Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

“আমার ভিতরের নারীরা সবাই ক্লান্ত”— বিলকিস বানো ধর্ষণ ও খুন মামলা এবং আমরা

তানিয়া লস্কর

 


বিলকিস, বদাও এবং উন্নাও, এই তিনটি মামলার তুলনামূলক অধ্যয়ন করলে এটা অন্তত স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে অমৃতকালে কীভাবে মহিলাদের সামাজিক অবস্থান ক্রমে অতলে নামছে। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অপরাধীদের সাহস কতটা বেড়ে চলেছে। সুতরাং আমাদেরকে এই চিন্তাগুলো মাথায় নিয়ে লড়ে যেতে হবে। বিলকিস কিংবা উন্নাও-এর পীড়িতার আইনি জয়গুলোর পিছনে লুকিয়ে আছে যে ক্লান্তি সেটাও আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে। এর স্বীকৃতি দিতে হবে। আমাদের এই ক্লান্তিগুলো শুধু মেয়েলি আবেগের কাব্যিক বহিঃপ্রকাশ নয়। বরং আমাদের ক্লান্তিগুলো ভীষণ রাজনৈতিক

 

নারীবাদী জ্ঞানতত্ত্বে শিরোনামে উদ্ধৃত উক্তিটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। নারীবাদী কবি নায়রা ওয়াহিদ তাঁর লেখা কাব্যগ্রন্থ ‘সল্ট’-এ এই শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীদের অস্তিত্বের লড়াই কীভাবে তাদের ভিতরের প্রাণশক্তি শুষে নিয়ে তাদেরকে ক্লান্ত অবসন্ন করে দেয় তারই দলিল হিসেবে যুগ যুগ ধরে উদ্ধৃত হয়ে আসছে এই উক্তিটি। ভারতীয় সমাজব্যবস্থা যাকে উমা চক্রবর্তী ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিকতা’ বলে চিহ্নিত করেছেন সেখানেও যুগ যুগ ধরে এরকমই ঘটে আসছে। তার একটি প্রমাণ হচ্ছে বিলকিস বানো মামলা।

সেই ২০০২-এর ৩ মার্চ তারিখে ঘটেছিল এই জঘন্য ঘটনাটি। বিলকিস বানোকে ৫ মাসের গর্ভাবস্থায় দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে খুনের চেষ্টা করে ধর্মান্ধ এবং রাজনৈতিক মদতে বলীয়ান একদল পুরুষ। তাঁর পরিবারের অন্য ১৪ জনকে খুন করা হয়। এরপর ন্যায়ের লড়াই চলছে আজ দুই দশক। ঘটনার দিন অত্যাচারের পর বিলকিস চৈতন্য হারিয়ে ফেলেন বলে অপরাধীরা ধরে নেয় যে তিনি মারা গেছেন। তাই তাঁকে ফেলে চলে যায় তারা। তিনি ৩/৪ ঘন্টা পর হুঁশ ফিরে পেলে পাশে রাখা একটি পেটিকোট গায়ে জড়িয়ে গ্রামের দিকে হাটা দেন। সেখানে এক আদিবাসী নারী তাঁকে দেখতে পেয়ে আরও কিছু কাপড় দেন। তখন তিনি থানায় গিয়ে এজহার দেন। তিনি প্রায় সব অপরাধীদের নাম বললেও পুলিশ সেগুলো লেখে না এবং তাঁকে গোধরা রিলিফ ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে একজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট জায়ন্তি রবি তাঁর বয়ান লিপিবদ্ধ করেন এবং তাঁর বয়ানের ভিত্তিতে পরিবারের বাকি ৭ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। কিন্তু সে-বছর নভেম্বর মাসে গুজরাত পুলিশ ‘সামারি রিপোর্ট’ জমা দিয়ে বলে যে ঘটনা সত্যি হলেও অপরাধীদের সনাক্ত করতে পারেনি তারা। তাই মামলাটি এখানেই খারিজ করে দেওয়া হোক। আদালত পুলিশের আবেদন না মেনে তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। পুলিশ ২০০৩ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে আবার একই আবেদন জানায়। এবার কোর্ট সেই আবেদন মেনে নেয়। বিলকিস সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন এবং সিবিআই তদন্তের দাবি জানান। ২০০৩-এর ডিসেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্ট সিবিআই তদন্তের আদেশ দেয়। ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে সিবিআই ২ ডাক্তার এবং ৬ পুলিশ সহ মোট ২০ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেয়। এর মধ্যে মামলায় গুজরাতে সরকারি হস্তক্ষেপের সন্দেহ করা হয়। সেজন্য সুপ্রিম কোর্ট মামলাটি মুম্বাইয়ের আদালতে স্থানান্তরিত করার নির্দেশ দেয়। ২০০৮ সালে শেষমেশ মামলায় রায় দান করা হয়। এবং ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২ জন অপরাধী মামলা চলাকালীন মারা যায়। ২০১৭ সালে এই রায়ের বিরুদ্ধে অপরাধীরা মুম্বাই হাইকোর্টে আপিল করে। সিবিআইও আপিল করে ৩ জন অপরাধীর ফাঁসির দাবি জানায়। মুম্বাই হাইকোর্ট আগের কোর্টের রায়কে বহাল রাখে। এরপর আরেক দফা সুপ্রিম কোর্টে আপিল হয় সেটাও মোটামুটি একই থাকে। এর মধ্যে ২০১৭ সালে বিলকিস সুপ্রিম কোর্টে ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়ে আপিল করেন এবং এটাও জানান যে মামলা চলাকালীন তাকে প্রাণের ভয়ে পরিবার-সহ লুকিয়ে থাকতে হয়েছে। এখন তিনি ফিরে যেতে চান তবে এখনও ভয়ে আছেন। সুতরাং তাঁর সুরক্ষা সুনিশ্চিত করে তাঁর জেলায় তাঁকে একটি সরকারি বাসভবন দেওয়া হোক। সুপ্রিম কোর্ট ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের রায়-সহ তাঁর দাবি মেনে নেন। ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো বিলকিস নিজের জেলায় ভোট দেন। এর মধ্যে ২০২২ সালে অপরাধী রাধেশ্যাম শাহ ১৪ বছর কারাদণ্ড ভোগ করার পর গুজরাত হাইকোর্টে সাজা মকুবের দরখাস্ত করে। সেখান থেকে তাকে মহারাষ্ট্র সরকারের কাছে আপিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। শেষমেশ সে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে। সুপ্রিম কোর্ট গুজরাত সরকারকে এই আবেদন বিবেচনা করতে নির্দেশ দেয়। অবশেষে ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট ১১ জন অপরাধীর সাজা মকুব করে তাদেরকে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় আরেক দফার লড়াই। এই সাজা মকুবের বিরুদ্ধে কয়েকটি জনস্বার্থ মামলা দাখিল হয়। সিপিএম নেত্রী সুভাষিণী আলি, সমাজসেবী রূপরেখা বর্মা এবং প্রাক্তন এনডিটিভি সাংবাদিক রেভতি লাল একটি মামলা করেন। তৃণমূল নেত্রী মহুয়া মৈত্র একটি মামলা করেন। এবং বিলকিস নিজেও একটি আবেদন দাখিল করেন। গত ৮ জানুয়ারি সেই আবেদনগুলির শুনানি করে অপরাধীদের ২ সপ্তাহের মধ্যে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। এর মধ্যে জানা গেছে যে ১১ জনের মধ্যে ৮ জন অপরাধীই নিখোঁজ হয়েছেন।

গত ২১ বছর ধরে এই পুরো প্রকরণ চলছে। এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটেছে। বিলকিসকে আইনি সাহায্য করতে এগিয়ে আসা তিস্তা শেতলওয়াড়কেও জেলে যেতে হয়েছে। গুজরাট গণহত্যার নায়করা দিল্লিতে বিরাজ এবং রাজ করছেন। কিন্তু বিলকিস হার মানেননি। তিনি লড়ে গেছেন। অবশেষে ফলাফল কী হল? অপরাধীদের জেল থেকে বেরোনোর পর মালা পরানো হল। গুজরাটের এক বিজেপি বিধায়ক অপরাধীদের পক্ষ নিয়ে বললেন যে অপরাধীদের অনেকেই ব্রাহ্মণ-সন্তান, তাই তারা এরকম কাজ করতেই পারে না। সুপ্রিম কোর্ট মহিলা আইনজীবীকে ধমক দিয়ে আবেগপ্রবণ না হতে আদেশ দিল। আমরা বেশিরভাগ মানুষ বছরের পর বছর ধরে শুধু নীরব দর্শক হয়ে থেকেছি। কিন্তু এছাড়া কীই বা করতে পারি আমরা। বিলকিসের পরে কি আরও এরকম মামলা ঘটেনি? ঘটেছে তো। ২০১৫-তে উত্তরপ্রদেশের বদাওতে দুজন নাবালিকাকে ধর্ষণ করা হয়। সে কেসে সিবিআই ক্লোজার রিপোর্ট দিয়েছে। কোর্ট সে রিপোর্ট ডিসমিস করেছে তাই রক্ষে। এখনও মামলা চলছে। ২০১৭তে উন্নাও ধর্ষণকাণ্ড হয়েছে। অপরাধী কুলদীপ সিং সেঙ্গারের সাজা হয়েছে। কিন্তু চরম মাশুল দিতে হয়েছে ভুক্তভোগীকে। তাঁর বাবা পুলিশ কাস্টডিতে মারা গেছেন। পরিবারের আরও দুজন লোক-সহ তিনি মারা যান কোর্টে যাওয়ার পথে একটি ট্রাক দুর্ঘটনায়। পরে জানা যায় সেটিও অপরাধীরা মিলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সংঘটিত করেছিল। সেও হয়তো কোনওদিন এরকম কোনও আইনের ফাঁক বের করে সাজা মকুব কিংবা অন্য কোনও উপায়ে ছাড়া পাবে। হতেই পারে তো। এই তিনটি মামলার তুলনামূলক অধ্যয়ন করলে এটা অন্তত স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে অমৃতকালে কীভাবে মহিলাদের সামাজিক অবস্থান ক্রমে অতলে নামছে। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অপরাধীদের সাহস কতটা বেড়ে চলেছে। সুতরাং আমাদেরকে এই চিন্তাগুলো মাথায় নিয়ে লড়ে যেতে হবে। বিলকিস কিংবা উন্নাও-এর পীড়িতার আইনি জয়গুলোর পিছনে লুকিয়ে আছে যে ক্লান্তি সেটাও আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে। এর স্বীকৃতি দিতে হবে। আমাদের এই ক্লান্তিগুলো শুধু মেয়েলি আবেগের কাব্যিক বহিঃপ্রকাশ নয়। বরং আমাদের ক্লান্তিগুলো ভীষণ রাজনৈতিক। তাই রাজনৈতিক উপায়েই এর উপশম সম্ভব। সেই রাজনীতিটা শিখতে হবে নতুন যুগের ছেলেমেয়েদেরকে। যত তাড়াতাড়ি আমরা সেটা বুঝতে পারব ততই আমদের ব্যাক্তিগত এবং সামাজিক ‘মুক্তি’ ত্বরান্বিত হবে।


*মতামত ব্যক্তিগত