Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ক্রোনিজম: আদানি ও বিল গেটস

বিশ্বনাথ উদিত

 

গৌতম আদানি কোনও প্রযুক্তিগত বিপ্লবের পথিকৃৎ নন্‌। তিনি একজন বিনিয়োগকারী। একজন প্রতিভাবান শিল্পপতি প্রতিযোগিতার পরিবেশে নিজের কোম্পানির বিকাশ ঘটাতে সক্ষম। কিন্তু বিকাশের জন্য রাজনৈতিক যোগাযোগ দরকার হয় তখনই যখন প্রতিযোগিতার বাইরে গিয়ে সরকারি অনুগ্রহ লাভের বাসনা জাগে। এখানেই আদানির বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ যার চূড়ান্ত প্রকাশ হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদনে

 

ক্রোনিজম শব্দটা চালু হয়েছে বিভিন্ন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন শক্তির সঙ্গে কোনও ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের অনৈতিক ঘনিষ্ঠতার ভিত্তিতে অর্থনীতির দিশা পাওয়া বোঝাতে। ঝুঁকি আর প্রতিযোগিতা এড়িয়ে এই শ্রেণির ব্যবসায়ীরা ফুলে-ফেঁপে ওঠে এবং তাদের মুনাফার অংশ অনুগ্রহকারীকে নানাভাবে দিয়ে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখে। যেহেতু পুঁজিপতিদের হাতে টাকা থাকে আর আমলা বা মন্ত্রী্দের থাকে ক্ষমতা এবং বিভিন্ন মাত্রায় তা অপব্যবহার করে আনুকূল্য দেওয়ার সুযোগ, তাই স্বাভাবিক গতিতেই তারা মিলে যায় স্বার্থের টানে। পৃথিবীর সব দেশেই এবং সম্ভবত সব সময়েই কম-বেশি এই প্রবণতা প্রচ্ছন্ন আছে এবং ছিল। অর্থবিদ্যায় এই প্রবণতাকে rent seeking বলে। এই আনুকূল্য আদান-প্রদানের পরিবেশ কখনও আবার একটা উগ্র মাত্রা পায়। পশ্চিমবাংলায় যেমন শোনা যায় শক্তির কেন্দ্র থেকে আসা আহ্বান— তিন ভাগ আমাকে দাও আর এক ভাগ তুমি নাও, তাহলে তুমি নিরাপদ। সেক্ষেত্রে rent seeking উৎসাহিত হয়ে সাধারণ মানুষের প্রাপ্য অধিকারেও থাবা বসিয়ে ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয়ের রূপ নেয়, যেমন স্কুলে টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়া এমনকি যোগ্যতার মাপকাঠি উড়িয়ে দিয়ে। এই দুর্বৃত্ততা আমাদের রাজ্যে তোলাবাজি নামে উগ্র বিরাজমান। ক্রোনিজম শব্দটা এই ধরনের ব্যাপক দুর্নীতি বোঝাতে সাধারণত ব্যবহার হয় না। ক্রোনিজম rent seeking-এর এক রাষ্ট্রীয় রূপ, যেখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তির সঙ্গে কিছু বৃহৎ পুঁজিপতির স্বার্থের মিলন ঘটে যার ফলে নীতি ও আইনকে দুমড়ে-মুচড়ে ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীস্বার্থে রাষ্ট্র চালিত হয়। অবশ্যই এই মিলনেরও রূপ ও মাত্রার তারতম্য আছে। স্বার্থের এই অনৈতিক আঁতাত গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে, এমনকি চরম প্রতাপান্বিত হয়ে এই স্বৈরাচারী প্রবণতা রাষ্ট্রকে ব্যর্থ পর্যন্ত করে দিতে পারে, যার অনেক উদাহরণ পৃথিবীতে জাজ্বল্যমান (অবশ্য রাষ্ট্র ব্যর্থ হতে পারে আরও অনেক কারণেই)। এই আলোচনার পটভূমিতে আমাদের দেশের সবচেয়ে ধনী হয়ে ওঠা পুঁজিপতি গৌতম আদানির বিরুদ্ধে ওঠা সাম্প্রতিক অভিযোগ বিচার করা যাক।

হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ আমেরিকার একটি কর্পোরেট কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত গবেষণা ও শেয়ার কেনাবেচার ছোট ব্যবসায়িক সংস্থা। এদের গবেষণার (সম্ভবত) মূল লক্ষ্য সারা দুনিয়ার বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার বেআইনি কাজ ও জালিয়াতি সম্বন্ধে সতর্ক করে দেওয়া এবং তার ফলে সংশ্লিষ্ট সংস্থার শেয়ারের দাম কমে গেলে লাভ ঘরে তোলা। কিন্তু বড় কোম্পানির বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা প্রচার করে— যা একটি বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য কাজ— কোনও সংস্থা বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। তাই গবেষণার ফল প্রকাশের আগে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ যথেষ্ট দায়িত্বশীল ও সতর্ক হতে বাধ্য। হিন্ডেনবার্গ জানে লাভের লক্ষ্যে পৌঁছবার সবথেকে বড় হাতিয়ার গবেষণার উচ্চ মান। গবেষণায় প্রকাশিত তথ্য অবধারিতভাবে পরবর্তী অনুসন্ধানে গভীরভাবে যাচাই হবে এবং ভুল প্রমাণিত হলে গবেষক সংস্থা বাজারকে প্রভাবিত করার ক্ষমস্তা হারাবে। হিন্ডেনবার্গের বিভিন্ন গবেষণা অতীতে যথেষ্ট সমাদর পেয়েছে, সেই সুনামের জন্যই তারা যখন জানুয়া্রি (২০২৩) মাসে আমাদের দেশের আদানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন কোম্পানি সম্বন্ধে হিসাবের কারচুপি ও প্রতারণার অভিযোগ আনে তখন আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং কোম্পানিগুলির শেয়ারের দরে ধস নামে।

আদানি ভারতের একজন প্রতিভাবান শিল্পপতি। সাজপোশাক বা চালচলনে নিজেকে একদম জাহির করেন না, সাংবাদিকদের থেকে দূরে থাকাই পছন্দ। তিনি এক অত্যন্ত সাধারণ ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিদ্যালয় পার হয়ে তিনি হীরে বাছাইয়ের কাজ নিয়ে মুম্বাইতে চলে যান, পড়াশোনা আর বেশি এগোয়নি। তিন বছর পরে দাদার ব্যবসায়ে যোগ দিয়ে নিজের ব্যবসা-বুদ্ধির নজির রাখতে থাকেন। তাঁর উন্নতির মূলধন ছিল অসম্ভব বাস্তববোধ ও সংগঠনের দক্ষতা। আদানি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলেন আমাদের দেশের বিধিনিষেধের প্রতিষ্ঠানগুলি নড়বড়ে। প্রভাবশালীরা চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে, তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারলে পথ অনেক মসৃণ হয়ে যায়। আমলা-মন্ত্রীদের মধ্যে অবাধ চলাফেরা এক সময় এই মৃদুভাষী অন্তর্মুখী শিল্পপতির বিশেষ ক্ষমতা বলে জনান্তিকে বহুচর্চিত হয়।

১৯৮০-র দশক থেকেই তাঁর ক্রম-উত্থান, ১৯৯০-র দশকের শেষের দিকে তিনি গুজরাটের মুন্দ্রা বন্দরের পরিচালনার দায়িত্ব পান, ২০০১ সালে এই বন্দর চালু হয় এবং সেই সময়ই নরেন্দ্র মোদি গুজরাতে ক্ষমতায় আসেন। অচিরেই তাঁর সেই বন্দর প্রসারিত হয়ে দেশের সবচেয়ে বড় বন্দরে পরিণত হয়। মুখ্যমন্ত্রী ও শিল্পপতির মধ্যে ঘনিষ্ঠতা এতই গভীর হয় যে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি যখন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিতে আমেদাবাদ থেকে দিল্লি আসেন আদানির ব্যক্তিগত প্লেন তাঁকে নিয়ে আসে। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়ার জন্য প্লেনের বা টাকার তো অভাব ছিল না, তবু ঘনিষ্ঠতা শোভনতার মাত্রা অতিক্রম করে। ইকনমিস্ট ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদন বলছে সেই সময় থেকে ২০২৩-এর গোড়ায় আদানির ব্যক্তিগত সম্পদ ৭০০ কোটি (ডলার) থেকে বেড়ে ১২০০০ কোটিতে দাঁড়ায়। যার অর্থ মাত্র নয় বছরে ষোলো গুণেরও বেশি বৃদ্ধি! শুধু এই তথ্যই, অন্য সব অভিযোগ সরিয়ে রাখলেও, এই উত্থানের বিষয়টার তদন্তের দাবি করে। বস্তুত সেবি (Securities and Exchange Board of India) ২০২১ সালে তদন্ত শুরুও করে, কিন্তু অচিরেই অজানা কারণে তা স্তব্ধ হয়ে যায়। তৃতীয় বিশ্বের এই আমাদের দেশ ভারতবর্ষের  গৌতম আদানি ২০২৩-এর গোড়ায় সারা বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ সম্পদশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন, তিনি বিশেষ সুবিধা পাওয়ার সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি শুধু দেন, প্রতিদানহীন। প্রধানমন্ত্রীকে শপথ নিতে দিল্লি যাওয়ার জন্য নিজের প্লেন এগিয়ে দেন, প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে মোটা চাঁদা দেন, নির্বাচনী তহবিলে টাকা দেন, আবার জনকল্যাণেও টাকা দেন।

গোল বাঁধে হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদনে গৌতম আদানি ও তাঁর বড় ভাই বিনোদের বিরুদ্ধে অভিযোগে। অভিযোগ এই যে তাঁরা মরিশাস থেকে অস্বচ্ছ কিছু কোম্পানি খুলে হিসাবে ও বিভিন্নভাবে কারচুপি করে নিজেদের বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক ভাবে স্ফীত করে রেখেছেন এবং তার থেকে সব সুবিধা নিচ্ছেন। আদানিরা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আর সরকার তাতে সন্তুষ্ট, পরন্তু সরকার সাবধানী কণ্ঠ বা প্রতিবাদকারীর বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে দেশের শেয়ার কেনা-বেচার নজরদারি সংস্থা সেবি  আংশিক তদন্ত করলেও বহু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। তদন্তের গতি অতি মন্থর তাই নতুন করে বিভিন্ন সূত্র থেকে সন্দেহ দানা বেঁধেছে যদিও সুপ্রিম কোর্ট এখনও সেবির উপরেই আস্থা রেখেছে। নির্বাচনী তহবিলে ও প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে চাঁদা দেওয়া এবং সে-সংক্রান্ত তথ্যের গোপনীয়তার (সুপ্রিম কোর্টে এ সংক্রান্ত বিচার চলছে) কারণে মানুষের সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

সম্প্রতি (২০১১ সালের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পর) টিউনিসিয়া ও ইজিপ্টে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে সেসব দেশের কর্তাব্যক্তিদের (বিশেষ করে দেশের প্রেসিডেন্টের) সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা বিভিন্নরকমের সরকারি অনুগ্রহ আদায় করে নিয়েছে আইনকে শিথিল করে বা তাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে এবং অন্যভাবেও। এইসব ব্যবসা দেশের সামগ্রিক আয়ে বা কর্মসংস্থানে যে ভূমিকা নিয়েছে তার তুলনায় বহুগুণ বিসদৃশভাবে বাড়িয়েছে নিজেদের মুনাফা ও আর্থিক শক্তি, মুনাফার একটা অংশ অনুগ্রহকারী-কর্তাদের বিলানোর পরও। ছোট-বড় ক্ষমতাশালীদের দেশে-বিদেশে ছড়ানো বিলাস সম্পদ যে-কোনও সাধারণ মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেবে। এইসব বিকট তথ্য, যা জনশ্রুতিকে হার মানায়, টিউনিসিয়া ও ইজিপ্টে সরকার পরিবর্তনের পর সংগৃহীত হয়েছে (সরকারি বাধায় আগে তা হতে পারত না!)। একই কথা পৃথিবীর আরও অনেক দেশের জন্যই সত্য। মানুষ সব জেনেও স্বৈরতন্ত্রের কাছে অসহায়। সাধারণভাবে বলা যায় এটাই ক্রোনিজমের চরিত্র।

কিন্তু অনুগ্রহের জোরে টাকার স্রোত নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও ক্রোনিজমের অদৃশ্য ক্ষতিকারক একটা দিক আছে, তা হল প্রতিযোগিতাকে প্রতিহত করে উদীয়মান দক্ষ উদ্যোগপতিদের হতাশ করা। যার অর্থ প্রকারান্তরে দেশে সামগ্রিকভাবে শিল্প-বাণিজ্যে দক্ষতার বৃদ্ধিকে বাধা দিয়ে বিকাশের সম্ভাবনাকে খর্ব করা। এভাবে স্বৈরতন্ত্র বা অবিকশিত দুর্বল গণতন্ত্রের শাসনে থাকা বহু দেশ প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদ-ধন্য হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের সম্ভাবনাকে আটকে রেখেছে বহু মানুষের স্বাধীন উদ্যোগে লাগাম পরিয়ে। তবে একটা কথা মনে রাখা দরকার— পুঁজিপতিদের যে-কোনও সুবিধা দেওয়াই ধিক্কারজনক নয়। অনেক সময় সেটা দরকার দেশের স্বার্থে, যদি সুচিন্তিতভাবে তা করা যায়। শিল্পকে জলের দামে জমি দেওয়া বা অন্যভাবে সুযোগসুবিধা দেওয়া অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই কাজটা হতে হবে স্বচ্ছ এবং মুক্ত আলোচনার বিষয়। আদানিদের ক্ষেত্রে অনেক গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও মুক্ত আলোচনার পরিবেশটাই নেই। দেশি-বিদেশি বিশ্বাসযোগ্যতা-সম্পন্ন সাংবাদিকদের, এমনকি দেশের সাংসদদেরও নানাভাবে নিগ্রহ ও ভীতিপ্রদর্শন করা হচ্ছে। এখানেই ঘনীভূত হচ্ছে ক্রোনিজমের ছায়া এবং উঠছে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্বন্ধে প্রশ্ন।

একটা মুক্ত গণতান্ত্রিক দেশে আমরা কী আশা করতে পারি? আমেরিকার কথা ধরা যাক।

বিল গেট্‌স্ এবং মাইক্রোসফট কর্পোরেশনের নাম আজকে সবাই জানে। মাত্র তেরো বছর বয়সে খেলার ছলে গেটস-এর কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এ হাতে খড়ি হয়, আর তার ছয় বছর পরে মাত্র উনিশ বছর বয়সে সে মাইক্রোসফট কর্পোরেশনের প্রতিষ্ঠা (বন্ধু পল এলেনের সঙ্গে) করে। বিস্ময়-বালকটি তারপর অপ্রতিরোধ্য উদ্যমে কম্পিউটার ব্যবহার প্রসারের দিগদর্শনে মগ্ন হয়। বয়স যখন তিরিশের কোঠায়, সে অপারেটিং সিস্টেম উইনডোজ চালু করে কম্পিউটার জগতের একজন দিকপাল হয়ে বসে সম্পূর্ণ নিজের উদ্ভাবনী শক্তি ও বহুজাতিক সংস্থা পরিচালনার দক্ষতায়। অবশ্যই কম্পিউটার চিপ্‌স্‌-এর অভাবনীয় প্রযুক্তিগত উন্নতি গেটস-এর সাফল্যের পরিবেশ তৈরি করেছে। উদ্ভাবন তো একটার সঙ্গে আর-একটা তাল মিলিয়েই এগোয়। কিন্তু দেশের সরকারের কোনও সাহায্য নেওয়ার প্রশ্নই ছিল না গেটস-এর কাছে কারণ সরকার বা অন্য কেউ বুঝে ওঠার আগেই উদ্ভাবন এগিয়ে গেছে। এ ছিল প্রযুক্তির বিপ্লবের আবর্তে নিজেকে টিকিয়ে রাখার লড়াই। গেটস তার The Road Ahead বইতে বিষয়টা বুঝিয়ে লিখেছে।

কিছুদিনের মধ্যেই ইন্টারনেটের প্রচলন হয় যা নানাভাবে মাইক্রোসফট কর্পোরেশনকে টিকে থাকার পরীক্ষায় ফেলে দেয়। গেটস-এর কাছে সব থেকে বড় প্রশ্ন দেখা দেয় কীভাবে উইনডোজ-কে ইন্টারনেট পরিষেবা পাওয়ার পক্ষে সবচেয়ে সুবিধাজনক মাধ্যম করে তোলা যায়। ভয় এই যে তা না করতে পারলে অন্যান্য কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মাইক্রোসফট কর্পোরেশন হারিয়ে যাবে। এই লক্ষে মাইক্রোসফট তার web-browser-কে উইনডোজ অপারেটিং সিস্টেমের সঙ্গে জুড়ে দেয়। এই জুড়ে দেওয়ার ফলে মাইক্রোসফটের প্রতিযোগী web-browser উইনডোজ অপারেটিং সিস্টেমের মধ্যে ঢুকতে পারছিল না, সেগুলোকে সহজে কম্পিউটারে স্থাপনই করা যাচ্ছিল না। বলতে গেলে এইভাবে মাইক্রোসফট web-browsing-এ একচেটিয়া অধিকার পাচ্ছিল।

এখানে ক্রোনিজমের কোনও অভিযোগ ছিল না কারণ মাইক্রোসফট কোনও সরকারি সুবিধা নেয়নি, কিন্তু নিজেদেরই তৈরি দুটো সফটওয়ারকে পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে সুবিধা নিচ্ছিল নিজেদের প্রযুক্তিগত ক্ষমতায়। বস্তুত তারা একটা চাবির সন্ধান পেয়েছিল যার সাহায্যে প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদের বাঁচাতে একটা আড়াল তৈরি করেছিল। Web-browsing-এর প্রতিযোগী উন্নত সফটওয়ার তৈরির পথে এই পন্থা বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং ফলস্বরূপ ব্যবহারকারীদের পছন্দও সীমিত হয়ে যায়। এই যুক্তিতে অনেক বিতর্কের পর আমেরিকার একচেটিয়া কারবার বিরোধী আইনে মাইক্রোসফট কর্পোরেশনকে রীতিমত বাধ্য করা হয় ওয়েব-ব্রাউজিং ও আপারেটিং সফটওয়ারকে পরস্পরের থেকে বিযুক্ত করতে। সারা বিশ্ব তাকিয়ে দেখেছে বিরাট বিতর্কের মধ্যেও উদ্যোগ ও প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করার প্রতিষ্ঠান কেমন হতে পারে। মাইক্রোসফট কর্পোরেশন, যা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির দিশারি, তাকে নিরস্ত করতে আমেরিকা পিছপা হয়নি। এ হল ক্রোনিজমের অপর মেরু।

আমাদের নিজেদের দেশ ভারতবর্ষ আছে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। গৌতম আদানি কোনও প্রযুক্তিগত বিপ্লবের পথিকৃৎ নন্‌। তিনি একজন বিনিয়োগকারী। একজন প্রতিভাবান শিল্পপতি প্রতিযোগিতার পরিবেশে নিজের কোম্পানির বিকাশ ঘটাতে সক্ষম। কিন্তু বিকাশের জন্য রাজনৈতিক যোগাযোগ দরকার হয় তখনই যখন প্রতিযোগিতার বাইরে গিয়ে সরকারি অনুগ্রহ লাভের বাসনা জাগে। এখানেই আদানির বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ যার চূড়ান্ত প্রকাশ হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদনে। এই অভিযোগ নিষ্পত্তিতে সরকারের যা ভূমিকা তা শিহরণ জাগায়।