শুভ্রদীপ চৌধুরী
বিপিন মণ্ডল সমস্যায় পড়েছেন। ছোটখাটো সমস্যা নয়। বিরাট সমস্যা।
গাঁ-গঞ্জে সমস্যা নিয়ে মাতব্বর টাইপের মানুষেরা চায়ের দোকানে বসে বিনেপয়সায় বিস্তর জ্ঞানের কথা বলেন। কেউ পরামর্শ না চাইলেও বলেন। এতবার সেসব বলেন যে পরামর্শটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এই মুহূর্তে বিপিন মণ্ডলের মাথায় ঘুরছে সেসব কথা। তাদের বলা সবচেয়ে চালু দুটি উপদেশ এইরকম:
এক, “যতবড় সমস্যা আসুক ঘাবড়াবে না। মনে রাখবে, যে সমস্যা দ্রুত আসে তা দ্রুত চলে যায়।”
দুই, “সমস্যা গোপন করা যাবে না, পরিচিত মানুষজনের সঙ্গে বিশদে আলোচনা করতে হবে।”
অথচ তার বিষয়টা এমনই যে, দুটো উপদেশের একটাতেও ভরসা পাচ্ছেন না। কাউকে জানালে সমস্যা আরও বাড়বে।
প্রতিটা মানুষের বুকের ভেতরে কিছু পাথরচাপা গোপন কথা থাকে। একলা হলেই বুকের ভেতর সেই গোপন কথারা হাজার ছটফট করে। অথচ কাউকে বলা যায় না।
বিপিন মণ্ডল মনেমনেই ঠিক করলেন, এবার থেকে বিপদ নিয়ে কেউ কিছু বলতে শুরু করলেই থামিয়ে দিয়ে বলবেন, ফাউল-টাইপ কথাবার্তা বলবেন না। এমন অনেক সমস্যা আছে যা বুকের ভেতরটা শূন্য করে দেয়। বুকের ভেতর খাঁ-খাঁ করা ভাব কমে না।
বিপিন মণ্ডলের সম্পর্কে এবার দু-চার লাইন বলা যাক। আধার কার্ড অনুযায়ী বিপিন মণ্ডলের বয়স আটচল্লিশ। তালগাছের মতো টিংটিঙে লম্বা, মাথাভরা কদমছাট চুল, টিকালো নাকের মাথায় একটা আঁচিল, আর কপালে একটা আবছা কাটা দাগ। ছেলেবেলায় জামগাছ থেকে পড়ার চিহ্ন।
এবার মোদ্দা বিষয়ে আসা যাক। বিপিন মণ্ডলের সমস্যাটা আসলে কী? ফুটানিগঞ্জের আশপাশের সাত-আটখানা গ্রামের কেউ মারা গেলে বিপিন মণ্ডলের ডাক আসে। তাকে খবর দেওয়া হয়। কারণ, তিনি এই বিরাট অঞ্চলের একমাত্র অস্থিবাহক। দাহের পর তিনি অস্থি নিয়ে যান নদীতে বিসর্জনের জন্য। ফুটানিগঞ্জের শ্মশানের পাশের কলকলি নদী মরে গেছে। জায়গায় জায়গায় ধান চাষ হয়। ফলে নদীতে দাহশেষে অস্থি বিসর্জন দেওয়ার উপায় নাই। আবার অনেক পরিবার চায় মৃতের অস্থি গঙ্গায় মিশে যাক। দাহশেষে অস্থি এনে তিনটে রাত মৃতের বাড়িতে রাখে এই তল্লাটের মানুষজন। শেষরাতে আকাশে দুধের সরের মতো আলো ফুটে উঠলে সেই অস্থি নিয়ে বিপিন মণ্ডলকে ছুটতে হয় ফারাক্কা।
ফুটানিগঞ্জ থেকে ফারাক্কার দূরত্ব প্রায় একশো কিলোমিটার। প্রথমে হাঁটাপথ তারপর দুখানা বাস পালটে যেতে হয় গঙ্গানদীর কাছে। বাসভাড়া, দুপুরের আহার, নতুন একখানা ধুতি ও গামছা বাদেও একটা বিসর্জনের কাজ থেকে চার থেকে পাঁচশো টাকা মতো আয় হয়। বিপিন মণ্ডল একলা মানুষ। ওতেই বেশ কিছুদিন চলে যায়। কোনও কোনও মাসে সাত-আটখানা কাজ আসে। আবার কোনও মাসে আসে না একটাও মৃত্যুসংবাদ। সেইসব টানাটানি, ধারবাকির মাসে নিজের অশান্ত মনকে বোঝান, চিন্তা করার কিছুই নাই, জন্ম হল মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা। মৃত্যু বড়ই অদ্ভুত, কখন কোন পথ দিয়ে আসবে কে জানে!
অশান্ত মন পালটা প্রশ্ন করে, মৃত্যুসংবাদের জন্য এমন হাপিত্যেশ করে বসে না থেকে অন্য একটা কাজ খুঁজে নাও না কেন?
বিপিন মণ্ডল নিজের মনকে সান্ত্বনা দেন, এই কাজ মোটেই হেলাফেলার নয়। কাজের গুরুত্ব বিরাট। এই বিসর্জন মোটেই পরলোকে সুখে থাকার জন্য নয়। বেঁচে থাকার দিনগুলিতে জল মাটি বাতাস থেকে যা কিছু নিতে হয় আমাদের সব কড়ায়গণ্ডায় ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ। সবাইকে ফিরিয়ে দিতে হয়। প্রতিবার ঘাটের কাজ শেষে মনে হয়, এমন পুণ্যের কাজ সবার কপালে জোটে না।
এই পুণ্যকাজের সূত্রেই এসেছে বিরাট সমস্যা। দুখানা অস্থি নিয়ে যাওয়ার ডাক এসেছে একদিনে। যা অসম্ভব। একজন ফুলডাঙা গ্রামের শেফালি দাস, অন্যজন বিদয়পুরের ডেঞ্জারাস মানুষ ওয়ানশাটার ভবেশ।
শেফালির কাছে মৃত্যু এসেছে চকিতে, সময় দেয়নি। টলমল পায়ে উঠোন পেরিয়ে কলতলার দিকে যাওয়ার সময়ে মৃত্যু ধাক্কা দিয়েছে তাকে। ভটভটি করে হাসপাতাল যাওয়ার পথেই শেষ।
একসময় এই শেফালির সঙ্গে তার ভাব ছিল। গাঁয়েগঞ্জে এসব কথা রটতে সময় লাগে না। চৈত্রদিনে খনখনে খড়ের চালে আগুন হয়ে তাদের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল। শেফালির বাবা ছিল বিরাট জোতদার। একমাত্র মেয়েকে চালচুলোহীন ছেলের হাতে কেনইবা তুলে দেবে। ফলে তাদের ভাব-ভালবাসার কথার মতোই দ্রুত ফিরে এসেছিল শেফালির বিয়ের খবর।
বিয়ের দিন সন্ধে পর্যন্ত বিপিন মণ্ডল আশায় ছিলেন কিছু একটা ঘটবে। বিয়ের কার্ড ছাপা হলেই কী সব বিয়ে হয়! তিনি নিশ্চিত ছিলেন, যতই ঘরবন্দি করে রাখুক শেফালি ছুটে আসবেই! এসেই হড়বড় করে বলবে, তুমি কি ভেবেছিলে তোমার শেফালি আসবে না! একমুহূর্ত দেরি না করে চলো আমরা এই ফুটানিগঞ্জ ছাড়ি। কিংবা কাউকে দিয়ে একটা হাতচিঠি পাঠাবে। সেই চিঠির লাইনটানা কাগজে গোটাগোটা হরফে এমন কিছু লেখা থাকতে পারে, যে করেই হোক শেষ ট্রেন ধরতে হবে। তুমি আগেই পৌঁছে যাবে। দেরি করবে না।
অথচ শেফালি আসেনি। এসেছিল অন্য একজন ভয়ঙ্কর মানুষ। চকচকে কালো একখানা পিস্তল মুখের সামনে ধরে মানুষটা বলেছিল, আজ আর কাল ঘরের বাইরে যাবি না। সেই মানুষটির নাম ওয়ানশাটার ভবেশ। মৃত্যু কাউকে ছাড়ে না। কাউকে ভোলে না।
ভবেশ ডেঞ্জারাস মানুষ। আশপাশের গ্রামের সবাই তাকে গোপনে ওয়ানশাটার ভবেশ নামে ডাকে। সে পুরনো সাইকেলের পাইপ দিয়ে ওয়ানশাটার বানিয়েছিল গোঁফের রেখা ওঠার পরেই। প্রথম কাজ সফল হওয়ার পর একে একে তার হাত দিয়ে সৃষ্টি হতে থাকে হাতবোম, পেট্রোলবোমা, খাজা বন্দুক, ওয়ানশাটার। শুরু করে দেয় এসবের ব্যবসা। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে বেশ কয়েকবার জেল খেটেছে। ছাড়া পেয়ে ডেরা বদলেছে, প্রবল টান কিংবা ভালবাসার জন্য এসব কাজ ছাড়েনি। হাতবোম বানানোর সময় ঝড়ের বেগে মৃত্যু এসে চকিতে তাকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে প্রায় ষাট-সত্তর হাত দূরে। ডানহাত আর বাম-পা উড়ে গিয়ে পড়েছে আরও বিশ-পঁচিশ হাত দূরে শালুক আর চাঁদমালা ফুলে ভরা দীঘিতে। তখনও সেই হাতে জ্বলজ্বল করছিল খান চারেক নবগ্রহ শান্ত রাখার আংটি। ভবেশের মৃতদেহ মর্গে পড়েছিল বেশ কয়েকদিন। দুজনেরই অস্থি তাঁকে নিয়ে যেতে হবে একদিনে।
একসঙ্গে দুজনের অস্থি নিয়ে যাওয়া যায় না। নিয়ম নেই। এ-কথা কানে যেতেই ছুটে এল ভবেশের ছেলে। গায়ে উত্তরীয়, হাঁটু অব্দি সাদা মার্কিন ধুতি। বামহাতে কুশের আসন। ডানহাতে কালো কুচকুচে বন্দুক। সে বলল, আমাদের ব্যবসার প্রথম শর্ত হল কাজকারবার হবে গোপনে। বাবার অস্থি আপনি নিয়ে যাবেন। অযথা আমার মাথা গরম করবেন না। তাতে আপনার ভাল হবে না। আর এত ঠান্ডা মাথায় আমি কথা বলি না। এবার চটপট বলুন আপনি রাজি?
বিপিন মণ্ডল বললেন, আমি রাজি।
অস্থি নিয়ে যাওয়ার সময় বেশ কিছু নিয়মকানুন আছে। নিয়মগুলি এইরকম।
এক, কথা বলা যাবে না।
দুই, নির্জলা উপবাসে থাকতে হবে।
তিন, কোনও অবস্থাতেই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া যাবে না।
চার, জুতো পরা যাবে না।
পাঁচ, কোনও প্রকার নেশা করা যাবে না।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নিয়ম হল, আত্মা কথা বলার ফিকির খুঁজবে, কিছুতেই কথা বলা যাবে না।
বিপিন মণ্ডলের কাছে এইসব নিয়ম এখন জলভাত। প্রতিবার ঘাটের কাজ শেষে তার মনে হয়, এমন পুণ্যের কাজ সবার কপালে জোটে না।
বেঁচে থাকতে বিপিন মণ্ডলের বাবা কুমুদ মণ্ডল ছেলের বিয়ে-থা দেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন। গঞ্জে কান পাতলে শোনা যায়, মরে যাওয়ার পরও হাল ছাড়েননি কুমুদ মণ্ডল। মাঝেমধ্যেই তিনি ছেলের কাছে এসে বিয়ের কথা তোলেন। সে বাপ-ছেলের এই বিষয়ে তর্ক অনেকেই শুনেছে। গঞ্জের মানুষজনও একসময় তার বিয়ের প্রসঙ্গ তুলত। বিপিন মণ্ডল তখন হাসতে হাসতে একই জবাব দিতেন:
—এসব কথা শুনলেই আমার ঠাকুরমার কথা মনে পড়ে। বুড়ি এককথা দ্বিতীয়বার শুনলেই বিরক্ত মুখে বলত, এই কথা সেই কথা/দে লো বুড়ি আলাপাতা। আপনাদেরও অন্য কথা নাই। ঘুরেফিরে সেই এক কথা! আর বিয়েটা করলে খাওয়াব কী! নিজেরই কোনওমতে টেনেটুনে চলে অন্য আরেকটা মানুষকে সমস্যায় ফেলা কি ঠিক হবে?
শেফালির খবরটা পাওয়ার পর বিপিন মণ্ডল ভেবেছিলেন দূরে কোথাও পালিয়ে যাবেন। ফিরবেন বেশ কিছুদিন কাটিয়ে। সেইমতো একটা চটের ব্যাগে ফতুয়া, ধুতি, গামছা, চিরুনি, আয়না আর চিড়েমুড়ি বেঁধে নিলেন। তাঁকে পালাতেই হবে। কিছুতেই শেফালির অস্থি নিয়ে গঙ্গায় যেতে পারবেন না। সব মৃত্যু সহজ করে নেওয়ার ক্ষমতা মানুষের নেই!
ভোরের ট্রেন ধরে তিনি ফুটানিগঞ্জ থেকে পালাতে পারলেন না। মাঝরাতে মৃত কুমুদ মণ্ডল এলেন। তিনি বিপিন মণ্ডলের কপালে হাত রেখে বললেন, জ্বরে যে তোর গা পুড়ে যাচ্ছে, বিপিন!
বিপিন মণ্ডল কোনওমতে চোখ খুলে নিচুগলায় বললেন, বাবা! তুমি আবার এসেছ কেন?
কুমুদ মণ্ডল উদাস গলায় বললেন, সন্তান জ্বরে ছটফট করবে আর আমি নন্দনকাননে গায়ে ফুরফুরে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াব, তাই হয়!
বিপিন মণ্ডল জড়ানো গলায় বললেন, বেঁচে থাকতে তো আশপাশের গ্রামে আলকাপের দল এলে ছুটে যেতে। অপ্সরাদের নাচ ছেড়ে এখানে এলে কেন? আমি ভাল আছি। তুমি যাও।
মুখে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে কুমুদ মণ্ডল বললেন, নন্দপুরে এক পাত্রীর সন্ধান পেয়েছি। মেয়ের নাম বিজলি। নামমাত্র বিয়ে হয়েছিল। ভুল বিয়ে। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। পাত্রীর পরিবার বড়ই গরিব। তোর সঙ্গে বয়সের তেমন ফারাক হবে না। যদিও বিয়ের ক্ষেত্রে বয়স কোনও বিষয় নয়।
বিপিন মণ্ডল ফিসফিস করে বলে উঠলেন, বাবা, শেফালি মারা গেছে। আমি পালাচ্ছি। নয়তো আমায় ওর অস্থি নিয়ে গঙ্গায় যেতে হবে।
কুমুদ মণ্ডল হাসলেন, তুই কোথাও যাবি না। যেতে পারবি না। আমি মাথায় জলপটি দিয়ে দিচ্ছি, ঘুমা। সকালে দেখবি জ্বর চলে গেছে।
বিপিন মণ্ডল গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন। ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে। দরজা ধাক্কাচ্ছে কেউ। ততক্ষণে ঝাঁঝালো চৈত্রের রোদ ঘর দখল করেছে। অনেক কষ্টে চোখ খুললেন। দরজা খুলতেই দেখলেন শেফালির বাড়ি থেকে কয়েকজন এসেছে।
শেফালির ছেলে বলল, সবই তো শুনেছেন, কাকু।
বিপিন মণ্ডল আড়চোখে একবার চৌকির পাশে গতকালের গোছগাছ করা চটের ব্যাগের দিকে তাকালেন। ব্যাগটা নয়, যেন ঠেস দিয়ে বসে আছে চামড়া কুঁচকানো এক বুড়ো মানুষ। সেই বুড়ো বিরক্ত মুখে বলছে, পালাও বিপিন, পালাও। তুমি শেফালিকে ভালবাসো। ভালবাসার ছাই বইতে নেই। ওদের না করে দাও।
বিপিন মণ্ডল ওদের না বলতে পারলেন না। বললেন, আচ্ছা, যাব।
ওরা যাওয়ার পর চটের ব্যাগটা ট্রাঙ্কের ভেতরে ঢুকিয়ে বিপিন মণ্ডল শান্ত হলেন।
খুব ভোরে শেফালির আর ভবেশের অস্থি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বিপিন মণ্ডল। আবছা অন্ধকার ঠেলে হনহন করে হাঁটার সময় তার কানে এল, জ্বর কমেছে? আমি ভাবলাম তুমি আসবে না।
বিপিন মণ্ডল থামলেন না। তিনি জানেন আত্মা এভাবেই ফাঁদে ফেলে। কিছুতেই কথা বলা যাবে না।
আবার সেই কণ্ঠ— এত তাড়াহুড়ো করছ কেন? শেষবারের মতো এই গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছি। একটু ভাল করে দেখতে দাও। আর শোনো, দীঘির পাশে দাঁড়াবে। ওখানেই আমি তোমার হাত ধরেছিলাম। মনে আছে?
এবার ভবেশের গলা ভেসে এল, খবরদার এখানে দাঁড়াবেন না। খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি। এখানে আমার হাত আর পা এসে পড়েছিল। অসহ্য লাগছে জায়গাটা।
শেফালি হাসল, তোমার সমস্ত ক্ষমতা মিলিয়ে গেছে ভবেশ। তুমি চুপ করে এখন ভোর দ্যাখো। দ্যাখো কেমন করে ঘটং ঘটং করে মস্ত একটা হ্যাচাক জ্বালাচ্ছেন বিধাতা। একটু একটু করে সেই আলো আসবে।
বিপিন মণ্ডলের খুব ইচ্ছে হল শেফালির সঙ্গে কথা বলার। ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখলেন। বলতে পারলেন না সেবার হাতচিঠি পাঠিয়েও কেন এলে না!
শেফালি বিড়বিড় করে বলল, এখনও সেই বিকেলের কথা মনে রেখেছ! নিজেও তো একবার খোঁজ নিতে পারতে। আজ এতদিন পরে ওসব নিয়ে নাইবা কথা তুললে।
ধীরে ধীরে অন্ধকার কাটছে। মিহি আলোর গুঁড়ো বাতাসে ভাসছে। শেফালি বলল, ওই দ্যাখো আলোর খবর পেয়ে কাঞ্চনফুলের জোড়াপাতা খুলছে। দ্যাখো কচি পাতারা ঠান্ডা বাতাসে কেমন দোল খাচ্ছে! আমের মুকুল এসেছে। আকন্দ ফুল ফুটেছে। একটু পরেই কোকিল ডাকবে। ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে যাবে। তবু ডাকবে। বাসনার ডাক। এসব ছেড়ে কোথায় যাবে তুমি বিপিন!
বিপিন মণ্ডল দাঁড়ায়। মুগ্ধ হয়ে ভোর দ্যাখে।
বাসে উঠে ইশারায় তিনটে টিকিট কাটেন। এটাই নিয়ম। শেফালিকে দিলেন জানলার পাশের সিট। মাঝখানে তিনি। তার পাশে ভবেশ। এই লাইনের কন্ডাকটর অবাক হয় না। ভোরের বাসে মাঝেমধ্যেই এই প্যাসেঞ্জার ওঠে।
শেফালি ফিসফিসিয়ে বলল, আমার একটা আবদার আছে। রাখবে?
বিপিন মণ্ডল চোখ সরু করে জানলার দিকে তাকাতেই শেফালি নিচু গলায় বলল, কথা দিলে তবেই বলব।
আর চুপ করে থাকতে পারলেন না বিপিন মণ্ডল। বললেন, আগে শুনি কী কথা।
শেফালি তার কানের কাছে মুখ এনে বলল, এবার একটা বিয়ে করো।
বিপিন মণ্ডল বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, সংসার বড়ই জটিল শেফালি।
শেফালি মিহি গলায় বলল, জটিল না ছাই! তুমি সংসার করো। একা থেকো না। একা থাকার নেশায় ডুবে যেও না। যারা এই নেশায় পড়ে তারা অন্য মানুষ দেখলে পালায়।
ভবেশ বলল, কথা মন্দ বলেননি। সবাই আমায় ভয় পেত। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেত। বালিশের নিচ থেকে পিস্তলটা বের করে চুপচাপ বসে থাকতাম। ঠান্ডা পাথরের টুকরোর মতো মনে হত পিস্তলটা। একা। একদম আমার মতো। শুনলে আপনারা অবাক হবেন যা কিছু কথা আমার পিস্তলটার সঙ্গেই হত। এমন একা কখনও হবেন না।
ঘাটের কাজ মিটে গেল ঝুটঝামেলা ছাড়াই।
সিঁড়ি বেয়ে নদীতে নামলেন বিপিন। ভবেশের অস্থি ভাসিয়ে দিলেন প্রথমে। তারপর শেফালির পালা, সেই চেনা গলা কানে এল, ভাল থেকো।
বিপিন মণ্ডল ভার গলায় বললেন, তুমিও ভাল থেকো।
শেফালি বলল, সেই ভোর থেকে না খেয়ে আছ, আর দেরি কোরো না। সামনের হোটেলে খেয়ে নিও।
বিপিন মণ্ডল বললেন, আমার একটা কথা রাখবে?
শেফালি বলল, কী?
—আমায় ছেড়ে যেও না শেফালি। আর ভয় নেই, তোমায় কেউ দেখতে পাবে না। যেখানে খুশি ঘুরব। শরীর বড়ই ঝামেলার জিনিস। একবার যখন তোমায় পেয়েছি আর ছাড়ব না।
—আমারও তোমায় ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে এমন নয়। তবে সব ভেবে বলছ তো?
—ভেবেই বলছি।
—তোমায় হন্যে হয়ে কেউ খুঁজবে না তো?
—না, তেমন মায়ার কেউ নেই আমার।
—ভুল জানো তুমি। সব খবর মানুষ রাখতে জানে না। মানুষ বড়ই সামান্য জীবন নিয়ে আসে। কত কিছু অজানা থেকে যায়।
—যা খুশি হোক। তুমি আমায় ছেড়ে যাও না শেফালি।
মাস তিনেক পরের কথা।
বিপিন মণ্ডল বসে আছেন মস্ত এক বটগাছের নিচে। তার কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে শেফালি। বিপিন মণ্ডলকে এখন চেনা দায়! একমুখ দাড়িগোঁফ, চোখের কোণে পিচুটি।
বটগাছটার সামনে বেশ কয়েকটা খেজুরগাছ। তাদের রং ধুয়েমুছে গেছে বলে খেজুরগাছগুলোকে মনে হচ্ছে সাদাটে চন্দ্রবোড়া সাপ। আকাশে কাঁচাহাতের মেঘের আলপনা। মাঠের ওপারে দেশলাইখোলের মতো কিছু বাড়ি। তালগাছের সারি। একটা গ্রাম।
গলাটাকে খানিক তরল করে শেফালি বলল, সামনের গ্রামটায় যাবে? অল্পক্ষণ থাকব। এই গ্রামে বখাটে ছেলেপুলে নাও থাকতে পারে। তোমায় দেখে, একটা পাগল এসেছে-পাগল এসেছে বলে নাও ছুটে আসতে পারে। যাবে?
বিপিন মণ্ডল বিড়বিড় করে বলল, ঢিল ছুড়ে ছুড়ে মারে। খুব যন্ত্রণা হয়। কুকুর তেড়ে আসে। আমার খুব ভয় করে।
শেফালি খিলখিল করে হাসল, ধ্যুস। চলো অচেনা রাস্তায় হাঁটার মজাই আলাদা। কত নতুন নতুন বাড়িঘর, কত সংসার দেখা যায়। দেখবে না দূর থেকে ভরা সংসার? সে-সব চোখ ভরে দেখা হলে আবার আগের মতো ট্রেনে উঠব আর যেখানে খুশি নেমে পড়ব। যাবে?
বিপিন মণ্ডল ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলো।
ফুটানিগঞ্জের বিপিন মণ্ডল নিখোঁজ হওয়ার মাস চারেক পেরিয়ে গেল।
গঞ্জের চায়ের দোকানে তাকে নিয়ে আলোচনা থিতিয়ে এসেছে। প্রত্যেকেই নিশ্চিত লোকটা আর বেঁচে নেই। একটা খোঁড়া শালিক আসে প্রতিদিন। বিপিন মণ্ডলের ঘরের বন্ধ দরজায় এসে ঠোকর দেয়। শালিখটাকে তিনবেলা খাবার দিত মানুষটা। সে এখন বিপিন মণ্ডলের জন্য অপেক্ষা করে। অন্য কেউ খুদকুঁড়ো দিলে সেদিকে তাকায় না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে বিপিন মণ্ডলের দরজার সামনে। একপায়ে। একা।