সৌমিত্র বসু
Paradise Papers নাম নিয়ে এক বিশাল দস্তাবেজ প্রকাশিত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের থেকে টাকাপয়সা যারা সুইস ব্যাঙ্ক এবং বিশ্বের অন্যান্য ‘কর-স্বর্গ’ বা tax-haven-এ জমা করেছেন সেইসব হস্তিদের নামের এক বিশাল ফর্দ। ভারতের যাবতীয় পয়সা-পাখি বা মানি-ফ্লাইট-এর নায়কদের সমস্ত নাম ও সম্পত্তির হিসেব নাকি সেখানে দেখানো আছে। হিন্দুস্তান টাইমস নাকি ভারতবর্ষে সেই ফর্দ প্রকাশ করার অধিকার কিনে নিয়েছে। এই সুবাদে তারা ৪০ দিন ধরে এই ফর্দ প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি প্রভূত ঢক্কানিনাদ সহকারে ঘোষণা করেছিল। বেশ কয়েকদিন কিছু নাম প্রকাশিতও হয়েছিল। এখন দিন দশেকের মাথায় প্রকাশ বন্ধ, সব জলচল হয়ে গেল। মানুষের মাথাব্যথা থাকলেও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উচ্চবাচ্য নেই, প্রথম দিন থেকেই ছিল না, কারণ এই দলগুলো সবই এই বাবুদের খাতক, নির্বাচনের বৈতরণী এই বাবুরাই পার করে দেন। এ ছাড়া যে নামগুলো বেরিয়েছিল সেগুলো খুবই পরিচিত, আগে থেকে এতই চর্চিত ছিল যে কোনওরকম চোখ ওল্টানোর মতো ব্যাপারই ঘটেনি। বাদবাকি নামগুলো সব ভুয়ো, বেনামি পরিচয়। কয়েকটি বড় কর্পোরেটের নাম বেরিয়েছিল, পরের দিন সেগুলো তুলে নেওয়া হল, কেউ জানল না, ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গেল। যাদের নাম থাকার কথা, সেইসব আসল নামগুলোই ছিল না; উদাহরণস্বরূপ পেপার্সে বিজয় মালিয়ার নাম ছিল না, টাটা বা রিলায়েন্স বা আদানি ইত্যাদি তো নয়ই। ব্যাপারটা এখন জলচল — এটা একটা পুরনো বুর্জোয়া কায়দা। যখন একেবারে বিস্ফোরণের পরিস্থিতি সমাসীন, তখন কিছুটা হাওয়া বার করে দাও। একদিন কগনিজান্ট বা CTS-এর নাম বেরোল, পরের দিন থেকে সেটা উধাও হয়ে গেল একেবারে, নাদারদ বিলকুল উবে গেল। ফর্দে TCS বা ইনফোসিস গরহাজির, এমনকি বেদিক বা বেদান্ত নামধারী সংস্থাগুলিও নেই। অতএব শান্তি স্বস্তয়ণ সমাপিত। এটাকেই বলে উদারনৈতিক প্রতারণা, অথবা লিবারেল বদমাইশি। অনেকে ভেবেছিলেন হিন্দুস্তান টাইমস সত্যি কথা লিখবে… না, কাক শেষ পর্যন্ত কাকের মাংস খেল না। এক কর্পোরেট অন্যান্য কর্পোরেটকে উদ্ঘাটিত করল না, ভেতরে ভেতরে বোঝাপড়া হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। আমরা যারা ভেবেছিলাম এটা ঘটবে, তারা আরও একবার উজবুক প্রমাণিত হলাম। প্রমাণিত হল শ্রেণি-ঐক্য বুর্জোয়ারা ভাঙে না, কখনও না।
Paradise Papers-এ শুধু ট্যাক্স ফাঁকিবাজদের নামই ছিল না, কোন দেশের কে কত টাকা ট্যাক্স দেয়নি, তা নিয়ে পশ্চিমের কর্তাদের খুব একটা কিছু এসে যায় না, ভারতের ক্ষেত্রে তো নয়ই। এই Paradise Papers থেকে আমরা চিনতে পারতাম money launderer-দের, যারা নিজেদের বেআইনি উৎসের টাকা বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে রেখে সেগুলো দিয়ে ফাটকা ব্যবসা করে থাকে। আমরা জানতে পারলাম না কারণ হিন্দুস্তান টাইমস এই সংবাদের ভারতে প্রচারের স্বত্ব কিনে নিয়ে আমাদের কাছে অর্ধসত্য পরিবেশন করল, আমাদের কাছে সমস্ত সূত্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া হল। ৭৪৮ সংখ্যার একাউন্ট হোল্ডার ভারতের মতো দেশের পক্ষে সামান্য ঘটনা নয়। অর্থাৎ আমাদের দেশের প্রায় সমস্ত উদ্বৃত্ত সম্পদ বিদেশের ব্যাঙ্কগুলোতে রয়েছে। একটা সামান্য অংশের তথ্য সামনে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, আসল সংখ্যাটা ৭৪৮-এর থেকে অনেক গুণ বেশি। হেডেন সাহেব তো আরও বড় লিস্টি বার করেছিলেন। যাই হোক, আর কোনওদিন এইসব চাপা পড়ে যাওয়া খবরগুলো বেরোবে কিনা বলা মুশকিল। এখন বোঝা যাচ্ছে পুরো ব্যাপারটা ছিল এক সুচারু চক্রান্ত যাতে ভবিষ্যতের সমস্ত অনুসন্ধানের প্রয়াস বন্ধ করে দেওয়া যায়। আইসল্যান্ড-এর মতো প্রায়-অজানা-নামের ছোট্ট একটা দেশ কিন্তু এই রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রত্যেকটি অপরাধীকে ফাটকে পুড়েছে, আর আমরা তাদের পুজো করছি। এটাই গণতন্ত্রের স্বরূপের ফারাক, একটা মানুষের গণতন্ত্র আর একটা কর্পোরেটের।
Paradise Papers-এ কিন্তু ঋণ খেলাপিদের ফর্দ বেরিয়েছিল, বেরিয়েছিল দেশের পয়সায় বিদেশে যারা রিয়েল এস্টেট কিনেছেন [অর্থাৎ টাকা-ডলারের বিনিময় মূল্য অনুসারে ৬৭ গুণ বেশি মুদ্রা দেশের বাইরে বার করে দিয়ে] তাদের নাম, আমরা জানতেই পারিনি। যারা বিদেশের ট্যাক্স-স্বর্গগুলোতে বেহিসেবি পয়সা জমা করেছে, যারা বিদেশে বেআইনি কারবারে টাকা বিনিয়োগ করেছে, যারা বেআইনি অস্ত্র ব্যবসায় টাকা ঢেলেছে, যারা বিদেশের ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ফেরত দেয়নি, যারা আফ্রিকাতে জমি কিনেছে, এমনকি এন্টার্টিকাতে জমি কিনেছে এবং এসবই করেছে ভারত থেকে আয় করা উদ্বৃত্ত পয়সায় — পেপার্সে তাদের সবার নাম বেরিয়েছে, কিন্তু আমরা জানতে পারলাম না। আমাদের কিছু এলেবেলে ভাসা ভাসা সংবাদ দিয়ে আসল খবরগুলো চেপে যাওয়া হল। এই দেশের রাজনৈতিক দল ও তাদের গণসংগঠনগুলোর, দেশের NGO-দের কত টাকা কোথায় আছে তাও বেরোনোর কথা ছিল, আমরা জানলাম না। অসাধারণ এক কৌশল, ভবিষ্যতে এই নিয়ে অনেক বই বেরোবে, কোনও রেফারেন্স ছাড়াই গপ্পোগাছা বেরোবে, কিন্তু তার ভিত্তিকে কাউকে আইনের দরবারে নিয়ে যাওয়া যাবে না, আইনের ঘরে গেলেই বলা হবে এটা ফিকশন, কোনও প্রমাণ নেই। এই আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যা নিয়ে আত্মশ্লাঘায় আমরা হাবুডুবু খাই। অর্থ বা সম্পদের উৎস যেখানে অপ্রকাশ্য, যেখানে তা ঘোষণা করা বাধ্যতামূলক নয়, সেখানে দুর্নীতিই তো দস্তুর ও দুরুস্ত। আমরা উৎসের উন্মোচনকে আইনি ঘেরাটোপে না এনে ব্যক্তির নাম নিই আর না নিই, তাতে কার কী এল গেল?
ভারত প্রাথমিক উৎপাদনের দেশ, অর্থাৎ সম্পদ এখানে তৈরি হয়, সাধারণ কৃষক জনতা নিজের শ্রমশক্তি ও শ্রম দিয়ে প্রকৃতিকে কর্ষণ করে সম্পদ তৈরি করে, সেই সম্পদের থেকে উদ্ভূত উদ্বৃত্ত আগে ভারতের মানুষ ব্যবহার বা ভক্ষণ করত, এখন সেগুলোও বিদেশে চলে যাচ্ছে, পয়সা আসছে ব্যাপারীদের কাছে, উদ্বৃত্তের যে অংশটি নগরায়িত চৌহদ্দিতে আসে তার থেকেই যাবতীয় নগরায়িত ‘উন্নয়ন’ হয়। উন্নয়নের অর্থ ব্যাপারের উদ্বৃত্ত থেকে আসার কথা ছিল, সরকারের কিছু কর পাওয়ার কথা ছিল। আগে নেতা, আমলা ও অমাত্যরা তার বহুলাংশই বিদেশে চালান করে দিত — নিজেদের বৈদেশিক সম্পত্তি ও ছেলেমেয়েদের বিদেশে আয়েশি জীবনচর্যার প্রয়োজন মেটাতে, এবং বিদেশে অর্থ লগ্নি করতে [আমাদের দেশের অর্থেই লগ্নি কিন্তু তা আমাদের দেশে নয় — এটাই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অর্থনৈতিক সংজ্ঞা], যা ছিঁটেফোঁটা পড়ে থাকত তা দিয়ে দেশ চলত খুঁড়িয়ে ঘষটে, এবার তার থেকেও সম্পদ বেরিয়ে যেতে শুরু করেছে। একদিকে আমরা বলছি টাকা বা রুপি খোলাখুলি বিনিময়যোগ্য নয়। অথচ এই বাবুরা যে টাকা বিদেশে পাঠালেন সেগুলো দিব্বি বিধিনিষেধের ঘেরাটোপকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে গেল। এর জবাবদিহি করবে কে? কেউ না! কারণ এই দেশটার গণতন্ত্র আসলে ওদের জন্যই, এটা দালাল মুৎসুদ্দিদের গণতন্ত্র।