অঞ্জুশ্রী দে
কালের নিয়মে হারিয়ে যেতে বসেছে অনেক লোকপুজো, তাকে ঘিরে লোকউৎসব। আগামী প্রজন্ম হয়তো এসব রীতি জানবেই না৷ তবে হারালেও, কিছু কিছু থেকেই যাবে। যা আমাদের লোকসংস্কৃতির ধারাকে সমৃদ্ধ করবে। উন্নয়নের জন্য আধুনিকতা প্রয়োজন। পাশাপাশি লোকসংস্কৃতির ধারাকেও বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। নল সংক্রান্তি, মুষ্টি সংক্রান্তি, ইতু সংক্রান্তিকে ঘিরে যে লোকপুজো, তা আজও লোকসংস্কৃতির ধারাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে
চাঁদের মাটিতে চন্দ্রযান-৩-র সফল ল্যান্ডিং ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার বড় সাফল্য। আগামী পৃথিবীর ভবিষ্যৎ মহাকাশপ্রযুক্তির হাতে বলেই ভাবা হচ্ছে। কৃষিতে এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে পোকামাকড়ের আক্রমণ ঠেকিয়ে ফসল নষ্ট অনেকটাই কমানো গেছে। চাষে জল, সার ও কীটনাশকের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে। এরকম একটা সময়েই চাষি ভাল ফলনের আশায় জমিতে নল দিচ্ছেন। নির্বিঘ্নে ফসল ঘরে তুলতে মুঠোপূজো করছেন। আবার বীজের অঙ্কুরোদ্গমের হার জানতে ইতুর ঘট পাতছেন। বৈপরীত্যে ভরা এই ভারত। একদিকে প্রযুক্তির হাত ধরে আধুনিকতার শিখরে পৌঁছাতে চাইছে, অন্যদিকে গ্রামীণ লোকাচারকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এর বেশিরভাগটাই আজ হারিয়ে গেছে। আধুনিকতা লোকাচারের শিকড়কে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করলেও পুরোপুরি সফল হয়নি। গ্রামের মানুষ পরম্পরায় চলে আসা লোকাচারকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। এসবের হয়তো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা লোকাচারের প্রতি বিশ্বাস থেকে মানুষ এগুলোকে জীবন থেকে বাদ দিতে পারেননি। আধুনিকতা সেই বিশ্বাসে হয়তো বদল এনেছে তবে পুরোপুরি সবটাকে শেষ করে দিতে পারেনি। আর সেইজন্য এখনও কিছু গ্রামীণ লোকাচার আমাদের নজরে পড়ে। যতদিন এঁরা এঁদের বিশ্বাসে অনড় থাকবেন ততদিনই তা লোকসংস্কৃতির পক্ষে মঙ্গল। এঁদের বিশ্বাসই বাঁচিয়ে রাখবে বিভিন্ন লোকাচারকে, যাকে ঘিরে পালিত হবে লোকউৎসব।
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। প্রতি মাসের একটি করে সংক্রান্তি। প্রতিটি সংক্রান্তির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, তাকে ঘিরে পালিত হয় ভিন্ন ভিন্ন পুজো, লোকাচার। পালিত হয় লোকউৎসব। এমনই তিনটি সংক্রান্তি নল সংক্রান্তি, মুষ্টি সংক্রান্তি ও ইতু সংক্রান্তি— যেগুলোকে ঘিরে কৃষক পরিবারের স্বপ্ন দেখা।
নলপুজো বা নল সংক্রান্তি— ধানের সাধভক্ষণ
নবজাতকের সুস্থ আগমন কামনায় গর্ভবতী মেয়েদের সাধ খাওয়ানোর রীতি সবার জানা। কিন্তু মানুষের খাদ্যের জোগান দেয় যে ‘ধান’, গর্ভবতী অবস্থায় সেই ধানগাছকেও সাধ খাওয়ানোর প্রচলন আছে— তা অনেকেরই অজানা। ধানকে সাধ খাওয়ানোর অনুষ্ঠান রাঢ়বঙ্গের কৃষক সম্প্রদায়ের একটি প্রাচীন লোকাচার। আশ্বিন মাসের শেষদিন অর্থাৎ সংক্রান্তির দিনে গ্রামবাংলার অনেক অঞ্চলেই এটি পালিত হয়৷ যা নল সংক্রান্তি নামেই পরিচিত। কোথাও কোথাও একে ডাকসংক্রান্তিও বলে।
আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি থেকে কার্তিকের মাঝামাঝি ধানগাছে ফুল হয়। এই সময়টা ধানের গর্ভকাল। চাষিদেরও দীর্ঘদিনের বিশ্বাস তাদের ধানগাছ গর্ভবতী হয়েছে। মায়ের গর্ভে শিশু যেমন অপরিণত থাকে ধানের ক্ষেত্রেও তাই। ফুল আসার সময় ধানের ভেতরের অংশটি একেবারে দুধের মতো। যেটি পরবর্তীতে চালে পরিণত হয়। এই নরম মিষ্টি দুধ পোকামাকড়ের খুব প্রিয়। ফলে এ-সময়ে পোকামাকড়ের আক্রমণ বাড়ে। এরা ধানের নরম অংশটি শুষে নেয়। তার ফলে ধানের পুষ্টি হয় না। ধান থেকে আর চাল পাওয়া যায় না। সব আগড়া বা চিটেতে পরিণত হয়। এতে কৃষকের সর্বনাশ, তার দুঃখের সীমা থাকে না। পোকার হাত থেকে ফসলকে বাঁচাতে কৃষকরা একধরনের টোটকা ব্যবহার করতেন। সেই টোটকা ব্যাবহারের রীতিই পরে ধানগাছের সাধ-ভক্ষণ হিসেবে পরিচিতি পায়।
কী সেই রীতি? আশ্বিন মাসের সংক্রান্তির আগের দিনে গ্রামের চাষিরা এক জায়গায় জড়ো হন। নিম, কালমেঘ, তুলসী, ওল, আদা, ভেট, বহেড়া, মানকচু, চালকুমড়ো খাড়া, নটে খাড়া, কেতকী, বেলপাতা, শশাপাতা ইত্যাদি দশ-বারো রকমের ভেষজ গাছকে খুব ছোট ছোট করে কেটে তাতে আতপ চাল ও শুকনো চিংড়িমাছ মিশিয়ে সেটিকে বড় মানপাতায় মোড়েন। নলবন থেকে কেটে আনা নলগাছের ডগায় পাট দিয়ে সেটিকে বাঁধেন। এই সময়ে কথা বলা বারণ। সারারাত জেগে নল বাঁধার কাজ চলে। সংক্রান্তির দিন ভোরে সূর্যের আলো ফোটার আগেই এই মিশ্রণ বাঁধা নলটি জমির ঈশান কোণে পুঁতে দেওয়া হয়। নল ব্যবহারের পিছনে বিশ্বাস হল, এই গাছ বহু প্রজননক্ষমতার অধিকারী। চাষিরা ভাবেন তাদের ধানগাছগুলোও নলগাছের মতো প্রজননক্ষমতার অধিকারী হবে। জমিতে নল পোঁতার সময় চাষিরা ছড়া কেটে বলেন— “আকাশের জল পাতালে নল/ ধান ফলা কলকল”। আবার কোনও জেলায় বলেন— “নল পড়ল ভুঁয়ে/ যা শনি তুই উত্তর মুয়ে”। এখানে পোকামাকড়ই হল শনি। হাওড়াতে নল পোঁতার অন্য ছড়া— “আশ্বিন গেল কার্তিক এল/ ছোট বড় ধানের গর্ভ হল/ এতে আছে মধু সাধ খাও গো রাজার বধূ/ এতে আছে গোটা গোটা সাধ খাও গো রাজার ব্যাটা/ এতে আছে ঘি সাধ খাও গো রাজার ঝি।” মন্ত্র শেষ করে ওই নলগাছের গোড়ায় চাল, বাতাসা প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয়। নলের গায়ে গঙ্গাজলের ছিটে দিয়ে শাঁখ বাজানো হয়। সেই অনুভূতিও দারুণ। সারা মাঠ জুড়ে শুধুই শাঁখের আওয়াজ। শেষে নলগাছকে প্রণাম করে চাষি বাড়ি ফেরেন। কোনও কোনও জেলায় জমি থেকে ফিরে এসে হাত পা ধুয়ে বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে পড়ার নিয়ম আছে। বিশ্বাস ধান পাকলে ধানগাছ সোজা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে। তাতে ফসল নষ্ট কম, কাটতেও সুবিধা।
এই লোকাচারের যৌক্তিকতা হল, কীটপতঙ্গের হাত থেকে ফসলকে বাঁচানো। যখন চাষে কীটনাশকের ব্যবহার ছিল না তখন তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত এই মিশ্রণটিকে জমিতে রাখলে, এর গন্ধে পোকামাকড় ফসল থেকে দূরে পালাত। রক্ষা পেত কৃষকের ফসল৷ শুধু তাই নয়, জমির মাঝে পুঁতে রাখা নলগাছে প্যাঁচা, চড়াইরা এসে বসত এবং সেখান থেকে তারা খুব সহজেই ফসলের ক্ষতিকারক পোকাকে শিকার করত৷ পুরো ব্যাপারটিতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষে উপকৃত হন কৃষক৷ মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া জেলার বিশেষ অঞ্চলের চাষিদের নিজের জমিতে নল পুঁততে এখনও দেখা যায়। কিন্তু আগের যে কৌলিন্য, তা আর নেই।
মুঠোপুজো বা মুষ্টি সংক্রান্তি— নির্বিঘ্নে ধানকে খামারে তোলা
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের গণদেবতা উপন্যাসে আছে ‘কার্তিক সংক্রান্তির দিনে কল্যাণ করিয়া আড়াই মুঠা কাটিয়া লক্ষীপূজা হইয়া গিয়াছে…।’ কার্তিক সংক্রান্তির দিনে কিসের কল্যাণে, কী কাটিয়া লক্ষীপুজোর কথা তিনি তুললেন? শহরে বসে একে বোঝা কঠিন। সাহিত্য থেকে বাস্তবের মাটিতে নামতে দ্বারস্থ হয়েছিলাম পারিবারিক বন্ধু মুর্শিদাবাদের সাগরদীঘির কেশব মণ্ডলের। এ-বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া। কার্তিক সংক্রান্তিতে চাষিরা মুঠি বা মুঠোপুজোয় মাতে। তাই কার্তিক সংক্রান্তিকে মুষ্টি সংক্রান্তিও বলে। কোনও কোনও অঞ্চলে একে “হালা কাটা” বলে।
এই দিনে চাষিরা ভোরবেলা স্নান করে নতুন কাপড় পরে কাস্তে নিয়ে মাঠে হাজির হন। আজও হয়তো গাঁয়ের ক্ষেতে অপলক অপেক্ষা নিয়ে বসে থাকে জীবনানন্দের গাংচিল। গায়ে এসে লাগে ঠান্ডা হাওয়া। চাষি, জমির ঈশান কোণে যেখানে নল সংক্রান্তিতে নল পুঁতেছিলেন সেখান থেকেই আড়াই আঁটি ধান আড়াই প্যাঁচে কেটে কাপড় জড়িয়ে মাথায় নিয়ে চুপটি করে সোজা বাড়ি আসেন। চাষির ঘরে মুঠো আনা এক মজার অনুষ্ঠান। ধানের আঁটি মাথায় চাষি বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালেই তাঁর স্ত্রী বা অন্য কোনও মহিলা তাঁকে একটা কাঠের পিঁড়িতে দাঁড় করিয়ে পা ধুইয়ে দেন। সেই গৃহবধূ নিজের কাপড়ের আঁচল দিয়ে পা মুছিয়ে ভক্তিভরে কৃষককে প্রণাম করেন। ধানের আঁটি সমেত কৃষককে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যান। মা লক্ষীকে সাদরে আহ্বান জানান নিজের ঘরে। শেষে সেই ধানের আঁটিকে লক্ষ্মীর আসনের পাশে বা বাড়ির কোনও পবিত্রস্থানে রেখে তাকে লক্ষ্মীরূপে পুজো করেন। মাঠ থেকে ধানের মুঠো আনার দিন, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের ঘরে ঘরে শুরু হয়ে যায় মুঠোপুজোর আয়োজন।
যে-কোনও লোকাচারের রূপ বদলে যায় অঞ্চল থেকে অঞ্চলে। এ-ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। কিছু কিছু জেলায় তাই দেখা যায়, কার্তিক সংক্রান্তির দিন জমির মালিক জমির ঈশান কোন থেকে আড়াই আঁটি ধান কেটে সেখানে কলাগাছের বাকলের উপর দুটি বা তিনটি মাটির পুতুল রেখে তাকে ফুল, বাতাসা, নকুলদানা ইত্যাদি দিয়ে শাঁখ ঘন্টা বাজিয়ে পূজা করছেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর-মজিলপুর অঞ্চলের চাঁপাতলায় এ-বছর চালবাটার রঙিন পুতুল দিয়ে মুঠোপুজো করতে দেখা গেছে। আসলে একই ধর্মের মধ্যে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, প্রত্যেকের নিজস্ব সংস্কৃতি। তাই একই লোকাচারের এত বৈচিত্র্য।
ক্ষেতের সোনালী ধান খামারে তোলার আগে যাতে কোনও বিপত্তি না হয়, তার জন্যই মা লক্ষ্মীকে তুষ্ট করতে এই পুজোর আয়োজন। চাষিরা বলেন মুঠোপুজোই হল বাংলার প্রথম লক্ষ্মীপুজো। শুরু হয়ে যায় নবান্নের আয়োজন। পরে এই ধানে পায়েস বা খিচুড়ি হয়। এ এক অদ্ভুত সংস্কৃতি, অদ্ভুত বিশ্বাস। মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমান, হুগলি, কিছুটা দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় অনেক চাষি মুঠোপুজো করছেন বটে তবে তা মূলত অবলুপ্তির পথে।
জীবনের নানা সমস্যার সমাধানে আমাদের পূর্বপুরুষরা এরকম অসংখ্য দেবদেবীর কল্পনা করেছিলেন। সম্পত্তি লাভ থেকে সন্তান লাভ, শস্য উৎপাদন থেকে শত্রুর নিধন, রোগমুক্তি থেকে শাপমুক্তি— এই সব কামনা পূরণের লক্ষ্যে বেশিরভাগ পুজোর প্রচলন। অঞ্চলভেদে তাদের নামের বৈচিত্র্য যতটা, ততটাই বৈচিত্র্য তাদের পুজো-পদ্ধতিতে। এদের উৎপত্তি যেমন বিশেষ অঞ্চলে, প্রভাব-প্রতিপত্তিও তেমন ওই অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শাস্ত্রে এদের অনেকেরই নাম লিপিবদ্ধ করা নেই। স্থানীয় চাহিদা থেকে এদের সৃষ্টি বলেই এরা লৌকিক দেবতা হিসেবেই থেকে গেছে। যাদের বেশিরভাগই পুজো পেয়েছে অ-ব্রাহ্মণ মহিলাদের হাতে। এই দেবতারা মূলত বিমূর্ত। তবে কোথাও কোথাও কাল্পনিক মূর্তি যে গড়া হয়নি তা নয়। এই পুজোর সঙ্গে লোকসংস্কৃতির যোগ অবিচ্ছেদ্য। যাকে ঘিরে রচিত হয়েছে লোকনাট্য ও লোকসঙ্গীত। সৃষ্টি হয়েছে লোকনৃত্য। আয়োজিত হয়েছে লোকউৎসব ও মেলা। যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে, সামাজিক যোগাযোগ বাড়ায়। এরকমই আর এক লৌকিক দেবতা ইতু। কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে যার পুজো শুরু হয়। শেষ হয় অগ্রহায়ণের সংক্রান্তিতে।
ইতুপুজো বা ইতু সংক্রান্তি– বীজের অঙ্কুরোদ্গমের হার জানা
সূর্য ও ইন্দ্রের সংযুক্তিতে গড়া লৌকিক দেবী হলেন ইতু। যাকে শস্যলক্ষ্মী রূপে কল্পনা করা হয়। কেউ কেউ ইতুলক্ষ্মীও বলেন। যার হাতে গ্রামবাংলার মেয়েরা তুলে দিয়েছেন কৃষি ও সমৃদ্ধির ভার। একটি মাটির সরাতে চাষের জমির মাটি ভরে তাতে নানারকম কলাই ছড়ানো হয়। যা থেকে কয়েকদিন পর গাছ বের হয়। চারাগাছ অঙ্কুরিত হলে ধরে নেওয়া হয় তা সংসারের সুখ-সমৃদ্ধির প্রতীক। এই মাটিভর্তি সরার মাঝে ছোট মাটির ঘট বসিয়ে তাতে কলমিফুল ও আমের পল্লব দেওয়ার রীতি। এ ছাড়া সরার মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয় ধানের শিস, যবের শিস, কলমিলতা, কচুগাছ। ঘটে জল, দুধ ও গঙ্গাজল ঢেলে ব্রতীরা ইতুর পুজো করেন। ঘটে জল ঢালার সময় ব্রতীকে বলতে শোনা যায়— “ইঁয়তি ইঁয়তি নারায়ণ/ তুমি ইঁয়তি ব্রাহ্মণ।/ তোমার শিরে ঢালি জল/ অন্তিম কালে দিও ফল।” এছাড়া, ঘটে দুধ ও গঙ্গাজল ঢালারও আলাদা মন্ত্র আছে। ব্ৰতী পুজোর দিন স্নান সেরে ঘটে জল ঢেলে প্রণাম করে সেদিনের মতো পুজো শেষ করেন। প্রণামেরও আলাদা শ্লোক আছে। প্রণাম শেষে ইতুর ব্রত পাঠের রেওয়াজ রয়েছে। কোথাও কোথাও পাড়া-প্রতিবেশীরা একসঙ্গে বসে ইতুর ব্রতকথা শোনেন। একজন ব্রত পাঠ করেন, বাকিরা হাতে ফুল নিয়ে বসে তা শোনেন। সেইসময় সংসারের সুখ ও ঐশ্বর্য কামনায় ইতুর উদ্দেশ্যে বলেন— “অষ্ট চাল অষ্ট দূর্বা কলস্ পাত্রে থুয়ে/ শুন এক মনে ইতুর কথা, সবে প্রাণ ভরে।/ ইতু দেন বর/ধন-ধান্যে, পুত্র-পৌত্রে বাড়ুক তাদের ঘর।/ কাঠি-কুটি কুড়াতে গেলাম/ ইতুর কথা শুনে এলাম।/ এ কথা শুনলে কী হয়?/ নির্ধনের ধন হয়।/ অপুত্রের পুত্র হয়।/ অশরণের শরণ হয়।/ অন্ধের চক্ষু হয়, আইবুড়োর বিয়ে হয়।/ অন্তিম কালে স্বর্গে যায়।” অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবার ইতুর পূজো হয়। অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিন অর্থাৎ অগ্রহায়ণ সংক্রান্তির দিন কাছাকাছি নদী বা কোনও পুকুরে ইতুর বিসর্জন হয়। এই সংক্রান্তিকে ‘ইতু সংক্রান্তি’ও বলে।
রবিশস্যের অঙ্কুরোদ্গমের হার নির্ধারণ করতেই ইতুপুজোর প্রচলন— চলতি ব্যাখ্যা তেমনটাই। প্রাচীন কৃষিব্যবস্থায় বীজ সংরক্ষণ ও পরীক্ষার ঠিকমতো ব্যবস্থা না থাকায়, বীজ থেকে অঙ্কুরোদ্গমের হার মানুষের অজানা ছিল। একটি পাত্রে জমির মাটির ওপর বীজ ছড়িয়ে অঙ্কুরোদ্গমের হার পরিমাপ করতে যে ধর্মীয় ব্যবস্থা সেটাই ইতুপুজো। সেইজন্য জায়গাভেদে রবিশস্যের বীজগুলি কোথাও নয়টি, কোথাও এগারোটি, আবার কোথাও তেরোটি করে দেওয়ার বিধান আছে। এর মধ্যে কতগুলি বীজের অঙ্কুরোদ্গম হল সেই হিসেবে মাঠে বীজের পরিমাণ ঠিক করা হত। অর্থাৎ শীতকালীন চাষের আগে রবিশস্যের বীজের অঙ্কুরোদ্গমের তথ্য সংগ্রহই ছিল ইতুপুজোর উৎস। এভাবেই মিলেমিশে গেছে ধর্ম ও কৃষিবিজ্ঞান।
এখন অগ্রহায়ণ মাস, ইতুপুজো চলছে। এরপর মানুষ টুসু উৎসবে মেতে উঠবেন। এটাই রাঢ় বাংলার মানুষের পরম্পরা। কয়েক বছর আগেও রাঢ় বাংলায় ঘটা করে ইতুর পুজো হত। অঞ্চলভেদে পুজোগুলি উৎসবের চেহারা নিত। এখন আর সেই ছবি চোখে পড়ে না। আগের মতো ঘরে ঘরে আর ইতুর আসন পাতা হয় না। হারিয়ে গেছে তার অতীত জৌলুস। সেই কথাই শোনালেন, বাঁকুড়ার কোতলপুরের গৃহবধূ সুপ্রিয়া কোলে। তিনি জানালেন, “বছর দশ আগেও আমাদের বাড়িতে পাঁচটা ইতুর ঘট পাতা হত। আমার শাশুড়ি, আমি ও তিন মেয়ে। আজ শাশুড়িমা পারেন না। মেয়েদের দুজন চাকরি করে, ছোট মেয়ে কলেজে পড়ে। ফলে ওদের সময় নেই। ইতু শস্যের দেবতা, আমি চাষিঘরের বউ, ফলে আমি এখনও ইতুর ঘট পাতি। আগে গ্রামে বিশাল ‘গামলায়’ ইতুর ঘট পেতে বারোয়ারি ইতুপুজো হত, সেও কয়েক বছর বন্ধ। এ ছবি গ্রামগঞ্জে সর্বত্র।”
কালের নিয়মে হারিয়ে যেতে বসেছে অনেক লোকপুজো, তাকে ঘিরে লোকউৎসব। আগামী প্রজন্ম হয়তো এসব রীতি জানবেই না৷ আর সেদিনও হয়তো সেই প্রজন্ম, তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’র ওই লাইনটুকু পড়ে জানতে চাইবে তার অন্তর্নিহিত অর্থ। তবে হারালেও, কিছু কিছু থেকেই যাবে। যা আমাদের লোকসংস্কৃতির ধারাকে সমৃদ্ধ করবে। উন্নয়নের জন্য আধুনিকতা প্রয়োজন। পাশাপাশি লোকসংস্কৃতির ধারাকেও বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। নল সংক্রান্তি, মুষ্টি সংক্রান্তি, ইতু সংক্রান্তিকে ঘিরে যে লোকপুজো, তা আজও লোকসংস্কৃতির ধারাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যদিও সেই ধারায় ভাটার টান স্পষ্ট। তবু লোকসংস্কৃতির গবেষকরা আশাবাদী। তাঁদের মতে যতদিন চাষ থাকবে ততদিন নল সংক্রান্তি, মুষ্টি সংক্রান্তি, ইতু সংক্রান্তি পালিত হবে।