Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গোপাল ঠাকুর এয়েচেন গো— কিছু ব্যক্তিগত কথাবার্তা

অশোক মুখোপাধ্যায়

 

[চওড়া রাস্তার ধারে একটা বড় চায়ের দোকান। সেখানে এক আড্ডাস্থলে এক বৃদ্ধ ও এক যুবকের বাক্যালাপ। বাতিল ল্যাম্পপোস্টকে দুদিকে ইটের পাঁজার উপর রেখে বেঞ্চি বানিয়ে তাতেই বসে আছে দুজনে।]

জনৈক সরল যুবক: খবরটা শুনে আপনার কাছেই প্রথম ছুটে গেলাম। অনেককাল ধরেই পশ্চিমবাংলার স্কুলের চাকরিতে দুর্নীতি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি, এদিক-ওদিক মতামত দিচ্ছি, নানারকম তর্কবিতর্ক শুনছি, নিজেও যেখানে যা পারি বলছি, কিন্তু সত্যিই বলছি, জীবনে এতটা ধাক্কা কখনও খাইনি। এর থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে, এর পেছনকার রহস্য উদ্ঘাটিত করতে ভূভারতে কেউ যদি পারে, সে শুধু আপনিই পারবেন। প্রচুর পূর্ব-অভিজ্ঞতা থেকেই এটা আমার দৃঢ় উপলব্ধি।

(স্বগতোক্তি) বুঝতেই পারছেন, ঘনশ্যাম দাস আর সিধুজ্যাঠা— এই দুজনের বেপাত্তা জোনে চলে যাওয়ার পরে আপনি ছাড়া আর কেউ নেই এখন ধরাধামে, যিনি মানুষের যে-কোনও কৌতূহল মেটাতে পারেন। যখনতখন। দেখেছি, উত্তর আপনার যেন তৈরিই থাকে। প্রশ্ন করাটাই যা বাকি! সেই ভরসাতেই এলাম!

যাক, বাঁচালেন দাদা। মোড় ঘুরতেই দেখলাম, ফাঁকাই আছেন। নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।

বহুদর্শী জ্ঞানী বৃদ্ধ (দুই গাল হেসে): চলে এলি? একটুও তর সইল না? চ্যানেলে চ্যানেলে এখন ব্যাপক বাইটিং চলছে, ভাষ্যকারদের মধ্যে ফাইটিং-ও হচ্ছে নিশ্চয়ই। আরও কিছুটা শুনে এলে পারতিস!

জনৈক সরল যুবক: আপনি হাসছেন বটে চটাদা। আমার মনের অবস্থাটা ভেবে দেখেছেন?

চটাদা: অমন সিঙ্কিয়ারা টানেলের মতো মন হলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। কোনও দিক তো খোলা রাখিস না। খবরপবন ঢুকবে কোথা দিয়ে?

জনৈক সরল যুবক: কী যে ছাই বলে লোকটা! কী বললেন? কোন চ্যানেলের কথা বলছেন?

চটাদা: চ্যানেল নয় রে বাচ্চু, টানেল। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর-মোদি চারধাম টানেলের কথাও ভুলে গেছিস? তোরা থাকিস কোন দেশে?

বাচ্চু: ও হো! বুঝে গেছি। (হাসি হাসি মুখে) চা-টা বলে আসি? আপনি মাঝে মাঝে এমন ঘাবড়ে দেন যে বলার নয়।

চটাদা: তুই আসলে আগে থেকেই ভেতরে ভেতরে বিগড়ে আছিস। একটা অতি পেয়ারের প্লেয়ার মোহনবাগানে সই করলে ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার ছোকড়াদের যেমন রাগ হয় সেরকম আর কি! কী বল?

বাচ্চু: খোঁচা দিচ্ছে বুঝেও চুপচাপ হজম করে নিতে হবে। এখন অন্য কথায় গেলে হবে না। এরকম কেন হল, কিছু বুঝতে পেরেছেন?

চটাদা (একটা সিঙ্গারার হাফ মুখের গর্তে ঢোকাতে ঢোকাতে): হল মানে? কবে হল?

বাচ্চু: এই যে আজ শুনে এলাম, উনি হুগলি নদীর ধার থেকে সরে গিয়ে হলদি নদীর ধারে পাকা আসনে বসতে চাইছেন।

চটাদা: তুই আজ শুনে জানলি। আমি তো সাত-আট মাস আগে থেকেই জানতাম।

বাচ্চু (একটা সিঙ্গারা হাতে তুলেও মাঝপথে আটকে গেল): আপনি জানতেন এমন করবেন উনি?

চটাদা: পুরো। শুধু আমি কেন, তোরও জানা থাকা উচিত ছিল।

বাচ্চু: কী করে জানব? আমি কি জ্যোতিষী নাকি?

চটাদা: তাহলে আমিই বা কী করে জানলাম? আমি কি তোর মতে আজকাল ঝোতিছিগিরি করি?

[জ যে ঝ-এর মতো আর ষ যে ছ-এর মতো শোনাল, তার জন্য অবশ্য তারুকাকার সিঙ্গারার অতি-উষ্ণতাই দায়ী]

বাচ্চু (নাছোড়ভাবে): সেটাই তো বুঝতে চাই। আপনি অতকাল আগেই কীভাবে বুঝে গিয়েছিলেন?

চটাদা (মুচকি হেসে): যা, চা নিয়ে আয়, বুঝিয়ে দিই। এ সবই অ্যালজেব্রা, বুঝলি, সিম্পল অ্যালজেব্রা। এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার ইকোয়েল টু এ-স্কোয়ার প্লাস টু-এবি…

বাচ্চু: প্লাস বি-স্কোয়ার— এ তো সবাই জানে। কিন্তু এই ব্যাপারটা কি এত সরল?

চটাদা: যদি অঙ্কটা জানিস, তবে একদম সরল। আর যদি এইমাত্র যেটা আমাকে বললি, সেটা আমাদের অন’বল পিএম-এর মতো হাথরাসে হাতড়ে বেড়াস, তবে গোলমাল হবে।

বাচ্চু: দেখুন চটাদা, আমরা আপনার কাছে কঠিন জিনিসগুলোই বুঝতে আসি। আপনার কাছে হয়তো জলের মতো সহজ, আমার তো মাথায় ঢুকছেই না, এরকম একটা ঋজু চরিত্র, এতটা কড়া কড়া জাজমেন্ট যাঁর, তিনি সেই ডাকু মাস্টার পদ্মগোখরোদের দলে গিয়ে নাম লেখাবেন এবং তার জন্য ছ-মাস আগেই চেয়ার ছেড়ে দেবেন! এসএসসি প্যানেল নিয়ে ওনার যে অবস্থান, আজও ভাবলেই আমার শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসে…

চটাদা: বুঝতে পেরেছি। তোদের বুদ্ধি-বিবেচনা এখন শুধু সংবাদপত্রের পাতা আর বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ফ্লোরে আটকে পড়ে আছে। মাথায় স্বাধীন ভাবনাচিন্তা একেবারে ফুরুৎ! তাই না?

বাচ্চু: নিজেকে বোঝাতে হয়, এখন চুপ করে থাকতে হবে। এই গোলাগুলি ছুড়তে ছুড়তেই উনি ঠিক আবার ক্লাস নিতে শুরু করবেন। না, মানে…

চটাদা: তোরা ভাবলি, রাজ্যের রুলিং পার্টিকে এইসব চুরি-দুর্নীতির মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে সরকার ফেলে দেবার মতো একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যাবে। দুর্নীতি-মামলার জালে ছোট থেকে মাঝারি হয়ে বড় বড় বোয়াল সব ধরা পড়বে। তারপর কোনও একটা সময়ে বিরোধীরা রাজ্যপালের কাছে গিয়ে সরকার ফেলে দেবার সুপারিশ করবে। তাই না?

বাচ্চু: তা যা বলেছেন, আমরা অনেকেই এরকমই ভেবেছিলাম।

চটাদা: তখন নতুন যারা সরকারে এসে বসবে, তারা এসেই তোদের সব কটাকে চাকরি দিয়ে দেবে। তাই না?

বাচ্চু: হ্যাঁ, সেটাও…

চটাদা: চোরের দল উৎখাত হয়ে যাবে আর সাধু পার্টি এসে সরকার চালাবে। তাই তো?

[বাচ্চু চুপ করে যেন সম্মতিই জানায়]

চটাদা: ফলে ওনার জাজমেন্টের সঙ্গে সঙ্গে ধেয়ে ধেয়ে আসা কমেন্টগুলি আর লক্ষ করিসনি। ঠিক বলেছি না?

বাচ্চু: কমেন্ট? কোন কমেন্টের কথা বলছ?

চটাদা: তা’লে আমি ঠিকই ভেবেছি। শুনেই ভুলে মেরে দিয়েছিস। এই ধর, স্কুল চালাতে না পারলে আদানিকে দিয়ে দিন। বলেছিলেন না তোদের এই হুগলির ধার?

বাচ্চু: হ্যাঁ, তা বলেছিলেন। একটু তেতো লাগলেও কথাটা মেনে নিচ্ছি।

চটাদা: ইউপি থেকে বুলডোজার আনতে পরামর্শ দিয়েছিলেন— মনে আছে নিশ্চয়ই?

[বাচ্চু চুপ করে থাকে]

চটাদা: এই সব বাণীগুলির কিছু মানে বুঝেছিলি? না, কিছুই খেয়াল করিসনি?

বাচ্চু: স্বীকার করছি, এই সব মন্তব্যের উপরে কোনও গুরুত্বই দিইনি। বরং তখন মনে হয়েছিল, দুর্নীতি সম্পর্কে ওনার মনোভাব একেবারে অনমনীয়। উনি আমাদের গরিবদের, বেকার যুবকদের ভগবান। বলেছিলেন, এর শেষ দেখে ছাড়বেন। কিসের শেষ, কোনদিকের শুরু তা নিয়ে মাথাই ঘামাইনি।

চটাদা: যখন বলেছিল, দরকার হলে রাহুল গান্ধির হিসাবও চাইতে পারি, তখন খেয়াল করেছিলি— আদানি বা রাফায়েলের হিসাব নিয়ে কোনো আওয়াজ দেয়নি? নাকি, তাও খেয়াল করিসনি?

বাচ্চু: বলছি তো, এইসব কথার মানে বুঝিনি তখন।

চটাদা: আর আমি তোদের এই পেয়ারাতলায় বসে বসেই সেদিন আন্দাজ করেছিলাম, ইনি পায়ে পায়ে আদানির বিচরণক্ষেত্র, বুলডোজার-রাজের কুম্ভতীর্থের দিকে এগোচ্ছিলেন। অনেককেই আমি সেইসব দিনে সাবধান করে বলেছিলাম, দেখে নিস, ইনিও চূড়াদালতের সেই মহোদয়ের মতো পোস্ট রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট নিয়ে চিন্তা শুরু করে দিয়েছেন। তোদের কয়েকজন বন্ধুবান্ধব আবার সেই সুযোগে আমাকে দিয়ে হাওয়াই চপ্পলও চাটিয়ে নিয়েছিল! মনে আছে?

বাচ্চু: আর লজ্জা দেবেন না। সত্যিই আপনি এরকম সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন অনেককাল আগেই। আমরা কেউই খুব একটা পাত্তা দিইনি। বরং আমাদের বন্ধুবান্ধবদের দু-চারজন মাথা গরম করে আপনার নাম ধরে ব্যঙ্গ করে যা-তা বলেছিল। আমিও যে তখন বাধা দিয়েছিলাম তেমন নয়। কেমন যেন একটু রাগই হয়েছিল আপনার উপর।

চটাদা: তোরা ছেলেমানুষ। আমি ওতে কিছু মনে করিনি। তবে আমারও বুঝতে ভুল হয়েছিল।

বাচ্চু: ভুল হয়েছিল? আপনার? কী ভুল?

চটাদা: আমি সত্যিই ভেবেছিলাম, পোস্ট-রিটায়ারমেন্ট পদসঞ্চার হবে। অবসর গ্রহণের আগেই বেরিয়ে পড়বেন, এটা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।

বাচ্চু: এখন কী মনে হচ্ছে?

চটাদা: আসলে পার্লামেন্ট ভোট এসে যাচ্ছে। চেয়ারে বসে চেহারা দেখানোর পালা মোটামুটি শেষ। এখন আরও বড় কিছু করে দেখানোর তাগিদ— ইয়ে মানে— তোরা যে বলিস খিদে, সেটা প্রবল হয়ে উঠেছে। প্লাস…

বাচ্চু: হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুন বলুন, আর কী বলছিলেন। আর একটু চা বলব?

চটাদা: অবশ্যই বলবি। জ্ঞানদানে কণ্ঠ শুষ্কায়তি… সেদিন যেই উনিজি ঘুরে গেলেন, মনে হয় একটা কিছু সিগন্যাল চলে গেস্‌ল! অনেক হয়েছে, এবার ছাল ছাড়তে পারো। আসলে কী বল তো, ছাল পরে বেশিক্ষণ বোধহয় থাকা যায় না, চুলকায়!

বাচ্চু (আরও দু-গ্লাস চা নিয়ে এসে): কী করে আপনি এত দূর বুঝলেন বলুন তো? অবশ্য যদি আপত্তি না থাকে…

চটাদা: আপত্তির কী আছে? (চায়ের গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক মেরে) তোরা যেটাকে মিডিয়ার প্রচারের তালে ভুলে যাস, আমি আবার ওটা দিয়েই ঘটনাবলি বোঝার চেষ্টা করি। আবেগ যেদিকেই টানুক, অবজেকটিভ থাকার চেষ্টা করি। তাতেই এইসব কমবেশি ধরা পড়ে যায়!

বাচ্চু: অবজেকটিভ? হ্যাঁ শব্দটা অনেকবার কানে এসেছে। মানে বুঝিনি।

চটাদা: এবার বুঝে নিস। এমন কিছু জটিল নয়। স্রেফ বস্তুবাদ। এক্স-রেও বলতে পারিস। কোনও জিনিস যেমন তাকে ঠিক তেমন করে বুঝতে হবে। তুই কী চাইছিস তাই দিয়ে নয়।

বাচ্চু (স্বগতোক্তির মতো বলতে থাকে): অবজেকটিভ হতে হবে… অবজেকটিভ হতে হবে…