হিরণ মিত্র
'ডেথ মাস্ক' হিরণ মিত্র-কৃত একটি ইন্সটলেশন, যা গত বছরের আগস্ট মাসে কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি-সংঘটিত "Breaking the Fourth Wall — Rediscovering Brecht: Exploring His Timeless Relevance" নামের একটি অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। এই প্রকল্পের পিছনের ভাবনা নিয়ে হিরণ মিত্র কয়েকটি কথা লিখে দিলেন। সঙ্গে দিলেন সেই ইন্সটলেশনের কিছু ছবি ব্যবহার করার অনুমতি। মানুষের মৃত্যুর পর পূর্ব ভারতের পায়ের আলতা-ছাপ আর পশ্চিমের মৃত্যুমুখোশ, এই দুই আপাত-পরস্পরবিরোধী ভাবনাকে পাশাপাশি বসিয়েছেন হিরণ। উদযাপন করছেন এই বৈচিত্র্য, আর উন্মুক্ত করছেন চেতনার অবগাঢ় ব্যাকরণ
মানুষ চলে যাওয়ার পর এ-দেশে প্রথা আছে পায়ের তলায় আলতা মাখিয়ে ছাপ নেওয়ার। তেমন ও-দেশে রীতি মুখের ছাপ বা মুখোশ তুলে রাখা।
কথা হতে পারে, মৃত্যু কেন? মৃত্যু কী? মানুষ মরে কেন? মরার আগে পর্যন্ত কী আমাদের পরিচয়? প্রাচ্যে মৃত্যুকে জীবনেরই একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে ধরা হয়। মৃত্যু শুধুই একটা পথ। এক পার থেকে অন্যপারে যাওয়ার পথ।
পূর্ব ভারতে শোকের ভাষা অত্যন্ত গভীর। আমাদের পা পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের সংযোগস্থাপনের ক্ষেত্র। জীবিতকালে আমরা সম্মান প্রদর্শনের জন্য বয়োজ্যেষ্ঠদের পা ছুঁয়ে প্রণাম করি। তাঁদের ব্যক্তিত্ব ও প্রজ্ঞার সামনে যেন নতিস্বীকার করি। মানুষ মারা গেলে তাঁর পায়ের ছাপ ধরে রাখি। যিনি চলে গেলেন, তিনি যেন মৃত্যুর পরেও আমাদের সঙ্গে আছেন। আমাদের সঙ্গে চলছেন।
অন্যদিকে মৃত্যুমুখোশ, বা ডেথ মাস্ক, যেন মৃত মানুষের অনন্য স্বরূপ। যিনি গেলেন, যাওয়ার সময় রেখে গেলেন শুধুমাত্র তাঁর চেহারার একটা মৃত খোলস।
পূর্ব ভারতে শিল্প আমাদের সামাজিক যৌথযাপনেরই একটা অন্যতম পরিণতি। জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে যেমন কোনও বিচ্ছেদ নেই, তেমনই আমাদের একজনের সঙ্গে অন্য কোনওজনের মধ্যকার মানবিক যোগটুকুও আদতে অবিভাজ্য। মৃত্যুকে ঘিরে আমাদের আচার সামুদয়িক, সদা-পরিবর্তনশীল এবং স্পন্দমান। তাকে কেবলমাত্র লোকায়তে বা সমাজতান্ত্রিক ঘেরাটোপে আটকে ফেলা যায় না।
শিল্পসৃষ্টিকে চিরটাকাল এবং এখনও একটা একাকী, নিভৃত সাধনা হিসাবে ভাবা ও ভাবানো হয়। সমাজবদ্ধতার নাড়ি কেটে, জীবাণুমুক্ত হয়ে যেন শিল্পচর্চা করতে হবে। শিল্প যেন দেবী। তাকে পূজা করা যায়, কিন্তু স্পর্শ করা যায় না। মানুষের থেকেও তার মূল্য অধিক, কারণ সে একটা উঁচু বেদিতে আসীন। এ-সবের বিরোধিতা করাই আমার উদ্দেশ্য।
শিল্প আসলে ছন্নছাড়া, অসংলগ্ন সময়ের চেহারা। সে একমাত্রিক। আমি তাকে বহুমাত্রিক করলাম।
তার সামনে ও পিছনে রাঙিয়ে দিলাম। সে জাতচ্যুত হলো। শ্রেণি ও শৃঙ্খলচ্যূত হল। তারপর তার সর্বাঙ্গে ফোকর কাটা হল। অর্থাৎ সে আর নিরেট দেওয়াল রইল না। প্রায় স্বচ্ছ হল। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়ে সে পবিত্র হল। তার মধ্যে বহুস্তরীয় অর্থ আর রূপক প্রকাশ পেল। জীবনের অর্থ, জীবনের রূপক।
এই কারণেই শিল্পের একটা অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে নেই। অনেক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেওয়াই বরং তার কাজ। আসলে শিল্প একজন অভিনেতার মতন। তার সংলাপ আছে। ক্রোধ আছে। ভালবাসা আছে। আবেগ আছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে। সে একসঙ্গে কর্কশ ও মোলায়েম। সে এক খোলা মঞ্চে সচল, সফল। ব্রেশটকে নিয়ে এই আমার বিচিত্র সংলাপ। বাস্তব ও অবাস্তবের খেলা। ঘোর নয়, মোহ নয়। সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করা। তুমি যে তুমি, একই সঙ্গে আমিও। মুখোশ খুলে এবং পরে। তুমি একই সঙ্গে মূক ও বধির। একই সঙ্গে দৃষ্টিহীন ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তুমি একই সঙ্গে নিশ্চল ও সচল। তুমি বিচিত্র। তুমি ব্যাখ্যার অতীত। তুমি সম্পূর্ণ বোধ্য।
মানুষ ব্রেশট এই বাদানুবাদটা দাবি করছেন।