয়তা আছে সেটা বীরুদার কাছে রেখা আশা করেনি। কিন্তু এমন জমি জবরদখলের ভঙ্গিও অপ্রীতিকর। মাতব্বরের ভঙ্গিতে বীরুদা যা বলেছিল তার মোদ্দা কথা হচ্ছে ছোটবেলা থেকে আমি তোকে ভালবাসি রেখা। কত মেয়ে আসে যায়, কারও দিকে আমি চেয়েও দেখিনি। কারণ তুই আমার। তোর কাছেও আর কোনও ছেলেকে আমি আসতে দেব না।

ভাবটা যেন এই প্রস্তাবে রেখার ধন্য হওয়া উচিত, প্রত্যাখানের তো প্রশ্নই ওঠে না।

রেখা অনেক ছেলের প্রেমপ্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। তাই আর একজনের ভালবাসার আখ্যানে অত কিছু ঘাবড়ায়নি। শুধু বলার ভঙ্গিতে গা রি রি করে উঠেছিল। সেই রাগ গলায় রেখেই বীরুদাকে স্পষ্ট বলেছে, তুমি কাকে ভালবাসো না বাসো, আমার কিছু যায় আসে না। তোমাকে আমার ভাল লাগে না, কোনওদিন লাগেনি। আজকাল আরও বেশি বিরক্তিকর হয়ে যাচ্ছ। প্লিজ, আমার ব্যাপারে আর নাক গলিও না।

এই বলে সেদিন উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে রওয়ানা দিয়েছিল। বীরুদা একটা লাল হিরো হন্ডায় বসেছিল। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করেনি, বুগবুগ আওয়াজ করে যাচ্ছিল বরাবর। রেখা কয়েক পা এগিয়ে যেতেই ক্লাচ ছেড়ে বাইক নিয়ে পাশাপাশি চলে এল।

রেগে দাঁড়িয়ে গেছিল রেখা। এটা কী হচ্ছে বীরুদা? আমি কি লোক ডাকব?

—কাকে ডাকবি, ডাক না। সব আমাদেরই লোক। সেসব ছাড় রেখা। তুই আমার থেকে ছোট, কী কথায় কী বলে দিস আমি কিছু মনে করিনি। আর বললাম যে তোকে আমি ভালবাসি, তোকে আমি কিছু করব না। কিন্তু অন্য কোনও ছেলের সঙ্গে ইয়ারদোস্তি দেখলে আমি তার ছালচামড়া তুলে নেব।
—তুমি কি রাজনীতি করো না গুন্ডাগিরি? আমাকে ধমকি দিচ্ছ?
—ধমকি নারে পাগল মেয়ে, তোকে বুঝিয়ে বলছি।

ওর এমন অন্তরঙ্গতা দেখানোর চেষ্টা রেখার একদম ভাল লাগল না। আমার সঙ্গে আর কথা বোলো না বীরুদা। আমার তোমাকে কোনওদিন পছন্দ ছিল না। এখন তোমার কথাবার্তা শুনে বিতৃষ্ণা লাগছে। বলে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে গেছিল রেখা। বাইক ছিল। ইচ্ছা করলেই তাড়া করতে পারত বীরুদা। আরও হেনস্থা করতে পারত। কিন্তু করেনি কেন কে জানে। পরে এটা ভেবে অবাক হয়েছে। রেখা শ্যামলকে সাবধান করে দিয়েছিল। চায়নি ও বেচারা মাঝখানে পরে মারধোর খেয়ে যায়।

সেসব কিছু হয়নি। রেখার মনে হয়েছিল এসব বীরুদার ফাঁকা আওয়াজ। বেশি পাত্তা দিয়ে লাভ নেই। তাছাড়া রাজনীতি করছে, হট করে কিছু করে নিজের নাম খারাপ করবে না। করেওনি। কাউন্সিলারের পদে দাঁড়িয়েছিল। ভোট চাইতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। রেখাকে দেখে বলল, তোকে আর কী বলব। তোর সব ভোট তো আমার জন্যেই। তুই আমার হয়ে একটু ক্যানভাসিং কর না রেখা।

কীরকম নির্লজ্জ আর বেহায়া হলে এমনভাবে কথা বলা যায়! গরম তেলে শুকনো লঙ্কা ভাজার ঝাঁঝ নিয়ে উত্তর দিয়েছিল রেখা। আমি, আমি কেন করব? তোমার পার্টির ছেলেমেয়েরা আছে। তাদের বলো।

—আমাদের রাজনীতির বাড়ি। বিয়ের পরে তোকেও আমার সঙ্গে কাজ করতে হবে, তাই না? এখন থেকেই শুরু কর সেটা।

রাগে চোখমুখ লাল হয়ে গেছিল রেখার। তুমি কী পেয়েছ বলো তো? আমি কী বলেছি যার থেকে তোমার মনে এরকম ধারণা জন্মেছে? যদি ভুল ধারণা জেগেও থাকে এই দ্যাখো সরাসরি না করে দিলাম। ব্যস। এই নিয়ে আর কোনওদিন জ্বালিও না।

কিন্তু ছাড়ল কই? যতটা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। হীরুর বাড়ির পার্টিতে ওকে আসতে দেখেই তাড়াতাড়ি ওই বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। এত তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে চাইছে শুনে মাও অবাক হয়েছিল। কিন্তু রেখা খুলে বলতে পারেনি। মা যদি এসব শুনে তার বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দেয় একদম, সে আরও দুর্বিষহ জীবন হবে। মা সেটা পারে। যেমন শানুর সঙ্গে দুটো কথা উঠতেই তাকে কলকাতায় মাসির বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। মার কথা, মেয়েদের চরিত্রহানি খুব সহজে হয়, সেটা নিয়ে কোন্দল করলে কাদা আরও বেশি গায়ে লাগে। বুদ্ধি করে এড়িয়ে যেতে পারাটাই আসল।

এই জন্যে মাকে কিছু জানায়নি এতদিন। কিন্তু আজ বীরুদার যা হাবভাব দেখল, এবার জানাতেই হবে। বীরুদা তার সঙ্গে হীরকের ব্যাপার জানতে পেরেছে। কী করে জানল সেটাই আশ্চর্য। কুকুরের মতো গন্ধ পায় নাকি? কিন্তু পেয়ে অবধি বোধহয় ওর মাথা গরম। হীরক ওর ধরাছোঁয়ার বাইরে। এখানে থাকলে ওর লাশ ফেলে দিতাম, কাউকে রেয়াত করি না আমি। কঠিন চোখে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল বীরুদা।

—কী যা তা বলছ বীরুদা? একসঙ্গে খেলাধূলা করতে করতে বড় হয়েছ তোমরা, কথা নেই বার্তা নেই তুমি তার লাশ ফেলার কথা বলছ। ভয় লজ্জা বিসর্জন দিয়েছ নাকি?
—বীরু যা চায় তা চায়। আর কেউ মাঝখানে এলে আমি তাকে সাবাড় করে দেব।

রেখা বুঝতে পারল বীরুদা নেতা কম, গুন্ডা বেশি। আসলে দিনদিন এই বিভেদটা যেন ঘুচে যাচ্ছে। আজকাল পার্টির নামে ভয় দেখিয়ে তোলাবাজি করা, জমির দালালি করা আর সবাইকে দাবড়ে রাখা এইসব প্রধান ব্যাপার। আগে যেসব ছেলেগুলো রেলের ওয়াগন ভাঙত, চুরি ছিনতাই করত সব এসে জুটেছে পার্টির ছত্রছায়ায়। আর বীরুদার মতো লোক তাদের নেতা হয়েছে। তাদের বাধা দেওয়ার লোক কমে যাচ্ছে, নেই বললেই হয়। এদেরই এখন একচ্ছত্র রাজ। কিন্তু সেসব বুঝেও রেখা নিজেকে সামলাতে পারল না। মুখের উপর বীরুকে বলে দিল, তোমায় আমি ঘেন্না করি বীরুদা, কিচ্ছু জানো না দাদাগিরি ছাড়া। তোমার যদি আমাকে নিয়ে অবসেশান থাকে সেটা তোমার প্রবলেম, ডাক্তার দেখাও গিয়ে। যদি ভাবো তুমি আমাকে ভয় দেখাবে আর আমি তোমার গলায় ঝুলে পড়ব, ভুল। আর একবার তোমাকে আমার ধারেকাছে দেখি, আমি পুলিশে যাব।

বীরু ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, খুব ভুল করলি রেখা। পস্তাবি। খুব পস্তাবি। আমি লোকটা অত সহজ নই কিন্তু। তুই আমার না হলে আর কারও হতে পারবি না রেখা।

—থ্রেট দিচ্ছ? যাও তো যেখানে যাওয়ার, করো যা কিছু করার।

রাগে এসব বলল বটে, কিন্তু রেখা জানে বীরুদার জ্বালায় ওর শান্তিতে দুর্গাপুরে থাকা মুশকিল হবে এবার। মার সঙ্গে কালকেই কথা বলতে হবে। দরকার হলে আবার মাসির বাড়ি গিয়ে থাকবে না হয় কিছুদিন।

এরপর যতক্ষণ বিয়েবাড়িতে ছিল বীরুদাকে আর দেখেনি। সেও অনুরাধার পাশে গিয়ে বসেছিল আর সব বন্ধুদের সঙ্গে। নানারকম মজায় ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল সন্ধ্যার ঘটনাটা। কিন্তু খচখচানিটা যাচ্ছিল না কিছুতেই। এইসব কারণেই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কথা ভেবেছিল। বাসরঘরে থাকতে পারত। কিন্তু তাহলে রাত দুটো বেজে যাবে, ফেরার কী ব্যবস্থা হবে কে জানে। বেশি দেরি হলে রিক্সা পাবে না মোটেই। অত রাতে হেঁটে ফেরার ইচ্ছে নেই।

এগারোটা বাজতে বাজতেই বেরিয়ে পড়েছিল। ভাগ্য ভাল, গেটের বাইরেই রিক্সা। আসলে জানে বিয়েবাড়ি, তাই বেশ কিছু রিক্সা এসে অপেক্ষা করছিল। ডাকার আগেই একটা রিক্সা লাইন ভেঙে এগিয়ে এল। সাধারণত এরকম হলে অন্য রিক্সাওয়ালাগুলো হাঁ হাঁ করে ওঠে। এখন করল না। রেখা এটা খেয়াল করলে ভাল হত। কিন্তু এত হইচই করে বেরিয়ে এইসব ছোটখাটো ব্যাপার কি মাথায় থাকে।

কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছে সেটা বুঝল রাস্তায়। অনুরাধার বাড়ি থেকে তার বাড়ি এমন কিছু দূর নয়। এমনি দিনে দিনের বেলায় হেঁটেই চলে যায়। সেই রাস্তা না নিয়ে যখন রিক্সা সাঁই সাঁই করে অন্য রাস্তা ধরল রেখা এক ধমক দিল। কোথায় যাচ্ছ? দুর্গাপুরে রিক্সা চালাও আর বেনাচিতির রাস্তাও চেন না? বললাম না বেনাচিতির মোড় থেকে ডানদিকে নিতে হবে?

রিক্সাওয়ালা কিছু শুনল বলে মনে হল না। তার বদলে আরও সাঁই সাঁই করে প্যাডেল করে একটা অন্ধকার গলিতে রিক্সা ঢুকিয়ে দিল। দিয়েই রিক্সা ফেলে ছুট। রেখার বুকের ভিতর দমাস দমাস করছিল। এসব কী হচ্ছে?

কোথা থেকে দুটো লোক উদয় হল। অন্ধকার থেকে ছুটে এল রেখার দিকে। ওদের মুখ গামছা দিয়ে ঢাকা। হাতে বড় বোতল। দৌড়ে এসে রিক্সার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওরা বোতলের তরল ছুড়ে দিল রেখার মুখে। শীতল আগুনের মতো আছড়ে পড়ল রেখার মুখের ডানপাশে, গালে, গলায়, মুখে। এক প্রচণ্ড যন্ত্রণায় যেন ওর চামড়া মাংস গলে গলে পড়ছিল। রেখার ভয়ার্ত চিতকার নিমেষে জান্তব হাহাকারে পরিণত হল। এরকম যন্ত্রণা জীবনে পায়নি রেখা, এত কষ্ট আসেনি ওর জীবনে।

এক মুহূর্তে রেখার জীবন গলে গলে ঝরে পড়ল গভীর রাতের জনহীন রাস্তায়।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]