Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মণিপুর ত্রিকোণ ষড়যন্ত্রের শিকার

মনসুর মণ্ডল

 


মণিপুরে জাতিদাঙ্গার প্রকৃতই কোনও ইতিহাস নেই। বিভিন্ন সময়ে স্থানীয়ভাবে ও বিচ্ছিন্নভাবে কুকি-জোমি ও মেইতেইদের মধ্যে সংঘাত হয়েছিল— সেটা ছিল এরিয়া ডোমিনেশন নিয়ে দ্বন্দ্বের ব্যাপার। কর্পোরেট পুঁজি ও আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রের স্বার্থে সঙ্ঘ পরিবার রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে জাতিবৈরিতার জমি তৈরি করেছে, যা তফসিলি স্বীকৃতির প্রশ্নে বিস্ফারিত হয়েছে। উপরন্তু হিন্দুত্বের কর্মপন্থায় আরএসএস জাতিসত্তা চেতনার মধ্যে হিন্দু-খ্রিস্টান ধর্মীয় বিভাজনের জমি তৈরি করেছে। সবদিক থেকে সংখ্যাগুরু আধিপত্যকামী রাজনীতি, কর্পোরেট হাউসের আগ্রাসন ও স্থানীয় মাদক মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য— মণিপুরে এখন রাজ করছে এই ত্রিমুখী স্বার্থচক্র

 

পাহাড় ঘেরা মণিপুরের ১০ শতাংশ সমতল ভূখণ্ডে মূলত মেইতেই জাতির মানুষের বসবাস। রাজ্যে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ— জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ। বাকি পাহাড়ি এলাকায় সংখ্যালঘু কুকি ও জোমি জনজাতি, যারা সংখ্যায় বেশি, ও নাগা-সহ আরও কিছু জনজাতি বসবাস করে। মেইতেইরা আর্থ-সামাজিক দিক থেকে এগিয়ে আছে। জনজাতি জনগোষ্ঠীগুলো আর্থ-সামাজিক দিক থেকে পশ্চাৎপদ। তারা তফসিলি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। মেইতেইরা তফসিলি জাতি হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।

কিন্তু ২০১২ সাল থেকে মেইতেইরা উপজাতি স্বীকৃতির জন্য দাবি তুলে আসছে। এ নিয়ে রাজ্যের জনজাতি সম্প্রদায়গুলোর বিরোধিতা আছে। এতদিন বিরোধ সহিংস চেহারা নেয়নি। ২৭ এপ্রিল ২০২৩-এ মণিপুর উচ্চ আদালত মেইতেইদের উপজাতি স্বীকৃতির দাবির বিষয়টা বিবেচনা করার জন্য মণিপুর সরকারকে নির্দেশ দিলে তার বিরোধিতায় চুরাচন্দপুর জেলার তোরবাংগ-এ ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন মণিপুর’ ‘ট্রাইবাল সলিডারিটি মার্চ’ করতে গেলে মেইতেই ও কুকি-জোমি জনগোষ্ঠীর মধ্যে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে।

মেইতেই জাতি ও কুকি-জোমি জনজাতির মধ্যে সংঘর্ষে মণিপুর আজ অগ্নিগর্ভ। ২০২৩-এর ৩ মে সংঘর্ষ শুরুর দিন থেকে জুনের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ১২০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, যাদের মধ্যে ৯৪ জন কুকি-জোমি। ২০০টি গ্রাম, যেগুলির মধ্যে ১৬০টি কুকি-জোমি অধ্যুষিত এবং ৩৫৫টি গির্জা আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গেছে। ৫০ হাজার মানুষ, যাদের মধ্যে ৪১ হাজার কুকি-জোমি, বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সংঘর্ষ এখনও বিক্ষিপ্তভাবে চলছে। আরও কত মানুষের প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পর এই সংঘর্ষ থামবে, কেউ জানে না। কিন্তু এই আশঙ্কা থেকেই যায়, পরিস্থিতি যেদিন শান্ত হবে, তখনও বাস্তুচ্যুত কুকি-জোমি জনগোষ্ঠীর মানুষের হয়তো তাদের পুরনো ভিটেতে ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না।

এমন হিংসা-দীর্ণ চেহারা আগে দেখা না গেলেও মণিপুর নিরবচ্ছিন্ন শান্তির আশ্রয় কখনও ছিল না। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভাবধারা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা এবং রাজনৈতিক স্বায়ত্ততা, ক্ষেত্রবিশেষে জনবিন্যাসভিত্তিক রাজ্য গঠন প্রশ্নে ভারত সরকারের সঙ্গে মণিপুরবাসীর দীর্ঘকালের বিরোধ ছিল এবং ভারত সরকারের সেনা-আধা সেনা তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধ সময়ে সময়ে সশস্ত্র সংঘাতের চেহারা নিয়েছিল। সময়ের পরিহাস এই যে, যে আফস্পা (AFSPA- আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট) নিয়ে ছিল মণিপুরবাসীর তীব্র আপত্তি, আজ তার সংশ্লিষ্ট বাহিনির কাছে নিরাপত্তা ভিক্ষা করতে হচ্ছে মণিপুরবাসীকে।

২০০৪-এর ১৫ জুলাই বারোজন মহিলা মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলে অসম রাইফেলস্-এর হেডকোয়ার্টারের সামনে এক প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন। তাঁদের হাতে ছিল ব্যানার, লেখা ছিল— “ইন্ডিয়ান আর্মি রেপ আস”, “ইন্ডিয়ান আর্মি টেক আওয়ার ফ্লেশ”। তাঁরা নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। দেশবাসী স্তম্ভিত হয়েছিল জেনে যে, মণিপুরে ধারাবাহিক সেনা অপারেশনের পরিণামে নারীধর্ষণ ও হত্যা রুটিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেশবাসী জেনেছিল ও মেনেছিল, ওই প্রতিবাদী মহিলারা “মাদার্স অফ্ মণিপুর”। তাঁরা সকলেই ছিলেন মেইতেই জাতির মানুষ। এখন দেশবাসী দেখল, ৪ মে ২০২৩-এ এই মণিপুরেই একদল হিংসা-উন্মত্ত পুরুষ কুকি জনগোষ্ঠীর দুই মহিলাকে নগ্ন করে গ্রামের রাস্তায় হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং তাঁদের মধ্যে একজনকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। বিস্ময়কর এটাই যে, এই দলের সকলেই ছিল মেইতেই জাতির লোক। তামাম মণিপুরবাসীর মানবাধিকার ও নারীর মর্যাদার জন্য “মাদার্স অফ্ মণিপুর”-এর লড়াইয়ের স্মৃতি কী করে এই বিষম বাস্তবতায় নিমজ্জিত হল, সেই দিকটা খুঁজে দেখা জরুরি।

মেইতেইদের তফসিলি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিরোধিতা কুকি-জোমিদের স্রেফ এই আশঙ্কা থেকেই নয় যে, তাদের শিক্ষা ও চাকরিতে জাতিগত সংরক্ষণের সুবিধায় মেইতেইরা ভাগ বসাবে। এর সঙ্গে তাদের জমির অধিকার হারানো ও অস্তিত্বের বিপন্নতার ভয় জুড়ে আছে এবং এটাই প্রধান কারণ। প্রথমত, পাহাড়ে বসবাসকারী কুকি-জোমিদের জীবিকার মূল উৎস কৃষিকর্ম। দ্বিতীয়ত, তাদের সমাজে জমির অধিকার জাতিগত প্রথাসিদ্ধ ও স্বতন্ত্র ধাঁচায় বিন্যস্ত হয়ে আছে, যা তাদের সমাজ-বিন্যাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জনজাতির জমির অধিকার সংরক্ষিত থাকায় তাদের জমি সংক্রান্ত রীতি-নীতি নির্বিঘ্নে টিকিয়ে রাখতে সুবিধা হয়েছে। মেইতেইরা তফসিলি উপজাতির স্বীকৃতি পেলে এই জমিতে হাত পড়বে, এটা কুকি-জোমিদের অস্তিত্ব ও সামাজিক স্থিতিশীলতার পক্ষে বিপজ্জনক। ফলে মেইতেইদের জনজাতি স্বীকৃতি নিয়ে কুকি-জোমিদের বিরোধিতা থাকবেই। এই নিয়ে বিরোধিতা ও দাবিকে জাতি-সংঘর্ষের ইন্ধন করা, এটা কায়েমি স্বার্থের ষড়যন্ত্রের পরিণাম। কায়েমি স্বার্থ দুর্বলকেই নিশানা করে। আর পাহাড়ি জমি ও বনসম্পদ আঁকড়ে পড়ে থাকা কুকি-জোমিরা তো সংখ্যালঘু ও প্রান্তিকবর্গের।

রাজ্যে মেইতেইদের মধ্যে বিজেপির সংগঠন মজবুত, সরকারও তাদের। এখানকার খোদ বিজেপির একাংশ বিধায়করাই অভিযোগ করেছেন যে, মণিপুরে জাতি-সংঘর্ষের জন্য বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং দায়ী। অন্যদিকে অভিযোগ উঠেছে, আরমবাই তেঙ্গোল (Arambai Tenggol) ও মেইতেই লিপুন (Meitei Leepun) সংগঠন দুটি কুকি-জোমি বিরোধী নাশকতায় জড়িত। এ দুটি আসলে আরএসএস-এর বেনামী সংগঠন। সুতরাং এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, মণিপুরে জাতি-সংঘর্ষের পিছনে সঙ্ঘী-হাত আছে। ফ্যাসিবাদের যাত্রাপথে মুসলিমরা প্রধান নিশানা হলেও অন্যভাবে সংখ্যালঘু দমনের সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পিছপা নয় সঙ্ঘীরা। মণিপুর তার সাম্প্রতিক মৃগয়াক্ষেত্র। ফলে এই রাজনৈতিক চক্রে মণিপুরে সম্মিলিত জাতিসত্তার প্রসঙ্গ আজ জাতি-শত্রুতায় প্রতিস্থাপিত হয়ে গেছে।

দেখা গেল, জাতিগত বিতর্কের মাঝে ২০২৩-এর ১১ এপ্রিল বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও ইম্ফলে অবস্থিত তিনটি গির্জা ধ্বংস করেছিল বীরেন সিং সরকার। আর সংঘর্ষ চলাকালীন মেইতেইদের হাতে অজস্র গির্জা ধ্বংসের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, জাতি-সংঘর্ষে ধর্মীয় ভেদবুদ্ধি ইন্ধন জুগিয়েছে ভালই। একদিকে মেইতেই, অন্যদিকে কুকি-জোমি-নাগা জনগোষ্ঠী। এদের পৃথক জাতি পরিচিতির পাশাপাশি পৃথক ধর্মীয় পরিচিতিও রয়েছে। মেইতেইদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু। কুকি-জোমি-নাগারা প্রায় সকলেই খ্রিস্টান। আরএসএস মণিপুরে হিন্দু মেইতেই জনগোষ্ঠীকে ধরে হিন্দুত্বের নতুন মডেল দাঁড় করাতে সচেষ্ট। তারা জাতি-পরিচিতির মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে হিন্দুত্বকে নিয়োজিত করেছে।

মণিপুরের পাহাড়ি অঞ্চল বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ ও বহু জায়গায় মাটির নিচে রয়েছে খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার। ২০১০ সালে চুরাচন্দপুর জেলায় প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল ভাণ্ডারের সন্ধান মিলেছে। কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর নজর সেদিকে। কিন্তু সংরক্ষিত বনাঞ্চল বাদ দিয়ে বাকিটায় কুকি, জোমি, নাগা সহ আরও কয়েকটি জনজাতির চিরাচরিত বসবাস ও কৃষিকর্ম। তাদের উচ্ছেদ করতে না পারলে কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর মুনাফা হবে কী করে? অপরদিকে, পাহাড়ি এলাকায় পোস্ত ও গাঁজা চাষের চল আছে। এই চাষ মূলত জনজাতির লোকেরাই করে থাকে। কিন্তু এই থেকে প্রসেসিং করে মাদক তৈরি করা হয়, সেটা একচেটিয়া মেইতেই মাদক ব্যবসায়ীদের কারবার। তারা আফিম ও কোকেন বিদেশে পাচার করে প্রচুর মুনাফা করে। পোস্ত ও গাঁজা চাষের জমিতে তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারলে মাদক ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠবে। তাদের পাশে রয়েছে রাজ্যের সরকার। মাদক ব্যবসা থেকে সরকারি কেষ্টবিষ্টুদের মুনাফা কম নেই। সুতরাং বনাঞ্চল থেকে জনজাতি বসতি উচ্ছেদ করা ও মেইতেইদের তফসিলি উপজাতি স্বীকৃতি দেওয়া বীরেন সিং সরকারের কাছে অবশ্যকরণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০২৩-এর ২০ ফেব্রুয়ারি চুরাচন্দপুর জেলায় সোংজাং গ্রামে বুলডোজার চালিয়ে কুকি-জোমি পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করেছে বীরেন সিং সরকার। এক্ষেত্রে নতুন করে সার্ভের নামে ভারতীয় অরণ্য আইন-১৯২৭এর অধীনে নির্দিষ্ট চুরাচন্দপুর-খুপুম সংরক্ষিত অরণ্য এলাকাকে বর্ধিত করে সোংজাং গ্রামবাসীদের অবৈধ বসবাসকারী ঘোষণা করা হয়েছিল। এভাবে আরও অন্তত ২৩টি গ্রাম সরকারের নিশানায়। এটা পরিষ্কারভাবে সংবিধানের ৩৭১সি ধারার বিরুদ্ধাচরণ। পাশাপাশি রাজ্য সরকার ২০২৩-এর প্রথম দিকে ‘অ্যান্টি-ড্রাগ অভিযান’-এর নামে কুকি-জোমিদের পোস্ত ও গাঁজার ক্ষেত বিনষ্ট করা শুরু করে। বীরেন সিং সরকারের বক্তব্য ছিল, এরা মায়ানমার থেকে এখানে অবৈধভাবে এসে এসব চাষ করছে। এই চাষ মণিপুরের বহু কুকি-জোমি পরিবারের জীবিকার প্রধান উৎস। ফলে কুকি-জোমিদের মধ্যে জীবিকা নিয়ে আশঙ্কা চেপে বসেছিল।

ওদিকে, সংসদের ২০২৩-এর বাদল অধিবেশনে বিরোধীদের আলোচনার সুযোগ না দিয়ে ‘অরণ্য সংরক্ষণ আইন, ১৯৮০’র সংশোধনী বিল ধ্বনিভোটে পাস করে নিল মোদি সরকার। যোগাযোগ পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে বনাঞ্চলে ছাড় দেওয়া হয়েছে সংশোধনীতে। এছাড়া ওই পরিসরে বনাঞ্চলে চিড়িয়াখানা, জঙ্গল সাফারির মতো বিভিন্ন প্রকল্প নির্মাণে বেসরকারি সংস্থাকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এজন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ ‘ফরেস্ট অ্যাডভাইসরি কমিটি’র অনুমতি নিতে হবে না। এর বিপদ সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমেই মণিপুরের কথা এসে যায়, যেখানে সংখ্যালঘু জনজাতিদের উচ্ছেদে তৎপর রাজ্য সরকারের হাতে নতুন অস্ত্র তুলে দেওয়া হল এবং কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর হাত দিয়ে সেখানে যথেচ্ছভাবে অরণ্যধ্বংস যজ্ঞ শুরু হবে।

মণিপুরে জাতি-ধর্মের বিভাজিত পরিমণ্ডলে জাতি-শত্রুতার ফিরিস্তি আরও লম্বা। বীরেন সিং সরকার বলছে, মায়ানমার থেকে বহু কুকি ও জোমি জাতির মানুষ মণিপুরে অবৈধভাবে ঢুকে বসতি গড়েছে এবং অবৈধভাবে পোস্ত ও গঁজা চাষ-সহ মাদক চোরাচালানে যুক্ত। আর মেইতেইদের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন ‘কো-অর্ডিনেশন কমিটি অন মণিপুর ইন্টিগ্রিটি’ (COCOMI) দাবি তুলেছে, বহু কুকি মায়ানমার থেকে অবৈধভাবে মণিপুরে এসে বসবাস করছে। তারা অবৈধভাবে পোস্ত ও গাঁজা চাষ করছে এবং অরণ্য ধ্বংস করছে। তারাই মেইতেইদের বিরুদ্ধে হিংসা ছড়াবার মূলে। তাদের চিহ্নিত করতে সংগঠনটি এনআরসি দাবি করছে।

বাস্তবিক, মণিপুরে জাতিদাঙ্গার প্রকৃতই কোনও ইতিহাস নেই। বিভিন্ন সময়ে স্থানীয়ভাবে ও বিচ্ছিন্নভাবে কুকি-জোমি ও মেইতেইদের মধ্যে সংঘাত হয়েছিল— সেটা ছিল এরিয়া ডোমিনেশন নিয়ে দ্বন্দ্বের ব্যাপার। কর্পোরেট পুঁজি ও আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রের স্বার্থে সঙ্ঘ পরিবার রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে জাতিবৈরিতার জমি তৈরি করেছে, যা তফসিলি স্বীকৃতির প্রশ্নে বিস্ফারিত হয়েছে। উপরন্তু হিন্দুত্বের কর্মপন্থায় আরএসএস জাতিসত্তা চেতনার মধ্যে হিন্দু-খ্রিস্টান ধর্মীয় বিভাজনের জমি তৈরি করেছে। খ্রিস্টানদের সম্পর্কে এতখানি বৈরিতা সঙ্ঘীদের এখনকার কর্মপন্থা নয়। কায়েমি স্বার্থের তাগিদের পরিপ্রেক্ষিতে সেই সীমারেখা ছাড়িয়ে মণিপুর-নাগাল্যান্ডের মতো রাজ্যগুলির জাতিসত্তাবর্গের স্বাধীনচেতা অবস্থান এবং স্বায়ত্ততার ভাবনা ও তার জন্য অমীমাংসিত দাবির বিপরীতে জাতিহিংসা তথা হিন্দু-খ্রিস্টান সংঘাত সৃষ্টি ভারত সরকারের কেন্দ্রীভূত শাসনের পক্ষে অনুকূল হয়েছে। সবদিক থেকে সংখ্যাগুরু আধিপত্যকামী রাজনীতি, কর্পোরেট হাউসের আগ্রাসন ও স্থানীয় মাদক মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য— মণিপুরে এখন রাজ করছে এই ত্রিমুখী স্বার্থচক্র। মণিপুর ত্রিকোণ ষড়যন্ত্রের শিকার।

মণিপুরে আক্রান্ত কুকি-জোমিদের পাশে দাঁড়িয়েছে নাগারা। কুকি-জোমি-নাগারা মণিপুরে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে আছে। পার্শ্ববর্তী মিজোরামে মিজোরা বিজেপি তথা সংঘ পরিবারের রাজনীতিটা ধরে ফেলেছে। কিন্তু তার প্রত্যুত্তর দিচ্ছে জাতিবৈরিতার পথ ধরে। মিজোরামের সশস্ত্র বাহিনি পামরা ও মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট-এর (বর্তমানে এনডিএর শরিক) আর্মড ইউনিট মিজোরামে বসবাসকারী মেইতেইদের, যারা সংখ্যায় ৫ লাখ, বলেছে, মিজোরামে তাদের থাকা নিরাপদ নয়, থাকতে হলে নিজেদের দায়িত্বে থাকতে হবে। ফলে তারা দলে দলে পালাতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে মণিপুর থেকে পালিয়ে এসে মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছে কুকি-জোমিরা। আপাতভাবে তার দায় মিজোরামের মেইতেইদের বহন করতে হচ্ছে। ওদিকে মেঘালয়ে বসবাসকারী মেইতেই ও কুকিদের মধ্য ঝামেলা শুরু হয়েছে। অর্থাৎ মণিপুরের জাতিহিংসা উত্তর-পূর্ব ভারত জুড়ে জাতি-সংঘাতের পটভূমি রচনা করেছে। কর্পোরেট ও মাদক মাফিয়াদের স্বার্থচক্র রাজনৈতিক অস্থিরতাজনিত অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে এবং হিন্দুত্বের সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ শুরুতেই শক্ত চ্যালেঞ্জের সামনে পড়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিসরে বাদ-প্রতিবাদের রাস্তা যতটুকু খোলা আছে, তাতে মণিপুরে জাতি হিংসায় দেশে মানবিক ও বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কেন্দ্রীয় ও মণিপুর সরকারের সামনে অতিরিক্ত চাপ। ফলে কেন্দ্র সরকার মণিপুরে জাতিহিংসায় রাশ টানতে কিছু প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে।

মণিপুর হিংসায় জড়িত থাকার অভিযোগে মেইতেইদের ন-টি সংগঠনকে ইউএপিএ-তে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে কেন্দ্র সরকার। অন্যদিকে কুকি-জোমিদের তিনটি সংগঠন জাতি হিংসায় জড়িত বলে আগেভাগেই অভিযোগ খাড়া করে রেখেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। কেন্দ্র সরকার মণিপুরে ১ লক্ষ সেনা, আধাসেনা ও অসম রাইফেলসের জওয়ান মোতায়েন করেছে, সঙ্গে আছে রাজ্য পুলিশ— যেখানে মণিপুরের জনসংখ্যা ৩২ লক্ষ। কিন্তু সমস্যা যেখানে জাতিগত, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক, সেখানে এরকম সামরিক কায়দায় মোকাবিলা করার প্রচেষ্টা আগুন না নিভিয়ে ছাই চাপা দেওয়ার মতো ব্যাপার।

বাস্তবিক, বিজেপির হাতে মণিপুরের জাতিসমস্যার সমাধান দূর অস্ত। কর্পোরেট হাউসের কাছে তারা বিকিয়ে আছেই, উপরন্তু কেন্দ্রীভূত ও কর্তৃত্বকামী শাসনপ্রণালী ও হিন্দুত্বের লক্ষ্যে সমস্যাকে তাদের জিইয়ে রাখতেই হবে। শুধু মণিপুর নয়, উত্তর-পূর্ব ভারত জুড়ে ছড়িয়ে আছে কুকি, জোমি, নাগা, মিজো, খাসি প্রভৃতি বেশ কিছু সংখ্যক জনজাতি গোষ্ঠী। তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ জাতিসত্তার চেতনা, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার-বোধ, রাজনৈতিক স্বায়ত্ততার দাবি সঙ্ঘ পরিবারের এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রভাবনা ও একদেশদর্শী সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভাবধারার বিপরীত। এই বাস্তবতাকে নির্মূল না করে সেখানে সঙ্ঘ পরিবারের দাঁড়াবার জায়গা নেই।

১৯৯৪ সালের আগে প্রায় তিন দশক রোয়ান্ডাকে অনেকটা এরকম জাতি-সংঘাতের সাক্ষী হতে হয়েছিল, যা ১৯৯৪-এ রাষ্ট্রীয় সহায়তায় ১০০ দিনের নৃশংস জেনোসাইডের জমি প্রস্তুত করেছিল। জেনোসাইডে সংখ্যাগুরু (৮৫ শতাংশ) হুতু (Hutu) জাতির চরমপন্থীদের হাতে ৮ লক্ষাধিক রোয়ান্ডাবাসীর হত্যার ঘটনা ঘটেছিল, যাদের মধ্যে ছিল সংখ্যালঘু (১৪ শতাংশ) তুৎসি (Tutsi) জাতির সিংহভাগ মানুষ ও বাকি হুতু জাতির মানুষ, যারা জাতি প্রশ্নে ছিল নরমপন্থী, এবং ২০ লক্ষ রোয়ান্ডাবাসীর দেশান্তর ঘটেছিল।

 

প্রবন্ধটি লেখকের সাম্প্রতিক বই ‘একটি ফ্যাসিবাদী প্রকল্প : মব লিঞ্চিং থেকে জাতি সংহার’ (চেতনা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত; প্রকাশ- কলকাতা বইমেলা, ২০২৪)এর একটি নির্বাচিত অংশ।