অন্তরা মুখার্জী
নব্বইয়ের দ্বিতীয়ভাগে, ‘সাদা মোজা’ আর ‘স্কুল স্কুল ইউনিফর্ম’-এর শেষ হওয়ার দুঃখ, নাকি খোলা চুলে, চোখে কাজল দিতে শেখার আনন্দ, কোনটার পাল্লা ভারী ছিল তা আজ আর মনে পড়ে না। ‘জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার’— নব্বইয়ের সেইসব অলস দুপুর সরে দাঁড়িয়ে সবুজ সঙ্কেত দিচ্ছে হাওড়াগামী লোকাল ট্রেনকে। যে-শহরে ঈশ্বর থাকেন, তারই নরক-কঙ্কাল পেরিয়ে, বাহান্নর বেহালাগামী বাসে উঠে বসে আমার চল্লিশের ক্লান্ত শরীর। খিদিরপুর বাজার পেরোলে মনে পড়ে এখানেই আছে মনসাতলা লেন। স্কুলের বন্ধু শুভঙ্করকে চিঠি লেখার সময় খেয়াল না করলেও এখন ভাবি এই তো সেই ঈশ্বরবিহীন কলকাতা যাকে চেনে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। আর সৎ ভেবে ব্রাত্য করেছে স্বজনেরা। আচ্ছা, আত্মীয়রা কি সত্যিই আত্মার কাছাকাছি থাকে? তাহলে, রোজ রোজ যখন বাস থেকে নেমে, আজানের ডাক আর কাঁসরঘন্টার সংমিশ্রণে এক চিলতে পথ অতিক্রম করি, তখন তাদের দেখতে পাই না কেন? ঘুপচি, দর্জির দোকানের সারি পেরিয়ে, ব্যস্ত পায়ে, ঘড়ির দিকে চোখ রাখতেই অপরাধবোধ গ্রাস করে। যতই হাতে সময় নিয়ে বের হই না কেন, এ-শহর আমাকে হারিয়ে দেবে ঠিকই। এগারোটার ক্লাসে দু-মিনিট লেট। অন্তবিহীন পথে জীবনের কথা বলার শিক্ষা সেই নব্বইয়ের নচিকেতার গানে। সুমন-অঞ্জন-নচিকেতা জেনারেশনের নিওলিবেরাল প্যারাসিটামল এমন সঠিক মাত্রায় মজ্জায় মিশে গিয়েছিল, যে আজও মনখারাপ ‘ডিপ্রেশন’কে হারিয়ে দেয়। প্রখর রৌদ্রে বসন্তের ঘ্রাণ নাকে আসে, সে ‘ফুল ফুটুক নাই বা ফুটুক’। তাই শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা আমার চলার পথ থামাতে পারে না। রোজনামচায়, ভোর থেকে একটার পর একটা ঘরে ঢুকেই বেরিয়ে পড়ি। লুকোচুরির খেলায় প্রথমে রান্নাঘর, তারপর সাজঘর, তারপর ট্রেনঘর পেরিয়ে ধাপ্পা দিই ক্লাসঘরে এসে। রানার কি আমার থেকেও জোরে ছুটতে পারত? কাজ করা মায়েদের বড় জ্বালা। শ্যাম রাখি না কুল রাখি ভাবতে গিয়ে ভাবা তো আর হল না। আর সমস্ত পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিয়ে মহাসিন্ধুর ওপার থেকে এল মহামান্য কোভিড-নাইনটিন। যত মজা ছিল অমিতাভ বচ্চনের ‘লক কিয়া যায়’-এর গাম্ভীর্যে, ঠিক ততখানি উদ্দীপনা নিয়েই সমাজের এক বৃহত্তর স্তর একটু জিরোল। সত্যজিৎবাবুর টিয়াপাখির অনুচ্চারিত ‘8-2-0’তে আশ্বাস পেলাম একটু জিরোনোর। তখনও বুঝিনি, দম নেওয়ার মানে একদিন দম বন্ধ হয়ে যাওয়া হবে।
কলেজগেটের দুপাশে পড়ে থাকা আবর্জনা যে মনখারাপের কারণ হতে পারে, লকডাউন শেখাল। যেদিন প্রথম বদলির পরোয়ানা হাতে এই নতুন কলেজে গিয়েছিলাম, স্বীকার করে নিই, খোদ কলকাতার কলেজ হলেও, সেদিন হাপিত্যেশ ছিল। কোথায় এলাম! বাঁধানো ঘাট নেই, গাছ নেই, নদী নেই! কী করে এই জমা জলে সাহিত্য পড়াব! কী নিয়ে থাকব অলস সময়গুলোতে? এক ঝাঁক উজ্জ্বল চোখ, দুষ্টুমি ভরা হাসিমুখ, স্বভাবসিদ্ধ অবাধ্যতার উদ্যমে জীবনের দশটা বছর কাটিয়েছিলাম ফরাসি বাতাবরণের চন্দননগরে। আজীবন শত্রুতায় ইংরেজ এবং ফরাসিরা জর্জরিত থাকলেও, চন্দননগরে আমার কোনও ছন্দপতন ঘটেনি। কিন্তু এখন আমি যে কালো কেশের ঢালু রাস্তার সাদা দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে মনের কথা জানান দিতে হবে ইংরেজিতে অথবা হিন্দিতে। সে-পথ এতই দুর্গম যে আমার চেতনার রঙে পান্না সবুজ বা নীল কোনও কিছুই হবে না। পড়াতে গিয়ে যে আপন উন্মুক্ততার ধারায় বিশ্বাস করে এসেছি এতদিন, সেই বিশ্বাসে শতাব্দীপ্রাচীন ‘মেটাফিজিক্যাল’ কবিরা হোঁচট খাচ্ছেন। আমার মফস্বলের কলেজে পাণ্ডিত্যের ভাণ্ডার নিয়ে চন্দ্রমোহনবাবু যখনই জন ডান পড়িয়েছেন, সব জল গিয়ে মিশে গেছে শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভুতে। ‘মহাপ্রভু’ অবশ্য নব্বইয়ের বাঙালি মা-দিদিমাদের সন্ধ্যার প্রদীপ। যিশু সেনগুপ্তকে বাঙালি সন্ধ্যাবেলায় কত বাতি দেখিয়েছিলেন! কলকাতা-বর্ধমান, বারো-সতেরো ইত্যাদির দূরত্ব মহাপ্রভুর মহিমায় অতিক্রম করেছে আপামর নব্বইয়ের বাঙালি দর্শক। এখানকার ছাত্রছাত্রীরা মহাপ্রভু ছেড়ে বালাজিকে আরাধনা করে বেশি। আমাদের কৈশোরের আশিতে, বুনিয়াদি সার্কাসে, ফৌজিদের আনাগোনা ছিল। তারপর ‘শান্তি’র শান্ত দৃঢ়তায় “বানেগী আপনি বাত”-এর কৌশল শিখলাম কলেজে। আজকাল শাশুড়ি-বৌমার ঝগড়ায় ‘মেটাফিজিক্যাল কনসিট’ বোঝানো যায় না। তাই উপমা দিতে গিয়ে শিক্ষক হিসেবে এত দৈন্যদশায় দিনের পর দিন ভুগেছি, যে নিজের সমস্ত শিক্ষাকে নিমিত্ত মাত্র মনে হত। সর্বোপরি, যে-শরীরকেন্দ্রিক প্রেমের কবিতা ছাত্র-ছাত্রী মিশ্রিত ক্লাসে অনায়াসেই আলোচনা করেছি, সেই একই কবিতা সদ্য স্কুলের গণ্ডি পেরোনো এক ঝাঁক তরুণীর সামনে বলতে দ্বিধা হচ্ছে! ঘটনাবহুল নব্বইয়ের দশকে যখন আমার সৌভাগ্যের যৌবন ছিল, যখন মাধুরী দীক্ষিতের খুক খুক কাশিতে অকহতব্য ইশারা ছিল আর ঐশ্বর্য্যের তীক্ষ্ণ চাহনিতে অকপটে ঠান্ডা পানীয়ের চাহিদা ছিল— ‘Hi, I’m Sanjana. Got a Lehar Pepsi?’— তখন অ্যান্ড্রু মার্ভেলের আগল খোলা ডাকে পাগল হয়ে গেছিলাম। চল্লিশের চালশে পড়া চোখে, এক নির্মম সত্য— “The grave’s a fine and private place,/But none, I think, do there embrace…”— স্বীকার করতে এত আমার কিসের দ্বিধা? ক্ষণিকের বিরতির পর যখন আরও গভীরে পৌঁছানো গেল তখন বুঝলাম আমি আছি এক ব্রাত্য করে রাখা কলকাতার পাড়ায়। এখানে কবরের বরফশীতল আলিঙ্গন নিয়ে ইংরেজদের বাঁকা হাসির ঠাট্টা-ইয়ার্কি চলে না। কলোনিয়াল হ্যাংওভার আমার থাকলেও, আমার ছাত্রীদের মনন কখনও কোনও বৈদেশিক শক্তির কাছে নতিস্বীকার করেনি। যাদের জীবন এক সূক্ষ্ম দড়ির ওপর রোজ রোজ বাজি ধরা, তাদের লড়াই চলে অন্দরমহলেও। আমাদের ভাতের থালা সাজানো থেকেছে, এদের সেটা বেড়ে খেতে হয়। এই সব দিনযাপনের সাহিত্য রচনা হচ্ছে না খুব একটা। তাহলে কি এই নতুন শতকে কোনও এক নতুন ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’র আগমন ঘটবে? কবে? আচ্ছা, “নাদের আলী, আমি আর কত বড় হব?/আমার মাথা এ ঘরের ছাদ ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে/তারপর তুমি আমায় তিন প্রহরের বিল দেখাবে?” প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তরটা অজানা।
কলকাতা তেইশে এসে হিসেবগুলো সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এই কলকাতা মিলছে না আমার চেনা কলকাতার অলিগলির সঙ্গে। নাকি বৃহত্তর কলকাতার কোনও প্রচেষ্টাই ছিল না এই পাড়াগুলোকে জানার? আমারই মতন যারা আশিতে জন্মে নব্বইয়ে শৃঙ্খলা ভেঙেছিল, যারা নিউমার্কেটে সদ্য গজিয়ে ওঠা ‘শ্রীরাম আর্কেড’ থেকে প্রিয়জনের সঙ্গে রাজকীয় ‘ফ্লুরিজ’-এর কাচের জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে শপথ নিয়েছিল এক কাপ চায়ে ‘তাকে’ একদিন ঠিক চেয়ে নেবে, তাদের কতজনই বা উদ্দেশ্যহীনভাবে এসপ্ল্যানেড ছেড়ে ফ্যান্সি মার্কেট গেছে? নাখোদা ছেড়ে সিবতেনাবাদে গেছে? বাবুঘাট ভুলে বিচলিঘাটে বসেছে? ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের অধ্যায় নিয়ে এই অঞ্চল যে বহুমুখী শিক্ষা এবং সংস্কৃতির পসরা সাজিয়ে বসে আছে, তার সুলুক সন্ধান পার্ক স্ট্রিট, সাউথ সিটি আর নিকো পার্কেরা করে? যে-যাত্রা আমি শুরু করেছিলাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমকে ভিত্তি করে, সে-পথে একটু বাঁক নিতে এক আশ্চর্য জাদুবলে বেপর্দা হল পর্দানশিন। পরিচয় হল একঝাঁক দামাল ছেলেমেয়েদের সঙ্গে, যারা ডাক দিয়েছে বৃহত্তর কলকাতাকে, যে-কলকাতা তাদের প্রতিবেশীকে খুব একটা চেনে না। সোহেলভাই, আনোয়ারভাইরা কলকাতা তেইশের অদৃশ্য ইস্টিশনে ট্রেন থামাচ্ছেন। ইতিহাসের পাড়ায় প্রাক্তনীদের সঙ্গে “তুমিও হেঁটে দ্যাখো/…তুমিও ভেবে দ্যাখো/যাবে কি না যাবে”।
মাসখানেক পর হাত বাড়িয়ে বন্ধু হলাম। আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকারা তফাত থেকে স্নেহ করতেন। তাঁদের জ্ঞানের দ্যুতিতে আমাদের ঝলসে যাওয়ার ভয় ছিল। আর ছিল কিছু মধ্যবিত্ত সংস্কার। সেইসব লোটাকম্বল নিয়ে আমরা ক্লাসে যেতাম, আর বুঝতাম বামন হয়ে সিংহদুয়ার ভেদ করা যায় না। অভিমানী বৃষ্টির ফোঁটারা জ্ঞানসমুদ্রে ডিঙ্গি নৌকায় সবটা পথ পেরোতে পারত না। নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষদিকে, পঁচিশ বছরের অবিবাহিত ম্যাডাম যেদিন এক শহরতলির কলেজে যোগদান করতে গিয়েছিল, গেটের বাইরে অপেক্ষা করছিল সম্পূর্ণ অচেনা কুড়ি বছরের হবু ছাত্র অরিজিৎ। নব্বইয়ের ধুতি-পাঞ্জাবিরা শার্ট-প্যান্ট পরলেও কোনও ছাত্রের অপেক্ষায় থাকেননি। “ওয়াগলে কি দুনিয়া”য় আসক্ত মফস্বলের কলেজচত্বরে, ছাত্রছাত্রীরা ‘ওয়াগা বর্ডার’ টপকে খুব একটা শিক্ষকদের কাছাকাছি যেতে পারত না। কিন্তু নতুন শতকে খোকন-সৌমেন-চুমকিরা অনায়াসেই আবছা সীমারেখা অতিক্রম করে ফেলল। মাস ছয়েক পর, ম্যাডামের বিবাহবাসরে রাজা-সৌম্যজিৎ দ্বার ছুটিয়ে, বাধা টুটিয়ে, সামিল হল এক স্বপ্নের উড়ানে। নতুন সংসারে খিচুড়ি রান্না হলে, পাত পেড়ে বসে চেটেপুটে খেয়েছে কত শত বিসমিল্লারা! অর্ণব-সায়ন্তনীরা, অর্ক-অভীপ্সারা যে কোহিনুর-দিন আমায় দিয়েছে, আমার নিজের কলেজের স্মৃতিতে তার কোনও মূলধন গচ্ছিত ছিল না। কর্মজীবনের অজস্র রডোডেন্ড্রনে খালি ডালপালা ভরে গিয়েছিল। শহর কলকাতার কলেজে ফারহানা-সাদিয়া-নাজমারা ক্যান্টিনে বসে যে তেলেভাজা খায় মধুরিমা-রাজরূপাদের সঙ্গে, কুড়ি বছর আগে আমিও সেভাবেই খেতাম বর্ধমানে, কলেজের পাশে কোনও চায়ের ঠেকে। আমার কলেজে ক্যান্টিনের স্বর্গসুখ ছিল না। তাতে অবশ্য জোয়ারভাঁটার অদলবদল হয়নি। তাহলে কলকাতা তেইশের সঙ্গে মফস্বলের বাইনারি কোথায়? রঞ্জনার প্রেমিকদেরকে অন্য পাড়া দিয়েই যেতে হয়। ঠ্যাং ভাঙার যন্ত্রণা শহর, শহরতলি, গ্রাম কিংবা মফস্বলের তফাত বোঝে না। তবু এক শতকের শেষে অন্য শতকের সন্ধিক্ষণে যে কলেজ আমায় ক্যান্টিন না-থাকার দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছিল, সেখানে তফাত ছিল খাবারের মেনুতে, টেবিল বাজানোতে, মাঠে বসে রোদ পোয়ানোতে এবং, সৌভাগ্যবশত, দু-বছরের বাড়তি অমরত্বে।
কলেজজীবনের শুরু ছিয়ানব্বইতে হলেও, সেটা ফুরিয়েছে তিনের বদলে পাঁচ বছরে। ইলেভেন থেকে থার্ড ইয়ার— আমার সোনালী রঙের দিনগুলি আজও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই। কঠিন, শৃঙ্খলাবদ্ধ কনভেন্ট স্কুলযাপনের পর মফস্বলের কলেজে জীবনের নতুন ইনিংস শুরু হল। কমার্স নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্তে আড়চোখে তাকানো স্কুলের সায়েন্স নেওয়া বন্ধুদের কাছে আমি তখন ব্রাত্য। তখন কে আর জানত কালের ঘূর্ণিপাকে, আমি দায়িত্ব পাব এমনই এক ব্রাত্য এলাকার কলেজের যেখানে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য সাধারণ মানুষরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিল বছরের পর বছর। ঘরের আঙিনাতে আবদ্ধ না রেখে তাদের বাড়ির মেয়েদের পৌঁছে দিতে চেয়েছিল শিক্ষার সৈকতে। সুইট সিক্সটিনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এইসব হিজিবিজি চিন্তা মাথায় আসে না। বরঞ্চ, প্রেমের থেকেও তীক্ষ্ণ রাজনীতিবোধ জন্মায়। জীবনে প্রথম রাজনীতির পাঠ আমি ওই কলেজের গাড়িবারান্দায় শিখেছিলাম এবং বুঝেছিলাম মফস্বলের সূক্ষ্ম রাজনীতি শহুরে সমীকরণকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোল দিতে পারে। বেশ কিছু প্রিয় বন্ধু উচ্চশিক্ষাকে সহায় করে মফস্বল ছাড়ল। অন্যেরা ডানা মেলল বিজ্ঞানের গর্বে। মনকে বোঝালাম নতুন বিষয় নিয়ে পড়বি যখন, তখন নতুন বন্ধু খোঁজ। আসলে, হাতে বাণিজ্যিক লোটাকম্বল নিয়ে সামনে যখন যেতেই হবে তখন আর মায়া বাড়িয়ে লাভ কী? সদ্য সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় পড়া মনকে বললাম ‘থাক না, পিছন পিছে পড়ে।’
কমার্সের বাপে তাড়ানো মায়ে খেদানো বদ এবং বিচ্ছুদের সঙ্গে পরিচয় হল জেভিয়ার্সের আপাতদৃষ্টিতে শান্ত দীঘির। গাড়িবারান্দায় শ্রেণিকক্ষের স্তর ভাঙার পরে, আমার পালতোলা নৌকাতে তখন ‘আমি ডুবতে রাজি আছি’। মাঝসমুদ্রের গভীরতাকে পরোয়া না করে, টেবিল বাজিয়ে, বেঞ্চে ওঠে তুমুল হুল্লোড়। আমার পাশে মোহাম্মদ, তার পাশে সৌমী, পিছনে কৌশিক-মধু, ঠিক আগের বেঞ্চে গুড্ডি-কাবলি আর সমবেত কণ্ঠে ‘দয়াবান’: ‘চাহে মেরি জান তু লে লে/চাহে ইমান তু লে লে/পেয়ার একবার তো দে দে….’। হয়তো আমার সাবিনারা এখন অন্য, বন্য গান গায়। কিন্তু সে গানের মাঝে হুড়মুড়িয়ে কোনওদিন আমি ঢুকে যেতে পারিনি। সবাই কি আর বীরেনবাবু হয়? এক বৃষ্টিভেজা আড্ডার দুপুরে আমাদের উদ্দাম বিরহকাতর হৃদয়কে একপ্রকার তুড়ি মেরে, হনহন করে ক্লাসে ঢুকতে শুধু বীরেনবাবুই পারতেন! “Put out the light, Put out the light… বল, কে কোথায় বলেছে?”— সব কটা চোখ আমার দিকে আর আমার পেটের ভেতর ‘হ্যামলেট’ আর ‘ওথেলো’ তাল পাকিয়ে বড়া হওয়ার জোগাড়! তারপর ‘একরাশ কালো কালো ধোঁয়া’য়, গালাগালির বন্যায়, শাপশাপান্তে, বাপের নাম খগেন হল। সযত্নে লালিত, শিক্ষকসুলভ ব্যবহারের পাঠ পাওয়া এক কনভেন্ট ছাত্রী ভিরমি খেয়ে ভুলে গেল তখনকার আগুন ঝলসানো বহ্নিশিখার অবজ্ঞা। এইসব নব্বইয়ের দুপুরেই সম্ভব ছিল। নতুন শতাব্দীর প্রথম দশক পার করে সৌরভদের বকাবকি করলে তারা ফেসবুকে ফ্যাতাড়ু হয়ে এমন চমৎকার সব স্ক্রিপ্ট লেখে যে আফসোস হয়— ওদের নির্ঘাত ইংরেজিটা শেখাতেই পারলাম না। পারলে, সৌমাভদের ইংরেজি খাতায় ভালবাসার লাল রং ফিকে হয়ে আসত। নতুন শতাব্দীর দুই দশক পরে, এখন আমার আমরিন, আলিশা, আমিনারা WhatsApp করতে শিখলেও তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ক্ষত কোনও প্রযুক্তি হাপিস করতে পারে না। চিচিংফাঁক হলেই বোঝা যাবে যে তারা এমন মরমে মরে থাকে যে ওদের বকা সম্ভবই নয়। প্রথম প্রথম চোরাস্রোত বুঝতে না পেরে একদিন নিলমকে শীতলদৃষ্টিতে জানতে চেয়েছিলাম কেন সে সাদা খাতায় কালো কালির আঁকিবুকি দিতে পারছে না। গনগনে আগুনের পাশে যারা রুটির সঙ্গে সাহিত্যের ইতিহাস সেঁকে, যাদের বাড়িতে রোজ সন্ধ্যা হলেই হাত-পা ধুয়ে পড়তে বসা বিলাসিতা, যারা অনেকেই কলেজে এসে নিঃশ্বাস নেয়, সাহস সঞ্চয় করে আগামীর, তাদের পাশে চুপ করে বসে থাকতে হয়, প্রশ্ন করতে নেই। এরা কলকাতার ছাত্রী হলেও এক অন্য কলকাতার বাসিন্দা। ফিটফাট ইংরেজিতে কথা বলতে না পারলেও, মুখে ‘ম্যাক’ না মাখলেও এদের নিত্যনৈমিত্তিক লড়াই আমাকে অনুপ্রাণিত করে। জন্মদিনে হয়তো তারা পার্টি থ্রো করতে পারে না। ডিমের ঝোলে বুশরার মতন প্রিয় দিন কাটানো কি মুখের কথা? এদের প্রাণের পরশ দিয়ে, ক্লান্তি ঘুচিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে হয়। এদের বকতে নেই।
ইস্পাতকঠিন বীরেনবাবুকে যেদিন কাকভোরে মর্নিংওয়াক সেরে ফেরার সময়ে কলেজের দেওয়াল গাঁথার কাজে যোগদান করতে দেখেছিলাম, তখন আঠারো পেরিয়ে বিশের আমি অক্ষরে অক্ষরে বুঝেছিলাম যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে। আইরিশ নাট্যকার জন মিলিংটন সিং-এর নাটক, ‘রাইডার্স টু দ্য সি’ পড়াবার সময় বীরেনবাবু যে ক্ষয়িষ্ণু সমাজের চিত্র তুলে ধরেছিলেন, এই শতাব্দীর দুই দশক পেরিয়ে গেলেও রোজ টের পাই সেই অসামান্য লড়াইটাকে যা একটি সমাজ, ভিন্ন রূপে, প্রতিনিয়ত করে চলেছে। নগরকীর্তনে বাদ পড়ে যাওয়া কলকাতা তেইশ তার সমস্ত তথাকথিত প্রতিকূলতা নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। ভিতটা এতই শক্ত যে তারা আমার দু-বেলা জল ঢালার পরোয়া করে না। তারা সূর্যের কাছে ভালবাসা নেয়, শক্তি পায়। তা না হলে, এই যে এতদিন ও-পাড়ায় যাইনি, সার মাটি কিছুই পড়েনি, তবুও তো বন্ধু সাবিরের তোলা ছবিতে কলেজপাড়ায় সবুজের বিচ্যুতি ঘটতে দেখিনি। গল্পের ছলে একদিন বন্ধু রিয়াজ বলেছিল একটা সময়ে ‘পিজা ডেলিভারি’ করতে আসত না এ-পাড়ায়। আসলে, ওয়াজেদ আলীর বিরিয়ানির সঙ্গে লড়াই করা ইতালির পক্ষে সম্ভব ছিল না। সুইগি, জোমাটো-কে ‘say cheese’ বলানো গেলেও ‘পিৎজা হাট’ গোমরা মুখে এখনও দাঁড়িয়ে। কিন্তু এই লকডাউন বুঝিয়ে দিল, যে ‘বেলা চাও’ তোমার বারান্দায় তুমি গাও, সেই একই গান কলকাতা তেইশও গায়। যে মাস্টার বকে, সেই আবার পরম স্নেহে তার ঘরজোড়া বইয়ের পাহাড়ে বেড়াতে নিয়ে যায়। দরাজ কণ্ঠের গান শুনতে দেয়; সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালা হলে সবচেয়ে মূল্যবান বইটা পেড়ে এক দল তরুণ-তরুণীকে জীবনের পাঠ শেখায়। অতএব, নিজের সমস্ত উন্নাসিকতা মাস কয়েকের মধ্যেই ঝেড়ে ফেলে বললাম, “আয়, আরও বেঁধে বেঁধে থাকি।”
একটা সময় ছিল যখন এই বেঁধে থাকার কথা বলে দিতে হত না। কলেজের ইলেভেন-টুয়েলভ হোক বা ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড ইয়ারই হোক, আমরা সবাই একসঙ্গেই থাকতাম। গোল করে মাঠে বসে গল্প করতাম, ফাংশনের আগে রিহার্সাল দিতাম, আবার গণসঙ্গীত গাইতেও পিছপা হতাম না। বড়-ছোটর ভেদাভেদ ছিল না। এক অমলিন আন্তরিকতায় কানমলা খেয়েছি সুকান্তদার কাছে। রাগে, অভিমানে, গাড়িবারান্দায় একলা একলা ভিজেছি খরার দিনে। হঠাৎ রং বদলে সেই একই সুকান্তদা কৃষ্ণেন্দুদার দিকে যেই না ইঙ্গিতপূর্ণ চাউনিতে গেয়ে উঠেছিল, “ইসকে আগে হাম আউর ক্যা কাহে, জানম সমঝা করো…,” তখন এক নিমেষে অভিমান গলে জল! কোথায় খরা! কোথায় বন্যা! অমিতদা, লোপাদি, কবিতাদির সঙ্গে শ্রুতিনাটক ‘বিবাহ বিচ্ছেদ মামলা’, ‘কানাকানি’-র মহড়া চলেছে, মানবদা-রাজশ্রীদির রবীন্দ্রসঙ্গীতে চোখ ছলছল করে উঠেছে, পঞ্চকন্যার সঙ্গে মনোমালিন্যর ঝড় উঠেছে আর টুয়াদি না থাকলে আমার সকলই গোপন কে-ই বা বুঝত? শ্রাবণের ধারার মতন কার বুকে ঝরে পড়তাম? পেন ধরলেই মুক্তো আর গলা ছাড়লেই মিছরির দানা, অর্ণবদা, আমার জীবনে অঙ্কে শূন্য পাওয়াগুলোকে সূর্যমুখী করে দিয়েছে। নির্লোভ জীবন কাটানো কাকে বলে তার জলজ্যান্ত উদাহরণগুলো ভাগ্যিস ছিল আমার সামনে! সিমিদির জ্বালাময়ী বক্তৃতায় সমাজবদলের অঙ্গীকার সেই বয়সে রংরূপের রাজনীতি ভুলিয়ে দিয়েছিল। স্মার্টফোন হাতে পেয়ে দুনিয়া হাতের মুঠোয় পাওয়া এই জেনারেশনকে এত ঠেলতে হয় না! ডেকে ডেকে ‘গান কর’, ‘নাচ কর’ বলে ওদের দিয়ে চমৎকার অনুষ্ঠান করল শম্পাদি, সেঁজুতি। বন্ধুরা হাত বাড়িয়ে ধরতে না পারলে, শিক্ষককে শ্রেণিকক্ষের বাইরে বেরিয়ে আসতে হয়— এটা নব্বই বলেনি সেভাবে। দোষ দেওয়ার চেয়ে সহজ কিছুই হয় না। তাই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রোমে রোমান হওয়াই শ্রেয়। পাণ্ডিত্যের গরিমায় পৃথিবীর শেষ সীমানা দর্শনের ক্ষমতা অর্জন করা যায়— এই ভাবনা মূর্খামি ছাড়া আর কিছুই নয়। অবশ্য শেক্সপিয়ারের মতন অ্যারিস্টটলের বহু পূজিত গ্রিক নাট্যতত্ত্বকে নস্যাৎ করে দেওয়ার ক্ষমতা কতজনেরই বা থাকে! শিক্ষকের জীবনে জ্ঞান ও বিনয়ের ভারসাম্য বজায় রাখতে দেখেছি সুকৃতিবাবুকে। গদ্যের রচনাশৈলীর মাঝে সামাজিক দায়বদ্ধতার পুর ভরে দিয়েছেন তিনি। শুধু এই কারণে যে প্রিয় ছাত্রীটির সঠিক মূল্যায়ন চাপা পড়ে যাবে ঈর্ষান্বিত অ্যাক্যাডেমিয়ায়, তিনি অধ্যক্ষ হয়েও কন্যাসম ছাত্রীটিকে তার কলেজে নিযুক্ত করেননি। যে সমাজের দায় আমার মাস্টারমশাই নিতে শিখিয়েছিলেন, সেই সমাজ আজ যৌবন অতিক্রম করে বার্ধক্যে প্রবেশ করেছে। তবু নতুন কুঁড়িরা জন্ম নেয়, তারা যৌবনা হয়, এবং ঠিক এই কারণেই সেঁজুতির মতন শিক্ষকদের থাকতে হয়। তারা আছে বলেই ছাত্র-ছাত্রীরা কলরবে, ব্যারিকেড-কাঁটাতার পেরোনোর সাহস পাবে। আমার ছাত্রীরা যখন কলেজের ফাঁকা ঘরে ম্যাডামের তালে তাল মেলায়, গর্বে বুক ভরে যায়। ইট-কাঠ-পাথরের ইমারত তেইশের কলকাতার ব্রাত্যজনের ‘আলমা মাটের’ হয়ে ওঠে।
আমাদের সময়ে তফাত ছিল শিক্ষকদের হাত বাড়ানোয়। তবে, শিক্ষকসুলভ কলেজের দাদা-দিদিরা না থাকলে কবেই চর্যাপদের জটিল জালে আটকে যেতাম! ক্লাস ইলেভেনের একটি অপরিচিত মেয়েকে, তার দাদাস্থানীয় দ্বিতীয় বর্ষের অর্থনীতি নিয়ে পড়া তন্ময়দা শুধু বাংলা প্রশ্নের উত্তর শিখিয়েই ক্ষান্ত হয়নি; শিখিয়েছিল কেমন করে বিতর্কসভায় যুক্তি সাজাতে হয়, তাৎক্ষণিক বক্তৃতায় আগুন জ্বালাতে হয়। আমার নব্বইয়ের মা-বাবা নিশ্চিন্তে কলেজের দাদাদিদিদের সঙ্গে, এক মফস্বল থেকে আরেক মফস্বলে, এমনকি কলকাতা যাওয়ারও অনুমতি দিয়ে দিত। বিশ্বাস ছিল, ভরসা ছিল। এবং আমাদের ওপর ছিল সেগুলো ধরে রাখার অন্তর্নিহিত তাগিদ: “মাটির গুণ? হবে/কাছে আসুক তবে”। শহরতলির যে-কলেজে আমি পড়িয়েছি, সেখানে একা একা ছাত্রছাত্রীরা ট্রেনে বাসে করে এসেছে। কিন্তু শহর কলকাতায় এসে দেখি, মাঝেমধ্যেই, ছাত্রীদের অভিভাবকরা আসছেন পৌঁছে দিতে, আবার নিয়েও যাচ্ছেন। অভিভাবক হিসেবে আমরা আমাদের সন্তানদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছি নাকি এই বদলে যাওয়া সময়কালে? কলেজের মাঠে, গেটের বাইরে এখন যেসব অভিভাবকদের মাঝেমধ্যেই বসতে, আসতে দেখা যায়, নব্বইয়ের দশকে সেইসব অভিভাবকরা ছিল আমাদের খোরাকের উপকরণ। বাবাকে কঠিন আদেশ দিয়ে রেখেছিলাম আটানব্বইয়ে। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার বিরতির সময় কোনওদিন যেন ডাব হাতে না দেখি— ওসব ভীষণ আনস্মার্ট ব্যাপার। গেটের বাইরে থাকবে ফুচকার গাড়ি, তাতে পচা কুঁচো চিংড়ির চপ, মোগলাই, ভেজিটেবিল চপের লাল পুর আর কাঠি আইসক্রিমের দাপাদাপি। সেখানে অভিভাবককে উপস্থিতির কোনও অনুমতি দেওয়াই হবে না। এখন কলেজে পড়তে আসা বাবাজীবনদের অথবা মামনিদের যে অভিভাবকেরা ভাত মেখে, মাছ বেছে, মুখে চালান করছেন, তারা কি অবচেতনে লিখে যাচ্ছেন নিজেদের মৃত্যুপরোয়ানা? মনে পড়ে, কলেজের আর আমার বাবার কর্মস্থানের মাঝে ছিল একটি সরু রাস্তার বিভাজন। হসপিটালের ডিউটি সেরে বাবা রাস্তায় নামলেই বিড়ি-সিগারেট লুকানোর হিড়িক পড়ে যেত। কত বকা খেয়েছি সিনিয়রদের কাছে! আসলে ‘সিগারেট টুকরোরা’ তখন ছিল সত্যিই ‘মুখচোরা’। কেন আমার বাবা ওই রাস্তা দিয়েই ওই সময়ে যাবে তার কৈফিয়ৎ আমাকেই দিতে হত। মহামান্য সিগারেট মাটিতে ফেলে দিয়ে “কাকু কেমন আছেন?” বলতে কার ভাল লাগে! রাজনীতি আর সংস্কৃতির ধ্বজা ওড়ানোর সেইসব সময়ে আমাদের পকেট ছিল গড়ের মাঠ। তাই খাবারের পসরা সাজানো ফুচকার স্টল দূর থেকে দেখেই চোখ সার্থক করতাম। অনতিদূরে নতুন আইসক্রিম পার্লার, ‘রলিক’— সেখানে যাওয়া হত বিশেষ দিনে। এছাড়া, পঞ্চাশ টাকার নোট শুধু মাত্র থাকত অমিতের পকেটে। আমরা লোভ দিলে সে কবিতা লিখত। একদিন আমার নাটকের খাতার শেষ পাতায় খস খস করে লিখে দিল— “পাবার আশায় থেকো না/পাবে না স্বপ্ন মালিকা/অমোঘ সময় মারবে ঝাপট/বুঝলে, বোকা বালিকা?” সত্যিই যেদিন সময় এসে ঝাপট মারল আইসিইউর বাইরে, আমার চোখের জল মুছে দিতে ছুটে এসেছিল সেই আমার বোকা বন্ধু অমিতই। কোনওদিন, যদি কৃতজ্ঞতায় অবনত হয়ে, প্রয়োজনের অধিক অর্থ ব্যয় করে দলবলকে খাইয়েছি, সেদিন আর রক্ষে নেই। হইহুল্লোড়, আড্ডা, খাওয়া-দাওয়ার পর জন্ম নিত এমন এক কবিতা যার তীক্ষ্ণতা বুক চিরে দিত। ‘২৭৮ ম্লান হয়ে গেল’ শীর্ষক কবিতার মালিক এখন জলে জঙ্গলে খবর সংগ্রহ করে। শুধু কি সে বিতর্ক করতে শিখিয়েছিল? এই বয়সে সে এখনও শেখাচ্ছে যে ফাঁকা ল্যাম্পপোস্টে গোল করতে কোনও মাহাত্ম্য লাগে না। এইসব ‘Base’-এর ওপর আমি স্বপ্নের ‘Superstructure’ বানাই, অক্ষিকাচে দেখি কলকাতা তেইশের ছাত্রীরা একা একা কলেজে আসছে, তাদের অভিভাবকরা তাদের এগিয়ে দিচ্ছে এক উজ্জ্বল অহনার দিকে।
কলকাতা তেইশের কলেজে ছাত্রীদের রাজনীতির অবকাশ নেই। ‘স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’-এর বদলে হতে পারে কালচারাল ইউনিয়ন। নব্বইয়ের শেষ বিকেলে, টেবিল চাপড়ে দাবি-দাওয়ার ফিরিস্তি দেওয়া আমার কলেজের ‘স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’-এর ছায়া দেখি না এ-পাড়ায়। ইউনিয়ন না থাকাতে অনেকেই বিশ্বাস করেন কলেজে শান্তি আছে। নির্ঝঞ্ঝাট জীবন-যাপনে গেট আটকে দেওয়া নেই, পথে বসে পড়া নেই, মিটিং-মিছিলে যাওয়া নেই। যদি এতক্ষণে ভুলে গেছেন পাঠক তাহলে আরেকবার পড়ুন, এসব কোথায় নেই। কলকাতা তেইশের একটি কলেজের কথা বলছিলাম আমি— যে-এলাকা ব্রাত্য হয়েছে সম্পূর্ণ একপেশে চিন্তাধারার জন্য। যদি মনে হয়, মহিলা কলেজ তো, তাই নেই, তাহলে একবার মহিলাদের ঝামেলা করার প্রবণতাকে বাড়ির চার দেওয়ালে ঝালিয়ে নিন পাঠক! আগের কলেজ অবশ্য রাজনীতিসচেতন ছাত্র-ছাত্রীতে ভরে থাকত। সেও প্রায় আমার মফস্বলেরই কলেজের মতন, শুধু পুকুরপাড় ছাপিয়ে সেখানে নদী আপন বেগে বয়। পড়াশোনায় জলাঞ্জলি ভেবে যারা ছাত্র-রাজনীতিকে সময় নষ্টের মূল ভাবে, তাদের জন্য পরজন্মে স্বর্গ-সুধা কামনা করি। আমরা, বখাটেরা, কি কম মিছিলে হেঁটেছি? স্বীকার করে নিই, প্রথমে ভয় পেয়েছি, পিছনদরজা দিয়ে পালিয়ে গেছি। তারপর একদিন ওই গোল করে বসা মাঠে কোনও এক দাদা পায়ে নূপুর পরা দেখে বলেছিল, “খুব ভাল লাগে পরতে? এ তো এক ধরনের বন্ধন যা খুব সহজেই আমরা মেনে নিই।” উনিশ পেরিয়ে বিশের আমি সেদিনের পর আর নূপুর পরে কলেজে যাইনি। কলেজ ইউনিয়ন রুমের কংক্রিটের ছায়ায় কত মতবিরোধ রোজ রোজ জন্ম নিয়েছে। ঘুণধরা শরীরে তর্কের জোর থাকত খুব। সিলেকশনের ইলেকশনে আমরা বেশিরভাগই মৃত সৈনিক। তবু কলেজেই মুগ্ধ হয়ে শুনেছি আমাদের আশপাশ-বয়সের দাদা-দিদিদের স্টাট-ভরানো অকাট্য বক্তৃতা। হাতের গুণ যে শুধু রন্ধনে নয়, সেও বুঝলাম অসামান্য চিত্রকল্পে। ‘টি-শার্ট’-এ আঁকার চল ছিল না, কাগজে কাগজে ভরে উঠেছে প্রতিবাদের সবুজ নীল প্রতীক। কলেজ সোশালে ‘স্টল ডেমনস্ট্রেশন’ দেওয়ার প্রথম পাঠ ওদের হাত ধরেই। পাঠক্রমের বাইরে প্রতিভার বহিঃপ্রকাশের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ ছিল কলেজ সোশাল। যার ভাল নাম ‘ফেস্ট’ সে ছিল আমাদের আরব্যরজনীর, অধরা মহানগরীর। ডাকনামে আমরা তাকে আদর দিয়ে বলতাম ‘সোশাল’। কলেজের সোশাল চলাকালীন বিভাগীয় স্টলের আখড়ায়, অনুভূতির নোনাজলে, ‘ঘুম ঘুম ক্লাসরুম’ রূপান্তরিত হত এক বানভাসি বন্যায়। খোলা আকাশের নিচে, হলুদ আলোয়, বাউলের গানে সবাই হাতে হাত ধরে নেচেছি। তখন বয়স, শ্রেণি, রং, সব মিলে গিয়েছিল ওই একতারার সুরে। সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার পুরস্কার যে-কোনও রেজাল্টকে হার মানতে পারত, তার কারণ সেইসব পুরস্কার যৌথ উদ্যোগে আমরা অর্জন করেছি। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত “সংহতি” আমাদের রাজপরিবারের যৌথ বসবাসের কথাই বলেছে। আমার ছাত্রীরা যখন রঙ্গোলি করে, পোস্টার বানায়, নাচ-গান করে, তখন একদিকে যেমন খুব অভাব বোধ করি তাদের স্বরে অনুচ্চারিত কবিতাপাঠের, অন্যদিকে, তেমন ওরাই আমাকে চমকে দেয় ওদের অভিনয় করার ক্ষমতায়। সঠিক সুযোগ পেলে সিতারা একদিন নক্ষত্র হবে। আমি অন্য শহরে বসে ওকে পর্দায় দেখব। এদের কলরব কেউ এখনও শুনতে পায়নি। এরা ‘ফেস্ট’ কালচারে অভ্যস্ত নয়। ‘স্টল ডেমনস্ট্রেশন’ কাকে বলে এরা জানে না। তবুও যেদিন বহুত্বের উদযাপন হল আমার কলেজপ্রাঙ্গণে, নাদিম সোহরাওয়ার্দির ‘দাস্তানগই’ শুনতে শুনতে, মহেশের কষ্টে, কেঁদে ফেলেছিল সাহিদা। বাউলের সুর পরিধি ছাড়িয়ে রুবাইয়াকে মিলিয়ে দিয়েছিল রত্নাবলীদির তালে। এটাই তো চাই। বেশি করে চাই। বৃহত্তর কলকাতা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরুক ‘বলা বারণ’ অলিগলিকে। গ্রামগঞ্জ, মফস্বল এবং শহরতলি থেকে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী যেভাবে পড়তে এসে আপন করে নেয় বড় শহরের নামজাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে, সেভাবেই একদিন কলকাতা তেইশের ব্রাত্যজনেরা আপনজন হয়ে মিশে যাবে এই শহরের ধমনীতে— এটুকু আশা করাই যায়!
বর্ধমান শহরের ধ্যারধ্যারে গোবিন্দপুরে অবস্থিত আমার ছোটবেলার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল। মূলস্রোতের এতটাই দূরে যে, যে-কোনও রোমিও প্রেম নিবেদনের চেয়ে হোমিওপ্যাথির দোকান দেওয়াকে বেশি প্রাধান্য দেবেই দেবে। স্কুলের গেটে লাঠি হাতে বসে থাকা আমাদের ফাদারকে দেখে ভালবাসার পিলে চমকে যেত। তবু কি গোলাপ ফোটেনি স্কুলের বাগানে? আমারই দেখার চোখ ছিল না হয়তো! ভালবাসতে না জানলে যে জীবনের ষোলো আনাই ফাঁকি, জানলাম মফস্বলের কলেজে এসে। আমাদের যুগে ভালবাসার মানে ছিল ‘আর্চিস গ্যালারি’। তাকেই সাক্ষী মেনে, কলেজের এক ঝকঝকে, রাজনীতিসচেতন, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন দাদা, আমাদের প্রবল চাপে পড়ে, তার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ করে বসল। গোলাপের তোড়া হাতে যেদিন সে কুচকাওয়াজের সামনে দাঁড়াল, সেদিন বুঝলাম আমি একা বোকা নই। রাজদলের সাগরেদ ওরফে ‘সভাপেত্নী’র হৃদয় তিড়িংবিড়িং করতেই পারে। অবাক করে দিয়ে একদিন ন্যালাক্ষ্যাপা জয়ন্তদা, শেষ বিকেলের পড়ন্ত রোদে, সাইকেলের রডে, রহস্যময়ী মামনকে সিঁদুর পরিয়ে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ল। রোজ দারুণ ছক্কা মারলেও সেদিন সব তাবড় তাবড় ব্যাটসম্যানদের মিডস্ট্যাম্প উড়ে গেছিল। নব্বইয়ের এই সর্বনেশে সাহস খুব কমজনে দেখাতে পারত মফস্বলে। গোপন ভালবাসাবাসির সাক্ষী থাকাকে আমার মতন অনেকেই পবিত্র ধর্ম বলে মনে করত। যতই বিশ্বায়নের দামামা বাজুক না কেন, আমাদের মফস্বলের কলেজে হৃদয় দিয়ে চলার বোকামো আগামীর ডাকের চাপে চাপা পড়ে যায়নি। প্রথম যৌবনের উদ্দীপনায় নিষ্পাপ মাথা পেতে দেওয়াকে কোনও সামাজিক কল্যাণমূলক কাজের চেয়ে কম প্রাধান্য দিইনি আমরা। আমাদের তখন কাঁচা বয়সের খাঁচা ছিল একমাঠ জুড়ে। সেই মাঠ পেরিয়ে, কলেজঘেঁষা ডাক্তারবাবুর বাড়িতে, তার মেয়ের পড়ার ঘর ক্রমশ হয়ে উঠল ডাক্তারবাবুর নামাঙ্কিত “ক্লাব হাউস”। সেখানের মলয় বাতাসে, বড়-ছোট মধুকর-মধুকরীদের সঙ্গে, এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ সার্জেন ফিরে ফিরে যেতেন তার পুরনো কলকাতার ক্যান্টিনে। আজকাল অভিভাবকদের সঙ্গে মিটিং করলে একরাশ অনুযোগ ছাড়া খুব একটা কিছু শুনি না। আমার ছাত্র-ছাত্রীরা বাড়িতে কী কী করে না তার ফিরিস্তি শুনতে শুনতে মনে হয় জিজ্ঞেস করি, আপনারা কি কখনও ওদের চোরাগলির খোঁজ রাখেন? অর্থের ঐশ্বর্যে বা দারিদ্র্যের দায়িত্বে কাঁচা ক্ষতের ওপর যে প্রলেপ পড়ে যাচ্ছে তার নিরাময়ের সন্ধান অভিভাবকদেরই তো করতে হবে। এবং তার সঙ্গে ছাদের সিঁড়ি ভেঙে শিক্ষকদেরও নামতে হবে। ওই উঁচু মঞ্চে দাঁড়িয়ে নতুন কিছু বলি কি আমরা? মনের কথা বলতে গেলে দুই বেঞ্চের মাঝের রাস্তায় খানিক অপেক্ষা করতে হয়। স্বীকার করেই নিই যে মনের চোরাগলিতে হাঁটতে গিয়ে প্রায়শই থমকে গেছি। তবু পড়াশোনার পাশে পাশে তাদের চিরন্তন ভেলকি নাচনের ঠ্যালা শিক্ষিকা হয়ে বেশ সামলাতে হয়েছে। “রাহুল— নাম তো শুনা হোগা”র ছাতা মাথায় দিয়ে যে পার করেছে তার বৃষ্টিদিন, সে শতাব্দী-পার এক দশক পরে তার ছাত্রদের মেঘবালিকা আর ছাত্রীদের বেণীমাধবের গল্পের ভাগ নেবে, সেটাই স্বাভাবিক। এদের মতন আমিও একদিন বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম, এদের মতন আমারও ‘শার্ট বৃষ্টির চেয়ে দামী’ ছিল না।
কলকাতা তেইশের কলেজের ছাত্রীরা ভালবাসার ধাপটা অনেক সময় টপকে গিয়ে সোজা বিয়ের পিঁড়িতে বসছে। ক্লাসের শেষে ‘মিঠাই’ হাতে অভিভাবকরা আসছেন ম্যাডামকে দাওয়াত জানাতে। কবুল করতে দ্বিধা নেই যে বেশিরভাগেরই কাচের চুড়ির ঝঙ্কারে চোখের কাজল গলে যায়। কিন্তু এই ভিড়ে নৌরিনরাও আছে, যাদের অসহায় চাউনিতে এক অর্ধ-পরিচিত শিক্ষিকার কাছে থাকে সবিনয় নিবেদন, অসময়ে সাংসারিক দায়ভার কাঁধে না নেওয়ার আর্তি। কিচ্ছুটি করার থাকে না আমার। তখন একটু উষ্ণতার খোঁজ দিতে পাঠক্রমের সিঁড়ি ভাঙি। হাজার ঝঞ্ঝাট সহ্য করে এই ছুঁয়ে থাকা আমার ফিরতি ট্রেনের ক্লান্তি ভোলায়। আমাকেও তো একসময় আমার কলেজ-পরিবারের সদস্যরা এইভাবেই ছুঁয়ে ছিল। তাই নব্বই শিখিয়েছিল পাশে থাকার অভয় দেওয়া। জীবনের যে-কোনও বাঁকেই হোক, শুধু স্তরভাঙা বন্ধুরাই বৈতরণী পার করে দিতে পারে, কোনও অদৃশ্য ঈশ্বর সে-স্থান পূরণ করতে পারেন না। ঐশ্বরিক বন্ধুরা বারবার পিছন ফিরে সাহস না দিলে ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার বাঁধভাঙা জলে কবে ডুবে যেতাম! আয়ারল্যান্ড-ইংল্যান্ডের গোলাবর্ষণে, আইরিশ প্রতিরোধের অক্ষমতায় জেমস জয়েস তখন বৃন্দাবন ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না। সৌমী-পার্থ-শুভায়ুরা না থাকলে দু-চোখের সরষেফুলে, কলেজের বিচ্ছেদগাথা ছাড়া একটা লাইনও লিখতে পারতাম না! প্রায় কুড়ি বছর পর, ঠিক একইভাবে, সানা-সাইমারা নৌরিনকে সামলে দিচ্ছে। আর কিছু না হোক, ওদের বন্ধু হয়ে যে চারাগাছ বাঁকা চাঁদের আলোয় সৃজন করে থাকি আমরা, সে গাছের ফুলে একদিন গুলদস্তা তৈরি হবেই।
এই অদ্ভুত, অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে আমাকে আমার শিক্ষকসত্তা ধিক্কার জানাচ্ছে রোজ। কী জানি এই দুর্যোগে কলকাতা তেইশ কীভাবে বাঁচছে! কতটা সচেতন হয়ে এই যুদ্ধে নেমেছে? আমরা কি পেরেছি এই দুঃসময়ে তাচ্ছিল্যের সেতু ভেঙে দিতে? আমার সংশয়ী মন জানে এ পৃথিবীতে “মানুষে মানুষে/আজও চেনাশুনো হয়নি”। কতজনের মনের সঠিক খবর পাচ্ছি? এই অজ্ঞতাভরা হৃদয়ে মস্তিষ্কের ঘিলু মাঝেমধ্যেই শুকিয়ে যাচ্ছে। কেউ যেন আমাদের উঁচু মগডালে উঠিয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন সকালবেলায় চাঁদের পাহাড় দেখতে বলছে। কলেজ থেকে যেদিন সদলবলে সদ্য গজিয়ে ওঠা আরকে রেস্তোরাঁয় খেতে গেছিলাম, জ্যোতিদার তালগাছে ওঠার ছবিতে আমাকে বেলনা হাতে এঁকেছিল অর্ণবদা। শিক্ষক হিসেবে আমি এখন সত্যিই ভয়ে মগডালে মুখ লুকিয়েছি। তাত্ত্বিক আলোচনা অথবা রোমান্টিকতার লেশমাত্র দেখাতে গেলেই কোনও একটা বোতাম বলে উঠছে— “পারছি না ম্যাডাম আপনার পড়া শুনতে, মা এখন ভেন্টিলেশনে।” সপাটে কেউ অদৃশ্য থাপ্পড় দিল আমার অনলাইনে নোবেল এনে দেওয়ার প্রচেষ্টাকে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে আছড়ে পড়ে এবং তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কায় দিনগোনা আমি, এক সাহিত্যের শিক্ষিকা, এমন বুরবক কাজ করছি কীভাবে? লজ্জা হল খুব। যাদের মনই বুঝি না, তাদের এই বিপদে জ্ঞান দেওয়া অন্তত আমার সাজে না। পৃথিবীটা তাহলে আজ সত্যিই ছোট হয়ে গিয়ে আমাদের এমন এক বোকা বাক্সের ভিতর পুরে দিয়েছে, যে আমরা গ্যালারিতে বসে অদৃশ্য মিস্টার ইন্ডিয়ার খেল দেখছি; শুধু নির্বোধের মতন ছুঁতে পারছি না প্রযুক্তির মাঝে আটকে পড়া আমাদের ভাঙা বোতামদের। নব্বইয়ের শেষ বছরে সুকান্তর “বোতাম বিটস” যে নির্মল আনন্দে আমাদের বিকেলগুলো মাতিয়ে রাখত, তার ঠিক উলটোদিকের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার ভাঙা বোতামের ছাত্রীদের তাল কেটে যেতে দেখছি। ছন্দপতন আমার জীবনে নতুন কী? কোনও এক নব্বইয়ের ডানাওয়ালা পথিক এক বুক অভিমানে, না বলে, তলিয়ে গেছে। অবুঝ বন্ধু, বিষাদসঙ্গী, তুই জানলিই না, কারও জন্য জল, কারও জন্য আকাশ, কারও জন্য কবিতা সিন্দুকে রাখা থাকলেও, তোর জন্য ছিল আকাশ-ভাসানো জলের মতন কবিতা। কিছুদিন আগে, সেই আকাশ-ভাসানো জলে আগুন ধরে গেল। তখন প্রযুক্তির মহিমা টের পেলাম। আজকাল জীবনের কত বিচ্ছেদ প্রযুক্তি সহনীয় করে তুলছে। হয়তো যান্ত্রিকতার চাপে সবসময় শুনতে পাচ্ছি না আমার ছাত্রী ফাইকার মা-হারানোর কান্না, দেখতে পাচ্ছি না সাইমার কন্যার হাসিমুখ, তবুও তো তুমি আছ, তাই আমি বাঁচি!
আমার কলেজবেলায় অধরাকে আষ্টেপৃষ্টে আন্তর্জালে পাওয়া হয়নি। তবুও আনমনে স্পর্শ ছিল, লজ্জাবোধ ছিল, অনুভবে বোঝা ছিল, এবং, সর্বোপরি, মূল্যায়নের মান ছিল। আমরা অনেকেই সেভাবে আগামীর সচেতনতা পোষণ না করলেও আজ ছাত্রসমাজের এতটা অনিশ্চয়তাও আমাদের গ্রাস করেনি। তবু ভরসা রাখি— ওরা বোতাম বোতাম পায়ে পৌঁছে যাবে ঠিক। ‘মগজে কারফিউ’, কাকপক্ষীর পাঁচালি এবং একঘেয়ে নিঃশ্বাসের ওঠানামা কুরে কুরে ধ্বংস করছে যে ছাত্র-নিশ্চয়তাকে তার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা অন্তত ভেঙে দিই আঁতলামির বিভাজন।
ঋণ: গাড়ি বারান্দা, বাঁকা চাঁদ আর “পিউপা’’