প্রিয়ক মিত্র
পূর্ব প্রকাশিতের পর
গাড়ি ছুটে চলেছে হু হু করে বজবজের দিকে, রাত নটার রেড রোড ধরে।
ভগা গাড়ি চালাতে চালাতে ইতিমধ্যে চারবার চোখ রেখেছে রিয়ারভিউ মিররে। বছর পনেরোর ছেলেটাকে ও হাঁ করে দেখছে। ছেলেটা শান্ত। যে মালিক ওকে কাজ দিয়েছে, তার সঙ্গে বেইমানি করছে। তাও কেমন নিরুত্তাপ! কী করে এত শান্ত থাকছে ও?
ভগা কিছুটা উপযাচক হয়েই জিজ্ঞেস করল ছেলেটাকে, তোর নাম কী?
ছেলেটা জানলার বাইরে চোখ রেখে বসেছিল। ফিরে তাকাল ভগার দিকে। নিস্পৃহভাবে বলল, মন্টি।
—থাকিস কোথায় তুই?
ভগার এবারের প্রশ্ন শুনে রাইটু একবার আড়চোখে তাকাল। ছেলেটার ব্যাপারে ভগার এই আগ্রহ দেখানোটা তার হাস্যকর লাগছিল। তার বিশ্বাস, ছেলেটাও এই কথাবার্তাটা চালিয়ে নিয়ে যেতে খুব একটা আগ্রহী নয়। ভগা কেন এটা করে চলেছে, তা ভগাই জানে।
—৩২ নম্বর।
মানে ৩২ নম্বর বস্তি। আর কী জিজ্ঞেস করবে ভেবে উঠতে পারল না ঠিক করে ভগা। সে মনটাকে একটু অন্যদিকে ঘোরাল। অনুজ পাণ্ডেকে খালাস করতে যাচ্ছে তারা। কাজটা খুব সহজ হবে কি?
বজবজের বিল্ডার অনুজ পাণ্ডের সঙ্গে বেগুনিবাবুর ঝামেলার হিস্ট্রি আছে। দুজনে একসঙ্গেই এই লাইনে এসেছিল। কিন্তু প্রথম থেকেই অনুজ পাণ্ডের সঙ্গে পলিটিক্যাল লাইনের ঝামেলা লেগেছিল বেগুনিবাবুর। বেগুনিবাবু রুলিং পার্টির কিছুটা কাছের লোক ছিল। আর অনুজ পাণ্ডে নতুন বিরোধী পার্টিতে জয়েন করেছিল নব্বইয়ের শেষে। দুজনেই বজবজে রমেন হালদারের আন্ডারে কাজ করত। রমেন হালদার ছিল বজবজের জুটমিল এলাকার বেতাজ বাদশা। অনুজই প্রথমে কাঁচি করে বেগুনিবাবুকে। বেগুনিবাবু চলে আসে নর্থ কলকাতায়, তখন এখানে পুরনো বাড়ির প্লট ফাঁকা হচ্ছে পর পর। এখানেই জাঁকিয়ে বসে বেগুনিবাবু। তার কিছুদিন পর শোনা যায়, রমেন হালদার কোনও একটা কালভার্টের ধার থেকে পড়ে মারা গেছে। এটা যে অনুজেরই কীর্তি ছিল, তাই নিয়ে খুব একটা সন্দেহ ছিল না কারও।
এহেন অনুজের সঙ্গে একটা ঠান্ডা লড়াই দীর্ঘদিন ধরে চলেছে বেগুনিবাবুর। আজ শুধু কিছু রাবিশ সরানো আর বউকে খিস্তি করার জন্য তাকে নামিয়ে দেবে বেগুনিবাবু?
ভগা সকালে এতকিছু ভাবেনি। অপারেশনের নেশায় বেরিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ লরিটা দেখে ওটাকে অনুজ পাণ্ডের লরি বলে চিনতে পারল ভগা। রাইটু তার মানে সকাল থেকেই জানত। ওকে বলেনি। এবং ভগার ধারণা, অনুজকে মারার আসল কারণটাও রাইটু ওকে বলছে না, সেটাও ও জানে।
ভগার মাথাটা ঘেঁটে যাচ্ছে। ও বুঝতে পারল আরেকটা জয়েন্ট না ধরালে হবে না।
ভগা গাড়ি সাইড করল খিদিরপুরের কাছাকাছি এসে।
‘হায় রে পোড়া বাঁশি…’
মৃদু গান ভেসে আসছে। রিনি ওরফে কবিতা দে তাদের পুরনো বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়েছিল। দু-একটা বাজিও ফাটল হঠাৎ করে। পাড়ায় শেতলাপুজো হচ্ছে আজ। সারাবছরই এই পাড়ায় কিছু না কিছু লেগে থাকে।
রিনি অপেক্ষা করছে কারও ফেরার জন্য? ঠিক তা নয়। তার স্বামী, দেবাশিস ফেরে অনেক রাতে, ঠিকই। কিন্তু রিনির অপেক্ষা ঠিক তার ফেরার জন্য নয়। না ফেরার জন্যই।
রিনি জানে, দেবাশিসের গোলমাল হাজার রকমের। ও জানে, যে-কোনও একদিন ওর কিছু একটা ঘটে যাবে।
সেই ঘটনাটার জন্যই যেন অপেক্ষা করে রিনি। হ্যাঁ, দেবাশিস ওকে নিরাপত্তা দেয়। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, মাথার ছাদের নিরাপত্তা। এই নিরাপত্তাগুলো না থাকলে রিনি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, ও জানে না নিজেও। ও একথা জানে, ওকে শেল্টার দেওয়ার পুরুষের অভাব হবে না। খুব নিশ্চিতভাবেই জানে। কিন্তু তাদের দয়াদাক্ষিণ্য কি ও আদৌ নেবে? নেওয়ার কারণ নেই।
ওকে নিজের রাস্তা হয়তো নিজেকেই দেখতে হবে। বাপের বাড়ি বলে আদতে কিছু নেই ওর। যা আছে, সেটার কথা ও মনে করতেও চায় না। তাই ও জানে, ওকে জীবনধারণের জন্য নানারকম পথ নিতে হতে পারে। ও প্রস্তুত তার জন্য। ওর পড়াশোনা কম নয় বিশেষ। ভাল ইংরেজি জানে। আসলে অনেক দূর পড়েছে। তাও চাকরিবাকরি ও পাবে না হয়তো। একটা বিউটি পার্লার ও নিশ্চয়ই খুলতে পারে। কিন্তু ওকে সুস্থভাবে, সোজা পথে ব্যবসা করতে দেবে তো এই ঢ্যামনা পুরুষগুলো?
তাই ও জানে, ওকে শেষমেশ হয়তো এমন কোনও রাস্তা নিতে হবে, যা সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয়। কিন্তু তাতে ওর আর কিছু যায় আসে না।
এই সময় হঠাৎ ওর ভগার কথা মনে পড়ল।
ভগা কি ওকে ভালবাসে? কে জানে। ভগা পাগলের মতো ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘরে এলেই। ওর শরীরে ডুবে যায় বাচ্চা ছেলের মতো। ভগাকে ওর অস্থির লাগে, মনে হয় ওর শত রোয়াবের আড়ালেও ও আদতে খানিকটা ক্যাবলা। প্রথম দিনটা মনে পড়ে রিনির। ভগা এসেছিল দেবাশিসের বিউটি পার্লারের বখেরা নিতে, যেটা রিনি চালায়। দেবার কারবারের মধ্যে খুব একটা ঢুকতে চায় না রিনি। কিন্তু সেদিন দেবা বাড়ি ছিল না বলে, আর ব্যাপারটা ওর বিউটি পার্লার বলেই ওকে ঢুকতে হয়েছিল গোটাটার মধ্যে। দেবার পয়সায় চলতে পারে, কিন্তু বিউটি পার্লারটা তো ওর। সরাসরি ভগার মুখোমুখি হয়েছিল রিনি।
—কী চাই?
রিনির হালকা ভাঙা গলার আওয়াজ পুরুষদের টলিয়ে দেয় অনেক সময়েই। সেটা ও জানে। কিন্তু প্রয়োজনে সেই কণ্ঠস্বর যথেষ্ট কর্কশ হতে পারে।
কালো চশমার আড়ালে ভগার চোখটা বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু ভগা একটা অচেনা মেয়ের এই কণ্ঠস্বর আদৌ নিতে পারেনি, ভেতরে ভেতরে ধিকিধিকি জ্বলছে, সেটা ভালই বুঝতে পারছিল রিনি।
বিউটি পার্লারের টাকার কথা শুনে সরাসরি প্রশ্ন করেছিল রিনি, কেন দিতে হবে টাকা।
—এটা বেগুনিবাবুর বখেরা! দেবা সব জানে, ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলেছিল ভগা।
—আচ্ছা! বেগুনিবাবু আমার সঙ্গে কথা বললে ভেবে দেখব। বিউটি পার্লারটা দেবার বাপের সম্পত্তি হতে পারে, কিন্তু ওটা চালাই আমি।
ভগা কিছুক্ষণের জন্য ব্যোমকে গিয়েছিল। কী বলবে বুঝতে না পেরে ভেবলে তাকিয়েছিল রিনির দিকে। কোনও মেয়ে ওর সঙ্গে এত রোয়াব নিয়ে কথা বলতে পারে, ও কল্পনাই করেনি। বাক্যব্যয় না করে সিগারেট ধরিয়ে বাইকে চড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।
শুধু দেবা, যার মুখ কিছুতেই ফোটে না, শুধু চোখে অভিসন্ধি ঘোরে, সে সেদিন বাড়ি ফিরেছিল প্রায় খুনে হাবভাব নিয়ে। এসেই শুরু করেছিল অকথ্য গালিগালাজ। হ্যাঁ, গলা চড়ছিল না। কিন্তু ফিসফিস করেই বিষ ছেটাচ্ছিল দেবা।
—রেন্ডি কুত্তি! তোকে একটা পার্লার দিয়েছি, তার ফায়দা নিচ্ছিস। আমার পয়সায় গান্ডেপিন্ডে গিলছিস, চামড়া চকচকে করছিস, বুক বাড়াচ্ছিস, ভাঁজ দেখিয়ে ঘরে ছেলে ঢোকাচ্ছিস, কিচ্ছু বলি না। তোর সাহস কী করে হল আমার টাকাপয়সার হিসসা নিয়ে কথা বলার? বেগুনিবাবুকে তুই চিনিস মাগি? তোকে আধখাওয়া করে রাবিশের সঙ্গে চালান করে দিতে পারে, জানিস সেটা?
পাত্তা দেয়নি প্রথমে রিনি। দেবার মুখোশটা খুলেছে এতদিন পর, এতে মজাই পাচ্ছিল। ও চুপচাপ রান্না করে যাচ্ছিল।
কিন্তু গোলমালটা হল তার পরেই।
দেবা এসে ওর চুলের মুঠিটা ধরতে গেল।
—কথা কানে যাচ্ছে না খানকি মাগি!
এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে গরম খুন্তি দিয়ে একটা চাপড় মেরেছিল দেবাকে রিনি।
দেবা কিছুক্ষণ হতভম্ব। তারপর চুপচাপ ঘরে চলে গিয়েছিল।
পরেরদিন ভোররাতের কাছাকাছি ঘরের কড়ানাড়া শুনে উঠে গিয়ে দরজা খুলেছিল রিনিই। দেবা বেডরুমের দরজা থেকে উঁকি মারছিল। বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার সাহস ওর ছিল না। ও জানত, কারা এসেছে। ও ভেবেই নিয়েছিল, রিনির যা হওয়ার তো হবেই, ওরও কপালে দুঃখ আছে।
কিন্তু পাশাটা কীভাবে উল্টোবে, কল্পনাও করেনি দেবা।
মানিক তরফদারের নাম এমনি এমনি বেগুনিবাবু নয়, গায়ের কালো রংটা চকচক করতে করতে যেন আলতো বেগুনিই হয়ে উঠেছে। তার ওপর মাথায় একবর্ণ চুল নেই, চোখে লাল শেডের গগলস সর্বক্ষণ পড়া, ফলে চোখদুটোও বোঝা যায় না।
বেগুনিবাবু কেবল ভগাকে সঙ্গে নিয়েই এসেছিল। এসেই দেবাকে কিছুক্ষণের জন্য বেরিয়ে যেতে বলেছিলেন বেগুনিবাবু। ভগাই দায়িত্ব নিয়ে দেবাকে বাইরে নিয়ে যায়। সিগারেট খাওয়ায়।
বেগুনিবাবু একা, একদম একা কথা বলেছিল রিনির সঙ্গে। তারপর দেবাকে ঘরে ডেকে জানিয়েছিল, বিউটি পার্লারের টাকা এবার থেকে নেবে না বেগুনিবাবু। বদলে আরও চার রকমের তোলার ভার ওর ঘাড়ে চেপেছিল।
রিনি সেদিন মুচকি হেসেছিল। সেই হাসি জ্বালা ধরিয়েছিল দেবার সর্বাঙ্গে। কী কথা হল ওর বেগুনিবাবুর সঙ্গে, দেবা জানতে চায়নি। ওর জানতে ভয়ই করেছিল।
রিনিকে তারপর থেকে একেবারেই ঘাঁটায়নি দেবা। তারপর থেকেই দরকারে-অদরকারে ভগার যাতায়াত বাড়ল এ-বাড়িতে।
আজ কেন জানি না, রিনি আনমনা।
বাজি ফাটছে।
‘চলে গেলে এ মধুরাত ফিরে পাবে না…’
গান বাজছে পাড়ায়।
রিনি অপেক্ষা করছে।
দেবাশিসের না ফেরার।
[আবার আগামী সংখ্যায়]