Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

“আমি ব্রেশটের সঙ্গে দেখা করার জন্য ঘুরছিলাম”

হাবিব তনভীর

 

ভারতীয় নাট্যমঞ্চের প্রবাদপুরুষ হাবিব তনভীর শতবর্ষ ছুঁলেন। জনপ্রিয় হিন্দি ও উর্দু নাট্যকার, নাট্যপরিচালক, নট হওয়ার পাশাপাশি হাবিবের গুরুত্বপূর্ণ অবদান তিনি ছত্তিশগড়ের গ্রামীণ ভাষা ও লোকসংস্কৃতিকে নিজের নাট্যরীতিতে সম্পৃক্ত করেছেন, এবং ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের দরবারে তাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। চিরকাল প্রান্তিক মানুষের জীবনের সুখদুঃখ তাঁর নাটকে মূল জায়গা অধিকার করে আছে। গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজার মতো আমরা হাবিবকে স্মরণ করছি তাঁরই স্মৃতিকথা ‘It Must Flow – A Life in Theatre’ থেকে নির্বাচিত অংশের অনুবাদের পুনঃপ্রকাশের মাধ্যমে। ইন্টারনেট সূত্রে প্রাপ্ত মূল ইংরেজি লেখাটিকে সম্পাদনা করেছিলেন আঞ্জুম কাটিয়ালবীরেন দাশ শর্মা। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর জন্য লেখাটির নির্বাচিত অংশ অনুবাদ করে দিলেন সোমরাজ ব্যানার্জি

 

আরও এক বছর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে হিচহাইকিং করে ঘুরতে ঘুরতে আমি নাটক দেখে বেড়াচ্ছিলাম। এছাড়া আরও অনেক কিছুই করছিলাম, যেমন— আঙুরতোলা, সার্কাসে দর্শক বসানো, রেডিওর জন্য লেখা, নাইটক্লাবে গান গাওয়া ইত্যাদি। এভাবে নিজের রোজগারটা কোনওমতে চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছিল। আমার আসল উদ্দেশ্য তো ব্রেশটের সঙ্গে দেখা করা। সেই উদ্দেশ্যেই প্যারিসেও চলে এলাম। সেখানে দেখা হল জঁ ভিলার আর মারিয়া সিসারেসের সঙ্গে। জঁ ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির জাঁদরেল সদস্য আর সেইসঙ্গে একটা কোম্পানির বামপন্থী অভিনেতা ও পরিচালক। খুবই দক্ষ অভিনেতা। মারিয়া ওঁর স্ত্রী। আমি ওঁদের নাট্যোৎসব দেখলাম। আর ওরকম সময়েই অ্যাভিনিয়ঁতে যুব নাট্যোৎসব চলছিল। ফলে সেখানে যাওয়া। সেটা ১৯৫৬ সাল। এদিকে রাহাখরচের জন্য আমার কাছে যথেষ্ট টাকাপয়সা নেই। আছে কেবল ইউথ হোস্টেলে থাকার মতো টাকাটুকু, আর সেইসঙ্গে দিন দশেক চালিয়ে নেওয়ার মতো সংস্থান। প্যারিস একটা দারুণ শহর। এখানে তুমি হয় খুব বিলাসিতায় জীবন কাটাতে পারো, অথবা দারিদ্র্য সইতে রাজি থাকলে সহজেই দিন গুজরান করে নিতে পারো। প্যারিসে দারুণ সময় কাটিয়েছি, তবে ভাষা নিয়ে ওদের নাকউঁচু ব্যাপারটা আমার পোষায়নি। অ্যাভিনিয়ঁতে আমি আঙুর তোলার কাজে লেগে পড়লাম যাতে রোজগারটা হয়, আর উৎসবটা দেখতে পারি। মজুরি হিসেব করে দেখলাম, এখানে ঘন্টার হিসেবে টাকা। এক সপ্তাহেই আমি বড়লোক হয়ে যাব। আমার হাতে তো অঢেল সময়। অনেকক্ষণ ধরে আঙুর তুলতে পারব। অচিরেই আমি বুঝতে পারলাম যে কথাটা বলা সহজ, কাজটা ততই কঠিন। আধঘন্টা কাজ করলেই আমার পিঠে ব্যথা শুরু হত, আর বিশ্রাম নিতে হত। ফলে, মজুরি যতটা ভেবেছিলাম ততটা হচ্ছিল না। বুঝলাম, এটা যত না গায়ের জোরের কাজ, তার চেয়ে বেশি অভ্যাসের। তবুও ভালই টাকা কামিয়েছিলাম, কারণ এই টাকাতেই আমি সেন্ট সেবাস্টিয়ান হয়ে মাদ্রিদ, বার্সেলোনা আর স্পেনের কয়েকটা জায়গায় সপ্তাহখানেক কাটিয়ে আবার নিসে ফিরে আসতে পেরেছিলাম। আরও একটা ভাল এই হয়েছিল, যে এইসব জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে নানান দেশ থেকে আসা অনেক অল্পবয়সি ছেলেমেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেছিল। আমি তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে তাদের ঠিকানা লিখে নিয়েছিলাম যা পরে আমার হিচহাইকিং-এর ক্ষেত্রে খুব কাজে এসেছিল।

নিসে একটা দারুণ ঘটনা ঘটল। লন্ডনে ফিরে যাওয়া বা ট্রেনে করে ত্রিয়েস্তে যাওয়ার মতো যথেষ্ট টাকা আমার কাছে ছিল। কিন্তু সেইসময়ে ইংল্যান্ড থেকে টাকার উপর একটা ইউরোপিয়ান কোটা ধার্য করা হত। ওখানে থাকাকালীন আমার সেই বার্ষিক কোটা শেষ হয়ে যায়। আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা থাকলেও আমি তা তুলতে পারছিলাম না। সেই টাকা ব্যবহার করতে হলে আমাকে লন্ডনে গিয়ে আবার ইউরোপে ফেরত আসতে হত। এই অদ্ভুত নিয়মের জন্য আমি খুব মুশকিলে পড়ে গেলাম। বুঝতে পারছিলাম না আমার লন্ডনে যাওয়া উচিত নাকি ত্রিয়েস্তের দিকে। একজন অস্ট্রেলিয়ানের সঙ্গে দেখা হল, আমি তাকে লন্ডনের একটা চেক অফার করলাম। কিন্তু আমি একেবারে অজানা-অচেনা হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই সে ওটা নিতে রাজি হল না। ইউথ হোস্টেলে তাই আর কোনও টাকা খরচ করলাম না। তখন গরমকাল। সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে বেড়াতে ঠিক করে ফেললাম যে আমি ত্রিয়েস্তেই যাব। আমার খাওয়া-দাওয়া ঠিক করে হচ্ছিল না। কিছু ব্রেড, চকলেট আর চিজ কিনে নিলাম। একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করছিলাম আমি— সৈকতটা বেশ মনোরম লাগছিল। কিন্তু পথচারী আর গণিকারা আমাকে উত্যক্ত করছিল। তাদের বললাম, “দেখুন, আমার এরকম কোনও আকাঙ্ক্ষা নেই, আর যদিও বা থাকে তা পূরণ করার মতো পয়সা নেই।” এই শুনে তারা কেটে পড়ল। কিন্তু তারপরই এক আলজেরিয়ান ছোকরা আমার সঙ্গে আলাপ জমাতে চলে এল—

“আপনি কী করছেন?”
বললাম, “একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করে সময় কাটাচ্ছি। আমার কাছে বিশেষ টাকা নেই।”
সে বলল, “আপনার কাছে কি বিয়ার আছে?”
উত্তর করলাম, “আমার কাছে রাতের খাবার খাওয়ার মতোই পয়সা নেই। আমি তোমাকে কোনও বিয়ার বা কফির টাকা দিতে পারব না। আমার কাছে এই দশ পাউন্ডই শুধু পড়ে আছে।”
“ওহ! আমি কখনও ইংলিশ টাকা দেখিনি। টাকাটা একবার দেখতে পারি? ছুঁতে পারি?” সে টাকাটা স্পর্শ করল, “আমি কি এটাকে একটা স্মারক হিসেবে রেখে দিতে পারি?”
“না তা পারো না মোটেই। ওই টাকাটুকুই আমার আছে যা আমাকে উপোস করে থাকার হাত থেকে বাঁচাতে পারে।” এই বলে আমি টাকাটা নিয়ে নিলাম।
“আপনি কী দিয়ে লিখছেন? ওটা কী পেন?”
“এটা মঁ ব্লা।”
“আমি কি সেটা দেখতে পারি? আর রেখে দিতে পারি স্মারক হিসেবে?”
বললাম, “দ্য নার্ভ। এটা দিয়েই আমি লিখি। তাছাড়া এই পেন খুব দামি। আমি এটা এনেছি কারণ উর্দু লেখার জন্য মোটা নিবের পেন দরকার হয়।”
কিন্তু ছেলেটা আমাকে চাপ দিতে লাগল। তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি গান গাইতে পারো?” ও উত্তর করল, “হ্যাঁ।”
বললাম, “একটা গান শোনাব, শুনবে?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি কি তাহলে আমাকে একটা আলজিরিয়ান গান শোনাবে?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে আমিও তোমাকে একটা ভারতীয় গান শোনাব।”

তখন সে আমাকে একটা আলজিরিয়ান গান গেয়ে শোনাল। আমার বেশ ভালই লাগল। গানে একটা চমৎকার আনন্দের সুর ছিল। আমি গানটা শিখে নিলাম। তারপর তাকে একটা ছত্তিশগড়ের লোকগান শোনালাম। ওরও সেটা বেশ পছন্দ হল। তারপর কিছুটা সময় ধরে আমরা পরস্পরের গানদুটি লিখে নিলাম, শিখেও নিলাম। জানি না তার এখনও গানটা মনে আছে কিনা। এভাবেই রাত গড়িয়ে গেল। ভোর চারটেয় আমার ট্রেন। আমি তার হাত ঝাঁকিয়ে বললাম, “তাহলে আমরা দুজনেই একে অপরের থেকে একটা করে স্মারক পেলাম। আর এতে কারও কোনও ক্ষতি তো হলই না, বরং দুজনেই সমৃদ্ধ হলাম। বিদায়।”

 

আমি ত্রিয়েস্তে চলে এলাম, আর সেখান থেকে আমার যাকে বলে ওডিসি শুরু হল। বেলগ্রেড, জাগ্রেব, দুবরোভনিক, প্রায় পুরো য়ুগোশ্লাভিয়াটাই ঘুরে ফেললাম। টাকা রোজগারের জন্য রেডিও বা খবরের কাগজে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছিলাম। ওরা সেগুলোকে অনুবাদ করে প্রকাশ করত। হাঙ্গেরি গেলাম। বুদাপেস্টে। সেখানে গিয়ে আমার সেই অ্যাভিনিয়ঁর বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। অনেকগুলো নাটক দেখলাম সেখানে। রেডিওর জন্য আগের লেখাগুলোই আবার লিখলাম। কিন্তু একটা বিষয়ের জন্য সমস্যা হচ্ছিল। ওই সময়ে একটা নিয়ম ছিল— বর্ডারের বাইরে যে-কোনও জিনিসের জন্যই শুধুমাত্র হার্ড কারেন্সি যেমন পাউন্ড, ডলার, স্টার্লিং, মার্কস ইত্যাদি ব্যবহার করা যেত। আর বর্ডারের ভেতরে শুধুমাত্র স্থানীয় টাকাই চলত। আমি যেহেতু শুধু স্থানীয় টাকাই রোজগার করছিলাম সেগুলো হার্ড কারেন্সিতে পরিণত করার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। ওদিকে লন্ডনের ব্যাঙ্কেও আমার তখন কোনও অ্যাক্সেস নেই। ফলে আমি বুদাপেস্টে আটকা পড়ে গেলাম। যেখানে এক সপ্তাহ থাকব ভেবে ছিলাম, সেখানে আমাকে তিনমাস বুদাপেস্টে কাটাতে হল। একটা সময় এল যখন আমার আর কিছু করার ছিল না। লেখার মতো কোনও বিষয় পাচ্ছিলাম না। তবে ততদিনে ছাত্র, থিয়েটারের লোক, সাংবাদিক, রেডিওকর্মী— এরকম অনেকের সঙ্গেই আমার আলাপ হয়ে গেছিল। তার মধ্যে একজন ছিলেন ইতালা বেকেস। তিনি একাধারে একজন সুগায়িকা, নৃত্যশিল্পী, অভিনেত্রী ও মাইম আর্টিস্ট। তাঁর মাথা থেকেই একটা বুদ্ধি বেরোল। যদি আমরা একটা কোনও নাইটক্লাবে একটা ইন্টারেস্টিং প্রেজেন্টেশন করতে পারি, তবে সেটা এখানকার কোনও নাইটক্লাবের চেইন নিয়ে নিতে পারে। বুদাপেস্টে সেইসময়ে প্রচুর নাইটক্লাব আর পানশালা ছিল। সেখানে উৎকৃষ্ট মানের ওয়াইন পাওয়া যেত, চমৎকার দেখতে জিপসি, সঙ্গীত, গিটারবাদক সব মিলেমিশে বেশ সুখকর ও আরামদায়ক একটা পরিবেশ তৈরি হত। ফলে আমি রাজি হয়ে গেলাম, ভাবলাম, দেখাই যাকয়। ইতালা, ওর ভাই আর আমি মিলে একটা আইডিয়া বার করলাম, খুব সহজ আইডিয়া— আমরা সিনেমা হলে একটা পশ্চিমি ছবি দেখতে গেছি। লম্বা লাইন। শেষে জানতে পারলাম হল ভর্তি হয়ে গেছে, তাই আমরা আর ভেতরে যেতে পারব না। হতাশ হয়ে আমরা কল্পনা করতে শুরু করলাম ভেতরে কী কী চলছে। ইতালা কয়েকটা মাইম করল, আমি ভারতীয় গান গাইলাম। এইরকম করে আমরা ২০-২৫ মিনিটের একটা পিস বানিয়ে ফেললাম। একটা নাইটক্লাবে সেটা প্রদর্শন করা হল। এবং আমাদের প্রচেষ্টা সফল হল। আমি প্রচুর টাকা রোজগার করলাম, এত টাকা, যা আমার কল্পনাতেও আসেনি। কিন্তু তবুও আমার সমস্যা মিটল না।

তারপর, স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিস্লাভা থেকে ভ্যানে একটা পাপেট থিয়েটার এল। আমি রোজ সেখানে যেতাম। কী অসাধারণ শিল্পী ছিলেন তাঁরা! তাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তখন হঠাৎ আমার মনে হল এঁরাও তো ব্রাতিস্লাভায় ফিরে যাবেন। ওঁদের জিজ্ঞেস করলাম কীভাবে এটা করা সম্ভব। তাঁরা উপায় বাতলে দিলেন। এই ঘটনার আগেই আমি হাঙ্গেরিতে রাষ্ট্রদূত রহমানের সঙ্গে দেখা করেছিলাম— উনি আগ্রার মানুষ, চোস্ত উর্দুতে কথা বলতেন। এর আগে একবারই আমার সঙ্গে রহমানের দেখা হয়েছিল, একটা থিয়েটারে, সিতারা দেবী সেখানে কত্থক নেচেছিলেন, বিলায়েত খান সেতার বাজিয়েছিলেন। খুবই অল্প সময়ের জন্য সেখানে আমাদের দেখা হয়েছিল, আর আমাকে তখন কেউই চিনত না। তাই আমার সমস্যা নিয়ে কথা বলার জন্য আমিই হাজির হয়েছিলাম ওঁর অফিসে। আমার সমস্যা শুনে উনি খুব অকপট আর অফিসিয়াল উত্তর দিয়েছিলেন— “আপনার জন্য আমরা একমাত্র একটা কাজই করতে পারি, আপনার ফ্রিতে ভারতে ফেরবার ব্যবস্থা করে দেওয়া। তবে তার জন্য আমরা আপনার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে নেব যেটা সম্ভবত আপনি আর কখনও ফেরত পাবেন না। সেজন্য আপনাকে প্রথমে নিজেকে সর্বস্বান্ত ঘোষণা করতে হবে। একমাত্র এভাবেই এমব্যাসি আপনাকে সাহায্য করতে পারে।” আমি বলেছিলাম, “না। এটা আমার জন্য অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে।” তবে সেই ভ্যান আমাকে সাহায্য করেছিল।

এবার আমার আর একটা সমস্যা এসে দাঁড়াল। হাঙ্গেরিয়ান টাকাগুলো নিয়ে আমি কী করব! চেকোস্লোভাকিয়াতে এর কোনও কার্যকারিতা নেই। আর সেই ১৯৫৬ সালে ক্যামেরা বা এমন কোনও গ্যাজেটও ছিল না যাতে বিনিয়োগ করা যায়। হাঙ্গেরি সে-সময়ে পুরোপুরি একটা কৃষিপ্রধান দেশ। এমনকি কেনার মতো ভাল জামাকাপড়ও পাওয়া যেত না। তাই আমি ঠিক করলাম আমার সব বন্ধুদের— ছাত্র, সাংবাদিক, অভিনেতা ইত্যাদি নিয়ে ততদিনে একটা বড় গ্রুপ তৈরি হয়ে গিয়েছিল— একটা বড় কোনও হোটেলে একটা ওয়াইন পার্টিতে নিমন্ত্রণ করব। হাঙ্গেরির সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও দামি ওয়াইনের নাম ইংরেজিতে আক্ষরিক তর্জমা করলে দাঁড়ায় ‘অক্সব্লাড’। আমরা ওয়াইন আর নৈশভোজ খেয়ে সব টাকা উড়িয়ে দিলাম। এরা সবাই আমার জন্য যা করেছে, তার জন্য এটা হল আমার তরফ থেকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন।

আমি ব্রাতিস্লাভাতে আসার তিনদিন পরেই হাঙ্গেরি থেকে এক বিপুল গণনিষ্ক্রমণের ঘটনা ঘটল। আমি জানতে পারলাম যে বিপ্লব ঘটে গেছে। সোভিয়েত হস্তক্ষেপ করেছে। আমি যদি আর কিছুদিন সেখানে থাকতাম, তাহলে আরও কয়েক মাস সেখানেই আটকা পড়ে থাকতে হত!

ব্রাতিস্লাভা থেকে আমি প্রাগে গেলাম। সেখানে অনেক নতুন বন্ধু হল, কয়েকটা চেক গান শিখলাম আর সেই একই কাজের পুনরাবৃত্তি করে যেতে লাগলাম— সেই একই আর্টিকেল লেখা। অনেক নতুন নাটক দেখলাম। দেখলাম রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’-এর উপর নির্মিত একটা চমৎকার পাপেট শো। অনেক নামকরা ডিরেক্টরের তৈরি অসাধারণ কিছু মিউজিক্যালও দেখা হল। দেখলাম জাঁ লুই ব্যারল্টকে, যিনি মার্সেল মার্সেও-এর আগের সময়ের একজন মহান মাইম শিল্পী ছিলেন, ছিলেন এক দুর্ধর্ষ অভিনেতাও। তাঁর চমৎকার আত্মজীবনীটিতে তিনি উল্লেখ করেছেন যোগার মতো ইজিপসিয়ান বুক অফ ডেড-ও তাঁকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি আরও লেখেন যে একটা বিড়াল যেভাবে তার শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে তার শক্তি সঞ্চয় করে রাখে, অভিনেতারাও অনেকটা সেরকমই। লিপিবদ্ধ করেন তাঁর যৌবনের অভিজ্ঞতা যখন একটা শো শেষের পর তিনি স্টেজে ঘুরে বেড়াতেন এবং ভলপোনের বিছানায় নিজেকে খুঁজে পেতেন, একা, আশেপাশে কেউ নেই— গোটা রাত্তিরটা তিনি স্টেজের উপর ভলপোনের বিছানায় কাটিয়ে দিতেন। তিনি গ্রিজপেইন্টের গন্ধ খুব ভালবাসতেন। হ্যাঁ, ইনিই ছিলেন ব্যারল্ট।

 

প্রাগ থেকে ট্রেনে কোনওমতে ব্যবস্থা করে অবশেষে আমি বার্লিনে এলাম। কিন্তু মাত্র তার কয়েক সপ্তাহ আগেই ব্রেশট প্রয়াত হয়েছেন। বিষয়টা আমার কাছে খুব হৃদয়বিদারক। কিন্তু তাঁকে না পেলেও তাঁর সব সৃষ্টিই আমি সেখানে পেলাম, আর দেখেও ফেললাম সব। দেখলাম দুই বিখ্যাত পরিচালক একসঙ্গে মহড়া দিচ্ছেন, দুজনেই ব্রেশটের শিষ্য। মহান অভিনেতা, ব্রেশটের জামাই এক্কেহার্ডকেও সেখানে পেলাম। তিনি এখনও ওদের শ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের মধ্যে অন্যতম। অসাধারণ অভিনেতা ও গায়ক আর্নস্ট বুচ মাদার কারেজ নাটকে রাঁধুনি হয়েছিলেন। আমি আট মাস বার্লিনে ছিলাম। ওখানে সব অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে আলাপ করেছি। তাঁদের ক্যান্টিনে গেছি, অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। দেখেছি ককেশিয়ান চক সার্কেল, কিছু চাইনিজ একাঙ্ক নাটক, মাদার কারেজ। শুধু গুড উইমেন অফ সেজুয়ান-টা দেখা হয়নি, কারণ এটা সে-সময়ে ওদের নাট্যসম্ভারে ছিল না।

এলিজাবেথ হপ্টমান আর হেলেন উইজেল-এর সঙ্গেও অবশ্যই দেখা করেছিলাম। তিনি মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন। অনেক নতুন নতুন বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল। প্রথমে আমি পুরো পূর্ব জার্মানি ঘুরলাম। তখন অবশ্য পূব-পশ্চিমে কোনও ভাগ ছিল না, কোনও দেওয়ালও ছিল না। এমন অনেক মানুষ ছিলেন যারা পশ্চিমে থাকতেন এবং পূর্বে কাজের জন্য যেতেন। এরকমই একজন ছিলেন হানিং শ্রোয়েডার। তিনি পূর্বের এক খ্যাতনামা ফিল্ম কোম্পানির সঙ্গীতকার ছিলেন। পশ্চিম জার্মানির কার্মাটিনওয়েগের ক্রুম ল্যাঙ্কে তাঁর বাড়ি ছিল। আমি রাত কাটাতাম ফুটপাথে, না-হয় কোনও ক্যান্টিন বা কোনও ক্লাবে। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরেও বেড়াতাম। রোজমেরি ম্যাগডেফ্রাউ ছিলেন বার্লিনের অনসম্বলের এক রেপার্টরির একজন ছোটখাটো অভিনেত্রী। তার অনেক বন্ধুবান্ধবের মধ্যে একজন হল শ্রোয়েডারের কন্যা নীল, যে মাঝে মাঝে এসে ওর সঙ্গে দেখা করে যেত। আমি তখন একটা থিয়েটার জার্নালের জন্য লিখতাম। সাম্যবাদ নিয়ে আমাদের মধ্যে জোরদার রাজনৈতিক আলোচনা হত। আমার বন্ধুবৃত্তের মধ্যে, সাংবাদিক বা অভিনেতা মহলে যারা বামপন্থী ছিল, তারা ইতিমধ্যেই শাসকের বিরুদ্ধে ভীষণভাবে সরব হয়ে উঠেছিল। একদিন নীল আমাকে তার মা-বাবার কাছে নিয়ে গেল এবং আমাকে একজন ভারতীয় বন্ধু হিসেবে পরিচয় করাল। এইভাবেই নীলের বাবা হানিং আর মা কোরার সঙ্গে আমার সঙ্গে পরিচয় হল। কোরাও কাজের সূত্রে গানবাজনার সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন, কিন্তু অন্য বিষয়ে— নোটেশন, তত্ত্ব আর লেখালেখি। হানিং আমাকে তাদের চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরটা ছোট্ট, সুন্দর আর আরামদায়ক। আমি সকালে উঠে ওদের সঙ্গে জলখাবার খেয়ে পূর্বের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ওয়েস্ট বার্লিনে আমার ইতিমধ্যেই অনেক নাটক দেখা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু থিয়েটারের শ্রেষ্ঠ কাজগুলো সেইসময় পূর্বেই হচ্ছিল। আর পশ্চিম থেকে, এমনকি সারা বিশ্ব থেকে লোক সেখানে নাটক দেখতে যেত। তবে, এই পরিবার, শ্রোয়েডার আর ওই চিলেকোঠার ঘরটা— যেখানে আমি ম্যান হু কেম টু ডিনার-এর মতো গিয়ে হাজির হয়েছিলাম— আমার খুব ভাল বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। আমি তারপর যতবার বার্লিনে গিয়েছি, এমনকি এখনও, ওই চিলেকোঠার ঘরটা আমার জন্য সবসময় খোলা থেকেছে। সেই বন্ধুত্বও এখনও অটুট রয়েছে। হানিং এই দু-এক বছর হল প্রয়াত হয়েছেন— ৯০-এর কোঠায় বয়স হয়েছিল ওঁর। কোরার বয়স ৯৬— এখনও দিব্যি সক্রিয় আছেন। কিছুদিন আগে পর্যন্তও সাইকেল চালিয়ে কেনাকাটা করতে যেতেন কিন্তু এখন আর পারেন না। এখন লাঠি নিয়ে হাঁটার চেষ্টা করেন। কিন্তু এখনও দিব্যি একাই নিজের দেখভাল করে যাচ্ছেন। নীল এখন পশ্চিম বার্লিনের অ্যাকাডেমি অফ মিউজিক-এর একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। রোজি ম্যাগডেফ্রাউ-এর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটাও এখনও অটুট আছে।

আমি গোটা জার্মানিতে ঘুরে বেড়ালাম— হিচহাইকিং করে করে নুরেমবার্গ, হেইডেলবার্গ, মিউনিখ, ভিয়েনা সব শহর দেখলাম। সেইসময়ে খোয়াজা আহমেদ আব্বাস মস্কোতে ছিলেন। উনি আফানাসি নিকিতিনকে নিয়ে একটা ছবি বানাচ্ছিলেন। নিকিতিন ভারতে এসেছিলেন এবং সেই নিয়ে তাঁর একটি ভ্রমণকাহিনি রয়েছে, হিন্দিতে যার নাম পরদেশি। ছবিটিতে অভিনয় করছিলেন রুশ অভিনেতা স্ট্রেজেনভ এবং তাঁর বিপরীতে ছিলেন নার্গিস। আব্বাস আমার খোঁজ করছিলেন। উনি লন্ডনের দূতাবাসে একটা টেলিগ্রাম করে জানতে পারেন যে আমি ইউরোপের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছি। আব্বাস সবকটা এমব্যাসিতেই খোঁজ লাগলেন। বার্লিনে আমি একটা টেলিগ্রাম পেলাম যেখানে আমাকে প্রত্যুত্তর পাঠাতে বলা হয়েছে। আমি উত্তর দিতে উনি আমাকে একটা প্রিপেইড রিটার্ন ফ্লাইটের টিকিট পাঠালেন। আমি বার্লিন থেকে মস্কো পাড়ি দিলাম। সেখানে মাস তিনেক কাটালাম। মসফিল্ম স্টুডিওতে ডিরেক্টর অফ ডাবিং হিসেবে স্ট্রেজেনভের কণ্ঠ ডাব করলাম। মস্কো থিয়েটার দেখলাম— দেখলাম মালি থিয়েটার, দ্য বলশই থিয়েটার, গোর্কি থিয়েটার, মেয়ারহোল্ডস থিয়েটার। বন্ধুত্বও হল অনেক। তারপর আবার বার্লিনে ফিরলাম। তখন আমি দিল্লি ফিরে যাওয়ার জন্য টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করছিলাম। মস্কোতে রোজগার করা টাকায় আমার সে-সমস্যা মিটল। তখন যেন হঠাৎ করেই হাতে বেশ কিছু টাকা এসে গেল। আবার আমি ওয়ারশ-তে গেলাম, তারপর বেলজিয়াম, হল্যান্ড, ডেনমার্ক— প্রায় গোটা ইউরোপ।

 

বিষয়টা হল, এই সব ভ্রমণের পেছনে নাটক দেখা ছাড়াও আমার একটা লক্ষ্য ছিল। আমি সংস্কৃত ক্লাসিক মৃচ্ছকটিক, দ্য লিটল ক্লে কার্ট প্রোডিউস করার চেষ্টা করছিলাম। আমি বেলজিয়াম, জার্মানি, এমনকি পোল্যান্ডেও এই ভাবনাটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। পোল্যান্ডে আমি ওয়ারশ গিয়েছি আর সেখান থেকে ক্রাকো। ক্রাকোতে আমার দেখা হয় ক্রিস্টিনা স্কুসঝাঙ্কার সঙ্গে। উনি একটা খুব ভাল থিয়েটারের প্রধান ছিলেন। আমার আইডিয়া শুনে আগ্রহ নিয়ে বললেন, “যতদিনে তুমি মস্কো থেকে ফিরে আসছ, আমরা নতুন অনুবাদটা তৈরি করে ফেলব।” ওঁদের একটা পোলিশ অনুবাদ ছিল কিন্তু সেটা একটু সেকেলে। ওয়ারশতে আমার মিকোলেইটিস বলে একজনের সঙ্গে দেখা হল। উনি এটার অনুবাদে আগ্রহ দেখিয়ে কাজটা নিলেন। আমি ওয়ারশতে ফিরে এসে দেখলাম অনুবাদ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তখন হঠাৎ তিনি বলে বসলেন, “আমি এটার কো-প্রোডিউসার হতে চাই।” ওঁর থিয়েটারের কোনও অভিজ্ঞতাই ছিল না— এতটুকুও না, কিন্তু একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল যে, ওঁর শুধু অনুবাদকের নয়, বরং কো-প্রোডিউসারের মর্যাদা পাওয়া উচিত। সেইসঙ্গে উনি টাকার সিংহভাগ দাবি করেছিলেন যেটাতে স্কুসঝাঙ্কা বা আমার মত ছিল না। এ তো পুরোদস্তুর প্রতারণা। ফলে কাজটা হল না। তবে আমি ওয়ারশতে টেলিভিশনের জন্য দ্য লিটল ক্লে কার্ট-এর একটা ছোট দৃশ্য প্রোডিউস করেছিলাম। জার্মানিতে আমি হানিং-এর জন্মস্থান রোস্টকে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে আমি ওঁর লোকজনের সঙ্গে দেখা করেছিলাম, নাটক দেখেছিলাম। একজন পরিচালক আমার প্রস্তাবে আগ্রহ দেখালেন। তিনি বললেন, “হ্যাঁ, কেন নয়? কিন্তু শুধু একটা নাটক কেন? তুমি এখানে পরিচালকের দায়িত্ব নাও আর কাজ করতে থাকো।”

কিন্তু ইতিমধ্যেই আমরা এখানে তিন বছর কেটে গেছে আর আমার দিল্লি যাওয়ারও সময় হয়ে এসেছে। তাই তিনি বললেন, “ঠিক আছে। বছরখানেকের মধ্যে তুমি এখানে ফিরে এসে নাটকটা করো।” কিন্তু আমার কাছে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে সাংস্কৃতিক দিক থেকে আমার জায়গা ভারতই। যখন তুমি শব্দ আর সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করতে চাইবে, তখন নিজের ভূমিকেই তোমার আশ্রয় করা উচিত। কারণ, সেখানেই তুমি সবচেয়ে বেশি সৃজনশীল হয়ে উঠতে পারো। তাছাড়া ওখানে এর মধ্যেই যথেষ্ট মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল, আমি তাদের পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। এখন আমি উপলব্ধি করতে পারছিলাম যে এবার আমার সময়টা পেরিয়ে যাচ্ছে। প্রায় তিন বছর বিদেশে কাটানোর পর দেশে ফিরে মানিয়ে নেওয়াটা মানুষের কাছে কতটা কঠিন হয়ে পড়ে, সেটা দেখার অভিজ্ঞতাও আমার ছিল।