সুব্রত রায়
দিনোকৃষ্ণ যে অবস্থান থেকেই ধর্মের সমালোচনা করুন না কেন, সে-জন্য তাঁকে আক্রান্ত হতে হবে কেন, এবং যদি আক্রান্ত হন, তো আমাদেরকে চুপ থাকতে হবে কেন? এবং, দিনোকৃষ্ণের ওই ধর্ম-সম্পৃক্ত ‘অবিশুদ্ধ’ সমালোচনাই যদি শারীরিক আক্রমণ ডেকে আনতে পারে, তাহলে সত্যিকারের যুক্তিবাদীদের তরফে ‘বিশুদ্ধ’ সমালোচনার পরিণতি কী হতে পারে?
A faith which cannot survive collision with the truth is not worth many regrets.
—ARTHUR C. CLARKE
সূর্যপদ নস্কর ওরফে দিনোকৃষ্ণ ঠাকুর (দীনকৃষ্ণ?) বিদ্বৎমহলে হয়তো খুব বেশি পরিচিত মানুষ নন। তিনি একজন ধর্মীয় কথক ও কীর্তনশিল্পী, গ্রামেগঞ্জে সঙ্কীর্তন করে বেড়ান। মূলত প্রান্তিক মানুষজনই তাঁর কীর্তনের শ্রোতা। তবে, সঙ্কীর্তনের মাঝেমধ্যে গুঁজে দেওয়া তাঁর বার্তাগুলো কিন্তু বেশ আনকোরা নতুন। এই বার্তার কারণেই তিনি ইদানীং বেশ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছেন, সমাজমাধ্যমে প্রায়শই ভেসে উঠছে তাঁর কথকতার দৃশ্য-শ্রাব্য অংশবিশেষ। কীর্তন-বাসরে তিনি রাধাকৃষ্ণের লীলা বর্ণনা করেন বটে, তবে তার চেয়ে বেশি মনোযোগ দেন সামাজিক দূরাচার, কুসংস্কার, অজ্ঞতা, ধর্মান্ধতা ইত্যাদি বিষয়ে শ্রোতাদের কাছে তাঁর নিজস্ব মতামত তুলে ধরতে। ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থগুলির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করেন, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের ফাঁকফোকরগুলির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, পৌরাণিক চরিত্রগুলিকে অবাধে কাটাছেঁড়া করেন, স্বর্গ-নরক নিয়ে নিদারুণ ঠাট্টা-তামাশায় মেতে ওঠেন। ধর্মের কারণেই পৃথিবী আজ সবচেয়ে বেশি অশান্ত, কোনও ধর্মই নারীকে সম্মান দেয়নি কিংবা ধর্মগ্রন্থগুলি মিথ্যা কাহিনিতে ভরপুর— এরকম বাক্য হামেশাই তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে। ব্রাহ্মণ্যবাদকে প্রবলভাবে আক্রমণ করেন। জাতপাতপ্রথার বিরুদ্ধে হয়ে ওঠেন খড়্গহস্ত। বাবাজি-মাতাজি-পীর-ফকির-সন্তরা কীভাবে মানুষকে ঠকাচ্ছে, কীভাবে ধর্মীয় রীতিনীতি-আচারবিচারকে সামনে রেখে বামুন-পুরুতরা উদরপূর্তি করছে, হরিধ্বনির ফাঁকে ফাঁকে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সেসব বৃত্তান্ত তুলে ধরতে তিনি কুণ্ঠিত হন না। তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে চার্বাকদের কথা, রামমোহন-বিদ্যাসাগরের কথা, মানবতার কথা, গণতন্ত্রের কথা, বিজ্ঞানের কথা, এমনকি, খণ্ডিতভাবে হলেও বিজ্ঞানমনস্কতার কথাও। বয়স্ক পিতামাতা কিংবা আর্তের সেবা না করে, সাংসারিক ও সামাজিক দায়দায়িত্ব পালন না করে কোনও ধর্ম পালন করা যায় না— ধড়িবাজ ধর্মগুরু ও সংসার থেকে পলায়নকারী সাধুসন্তদের নিশানা করে এ কথা বলতেও ভোলেন না তিনি। অবাক হওয়ার মতো কথা এটাই যে, ধর্মবিশ্বাস ও রীতিনীতি নিয়ে এইসব খোঁচার পরেও কীর্তনীয়া হিসেবে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কমেনি, বরং অনেক ধার্মিক মানুষ অনেক ব্যয় স্বীকার করেও নাকি তাঁর কীর্তন ও কথকতা শুনতে চাইছেন।
দিনোকৃষ্ণের বাচনশৈলীটি মেঠো, কখনও কখনও তাতে রুচিশীলতারও কিঞ্চিৎ হানি ঘটে। তাঁর যুক্তিগুলিও খুব যে পরিশীলিত বা নিখুঁত, এমনটাও বলা কঠিন। অর্থাৎ একজন যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ যে পদ্ধতি ও ভাষায় ধর্মের সমালোচনা করেন, দিনোকৃষ্ণের আঙ্গিকটি তা থেকে কিছুটা ভিন্ন। তাঁর দর্শক-শ্রোতাদের অধিকাংশের কাছেই এটি হয়তো খুব কিছু দোষের নয়, তাঁর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা তেমন ইঙ্গিতই দেয়। হয়তো-বা তাঁর শ্রোতাদের কিয়দংশ ক্রমশ তাঁর চিন্তার শরিকও হয়ে উঠছিলেন। অবশ্য, জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শত্রুসংখ্যারও বৃদ্ধি ঘটছিল। শেষোক্ত এই বৈরিতা নিছক পেশাগত ও প্রতিযোগিতামূলক ছিল না। কিছুকাল ধরে তিনি হুমকি ফোন পাচ্ছিলেন। হিন্দু ধর্ম ও রীতিনীতির বিরুদ্ধে কোনও রকম সমালোচনা থেকে তাঁকে নিরস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। সম্প্রতি নিজ বাসগৃহে কতিপয় উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে তিনি নিগৃহীত হয়েছেন, তাঁকে অপহরণ করে পার্শ্ববর্তী এক হনুমান মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হয়তো তাঁকে মারধর করে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্যই এক সুচারু চিত্রনাট্য রচনা করা হয়েছিল, কিন্তু পুলিশের তৎপরতায় তা ঘটতে পারেনি। বিভিন্ন গণতন্ত্রপ্রেমী সংগঠন সময়মতো এগিয়ে এসেছে। পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করে দোষীদের গ্রেফতার ও তাঁর নিরাপত্তার দাবি জানানো হয়েছে।
দিনোকৃষ্ণের নিগ্রহকারীরা রামচন্দ্রের নামে জয়ধ্বনি দেওয়ার পাশাপাশি সরোষে জানিয়েছে যে, তিনি হিন্দু ধর্মের অবমাননা করেছেন, কাজেই, তা সহ্য করা হবে না। কারা এই হামলার পেছনে তা বুঝতে কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। এ কথা সত্যি যে, ধর্মের মধ্যে সমালোচনার বিশেষ জায়গা থাকে না। ধর্ম মূলত বিশ্বাসনির্ভর, সেখানে যুক্তির আনাগোনা চলে না। অতীতে যখন রাষ্ট্র থেকে ধর্ম পৃথক হয়েছে কিংবা কোনও ধর্মের অভ্যন্তরীণ সংস্কার সাধিত হয়েছে, তা দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের মধ্য দিয়েই সংঘটিত হয়েছে। হরিনাম সঙ্কীর্তনকে বাংলায় যিনি জনপ্রিয় করেছিলেন, সেই শ্রীচৈতন্যের কাজটিও সহজ ছিল না। তাঁরও লড়াই ছিল পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের বর্ণব্যবস্থার বিরুদ্ধে, সামাজিক অনুশাসনের বিপরীতে হেঁটে জাত-ধর্ম নির্বিশেষে সকল ভক্তদের তিনি হরিভজনার পতাকাতলে সমবেত করতে চেয়েছিলেন।
আজকের একবিংশ শতকের ভারতে আগ্রাসী হিন্দুত্বের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বর্ণব্যবস্থা নতুন করে আত্মপ্রকাশ করেছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদ গঠনের ক্ষেত্রে আবশ্যিক উপাদান হল এই বর্ণব্যবস্থা। আর এই ব্যবস্থার নীল নকশাটি বোনা হয়েছে যে গ্রন্থে সেই মনুস্মৃতি হয়ে উঠেছে সঙ্ঘীয় মতাদর্শের এক আকরগ্রন্থ। সঙ্ঘীয় উদ্যোগে জয়পুর হাইকোর্ট চত্বরে মনুর মূর্তিও স্থাপিত হয়েছে। স্মর্তব্য যে, ২০০৫ সালে মধ্যপ্রদেশে বিজেপি সরকার মনুস্মৃতিকে শিরোধার্য করেই গোহত্যাকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছিল। ভারতে বিভিন্ন প্রান্তে দলিতদের উপরে নিত্যনৈমিত্তিক অত্যাচারের কাহিনি, রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা, ভীমা-কোরেগাঁও জমায়েতে দলিতদের ওপর হিন্দুত্ববাদী হামলা, এতে অংশগ্রহণকারী বুদ্ধিজীবীদের উপরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নামিয়ে আনা ও তাঁদেরকে ‘শহুরে নকশাল’ তকমা দেওয়া প্রভৃতি ঘটনা বর্ণব্যবস্থার আবারও ফিরে আসার লক্ষণ। যতদূর জানি, দিনোকৃষ্ণও উচ্চবর্ণ অভিজাত শ্রেণির মানুষ নন। তিনি একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তাঁর নিজস্ব সামাজিক অবস্থান থেকে জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চেয়েছেন। তাঁর পেশাকে মাধ্যম করেই জনসাধারণের কাছে আপন মতাদর্শ পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে চলেছেন। তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে চেয়েছেন। কিন্তু সকলেই জানেন যে, বিরুদ্ধ মতাদর্শের প্রচার ও গণতন্ত্রের অনুশীলন— দুটোই ভারতের বর্তমান শাসকের অত্যন্ত অপছন্দের জিনিস।
আধুনিকতার একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও আবশ্যিক লক্ষণ হল, পশ্চাৎপদ মূল্যবোধের প্রধান ধারক ও বাহক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে ক্রমাগত সমালোচনা করে যাওয়া। আধুনিক সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও বৈজ্ঞানিক মেজাজের প্রভাবে যে প্রশ্নশীলতা জন্ম নেয়, নানা দিক থেকে ক্রমাগত অগ্রসর হতে হতে তার সূচিমুখ অবধারিতভাবে ধর্মের দিকে আছড়ে পড়ে। জার্মান সমাজতত্ত্ববিদ ম্যাক্স ওয়েবার যেমনভাবে আধুনিকতাকে বিশ্বের মোহমুক্তির সমার্থক বলে ভেবেছিলেন, ঠিক তেমনভাবে। গোটা বিশ্বে ধর্মমুক্ত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু হওয়া ও ধর্মে অবিশ্বাসী মানুষের দ্রুত হারে সংখ্যাবৃদ্ধিতে তাইই প্রতিফলিত হয়। এই অগ্রগতিকে প্রতিহত করতে ও ধর্মকে সমাজজীবনে প্রাসঙ্গিক রাখতে বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্মগুলি বিংশ শতকে এসে যে আগ্রাসী পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যাকে আমরা আজকে মৌলবাদ বলে চিহ্নিত করি, তারই প্রভাবে বিশ্বের কয়েকটি এলাকায় কতকটা বিক্ষিপ্তভাবে এক সাময়িক উলটপুরাণ লক্ষ করা যাচ্ছে। আমাদের উপমহাদেশে এখন এই মৌলবাদেরই প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে জোরকদমে। বিগত দশক থেকে আমরা দেখছি যে, ভারতে হিন্দুত্ববাদী শক্তি আধুনিকতার প্রতিটি স্তম্ভকেই একে একে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। প্রতিটি সাংবিধানিক অধিকারই আজ প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে। প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানই আজ ওই উন্মাদদের দখলে। শিক্ষাব্যবস্থাতেও এমনভাবে বদল আনা হচ্ছে যাতে, দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আদৌ গড়ে উঠতে না পারে।
ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে মশগুল এই উন্মাদের পাঠক্রমে হিন্দুত্বের প্রতি কোনওরকম সমালোচনার অবকাশ থাকতে পারে না। তাই ভয় দেখিয়ে, বল প্রয়োগ করে বা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে নাগরিকদের বাক্স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করতে তারা বদ্ধপরিকর। অতীতে এদেশে দাভোলকর-পানসারে-কালবুর্গী-লঙ্কেশরা এই হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণ প্রকল্পে নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করে প্রাণ দিয়েছেন। তাঁরা দেশের বিদ্বৎমহলে যথেষ্ট প্রভাবশালী হওয়া সত্ত্বেও এখনও তাঁদের আততায়ীদের খুঁজে পাওয়া যায়নি! অথচ, শুধুমাত্র সরকারের বিরাগভাজন হওয়ার কারণে অনেকেই কারান্তরালে দিন গুজরান করছেন। কাজেই, দিনোকৃষ্ণের মতো এক নিতান্ত স্থানীয় ধর্মগুরু যখন সীমিত সামর্থ্য নিয়েও আপাদমস্তক ধর্মের অনুশাসনে আষ্টেপৃষ্টে বন্দি সমাজের নিচুতলার মানুষের সামনে হাজির হয়ে মাথা উঁচু করে ধর্মের উদাত্ত সমালোচনা করেন, তাঁকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। তিনি হয়তো পুরোদস্তুর আধুনিকমনস্ক যুক্তিবাদী মানুষ নন, কিন্তু তাতে করে হিন্দুধর্মের অন্তর্গত ক্লেদগুলোর প্রতি তাঁর সমালোচনা মোটেই অর্থহীন হয়ে যায় না।
এটা মানতে হবে যে, দিনোকৃষ্ণ কিন্তু তাঁর কথকতার মধ্যে শুধুই ধর্মের সমালোচনা করেন এমন নয়। বরং এমন অনেক কিছুও তিনি বলেন, যাতে তাঁর সঙ্গে একজন পরমবিশ্বাসী রক্ষণশীল ধার্মিকের পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। এক অর্থে এটা খুবই স্বাভাবিক। তিনি একজন কীর্তনীয়া এবং ধর্ম-কথক, কাজেই সঙ্কীর্তনের আসরে ওটাই তো তাঁর করবার কথা, ওই আসরে হাজির লোকজন তো ওটাই শুনতে গেছেন। কিন্তু আবার, ধর্মের সমালোচনার সঙ্গে তার বিরোধটুকুও চোখ এড়িয়ে যাওয়ার নয়। কাজেই, সমাজমাধ্যমে সক্রিয় কিছু যুক্তিমনস্ক মানুষ সেদিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে ভ্রূকুঞ্চন করেছেন। দিনোকৃষ্ণ আসলে তবে ঠিক কতটা যুক্তিবাদী? ধর্মের প্রতি তাঁর সমালোচনা তবে কতটা আন্তরিক? হিন্দুধর্মের মূল বিষয়গুলোতে যদি তাঁর পরম আস্থা বজায় থাকে, তাহলে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিরোধই বা শেষতক ঠিক কতটা টেকসই হবে? সত্যিই, এ স্ববিরোধিতার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা সহজ নয়।
দিনোকৃষ্ণ কি নিজের বিশ্বাস ও ইচ্ছের বিরুদ্ধে ক্রমাগতই ধর্মের মাহাত্ম্যকীর্তন করে যেতে বাধ্য হন, যেহেতু ওটাই তাঁর পেশা? কিংবা, তিনি তাঁর শ্রোতৃবর্গের কাছে তাঁর বার্তাকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চান ওটাকে কাজে লাগিয়ে? নাকি ওটা প্রকৃতই তাঁর স্ববিরোধিতা— চেতনায় এলোমেলোভাবে জট পাকিয়ে পড়ে থাকা দুই পরস্পর-সঙ্গতিহীন বস্তু মাত্র? অথবা, তাঁর চেতনার গভীরে কোথাও গিয়ে কোনও একটা ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন’ গোছের ব্যবস্থা করে রাখা আছে, যার খোঁজ আমরা রাখি না? এ-সব প্রশ্নের উত্তর কেউ হয়তো জানতে চাইতেই পারেন, কিন্তু তা জানাটা কি আদৌ খুব জরুরি, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে?
আমাদের অবশ্য ধারণা, এই মুহূর্তে তার চেয়েও জরুরি প্রশ্ন আছে। প্রথম প্রশ্নটা হচ্ছে, দিনোকৃষ্ণ যে অবস্থান থেকেই ধর্মের সমালোচনা করুন না কেন, সে জন্য তাঁকে আক্রান্ত হতে হবে কেন, এবং যদি আক্রান্ত হন, তো আমাদেরকে চুপ থাকতে হবে কেন? এবং, এ থেকে দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি বেরিয়ে আসে, সেটি আরও ভয়ঙ্কর। দিনোকৃষ্ণের ওই ধর্ম-সম্পৃক্ত ‘অবিশুদ্ধ’ সমালোচনাই যদি শারীরিক আক্রমণ ডেকে আনতে পারে, তাহলে সত্যিকারের যুক্তিবাদীদের তরফে ‘বিশুদ্ধ’ সমালোচনার পরিণতি কী হতে পারে? বলা বাহুল্য মাত্র, অদূর ভবিষ্যতে এ প্রশ্ন জ্বলন্ত আকারে আমাদেরকে আক্রমণ করবে, এবং দিনোকৃষ্ণ আসলে কতদূর যুক্তিবাদী সেই সূক্ষ্মবিচারের আড়ালে তাকে আর কিছুতেই চাপা দিয়ে রাখা যাবে না।
আধুনিক মানবসমাজে সমালোচনার জবাব যে যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা দিয়েই দিতে হয়, দাঁতনখ বার করে আক্রমণ করা সাজে না— এ কথা ধর্মান্ধরা সহজে বুঝবে বলে মনে হয় না। তবুও, একমাত্র আমাদের সম্মিলিত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধই বোধহয় পরিস্থিতিকে দ্রুত বদলে দিতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিষাক্ত আগল ভেঙে মানবসমাজ একদিন পুরোপুরি মুক্ত হবে। হবেই। ইতিউতি সাময়িক বিচলনে সভ্যতার মোদ্দা পথরেখাটা বদলাবে না। আমাদের কাজ হচ্ছে সমাজটাকে ক্রমাগত সেদিকে ঠেলে দেওয়া।
সব সময়ে আমরা সেটা ঠিকঠাক পেরে উঠছি কিনা, সেই সতর্ক বিচার চালু রাখাটা আমাদেরই দায়িত্ব।
*মতামত ব্যক্তিগত