Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

“আসন্ন নির্বাচন জিততে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপাবে বিজেপি”

আনন্দ তেলতুম্বডে

 


আনন্দ তেলতুম্বডে গণ-আন্দোলন, নাগরিক আন্দোলন এবং অধিকার আন্দোলনে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। পেশাগত ক্ষেত্রে তিনি প্রযুক্তি-গবেষক, ম্যানেজমেন্ট-ক্ষেত্রে উচ্চপদস্থ আধিকারিক, প্রায় চার-দশক ধরে বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার উচ্চপদে কাজ করেছেন, অধ্যাপনা করেছেন আরও এক দশক। একই সঙ্গে তিনি একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক ও নিবন্ধকার।

আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে জয়লাভের জন্য বিজেপির বিভিন্ন কৌশল নিয়ে বর্তমান সাক্ষাৎকারটিতে তিনি আলোচনা করেছেন সাংবাদিক অভীশ বসুর সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি গত ২০২৩-এর ২২ ডিসেম্বর এশিয়ান লাইট পরিকায় ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়। অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় আমরা এটি অনুবাদ করে প্রকাশ করলাম। অনুবাদ করেছেন অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 

অভীশ বসু: কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের ‘এক দেশ-এক নির্বাচন’ নীতির কৌশলগত গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু বলবেন? আপনার কি মনে হয় ভারতীয় সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংস করতে ও একই সঙ্গে ভারতের বিবিধতা রক্ষার্থে ভারতীয় গণতন্ত্রের যে ভূমিকা, তাকে আরও কোণঠাসা করতেই এই কূট-কৌশলের আশ্রয় নেওয়া?

আনন্দ তেলতুম্বডে: অবশ্যই। ভারতীয় সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে আঘাত করতেই এই কৌশল নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও বৃহৎ পরিসরে দেখলে, আরএসএস-এর তরফে হিন্দুরাষ্ট্রের যে ঘোষিত অ্যাজেন্ডা, এটি সেই লক্ষ্যপূরণেরই অঙ্গ। হিন্দু রাষ্ট্রের লক্ষ্যই হল দেশের প্রতিটি বিষয়ে ‘একত্ব’ আরোপ (এক দেশ, এক ভাষা, এক ধর্ম, এক নেতা)— যা এই দেশের বিবিধতার ধারণাকে, যে ধারণা কিনা তর্কযোগ্যভাবে ভারতের আত্মা-স্বরূপ, তাকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে। আরএসএস চায় তাদের সংগঠনের মতোই গোটা দেশের নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা কেবল একজন ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হোক। গণতন্ত্র অথবা সংবিধানের সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ করা এই মুহূর্তে তাদের পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু তাদের এগুলির প্রতি কোনও শ্রদ্ধা বা ভালবাসা নেই। আমরা সকলেই জানি মূল ভারতীয় সংবিধান যখন গৃহীত হয় সে-সময়ে আরএসএস “প্রশাসন-পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রাচীন ভারতীয় রীতিনীতি, প্রতিষ্ঠান, নামকরণ-পদ্ধতি… যা কিনা ‘মনুস্মৃতি’তে লিপিবদ্ধ রয়েছে,” তার কিছুই সেই সংবিধানে গৃহীত হয়নি বলে কঠোর সমালোচনা করেছিল।

একথা ঠিক যে আমাদের সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রবর্তিত হয়েছে, কিন্তু তবুও তা গঠনগতভাবে বিভিন্ন বিষয়েই কেন্দ্রের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। রাজ্যগুলির প্রশাসনের উপর অনেক ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে চূড়ান্ত বা অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে যে কেন্দ্রাভিমুখিনতা তৈরি হয়েছে তা যে কেবল রাজনৈতিক তা-ই নয়, বরং রাজ্যগুলির সংবিধান-প্রদত্ত ভূমিকা পালনেরও প্রতিবন্ধক-বিশেষ।

এর উপর রাজ্যগুলির সঙ্গে কেন্দ্রের যে সহজাত আর্থিক ঘাটতির বৈষম্য, সেই বিষয়টিও সংবিধানের এই অতিরিক্ত কেন্দ্রাভিমুখতার বৈশিষ্ট্যকে বা তার প্রভাবকে বাড়িয়ে তোলে। কারণ, সম্পদ বন্টনের দায়িত্ব কেন্দ্রের হাতে, আর আর্থ-সামাজিক দায়-দায়িত্বগুলি পালনের দায়িত্ব রাজ্যগুলির ওপর। ফলত প্রায়শই রাজ্যগুলিকে তাদের রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতার অতিরিক্ত বোঝা কাঁধে নিতে হয়। এই সমস্যা সমাধানে সংবিধানের নিদান প্রতি পাঁচ বছরের ব্যবধানে একটি অর্থ-কমিশন তৈরি করা এবং রাজ্যগুলির ব্যয়বরাদ্দের খতিয়ান দেখে কেন্দ্রের তরফে আহরিত সম্পদের কিছু অংশ তাদের ফিরিয়ে দেওয়া। কিন্তু এই পদ্ধতিতে গুরুতর গলদ রয়েছে।

যেহেতু অর্থ-কমিশনগুলি রাজ্য সরকারের সঙ্গে কোনওরকম আলোচনা ছাড়াই, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশবলে গঠিত হয়, ও কেন্দ্রের দ্বারাই সেই কমিশনের কার্যবিধি রচিত হয়, সে-কারণে সেই কমিশনের তরফে স্বাধীন সুপারিশ আশা করা অনুচিত। এছাড়া মোট যে পরিমাণ সম্পদ কেন্দ্রের তরফে আহরণ করা হয়, তার একটা বড় অংশ অর্থ-কমিশনের আওতার বাইরে রাখা হয়। ফলে বঞ্চনা ও সম্পদ-বন্টনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের একাধিপত্য আরওই প্রতিষ্ঠিত হয়। মোদি-সরকার যোজনা কমিশন ও জাতীয় উন্নয়ন পর্ষদ তুলে দিয়েছে। এবং তার পর থেকেই এই বৈশিষ্ট্য আরও বেশি করে লক্ষ করা যাচ্ছে। ‘ডবল-এঞ্জিন’ সরকারের ঢক্কানিনাদ আদতে এই বৈশিষ্ট্যেরই এক নির্লজ্জ উদাহরণ মাত্র। বিগত বেশ কিছু বছর ধরে সেস ও সারচার্জ সংগ্রহের উপর নির্ভরতা অতিরিক্ত বেড়েছে, যার মাধ্যমে আহরিত অর্থ ফিনান্স কমিশনগুলির আওতায় আসে না। জানা যাচ্ছে, মোদি-সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় সরকারের মোট যে আয়, তার প্রায় ১৫ শতাংশই এসেছে এ-সমস্ত সেস ও সারচার্জ সংগ্রহের মাধ্যমে।

সম্পদ হস্তান্তরের যখন এইরকম করুণ পরিস্থিতি, সেই অবস্থায় জিএসটি চালু করাটা হল মোদি-সরকারের তরফে কফিনে শেষ পেরেক। এই জিএসটি-ব্যবস্থা চালু হওয়ার কারণে রাজ্যসমূহের তরফে সম্পদ আহরণের ক্ষমতা প্রায় বন্ধ হতে বসেছে। মদ ও জ্বালানি, এই দুই উপাদান জিএসটি-ব্যবস্থার বাইরে রয়েছে, ফলে রাজ্যগুলির আয় এই মদ ও জ্বালানি-বিক্রি বাবদ যথাক্রমে শুল্ক ও এক্সাইজ ডিউটির মাধ্যমে যেটুকু হয় সেটুকুর মধ্যেই এখন সীমাবদ্ধ। ফলত রাজ্যগুলি এখন তাদের প্রয়োজনীয় সম্পদের প্রায় অর্ধেক অংশের জন্য এখন কেন্দ্রের মুখাপেক্ষী, আর রাজ্যগুলির আহরিত রাজস্বের দুই-তৃতীয়াংশই এখন কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণাধীন। যেভাবে এই জিএসটি-ব্যবস্থা এদেশে প্রবর্তিত হয়েছে, তা দেশের অর্থ-বন্টন ব্যবস্থার যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্রকে চরম আঘাত করেছে।

এবারে এই ‘এক দেশ-এক নির্বাচন’ কৌশল, যা কিনা পাঁচ বছর অন্তর কেন্দ্রীয় একটি নির্বাচন-ব্যবস্থা প্রবর্তন করবে, তা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্রকে বিধ্বস্ত করার লক্ষ্যেই আনতে চাওয়া হচ্ছে।

 

মজার বিষয় হল, বিরোধীশূন্য যে কমিটিকে আপাতত এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তার চেয়ারম্যান হলেন পূর্বতন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দ। এই কোভিন্দই ২০১৮ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সংসদে দেওয়া অভিভাষণে এই নির্বাচনী সংস্কারের কথা ঘোষণা করেছিলেন। কাজেই এই কমিটির সুপারিশ যে কী হতে চলেছে সকলেই জানেন। এই জমানায় সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি এখন এরকমই অর্থহীন নিয়মরক্ষায় পর্যবসিত হয়েছে।

‘এক দেশ-এক নির্বাচন’ এই নীতির কথা বলতে গেলে মনে রাখতে হবে ১৯৫৯ সাল অবধি কিন্তু এভাবে একত্রেই লোকসভা ও বিধানসভাগুলির নির্বাচন আয়োজিত হত। ১৯৫৯-এ ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে কেন্দ্র-সরকার কেরলের নির্বাচিত বিধানসভা ভেঙে দেয় ও রাষ্ট্রপতি শাসন ঘোষণা করে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সেই বছর প্রথমবারের জন্য এমন একত্রে নির্বাচন আয়োজনের প্রক্রিয়াতে বাধা পড়ে। তারপর থেকে আর কোনওদিনই আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

এই প্রক্রিয়ার সুবিধা হিসেবে যেগুলিকে তুলে ধরা হচ্ছে, সেগুলির প্রতিটিই প্রশ্নসাপেক্ষ। প্রথমত, বলা হচ্ছে এই নীতি চালু হলে সরকারের তরফে প্রশাসন চালানোয় সুবিধা হবে। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতিতে বারংবার নির্বাচন ঘোষণা হলে প্রধানমন্ত্রী (বর্তমান)-সহ অন্যান্য মন্ত্রীরা সকলেই ভোট প্রচারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলস্বরূপ প্রশাসনিক কাজ ব্যহত হয়। এই যুক্তি আসলে হাস্যকর। যদি এটি সত্যিই এত বড় সমস্যা হয়, তবে সামান্য একটি সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাচিত যাঁরা প্রশাসনিক পদস্থ ব্যক্তি, তাঁদের নির্বাচনী কাজ বা প্রচারে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে দিলেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। এর মাধ্যমে নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন শাসক দলের অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়ার বিষয়টিও যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পাবে। দ্বিতীয়ত বলা হচ্ছে, এই নীতি কার্যকর হলে নির্বাচনী ব্যয়ের নিরিখে অনেকটা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। কারণ নির্বাচক-তালিকা তৈরি থেকে শুরু করে প্রশাসনিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা, নিরাপত্তার দায়িত্ব, নির্বাচন কমিশনের কাজ— ইত্যাদি সমস্ত কিছুর ক্ষেত্রে প্রতিটি নির্বাচনেই বিপুল খরচ করা হয়ে থাকে। এই সুবিধার কথাটি অবশ্য আপাতভাবে মেনে নেওয়া যেতে পারে কারণ, নির্বাচন কমিশন ও নীতি আয়োগ— দুটি প্রতিষ্ঠানেরই নিরপেক্ষতা আজকাল সন্দেহের বিষয়— দুইয়ের তরফেই দাবি করা হয়েছে এই ‘এক দেশ-এক নির্বাচন’ নীতি’ চালু হলে নির্বাচনজনিত ব্যয় অর্ধেক হয়ে যাবে। অন্যান্য যে সমস্ত সুবিধার কথা উল্লিখিত হয়, যেমন কিনা এর ফলে ‘ঘোড়া কেনাবেচা’র ঘটনা কমবে অথবা ‘সহজ উপহার’ কিংবা ‘বিনাশর্তে নানাবিধ ভাতা’র সুবিধা— এগুলির মতো ‘লোভনীয়’ ঘোষণার মাধ্যমে দলগুলি নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারবে না— সে-সব যে ছেঁদো কথা সে নিয়ে বাক্যব্যয় করার প্রয়োজন নেই।

এর বিপরীতে দেখলে, ভারতীয় সংবিধানের ৮৩(২), ১৭২ ও ৩৫৬ ধারায় যে গণতন্ত্রের আদর্শকে তুলে ধরা হয়েছে ‘এক দেশ-এক নির্বাচন’ নীতি তা সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে। বিচারপতি বিএস চৌহানের নেতৃত্বাধীন আইন কমিশন তাই সঠিক অর্থেই জানিয়েছে বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামো অনুসারে এই নীতি বলবৎ করা অসম্ভব। সরকার সেই সাংবিধানিক কাঠামোকে, ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনকে এবং তার সঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভাগুলির কার্যনির্বাহী রীতি-পদ্ধতিগুলিকে বদলে দিয়ে এই রীতি কার্যকরী করতে পারে বটে, কিন্তু তাতে মূল্য চোকাতে হবে দেশের গণতন্ত্রকেই— সেটি স্রেফ ধ্বংস হয়ে যাবে। এছাড়া, পরিকাঠামোর দিক থেকেও এই রীতি কার্যকরী করা কার্যত অসম্ভব। কারণ এতে একেকটি নির্বাচনের সময়ে যে বিপুল সংখ্যক নির্বাচনকর্মী, ভোটযন্ত্র ও অন্যান্য পরিকাঠামোর প্রয়োজন পড়বে— নির্বাচন কমিশনের কাছে তা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এছাড়া, আইডিএফসি ইনস্টিটিউটের ২০১৫ সালের এক সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা গেছিল, ‘এক দেশ-এক নির্বাচন’ বলবৎ হলে একই দল কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলিতেও সরকার গড়বে এমন সম্ভাবনা ৭৭ শতাংশ। সেক্ষেত্রে আবারও নির্দিষ্ট রাজ্যগুলির রাজ্য-ওয়াড়ি বিবিধ সমস্যা বা ইস্যুগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া হবে, এবং দীর্ঘমেয়াদে আবারও আঘাত নেমে আসবে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর।

 

অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সব্যসাচী দাস সম্প্রতি একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করার ‘অপরাধে’ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করেন। গবেষণাপত্রটির শিরোনাম ছিল ‘পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পশ্চাদপসরণ’। এই রচনাটিতে কেন্দ্রীয় শাসকদলের বিরুদ্ধে ভোট-জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয় ও ফলস্বরূপ এক বিরাট বিতর্কের সূত্রপাত হয়। গবেষণায় অধ্যাপক দাস দেখান, ২০১৯ সালের নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হওয়া আসনগুলির একটা বিরাট অংশ শাসক বিজেপির ঝুলিতে গিয়েছে এবং, সেই সমস্ত রাজ্যেই এমন ফলাফল দেখা গেছে, যে রাজ্যগুলিতে তখন বিজেপি ক্ষমতায় ছিল। গত ২৫ জুলাই সোশ্যাল সায়ান্স রিসার্চ নেটওয়ার্ক পত্রিকায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। ২০২৪এর লোকসভা নির্বাচন যখন আসন্ন, তখন এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কীভাবে শাসক বিজেপি তাদের কৌশল নির্ধারণ করবে বলে আপনার মনে হয়?

প্রাথমিকভাবে দেখলে এই বিষয়টি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্বনামধন্য অধ্যাপকের তরফে কৃত গবেষণার বিষয়, যা তিনি নির্দিষ্ট আলোচনার পরিসরে (অর্থাৎ কিনা একটি গবেষণাপত্রিকায়) প্রকাশ করেছেন ও সংশ্লিষ্ট আরও অন্যান্য গবেষকদের কাছে এই বিষয়ে মতপ্রকাশের জায়গা খুলে দিয়েছেন। তুমি যে বিতর্কের কথা বলছ, সেটা কিন্তু এই ফোরামে তৈরি হয়নি। তৈরি হয়েছে বাইরে থেকে, এমন কিছু মানুষ এই বিতর্ক তৈরি করেছে যারা কেন্দ্রীয় শাসকদলের সমর্থক। গবেষণার বিষয় বা তার পদ্ধতির খুঁটিনাটি দিকগুলি নিয়ে আলোচনা উঠলে কিন্তু কোনও আপত্তি ছিল না। অধ্যাপক দাস নিজেই সেই বিতর্ক সামলাতে পারতেন।

কিন্তু যখন তা গুণ্ডাগিরির পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়, তখন তার মোকাবিলা আর কোনও শিক্ষাবিদের কাজ থাকে না। এমতাবস্থায় অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও কর্তব্য ছিল অধ্যাপকের পাশে দাঁড়ানো। দুর্ভাগ্যবশত, তারা সেটি করেনি এবং বিষয়টিকে অধ্যাপকের ঘাড়েই ছেড়ে দিয়েছে— জেনেবুঝেই, যে অসভ্যতার মোকাবিলা তাঁর পক্ষে কখনওই সম্ভব হবে না। যদিও এটা জানা নেই যে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর উপর পদত্যাগের জন্যও চাপ সৃষ্টি করেছিল কিনা, কিন্তু একই সঙ্গে প্রথিতযশা অধ্যাপক পি বালাকৃষ্ণনের পদত্যাগ ও অন্যান্য অধ্যাপকেদের তরফে অধ্যাপক দাসকে পুনর্বহালের দাবি করা— এই দুই ঘটনায় পরিষ্কার যে উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠান হিসেবে অশোকা বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজের সম্মানের প্রতি সুবিচার করেনি।

অধ্যাপক দাসের গবেষণাপত্রটি পড়লে দেখা যাবে, ২০১৯ সালের অস্বাভাবিক ভোট-বিন্যাসকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি দুটি সম্ভাব্য তত্ত্বের কথা বলেছেন। প্রথম হচ্ছে, সরাসরি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জালিয়াতি করে জয় নিশ্চিত করা, এবং দ্বিতীয় হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের তরফে নিখুঁতভাবে কেন্দ্রওয়াড়ি জয়ের ব্যবধানকে আগে থেকে আন্দাজ করে সেই অনুসারে তাদের নির্বাচনী প্রচারকৌশল নির্ধারণ করা। তারপরে যে-সমস্ত তথ্য তিনি সন্নিবিষ্ট করেছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে বোঝাই যায় প্রথম সম্ভাবনাটিই সত্য। তিনি উল্লেখ করেছেন, এই ভোট-জালিয়াতির অংশ হিসেবে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে নির্দিষ্টভাবে মুসলিম ভোটারদের নাম ভোটার-তালিকা থেকে বাদ দেওয়া, এবং সেই ন্যক্কারজনক ঘটনায় ইন্ধন জুগিয়েছে নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের কর্তব্যে গাফিলতি। যতদূর আমি জানি, সোশ্যাল সায়ান্স রিসার্চ নেটওয়ার্ক পত্রিকায় অধ্যাপক দাসের প্রবন্ধের বিরোধিতা করে কোনও প্রবন্ধ বা গবেষণা আজ অবধি প্রকাশিত হয়নি। আমি গবেষণাপত্রটি মনোযোগ সহকারে পড়েছি, এবং অধ্যাপক দাসের গবেষণা-পদ্ধতিতে অন্তত যে কোনও ভুল আমার নজরে আসেনি তা আমি হলফ করে বলতে পারি। পক্ষান্তরে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল সায়ান্স, সোশিওলজি ও অ্যানথ্রোপলজি বিভাগের অধ্যাপকেদের তরফে অধ্যাপক দাসকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। কাজেই তাঁর গবেষণার ফলাফল যে এখনও অবধি মান্য, এ-কথা বলাই যায়।

অধ্যাপক সব্যসাচী দাস

 

২০১৪ সাল থেকেই যারা বিজেপির সম্ভাব্য ভোটার নয় ভোটার-তালিকা থেকে সেই সব সম্প্রদায়ের নাম গণহারে বাদ দেওয়া, নাম থাকলেও তাঁদের ভোট দিতে যাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করা, ধর্মের ভিত্তিতে অপর সম্প্রদায়ের কাছে উসকানিমূলক প্রচার— এরকম প্রচুর অভিযোগ সামনে এসেছে। এ-কথাও বলা বাহুল্য যে নির্বাচনে জিততে বিজেপি যে কোনও পদ্ধতি ব্যবহার করতেই পিছপা হয় না। তারা প্রতিটি কেন্দ্রকে আলাদা আলাদা করে নির্বাচনের আগে খতিয়ে দেখে, কেন্দ্রওয়াড়ি কৌশল নির্ধারণ করে, এবং সেই কৌশল কার্যকরী করতে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপায়। হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণের তাদের যে ঘোষিত অ্যাজেন্ডা, তা পূর্ণ করার লক্ষ্যে ২০২৪-এর নির্বাচন তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই এই নির্বাচনে জিততে বিজেপি সবরকম কৌশল ব্যবহার করবে। যদিও, সদ্যসমাপ্ত পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল দেখে মনে হচ্ছে বিজেপির নিজস্ব কৌশলের চেয়েও, বিরোধী কংগ্রেসের দুরবস্থাই বেশি করে দায়ী। তারা এখনও তাদের গয়ংগচ্ছ মনোভাব দিয়ে বিজেপিরই সুবিধা করে দিচ্ছে। কংগ্রেস দল একথা বুঝতে পারছে না, এই নির্বাচনের পর তারা আর কোনও নির্বাচনে নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগই পাবে না।

 

কিছুদিন যাবৎ দেখা যাচ্ছে নিজেদের চিরকালীন উচ্চ-বর্ণের ভোটব্যাঙ্ক থেকে কিছুটা সরে এসে, বিজেপি ওবিসি অথবা অনগ্রসর শ্রেণি এমনকি দলিত ভোটারদেরও নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করছে। উত্তরভারতের হিন্দিবলয়ভুক্ত রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অনগ্রসর শ্রেণি এবং দলিতদের কথা মাথায় রেখে বিজেপি নির্দিষ্ট কী প্রচার-কৌশল নিতে পারে? অনগ্রসর শ্রেণিগুলির জন্য সামাজিক ন্যায়ের দাবিতে গড়ে ওঠা বিরোধীদের যে প্রচার-আন্দোলন, তাকে প্রতিহত করতে বিজেপি কোন পথ অনুসরণ করবে?

বিজেপি তাদের অভিভাবক-সংগঠন আরএসএসের কাছ থেকেই ব্রাহ্মণ্যবাদ ও বেনিয়া-বাদের উত্তরাধিকার পেয়েছে। গোলওয়ালকরের মৃত্যু অবধি মূলত ব্রাহ্মণ এবং বেনিয়াদের সংগঠন হিসেবেই আরএসএস কাজ করেছে। গোলওয়ালকরের মৃত্যুর পর বালাসাহেব দেওরাস সঙ্ঘচালকের দায়িত্ব নেন, ও কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদী সংগঠন হিসেবে সামাজিক পরিসরে আরএসএসের উপস্থিতির সঙ্কীর্ণতা উপলব্ধি করেন। তিনিই প্রথম সাংগঠনিকভাবে আরও নিম্নবর্গীয় জাতি-উপজাতি-শ্রেণিদের কাছে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। সঙ্গোপনে আরএসএস গান্ধি বা আম্বেদকরের মতো চরিত্রদের তাদের পূজনীয় তালিকায় নিয়ে আসতে শুরু করে যাঁদের তারা কায়মনোবাক্যে ঘৃণাই করে থাকে। এছাড়াও তারা দলিত বা অনগ্রসর শ্রেণির কথা মাথায় রেখে ‘সমরাস্তা মঞ্চ’ জাতীয় বিভিন্ন প্রচারমঞ্চ তৈরির দিকেও নজর দেয়। অরণ্যচারী আদিবাসী-উপজাতিদের মধ্যে যদিও আগে থেকেই আরএসএস তাদের জাল বিস্তারের চেষ্টা করছিল— যদিও তাঁদের তারা জংলি, বনবাসী জাতীয় অসম্মানজনক নামেই ডাকত বা ডাকে— কিন্তু সেটা মোটেও আদিবাসীদের সামাজিক অত্যাচার থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে নয়। বরং ঔপনিবেশিক সময় থেকে আদিবাসীদের সঙ্গে কাজ করে আসা খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রভাব কমাতেই আরএসএসের এই প্রচেষ্টা। ওবিসি-দের অভিমুখে আরএসএসের প্রচার-অভিযান ততদিন অবধি শুরু হয়নি, যতদিন না অবধি ভিপি সিং সরকারের আমলে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ও তারই প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিজেপি রামমন্দির আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনে ঝুঁকি ছিল, কারণ এই আন্দোলন ব্যর্থ হলে ব্যুমেরাং হওয়ার সম্ভাবনা ছিল ষোলো আনা। কিন্তু আজকের মতো সে-সময়েও রাজনৈতিক বিরোধীরা বিজেপি বা আরএসএসের এই কৌশলের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়। বিজেপির তরফে অনগ্রসর শ্রেণিগুলির হিন্দু-করণ (নাকি বলব ব্রাহ্মণ-করণ?) সম্পন্ন হয়।

শাস্ত্রীয় বর্ণপ্রথা অনুসারে ওবিসি-রা বৃহদর্থে শূদ্র-বর্ণের আওতায় পড়ে। তাদের উপযুক্ত আত্মপরিচয় দেওয়া গেলে তারা একটা ব্যাপক সংখ্যক মানুষের প্রতিনিধিত্ব করবে, যা কিন সামাজিকভাবেও তাৎপর্যপূর্ণ। ‘ওবিসি’ নামটার মধ্যেই ‘ব্যাকওয়ার্ড’ বা ‘অনগ্রসর’ শব্দটি তাঁদের সামাজিক গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। সেই কারণেই তাঁরা উচ্চবর্ণের সান্নিধ্য পাওয়ার লোভে মণ্ডল কমিশনের বিরোধিতা করে ও সংরক্ষণের দাবিকে সমর্থন জানানো দলিত ছাত্রদের মারধর করতেও সামিল হয়। ব্রাহ্মণ এবং বেনিয়া-অধ্যুষিত বিজেপির হিন্দুত্ব বলয়ে ঢুকে পড়ে তাঁরা নিজেদের সামাজিকভাবে মূল্যবান ভাবতে শুরু করে। জাতপাত-প্রথা এত দীর্ঘ সময় ধরে যে টিকে আছে তার পেছনের মূল কারণটিই হল কিন্তু এক বিপুল সংখ্যক ভূমিদাস শ্রেণির মানুষ এই প্রথাটির সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন এই ভেবে যে তাঁরা দলিতদের থেকে সামাজিকভাবে উঁচুতে। রামমন্দির আন্দোলনের পরে বিজেপির উঠে আসা আসলে তাদের ওবিসি-কৌশলের সাফল্য।

 

জাতিগত রাজনীতির বিষয়ে বিজেপির কৌশল হল, কিছু বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায় বা জাত-কে নিশানা করা— যেমন তফসিলি জাতি, ওবিসি অথবা মুসলিম— যাদের অন্যান্য রাজনৈতিক দল ততটা গুরুত্ব দেয় না। এবার তাদের মধ্যেই সে তার কাজ কেন্দ্রীভূত করে। অন্যান্য দলের তুলনায় এই কৌশল সম্পূর্ণ বিপরীত— কারণ, তাদের লক্ষ্য হয় সাধারণভাবে যেসব সম্প্রদায় বা জাতিগোষ্ঠীর জনসংখ্যা বেশি তারাই। তাদের ধারণা গোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশটাকে নিজেদের দিকে আনতে পারলে ছোট ছোট ভগ্নাংশগুলি আপনা থেকেই তাদের পক্ষে চলে আসবে এবং ভোটে জয় নিশ্চিত করা যাবে। সেই কারণে তারা দলিতদের দিকে নজর দিয়েছে, কারণ তাঁরা সংখ্যায় প্রচুর, একইসঙ্গে আম্বেদকরপন্থী এবং সবচেয়ে রাজনীতি-সচেতন। বিজেপি সে-জায়গায় ভিড় এড়িয়ে দলিতদের মধ্যেও যাঁরা বাকি থেকেছে, তাঁদের নিশানা করেছে, এবং তাঁদের হিসেব এই সবাই মিলে একত্রে আম্বেদকরপন্থী দলিতদের কাছাকাছি সংখ্যা হয়ে যাবে। প্রত্যেক জাত বা সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই বিজেপি এইভাবেই নিজেদের কৌশল সাজিয়েছে। ওবিসিদের ক্ষেত্রে কংগ্রেস যেখানে সংখ্যাগুরু কৃষিজীবীদেরই গুরুত্ব দিয়েছে, বিজেপি সেখানে লক্ষ্যবস্তু করেছে আরও নিচুতলার এবং ফলে অবহেলিত ওবিসি-দের। এর ফলও ফলেছে মারাত্মক: ১৯৯৬ সালে তাদের ভোট ১৯ শতাংশ থেকে ২০১৯ সালে দাঁড়িয়েছে ৪৪ শতাংশে। ব্রাহ্মণ এবং বেনিয়ারা তো তাদের পক্ষে দৃঢ়ভাবে ছিলই, কিন্তু তাদের জয়ের সূচক হয়ে দাঁড়িয়েছে ওবিসি ভোট। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন অনুসারে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ১৮.৬ শতাংশ। ২০১৯ সালেই সেই পরিসংখ্যান প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭.৬ শতাংশে। এর কারণই হল, উচ্চবর্ণের ভোটব্যাঙ্ক অক্ষুণ্ণ রেখে তারা ওবিসিদের (দলিত ও আদিবাসী মধ্যেও কিছু) মধ্যে নিজেদের অনুপ্রবেশ শক্তিশালী করেছে।

নিপীড়কদের দল বিজেপির হাত থেকে নিপীড়িত বর্গ হিসেবে ওবিসিদের বিরোধীরা কতখানি বের করে আনতে পারবে, তার ওপরেই ২০২৪ নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করছে। জাতভিত্তিক জনগণনা ক্ষমতা এবং সম্পদের নিরিখে ব্রাহ্মণ-বেনিয়াদের বিপ্রতীপে দলিত এবং ওবিসি-রা ঠিক কোন জায়গাতে রয়েছে তা সামনে তুলে আনার একটা হাতিয়ার ঠিকই, কিন্তু সে তো আর আপনাআপনি হবে না। এর সঙ্গে ওবিসিদের সাথে একটি সুপরিকল্পিত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যা তাঁদের বুঝিয়ে দেবে যে তাঁদের বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, ফলে তাঁদের বিজেপির নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বিরোধীদের আত্মতুষ্ট হাবভাবে মনে হচ্ছে যে এই জাত-গণনা এবং সংরক্ষণ-এর মাধ্যমে বিজেপিকে পরাস্ত করার ব্রহ্মাস্ত্র তারা ইতিমধ্যেই পেয়ে বসে রয়েছে। রাহুল গান্ধি প্রয়াত কাঁসিরামের একটি স্লোগান নিজের করে নিয়েছেন— “জিসকি জিতনি সংখ্যা ভারি, উসকি উতনি ভাগীদারি”। বিজেপি এর জবাবে সংখ্যাতত্ত্বের আশ্রয় নিয়েছে— তাদের মোট ৩০৩ জন সাংসদের ৮৫ শতাংশ এবং মোট ১৩৫৮ জন বিধায়কের মধ্যে ৩৬৫ জন ওবিসি, এমনকি ২৭ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও রয়েছে। বিজেপির জাতপাতের মধ্যে উপ-বিভাগ তৈরির প্রতিশ্রুতি যে কতখানি প্রভাব বিস্তার করতে পারে বিরোধীরা তো তা আঁচ করেই উঠতে পারেনি। মনে রাখতে হবে, ওবিসি-ই হোক আর দলিত-ই হোক, কোনওটিই একটি সমস্বত্ব জনসমষ্টি নয়। তাঁদের মধ্যে যে বৈষম্য রয়েছে তা বঞ্চিত অংশকেই সবচেয়ে বেশি বিক্ষুব্ধ করে। উত্তরপ্রদেশ— যে-রাজ্য কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলের প্রধান চাবিকাঠি— সেখান থেকে খবর পাচ্ছি সেখানকার ওবিসিদের গৈরিকীকরণ নিশ্চিত করতে বিজেপির তরফে ২০,০০০ ওবিসি কর্মকর্তার একটি দল গঠন করা হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য বিরোধী দলগুলির তরফে কিন্তু কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

 

একদিকে যেমন বিজেপি সিএএ-র মতো মুসলমান-বিরোধী আইন নিয়ে আসছে ও অন্যান্য নানাভাবে তাদেরকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে, আবার অন্যদিকে মুসলিমদের ক্ষতে প্রলেপ লাগানোর চেষ্টাও কিন্তু দেখা যাচ্ছে। এই বিষয়টি পরস্পরবিরোধী বলে মনে হয়। আপনি কী মনে করেন আগামী এক দশকে বিজেপির মুসলিম-নীতি কী হতে চলেছে? সত্যিই কি তারা চায় যে মুসলিমরা তাদের ভোট দিক?

মুসলিমদের প্রতি বিজেপির ঘৃণার দুটি দিক রয়েছে। প্রথমটি কৌশলগত, দ্বিতীয়টি সাংস্কৃতিক। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তারা মুসলিম (এবং খ্রিস্টানদেরও বটে) ঘৃণা করে কারণ তাদের একটা বড় অংশই এসেছে দলিত অথবা শূদ্র কারিগর-শ্রেণির মধ্যে থেকে। সরাসরি একথা তারা বলতে পারে না, কারণ বললে পরে তাদের হিন্দুত্বের প্রচার চুপসে যাবে। অন্যদিকে কৌশলগতভাবে তাদের এই ঘৃণার কারণ হল, ‘অপর’-এর প্রতি এক ঘৃণার বাতাবরণ সৃষ্টি করা, যার পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক একত্রিত হবে এবং তারা ক্ষমতা দখল করতে পারবে। এই ক্ষমতার জন্য তাদের যদি মুসলিমদের প্রতি ভালবাসা দেখাতে হয় তারা তাতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হবে না। তাদের ঘোষিত লক্ষ্য হল ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র বানানো। কী এই হিন্দু রাষ্ট্র? হিন্দু রাষ্ট্রের অর্থ এই নয় যে সে-দেশে সব হিন্দুই উদারতা, সমদর্শিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ অথবা ন্যায়বিচারের আদর্শ উপভোগ করবে; কোনও হিন্দুই কোনও হিন্দু জমিদার বা হিন্দু পুঁজিপতির দ্বারা শোষিত হবে না বা কোনও হিন্দু আমলার দ্বারা অত্যাচারিত হবে না, হিন্দু পুলিশকর্মীরা কোনও হিন্দু মানুষকেই আর হেনস্থা করবে না। হিন্দু রাষ্ট্রের অর্থ হল আদতে সমাজের প্রতিটা স্তরে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিষ্ঠা। যার অর্থ উচ্চবর্ণের কিছু মানুষ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন। বাকি প্রত্যেকেই অনুগত চিত্তে তাদের সেবকের ভূমিকা পালন করবে। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত সম্প্রতি যে দলিতদের উপর ‘পূর্বপুরুষদের অমানবিক অত্যাচারের জন্য’ ক্ষমা চাইলেন তা সাধারণ মানুষকে অবাক করেছে বটে, কিন্তু তিনি কখনওই ব্রাহ্মণ্যবাদের মূল নীতিগুলির বিরুদ্ধে একটিও শব্দ উচ্চারণ করবেন না। বলবেন না যে, ব্রাহ্মণ্যবাদের কারণেই সমাজে নিপীড়ক ও নিপীড়িতের এক অসম ব্যবধান তৈরি হয়েছে। ব্রাহ্মণ্যবাদ-নির্দেশিত সামাজিক গঠনই সমাজে ‘নিচুতলার মানুষ’দের উপস্থিতিকে নিশ্চিত করে, যারা কেবল উঁচুতলার মানুষের সেবা করার জন্যই জন্মিয়েছে। বিজেপির বিশ্বাস এমন একটি ব্যবস্থাই মুসলমান শাসকদের আসার আগে অবধি এদেশে বর্তমান ছিল, এবং তারা সেটাকেই ফিরিয়ে আনতে চায়।

মুসলিমদের কেবল বিরোধিতা করাই নয় বিজেপি সুযোগ পেলেই তাদের হেনস্থা করেছে। তারা দানবিক সমস্ত গো-আইন প্রবর্তন করেছে, সেই নিয়ে নিজেদের গুণ্ডাবাহিনিকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে, মুসলিমদের সরাসরি জঙ্গি আখ্যা দিয়ে বিনা বিচারে জেলবন্দি করে রেখেছে। ২০১৯-এ তারা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন প্রবর্তন করেছে যাতে নির্লজ্জভাবে ধর্মীয় পরিচয়কে নাগরিকত্ব-প্রাপ্তির শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই আইনবলে পরিষ্কার ঘোষণা করা হচ্ছে মুসলিমরা এ-দেশে স্বাগত নন। সারা পৃথিবীতে এই আইন ধিকৃত হলেও, বিজেপির হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক খুশি হয়েছে। এই আইন ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনকে সংশোধন করে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাস বা তার আগের কোনও সময়ে উদ্বাস্তু হয়ে আসা অত্যাচারিত ধর্মীয় সংখ্যালঘু শরণার্থীদের তাড়াতাড়ি নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলছে। কেবলমাত্র হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি অথবা খ্রিস্টানরাই এই সুবিধা পাবেন।

 

মুসলিমদের উপর এই অত্যাচার তাদের আরও প্রান্তিক করে তোলার বদলে তাদের বিজেপির সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করতে বাধ্য করেছে। গুজরাতি মুসলিম সমাজ, যাঁদের স্মৃতিতে ২০০২ সালের ভয়াবহ গণহত্যার অভিজ্ঞতা এখনও দগদগে, তাঁরা কিন্তু এখন জীবনরক্ষার্থেই বিজেপিকে ভোট দিয়ে থাকে। মূলত সম্পন্ন মুসলমানদের ক্ষেত্রেই এই ঘটনা ঘটেছে। আর্থিকভাবে নিচুস্তরে যাঁরা, তাঁরা একেবারেই অসহায় অবস্থায় রয়েছে। বিজেপির আসলে এটি দ্বিমুখী কৌশল— একদিকে তারা হিন্দু ভোটারদের বোঝাচ্ছে যে তারা দেশ থেকে মুসলমান তাড়াতে চায়, অন্যদিকে তারা তাদের ওবিসি-কৌশলের মারফত নিচুতলার মুসলিমদের ভোট পেতে চাইছে। মুসলিম মহিলা এবং পশমন্দা (পিছড়ে বর্গ) মুসলমানদের জন্য তাদের নানান আইন বা সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা সকলেরই জানা। মনে রাখতে হবে, হিন্দি-বলয়ে মোট মুসলিম ভোটারের ৮৫ শতাংশই কিন্তু এই পশমন্দারা। উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে— যা আবার হিন্দুত্বের অন্যতম পোস্টার-বয় যোগী আদিত্যনাথের হোম টার্ফ— বহু আসনেই এই পশমন্দা-ভোট বিজেপিকে জিততে সাহায্য করেছে। আসন্ন ভোটে জেতার জন্য কোনও কিছু করতেই বিজেপি পিছপা হবে না। মোদি-মিত্র নামে একটা প্রকল্পই নামানো হয়েছে, যা বিশেষ করে পশমন্দা মুসলিমদের কাছে বিজেপির বিভিন্ন আর্থিক প্রকল্পের বার্তা পৌঁছে দেবে। এই প্রকল্পে ২৫,০০০০ মুসলিম কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ৬৫টি আসন বিশেষ এই প্রচার-প্রকল্পের লক্ষ্যবস্তু, যেগুলিতে মুসলিম-ভোটার সংখ্যা ৩০ শতাংশের বেশি, মোটামুটিভাবে দেশের জনসংখ্যার নিরিখে যা তাদের গড় শতাংশের দ্বিগুণ।

 

একদিকে বিজেপি বিভিন্ন কর্পোরেট গ্রুপ এবং বৃহৎ পুঁজিপতিদের সঙ্গে মাখামাখি করে, যারা আদতে জনজাতি-আদিবাসী এলাকার সম্পদ লুঠ করে ও আদিবাসী জনতাকে উচ্ছেদ করেআবার অন্যদিকে তারা আদিবাসীদের মধ্যে একটা ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করতেও সচেষ্ট, এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেই ভোটব্যাঙ্ক তাদের যথেষ্ট কাজেও এসেছে। এমন দ্বিচারিতা নিয়ে বিজেপি কভাবে আদিবাসীদের মধ্যে ঢুকছে, সেই বিষয়ে যদি বলেন…

বিজেপির সাফল্যে মূলেই হল তার নিজের মধ্যেকার পরস্পরবিরোধিতার সমন্বয় ঘটানো। তারা একদিকে মুসলিমদের উপর নাগাড়ে অত্যাচার চালাতে পারে আবার অন্যদিকে একইসঙ্গে পশমন্দা মুসলিমদের নানান সুবিধের লোভ দেখিয়ে নিজেদের দিকে টেনে আনতে পারে। তারা অন্যান্য বিরোধী দলকে জাতপাতের রাজনীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারে, আবার নিজেরাই সুচতুরভাবে এই জাতপাতের রাজনীতিতে বহুদূর এগিয়ে উপ-জাত তৈরির মতো হীন কৌশলও অনায়াসে নিতে পারে। আদিবাসীদের ক্ষেত্রেও তাদের এই কৌশলের কোনও অন্যথা ঘটেনি। আদিবাসীরা বরাবরই অবহেলিত ছিল, তাই ১৯৪০ সাল থেকেই বিজেপির জনক আরএসএসের নেতা ও কর্মীরা সন্তর্পণে আদিবাসীদের মধ্যে নিজেদের সাংগঠনিক প্রভাব বাড়াতে শুরু করে ও ক্রমশ খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রভাব কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়। আদিবাসীরা মূলত অ্যানিমিস্ট বা সর্বপ্রাণবাদী হলেও আরএসএস কিন্তু প্রায় তাদের হিন্দু-করণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। এই গেল তাদের কৌশলের একটি দিক। অন্যদিকে মনে রাখতে হবে, আদিবাসী-প্রভাবিত যে বিরাট জমি ও জঙ্গল অঞ্চল, তার নিচেই রয়েছে ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের বিবিধ খনিজ সম্পদ। সারা পৃথিবীর পুঁজির প্রতিনিধিরাই এখন যে সম্পদের দিকে এখন লালায়িত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। বিজেপি, আর সব রাজনৈতিক দলের মতোই, চাইলেই এই ঘটনাকে নিজেদের ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিয়ে অস্বীকার করতে পারে না। আদিবাসীদের সেই জমির মালিকানা থেকে যে করেই হোক উচ্ছেদ করতে হবে। বিজেপি এই কাজে নকশাল দমনের কৌশল কাজে লাগাচ্ছে। এই কথা বলেই দীর্ঘদিন ধরে আদিবাসীদের উপর অত্যাচার চালানো হচ্ছে। কংগ্রেস সরকারের আমলেও একই ঘটনা ঘটেছে। বিজেপি কংগ্রেসের তুলনায় আরও ভালভাবে পুঁজিকে সন্তুষ্ট করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে— এবং নির্মমভাবে তারা পুঁজিকে সন্তুষ্ট করে চলেছে।

 

যেমনটা আগেও বলেছি, দ্বিচারিতা বা পরস্পরবিরোধিতাকে সমন্বিত করতে বিজেপির চেয়ে ভাল আর কেউ পারে না। আদিবাসীদের উচ্ছেদ করতে নকশাল হিংসার অজুহাত ব্যবহার করার কৌশল কংগ্রেস আমলেই নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বিজেপি আরও দ্রুততা ও নির্মমতার সঙ্গে সেই নীতি কার্যকর করেছে। যদিও বিজেপি আদিবাসীদের তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করেছে, এবং সেই কাজ করতে গিয়ে তারা পরিবেশ-বিষয়ক সমস্ত নীতিকে উপেক্ষা করেছে, এমনকি গ্রামসভার প্রতিনিধিত্ব বা বিরোধিতাকে অবধি স্পষ্ট সন্ত্রাসের মাধ্যমে দমন করেছে, তবুও আদিবাসীরা কিন্তু বিজেপিকে নিয়েই খুশি। এতটা খুশি তারা আগে কখনও ছিল না। কারণ বিজেপি খুবই কৃতিত্বের সঙ্গে প্রতীকী রাজনীতির বিষয়টিকে ব্যবহার করে। রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রথম একজন আদিবাসী মহিলাকে পাঠানো যে একটা মাস্টারস্ট্রোক, তা অস্বীকার করা চলে না। অথচ, সংবিধান সভায় প্রথম আদিবাসী নেতা হিসেবে জয়পাল সিং মুন্ডা যেভাবে আদিবাসী সমাজের উপর দেশের অন্যান্য বর্গের মানুষের অত্যাচারের কথা বিবৃত করেছিলেন— সেই জয়পাল সিং মুন্ডাকে কিন্তু বিজেপি কোনওদিন ভুলেও স্বীকৃতি দেবে না।

 

ব্যক্তিগত ক্ষেত্র থেকে শুরু করে পার্টনারশিপ ফার্ম এমনকি বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থার কাছ থেকে অবধি যাতে রাজনৈতিক অনুদান আদায় করা যায়, সে কারণে বিজেপি জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, কোম্পানি আইন এমনকি আয়কর আইনেও পরিবর্তন এনেছে। বৃহৎ পুঁজির অর্থ সরাসরি রাজনীতিতে ঢোকা এর ফলে সহজ হয়েছে। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে এর কী প্রভাব পড়বে, রাজনৈতিক দলগুলিই বা কীভাবে নির্বাচনী বিধিকে পাশ কাটিয়ে এই পুঁজির অনুপ্রবেশের সুযোগ নেবে?

হ্যাঁ, সংশ্লিষ্ট সমস্ত আইন সংশোধন করে বিজেপি সরকার ইলেকটোরাল বন্ড-ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যক্তিগত ক্ষেত্র থেকে শুরু করে পার্টনারশিপ ফার্ম, কোম্পানি, এমনকি বিদেশি কর্পোরেশনগুলির থেকেও যাতে অনুদান এসে রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলে ঢোকে, সেই রাস্তা তৈরি করেছে। ২০২১-২২ সাল পর্যন্ত ৭টি জাতীয় দল ও ২৪টি আঞ্চলিক দলের তহবিলে মোট ৯,১৮৮.৩৫ কোটি টাকা ইলেকটোরাল বন্ডের মাধ্যমে জমা পড়েছে। এর মধ্যে কেবল বিজেপির তহবিলেই ঢুকেছে ৫,২৭২ কোটি টাকা, কংগ্রেসের তহবিলে গিয়েছে ৯৫২ কোটি টাকা, বাকি অর্থ অন্যান্য দলগুলির তহবিলে। অর্থাৎ ৫৭ শতাংশই পেয়েছে একা বিজেপি। পুঁজিপতিদের কাছে বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা যে কতখানি, এই তথ্য তারও একটা সূচক। এমন ইলেকটোরাল বন্ডের সাংবিধানিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সেই সময়ে বিপুল বিতর্কের সৃষ্টি হয় ও সুপ্রিম কোর্টে একগুচ্ছ মামলাও দাখিল করা হয়। অতি সম্প্রতি প্রায় পাঁচ বছরের অপেক্ষার পর তেমন একটি মামলার শুনানি শুরু হয়েছে। মামলার রায় আসতে এখনও দেরি আছে। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রের যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে।[1]

 

যদিও রাজনৈতিক দলগুলির, বিশেষত কেন্দ্রীয় শাসক দলের তহবিলে অর্থ আসার পথ কিন্তু কেবল এই ইলেকটোরাল বন্ডেই সীমাবদ্ধ নয়। আরও অজস্র পথ দিব্যি খোলা রয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে দলগুলির তরফে তাদের খরচের হিসেবও আর জমা পড়ছে না, নির্দিষ্ট ঊর্ধ্বসীমা মেনে দলগুলির তরফে খরচ করা হয়েছে কিনা সেই তথ্যও সামনে আসছে না। নির্বাচন কমিশন, যারা এই নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়বদ্ধ, তাদের তরফেও কোনও হেলদোল দেখা যাচ্ছে না। এমনকি, কমিশনের তরফে রাজ্যবিশেষে লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থীপিছু খরচের ঊর্ধ্বসীমা বাড়িয়ে ৭০ থেকে ৯৫ লাখ টাকা অবধি করা হয়েছে (আগে যে পরিমাণ ছিল ৫৪ থেকে ৭০ লাখ টাকা)। বিধানসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রার্থীপিছু এই ঊর্ধ্বসীমার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ থেকে ৪০ লাখ টাকা (আগে যে পরিমাণ ছিল ২০ থেকে ২৮ লাখ টাকা)। আসলে যে এর চেয়েও অনেকগুণ বেশি টাকা খরচা হয়, তাও সকলেই জানে। এখনই সারা পৃথিবীর মধ্যে ভারতের নির্বাচন সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্বাচন হিসেবে স্বীকৃত। সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজের সমীক্ষা অনুসারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, প্রার্থী ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার তরফে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে মোট ৮৬০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করা হয়েছে। যেখানে ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অবধি ব্যয় করা হয় ৬৫০ কোটি মার্কিন ডলার। এই অর্থের প্রায় অর্ধেক, প্রায় ২৭,০০০ কোটি টাকা খরচ করেছে কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি। সিএমএস চেয়ারপার্সন এন ভাস্কর রাওয়ের অনুমান, ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা অবধি ব্যয় করা হতে পারে।

মোদি সরকার-প্রবর্তিত ইলেকটোরাল বন্ড ব্যবস্থা বাঁধনছাড়া দুর্নীতির সম্ভাবনাকেই উজ্জ্বল করেছে। পুঁজির সঙ্গে বরাবরই শাসকদলগুলির সহজাত সম্পর্ক থাকে। ‘বিকাশ’-এর নামে পুঁজিপতিদের সঙ্গে বিজেপি সরকারের দহরম-মহরম আর কর্পোরেটের থেকে তাদের প্রাপ্ত বিপুল অর্থ একই সুতোয় বাঁধা। এমন অনুদান আইনত ঘুষ ছাড়া আর কিছুই নয়। যেমনটা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের তরফে লেখা হয়েছে, “নির্বাচনী ব্যয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সমস্ত দুর্নীতির মূল।”

 

কিছু বছর আগে পিউ সংস্থার তরফে একটি সমীক্ষা চালানো হয় যেখানে বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁদের অভিমত জানতে চাওয়া হয়েছিল ও সেই সম্পর্কিত আরও কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল। সেই সমীক্ষা অনুসারে সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৭৫ শতাংশ মানুষ ভারতের বর্তমান জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকারি ব্যবস্থাকে সমর্থন করেন (সমগ্র এশিয়ার ক্ষেত্রে এই মান সর্বনিম্ন), ৬৫ শতাংশ বিশেষজ্ঞ মানুষদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণাধীন শাসনব্যবস্থা সমর্থন করেন (সমীক্ষা চালানো দেশগুলির মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ); আর, আমাদের দেশেরই সবচেয়ে বেশি মানুষ (৫৫ শতাংশ) কোনও একজন শক্তিশালী নেতার অধীনে একনায়কতান্ত্রিক শাসনকেই উপযুক্ত বলে মত দেন। এই সমীক্ষা কি তাহলে সত্যিই একনায়কতন্ত্রের প্রতি আমাদের দেশের মানুষের আকর্ষণের প্রতিফলন? যদি তাই হয়, তাহলে কেন এমন হল— সে নিয়ে আপনার ব্যাখ্যা কী?

আমি কিন্তু এই তথ্যে মোটেই চমৎকৃত নই। বরং এর পেছনের অন্তত চারটি কারণ আমি এখনই বলতে পারি।

এক, ঐতিহাসিকভাবে দেখলে প্রাক-বৌদ্ধ যুগের দু-একটি বিচ্ছিন্ন নগরসভ্যতা যেগুলিতে নাকি গণতন্ত্র ছিল বলা হয়ে থাকে, সেগুলি ব্যতীত এ-দেশের মানুষ গণতন্ত্রের সঙ্গে কোনও দিনই পরিচিত ছিল না। সত্যি কথা বলতে গেলে, স্বাধীনতা বা ভারত প্রজাতন্ত্র হওয়ার পরেও সাধারণ মানুষের জীবনে সে অর্থে প্রায় কোনও পরিবর্তন আসেনি। বরং জাতিভেদ প্রথা সম্পর্কে অতটা সচেতন না-থাকা ব্রিটিশ আমলাদের প্রস্থানের পর এ-দেশে তথাকথিত নিচুজাতের মানুষের দুর্দশা বেড়েছে। তাঁদের কাছে গণতন্ত্রের অর্থ হল পাঁচ বছর অন্তর বাধ্যতামূলকভাবে ভোটবাক্সের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো। তাঁরা জানতেও পারেন না কাদের তাঁরা ভোট দিচ্ছেন, অথবা এর ফলে তাঁদেরই বা কী সুবিধা হবে। এখন তো নির্দিষ্ট পার্টিকে ভোট দেওয়ার জন্য তাঁরা সেই পার্টির দালালদের কাছ থেকে মদ ও নগদ অর্থ পান। গণতন্ত্র এ-দেশে এমনই তামাশার বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের সমর্থনে আমাদের দেশ থেকেই যে সবচেয়ে কম সংখ্যক লোক এগিয়ে আসবে সে আর আশ্চর্য কী! এছাড়াও, প্রথম-সীমানা-পেরুনো বা ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-মার্ক মার্কা যে নির্বাচনী ব্যবস্থা আমরা আমাদের গণতন্ত্রের জন্য বেছে নিয়েছি, তা আদতে সার্বিকভাবে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। গঠনগতভাবে দেখলে, এই ব্যবস্থা অর্ধেকের বেশি মানুষের মতামতকে অগ্রাহ্য করে। গত সাত দশকে কোনও সরকারই দেশের অর্ধেক মানুষেরও সমর্থন পায়নি। মানুষ এত বোকা নয় যে তারা এই নগ্ন সত্যকে দেখতে পাবে না। এই ভাঁওতাকে ধরে ফেলেছে বলেই এ-দেশের সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা হারিয়েছে।

 

দুই, ভারতে বহুদিন ধরে জাতিভেদের মতো কুপ্রথা বহমান, যা সম্পূর্ণভাবে গণতন্ত্রের পরিপন্থী। বাবাসাহেব অম্বেদকর যেমনটা বলেছিলেন, “গণতন্ত্র আদতে মাটির একেবারে উপরের প্রলেপটুকু মাত্র, যেখানে ভারতের মাটিটা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক।” এই বাস্তবতাকে মনে রেখেও, স্বাধীনতা-পরবর্তীতে যে সকল প্রতিষ্ঠান ক্রমশ গড়ে ওঠে, সেগুলির কোনটিতেও গণতন্ত্রের বীজরোপণের চেষ্টা করা হয়নি। যাদের ওপর দেশ গড়ার দায়িত্ব ছিল, সেই রাজনৈতিক দলগুলি নিজেরাই রন্ধ্রে রন্ধ্রে সামন্ততান্ত্রিক, ‘হাইকমান্ড’ নামক এক প্রভুসুলভ সংস্কৃতি সর্বত্র। কাজেই, সাত দশক ধরে চলে আসা এই ভ্রান্ত গণতন্ত্রের ধারণার প্রতি মানুষ যে বীতশ্রদ্ধ হবে, সেটাই স্বাভাবিক।

তিন, মিলেনিয়াল প্রজন্ম (যাদের বয়স এখন ১৫ থেকে ৩৫), যাদেরকে আমি কখনও কখনও নিও-লিবেরাল প্রজন্ম বলে থাকি, তাদের মধ্যে কখনওই গণতন্ত্রকে মূল্য দেওয়ার বোধটা তৈরি হয়নি। জনসংখ্যার নিরিখে এরা এখন প্রায় ৩০ কোটির কাছাকাছি, এবং গণতন্ত্র প্রসঙ্গে এদের কিচ্ছুটি এসে যায় না। নিও-লিবেরালিজম আদতে সামাজিক পরিসরে ডারউইনীয় তত্ত্ব অনুসরণ করে— যার শক্তি বেশি, সে-ই শাসন করবে; যে সবচেয়ে মেধাবী, সে-ই সবার ওপরে থাকবে। এই ধারণা গণতন্ত্রের ‘এক নাগরিক-এক ভোট-এক মূল্যবোধ’ ধারণার সম্পূর্ণ বিরোধী। নিও-লিবেরালিজমের ধারণা জন্মের সময় থেকেই নানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, এবং ক্রমশই গণতন্ত্রের পক্ষে আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। সে গণতন্ত্র-বিরোধী শক্তিগুলির সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে। নিও-লিবেরালিজমের মূল ধারণা এমন একটা মঞ্চ তৈরি করেছে যা আজ সারা পৃথিবীতে উগ্র দক্ষিণপন্থী নেতাদের একটা নয়া-প্রজন্মের উত্থান ঘটাচ্ছে। নিও-লিবেরালিজমের সঙ্গে বৃহৎ পুঁজি গাঁটছড়া বাঁধতে শুরু করেছে, এবং এই জোট জাতীয়তাবাদী, সামাজিকভাবে রক্ষণশীল ও স্বৈরাচারী জনপ্রিয় নেতাদের সমর্থন জোগাচ্ছে। আজ এই জোট গণতান্ত্রিক রাজনীতির সামনে অন্যতম বড় বিপদ। সামাজিক মাধ্যমের ঝলমলে প্রচার ও পুঁজি-প্রভাবিত সংবাদমাধ্যম— এই দুইয়ের প্রভাবে তরুণ প্রজন্ম ক্রমশই গণতন্ত্রের ধারণার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে।

চার, ভারতে তো বটেই, অন্যত্রও দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি ধর্মকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে গণতন্ত্রের বিপরীতে চালিত করছে। হিন্দুত্বের অন্যতম ধ্বজাবাহক, আরএসএস গণতন্ত্রে চূড়ান্ত অবিশ্বাসী। তার রাজনৈতিক শাখা বিজেপি বিদ্যমান গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ব্যবহার করেই ক্ষমতায় এসেছে, এসে এবার গণতন্ত্রকেই ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষ তাদের প্রচারে মোহাবিষ্ট, এবং তারাই আজ সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা সত্যিই আজ আরএসএসের সরসংঘচালকেরই সমতুল একজন কাউকে ‘উপকারী একনায়ক’ হিসেবে ক্ষমতায় দেখতে চাইছে।

এমন প্রতিটি লক্ষণই আমার কাছে অশনিসঙ্কেত বহন করে নিয়ে আসে— আমরা বোধহয় সত্যিই আজ হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে উঠতে চলেছি!

 

মণিপুরে কুকি-মেইতেই সংঘর্ষের সময়ে সরকারে থাকা সত্ত্বেও বিজেপি যে সদর্থক কোনও ব্যবস্থা নিল না, তা কি কোনওভাবে নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে যেতে পারে? যেভাবে মহিলাদের নগ্ন করে রাস্তায় ঘোরানো হল, যার পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধি সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন, “উত্তর-পূর্বে ভারতমাতাকে হত্যা করা হয়েছে,” তারও কি কোনও প্রভাব জাতীয় স্তরে বিজেপির বিরুদ্ধে পড়বে না?

আসলে, ২০১৪ সালের পর থেকে মানুষ এত শক পেয়েছে যে তাদের আর নতুন করে কিছু নাড়া দেয় না। যাঁরা মানুষকে নৈতিকতার বিষয়গুলি দেখিয়ে দিতেন, তাঁরা আজ জেলে। তাঁদের উদাহরণ দেখিয়ে মানুষকে আরও চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। মণিপুরে মেইতেইদের তরফে চালানো কুকি গণহত্যা, মহিলাদের নগ্ন করে রাস্তায় ঘোরানো, সবকিছুই জাতীয় স্তরে মানুষকে অবশ্যই ধাক্কা দিয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় না নির্বাচন অবধি তার রেশ থাকবে। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত এত কিছু ঘটে চলেছে যে সেই প্রচারের ধাক্কায় এই স্মৃতিগুলি ফিকে হয়ে যায়। যা থাকবে, তা হল কেবল শেষ মুহূর্তের নাটকবাজি। সাধারণভাবে এমন ঘটনার প্রেক্ষিতে সরকারের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর যা প্রতিক্রিয়া, তার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু না তা কেউ ভাবল, না সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে কোনও দলের ইস্তেহারে তা দেখা গেল। বরং, তিনটি রাজ্যে বিজেপির জয় দেখে তো মনে হল মানুষ মণিপুরের বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের যে অবস্থান, অথবা প্রধানমন্ত্রীর যে নীরবতা— তাকেই যেন সমর্থন জানিয়েছে।

 

আমার মনে হয় না সংসদে রাহুল গান্ধির আবেগমথিত ভাষণ বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কোনও দাগ কাটতে পারবে। পক্ষান্তরে, কংগ্রেসের বিরোধী জোটকে নেতৃত্ব দেওয়ার অযোগ্যতা বা বিজেপির মোকাবিলা করার জন্য কোনও সঠিক রণকৌশল প্রণয়নে ব্যর্থতা আমাকে অবাক করছে।

 

বিজেপি সরকার উজ্জ্বলা যোজনা, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা— এমন একগুচ্ছ কল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করেছে। আপনার কি মনে হয় এগুলির মাধ্যমে সত্যিই কোনও সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তন এসেছে? এই কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি আবার আদানির মতো বৃহৎ পুঁজিপতিদের সঙ্গে সরকারের যে দহরম-মহরম, সেই ধারারও পরিপন্থী। একদিকে আদানির মতো বৃহৎ পুঁজিপতিদের অন্যায্য সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, অন্যদিকে কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির মাধ্যমে নিজেদের গরিব-দরদি হিসেবে তুলে ধরা— একে কি আপনি দ্বিচারিতা বলবেন না?

কল্যাণমূলক প্রকল্প ঘোষণার সঙ্গে বৃহৎ পুঁজিপতিদের সেবা করা, এই দুয়ের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। বরং আদতে তারা একে অপরের পরিপূরক। যদি সরকার বেআইনি পথে পুঁজিপতিদের অতিরিক্ত সুবিধা পাইয়ে দিতে চায়, তাদের অবশ্যই কল্যাণমূলক কিছু প্রকল্পের মাধ্যমে জনগণকে ভুলিয়ে রাখতে হবে, যাতে তারা আর ওইদিকে নজর না দেয়। আপনি আমাকে এই প্রকল্পগুলির অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। আমার মনে হয় না বাস্তব ক্ষেত্রে এই প্রকল্পগুলির আদৌ কোনও উল্লেখযোগ্য প্রভাব আছে। কিন্তু শাসকের কাছে এগুলির প্রচার-মূল্য বিরাট, এবং সেটা তারা নিংড়ে নিতে কোনও কসুর করছে না। সত্যিকারের কোনও প্রভাব থাকলে, এত প্রকল্পের পরেও সরকারি তরফে ৮১ কোটি মানুষের জন্য বিনামূল্যে রেশনের ব্যবস্থা করতে হত না, ও তারপরেও রেঊড়ি-রাজনীতি নিয়ে কটাক্ষ করতে হত না। বৃহৎ পুঁজির সঙ্গে সমঝোতা হয়েছিল বলেই বিজেপি আজ ক্ষমতায় আসতে পেরেছে। আর এটাও সত্য, গরিব-দরদি সাজার চেষ্টা কেবল বিজেপিরই বৈশিষ্ট্য নয়। উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রতিটি সরকারের আমলে এই চেষ্টা হয়েছে। তারই সঙ্গে বৃহৎ পুঁজির সঙ্গে গা-ঘষাঘষির অভ্যাসটুকুও সকল সরকার বজায় রেখেছে, কেউ বা প্রত্যক্ষে, কেউ বা পরোক্ষে। তফাত মাত্রার।


[1] সাক্ষাৎকারটি ইলেকটোরাল বন্ড নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়দানের আগে নেওয়া। সে-বিষয়ে জানতে পড়ুন: নির্বাচনী বন্ড: আইনসিদ্ধ দুর্নীতির সাতকাহন, সুমন কল্যাণ মৌলিক।