Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

তুলো নিয়ে তুলকালাম

উন্মেষ মিত্র

 


২০২৪ সালের অন্তর্বর্তীকালীন বাজেটে বয়নশিল্পের জন্য ২৭.৬ শতাংশ তহবিল বৃদ্ধির ঘোষণা করা হলেও মুখে আনা হয় না শ্রমিক সমস্যা অথবা বর্জ্য পদার্থের ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলো। বর্তমানে প্রাধান্যের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত শুকনো বর্জ্যের ব্যবস্থাপনার ওপর গবেষণা, বর্জ্য থেকে কৃত্রিম তন্তু চিহ্নিতকরণ এবং আলাদা করার অত্যাধুনিক ব্যবস্থা, পুনর্ব্যবহার প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ, শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি ইত্যাদি বিষয়গুলো। সচেতন হতে হবে ব্যবহারকারীদেরও। কৃত্রিম তন্তু এবং প্রাকৃতিক তন্তুর তফাৎ, ব্যবহারের পর কী করা উচিত, এগুলি শিখতে হবে সাধারণ মানুষকে

 

খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, এই তিনটি হল মানুষের নূন্যতম চাহিদা। এর মধ্যে বস্ত্র, অর্থাৎ জামা-কাপড় মানুষের নগ্নতাকে আচ্ছাদিত করতে শুরু করেছিল আজ থেকে ৮৩,০০০ বছর থেকে ১,৭০,০০০ বছরের সময়কালের মধ্যে। এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত ঐতিহাসিক উপাদান থেকে বলা যায়, তুলোচাষের আঁতুড়ঘর ভারতীয় উপামহাদেশ। বর্তমান পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশে অবস্থিত মেহেরগড়ের কাছেই পাওয়া গেছে প্রাচীনতম তুলোচাষের প্রমাণ। তার প্রায় সাত হাজার বছর পর স্বাধীন ভারতবর্ষের সংসদের উচ্চকক্ষে আলোচনার মূল বিষয় এই তুলো!

ভালভাবে বলতে গেলে, বয়নশিল্পের অবশিষ্ট বর্জ্য পদার্থের ব্যবস্থাপনা নিয়ে দেশের নীতিনির্মাতাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ক্রমশ বাড়ছে। ২০২২ সালে Union Ministry of Housing and Urban Affairs দ্বারা প্রকাশিত Circular Economy in Municipal Solid and Liquid Waste শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে প্রতিদিন গড়ে ৪৭৮৬০ টন শুকনো বর্জ্য উৎপাদিত হয়েছে, যার মধ্যে ১৫ শতাংশ বর্জ্যের উৎপত্তিস্থল বয়নশিল্প। আর এই বিপুল বয়নশিল্পজাত বর্জ্যের মাত্র ৩০ শতাংশ সংগ্রহ করে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তোলা সম্ভব হয়েছে।

বয়নশিল্পজাত বর্জ্যকে মূলত দুভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, প্রাকৃতিক তন্তু, অর্থাৎ তুলো, পাট, পশম ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত, কৃত্রিম তন্তু, যেমন, পলিয়েস্টার, নাইলন, অ্যাক্রিলিক ইত্যাদি। এর মধ্যে প্রথমভাগের তন্তুরা পচনশীল, এরা পচে পরিবেশে মিশে যেতে বেশি সময় লাগলেও পরিবেশের সঙ্গে মিশে যাবে সেই নিশ্চয়তা আছে। কিন্তু দ্বিতীয়ভাগের তন্তুরা হল প্লাস্টিকের মতো, বিনা বিকৃতিতে হাজার হাজার বছর পরিবেশে টিকে যায়। সোজা কথায় বলতে গেলে এই কৃত্রিম তন্তু হল প্লাস্টিকের মাসতুতো ভাই।

আমাদের দেশের চাহিদা অনুসারে ২০ শতাংশ কৃত্রিম তন্তু আমরা বাইরের দেশ থেকে আমদানি করি, বাকি ৮০ শতাংশ আমাদের দেশেই উৎপাদিত হয়। আর এই দেশে উৎপাদিত কৃত্রিম তন্তুর মধ্যে ৯৪ শতাংশ হল পলিয়েস্টার এবং রেয়ন। এই পলিয়েস্টার তৈরি করতে প্রয়োজন হয় ৩৪ কোটি খনিজ তেলের ব্যারেল এবং প্রায় ৪ কোটি ৩০ লক্ষ টন রাসায়নিক। পরিবেশের ওপর প্রভাবটা একবার ভেবে দেখুন।

আপনার মনে এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে, এই সমস্যার সহজ সমাধান হিসাবে বর্জ্য সংগ্রহ করে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য বানিয়ে ফেললেই হয়। কিন্তু এখানে ব্যাগড়া দিয়ে বসল অর্থনীতি। প্রথমত ময়লার স্তূপ থেকে এই কৃত্রিম তন্তু আলাদাভাবে সংগ্রহ করা বেশ সময়সাপেক্ষ, পরিশ্রমসাধ্য কাজ। প্রতি কেজি কৃত্রিম তন্তুর বর্জ্য আলাদা করার খরচ ৪০-৫০ টাকা। তারপর পরিবহন খরচ, শ্রমিকদের মজুরি মিটিয়ে কেজিতে আরও ১০ টাকা বেড়ে যায়। এত ঝক্কিঝামেলা করে বাজারে এই ব্যবহৃত তন্তুর বর্তমান বাজারমূল্য কেজি-প্রতি ৮-১২ টাকা। দুঃখের কথা, প্রতি কেজিতে ৩০-৩৫ টাকা লোকসান পুষিয়ে স্বয়ংসেবক হতে কেউ রাজি নয়।

ভাল নেই এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকেরা। মজুরি কম, নিশ্চয়তা নেই, অস্বাস্থ্যকর কর্মস্থল। যে সকল শ্রমিকেরা বর্জ্য পদার্থের মধ্যে থেকে বেছে বেছে কৃত্রিম তন্তু সংগ্রহ করার কাজ করেন, তাঁদের অবস্থা তথৈবচ। ২০২৪ সালের অন্তর্বর্তীকালীন বাজেটে বয়ন শিল্পের জন্য ২৭.৬ শতাংশ তহবিল বৃদ্ধির ঘোষণা করা হলেও মুখে আনা হয় না শ্রমিক সমস্যা অথবা বর্জ্য পদার্থের ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলো। এই পরিস্থিতিতে প্রাধান্যের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত শুকনো বর্জ্যের ব্যবস্থাপনার ওপর গবেষণা, বর্জ্য থেকে কৃত্রিম তন্তু চিহ্নিতকরণ এবং আলাদা করার অত্যাধুনিক ব্যবস্থা, পুনর্ব্যবহার প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ, শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি ইত্যাদি বিষয়গুলো। সচেতন হতে হবে ব্যবহারকারীদেরও। কৃত্রিম তন্তু এবং প্রাকৃতিক তন্তুর তফাৎ, ব্যবহারের পর কী করা উচিত, এগুলি শিখতে হবে সাধারণ মানুষকে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থেকে ব্যবসায়ীদের সচেতনতা, ব্যবহারকারীদের সামনে সঠিক তথ্য পরিবেশনা থেকে শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি, বহুমুখী সমাধানই পারে তুলো নিয়ে তুলকালাম হওয়া থেকে আমাদের রক্ষা করতে।