Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিবাহ, নারী ও পদবি

অনুরাধা কুন্ডা

 


বরের কাছে এনওসি নিয়ে যদি স্ত্রীকে নিজের পদবি বজায় রাখতে হয় তাহলে এ বড় লজ্জার কথা। মেয়েদের আত্মসম্মান ধূলায় লুটিয়ে দেওয়ার প্রকৃষ্ট চেষ্টা। স্বামী প্রভু, তিনি অনুমতিদাতা। এই আইনি নির্দেশ কি ভীষণরকম ধাক্কা দেয় না?

 

 

সরকারি নোটিস জারি হল।

ভারতীয় নারী বিবাহের পূর্বের পদবি বিবাহের পরেও ব্যবহার করতে চাইলে স্বামীর কাছ থেকে এনওসি নেবেন। বিবাহের পর তিনি নাকি এমনি এমনিই স্বামীর পদবিযুক্ত হয়ে যান। বিবাহপূর্ব পদবিতে “ফেরত” যাওয়ার জন্য তাঁকে স্বামীর অনুমতিপত্রের ব্যবস্থা করতে হবে। দিল্লি হাইকোর্টে অবশ্য এই আদেশের বিরোধিতা করা হয়েছে। হঠাৎ কেন এমন আদেশনামা? ভারতীয় মেয়েরা চন্দ্রযান অভিযানে কাজ করছেন। এভারেস্টে উঠছেন। ডাক্তার হচ্ছেন। ইঞ্জিনিয়র হচ্ছেন। আপিসকাছারি করছেন। পুলিশ, শিক্ষক, গবেষক হচ্ছেন। এমন কোনও পেশা নেই যেখানে মেয়েরা কাজ করছেন না। মোটের ওপর, অর্থনৈতিকভাবে মেয়েদের স্বনির্ভর হওয়াটা একটা সামাজিক প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই সরকারি আদেশনামা মেয়েদের পদবি নিয়ে একটা বিশাল পশ্চাদপসরণের জায়গা তৈরি করে দিল। মেয়েরা যেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। তারা যতই উচ্চশিক্ষিত হোক, যতই উচ্চপদে চাকরি করুক, তাদের নিজস্ব কোনও অস্তিত্ব নেই। অবশ্য এখানে উচ্চশিক্ষা এবং উচ্চপদের চাকরির কথা লেখাও ভুল। যে-কোনও সাধারণ মানুষের যে অধিকার থাকে, অধিকাংশ মেয়ের সে অধিকার থাকবে না, যেন তারা মনুষ্যপদবাচ্যই নয়, এটাই এ-দেশে স্বাভাবিক। ধরা যাক সে লেখাপড়ায় অন্য কোনও পুরুষের মতোই খুব সাধারণ, কোনও পুরুষের মতোই সে নিতান্ত ছোটখাটো কোনও কাজ করে বা করে না। তবু পুরুষটি নিজের অস্তিত্বের ধারক, আর মেয়েটির কাজ হল নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে দেওয়া। সে গর্ভ। বংশের ধারক নয়।

পূর্ব্বেই বলিয়াছি, আমার মামীশাশুড়ী আমাকে বড় যত্নে গ্রহণ করিয়াছিলেন। তথাপি কলিকাতায় আসিবার তিন-চারদিন পর একদিন তিনি বলিলেন, বাছা, তোমাকে সব কাজ শিখিয়া লইতে হইবে। আমি বলিলাম, তুমি আমায় যাহা শিখাইবে, তাহাই শিখিব। ‘তুমি’ ডাক শুনিয়া ও বশংবদ ভাব দেখিয়া মামীশাশুড়ী বড় আহ্লাদিত হইলেন, তিনি প্রবল উৎসাহে আমাকে সকল প্রকার সহবৎ ও কর্ত্তব্যকর্ম্ম শিখাইতে ব্যাপৃত হইলেন। প্রথমেই বলিলেন, বাছা তোমায় পাছাপাড় শাড়ি পরিতে হইবে, তাহাতেই হায়া বজায় থাকে। বেশ কথা, তা পাছাপাড় শাড়ী কাহাকে বলে? পাছার নিকট একটী অতিরিক্ত পাড় থাকে, তুমি বিবাহিতা, তোমার তাহাই পরিধেয়। পরিলাম সে শাড়ী। সেমিজ পরিবে না, সে কী কথা, পরিতেই হইবে। পরিলাম সেমিজ। গাত্রে তেল-হলুদ মাখা কর। ত্বক উজ্জ্বল হইবে। মাখিবে তো? মাখিব। দ্বিপ্রহরে তোপ পড়িলে বুঝিবে ঘড়িতে একটা বাজিল, ঘড়ি মিলাইতে হয় তখন। ঘড়ি দেখিতে জান না? শিখাইয়া দিব। শিখিব। বিকাল হইয়াছে, স্নান করিয়া চুল বাঁধিয়া ফিরিঙ্গী খোঁপা বাঁধো দেখি, তাহার পর আলবোট কাটিয়া দাও। ও হরি, সে জান না বুঝি, বুঝাইয়া দিব। বুঝিব। তাহার পর মধুর স্বরে শঙ্খ বাজাইয়া সন্ধ্যা দেওয়া হইবে, এ এক বৃহৎ শঙ্খ, ইহা বাজাইতে শিখিবে না? শিখিব। সন্ধ্যা বেশ পাকা হইলে ফিরিওয়ালা ডাকিবে ‘বেলফুল’। কিনিতে পার একছড়া। কিনিব। বলি ও মেয়ে, বেলু নাপিতানী ঠিক রাত্রির খাইবার পূর্ব্বে কেন আসে বল দেখি? কি জানি! আলতা পরাইবে গো। পরিয়া লও, আলতায় স্বামীর সোহাগ বাড়িবে। পরিব আলতা। সে না হয় হইল, ইহার পর রাঁধিতে শিখিতে হইবে। রাঁধিতে হইলে স্বাদ বুঝিতে হয়। ওইরূপ হাবর-জাবর হাপুস-হুপুস করিয়া ভাত-ডাল খাইলে তাহাই রাঁধিতে শিখিবে। তা কেন, মাছ রাঁধিতে শিখ দেখি। তপসে মাছ বেসন দিয়া ভাজিতে হয়, কেমন? আইস মেয়ে, ইলিশ মাছের ভাপা করিবার একটুক কায়দা শিখাইয়া দিই। মাঝে মাঝে সরপুঁটী খাইবে, দেখিবে, বেশ লাগে।

—পান্তীর মাঠ, কৃষ্ণভামিনী দাসী, ১৯১২

লেখিকার পদবি আমরা জানি না। কিন্তু নামের শেষে “দাসী” বুঝিয়ে দেয় তিনি অব্রাহ্মণ ছিলেন। অন্যথা তাঁর নামের শেষে “দেবী” যুক্ত হত। বিনোদিনী দাসী ছিলেন, স্বর্ণকুমারী দেবী। সরলা দেবী। কাননও দেবী। আবার তিনকড়ি দাসী। জাতিভেদের তকমা গায়ে এঁটে ছিল বাঙালি মেয়ের জীবনে।

মেয়েদের বিয়ে হয়। পুরুষরা বিয়ে করে। কি স্বদেশে, কি বিদেশে, যুগ-যুগান্তর ধরে মেয়েদের গ্রহণ করা হত। মেয়েরা পূর্বজন্মের মতো তাদের বিবাহপূর্ব জীবনের সবকিছু ছেড়ে পিতৃগৃহ থেকে পতিগৃহে আসতেন। পিতৃগৃহের অভ্যাস, জীবনযাত্রা, রুচি এমনকি পদবিটুকুও তাঁরা ত্যাগ করে শ্বশুরকুলের দ্বারা গৃহীত হতেন, শ্বশুরকুলের সবটুকু গ্রহণ করতেন, এটাই ছিল রীতি। বাঙালি মেয়ের তো আবার লাজাঞ্জলি দিয়ে মাতৃঋণটুকু শোধ করে আসার রীতি। অতি আধুনিককালেও উচ্চশিক্ষিতা মেয়েরা বিয়ের সময় কেমন ট্র্যাডিশনাল হয়ে যান, ট্র্যাডিশনের মানে না বুঝেই। আর বিয়ের পিঁড়িতেও বসে পড়েন কন্যাদান, লাজাঞ্জলি ইত্যাদি মেনে নিয়ে এবং বিবাহ-পরবর্তীতে মেনে নেন পদবিবদলের পর্যায়।

একটা রীতি বাঙালি সমাজে চালু আছে। বিবাহ-পরবর্তী ও পূর্ববর্তী, দুটি পদবিই বজায় রাখা।

কেতকী কুশারি ডাইসন। নবনীতা দেবসেন। চিত্রা দিবাকুর্ণি ব্যানার্জি। বাসবী দত্ত ফ্রেজার।

আরও একটু আগের যুগের ইন্টেলেকচুয়াল মেয়েরা এসব নিয়ে ভাবতেন না। বিয়ের পরে দিব্যি স্বামীর পদবি গ্রহণ করতেন। লীলা মজুমদার বা সুখলতা রাও, সুধা মূর্তি বা সুচিত্রা মিত্র। প্রতিভা বসু। এমনকি ইন্দিরা গান্ধি। রাশি রাশি উদাহরণ। তখন নাকি মেয়েরা এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে ভাবতেন না। স্বামীর পদবি হোক বা বাবার, দুটোই তো পিতৃতান্ত্রিক!

মেয়েরা বিয়ের পরে পদবি বদল করেন কেন? তাঁরা শ্বশুরকুলের বংশের ধারক। সমস্ত নিজস্বতা ছেড়ে তাঁরা শ্বশুরকুলকে ধারণ করবেন। তাই? এর ফলে নাকি দাম্পত্য চিহ্নিত করতে সুবিধে হয়। সমাজ স্বীকৃতি দেয়।

আদতে কিন্তু এটি সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি সিদ্ধান্ত। পূর্ববর্তী প্রজন্মের মেয়েদের এই প্রথা মেনে নিতে তেমন অসুবিধে ছিল না। কিন্তু এই প্রজন্মের মেয়েরা? বিয়ের পরে পদবি পরিবর্তন মানে প্যানকার্ড, আধার কার্ডে পরিবর্তন। চাকরিরতা হলে প্রভিডেন্ট ফান্ড আর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পরিবর্তন। কেওয়াইসি সবার আগে পাল্টাতে হবে। এর জন্য এফিডেভিট পর্যন্ত করতে হতে পারে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে এবং ব্যক্তিগত ডকুমেন্টেশনের ক্ষেত্রে বেশ ঝামেলাদার ব্যাপার। যে কোনও প্রফেশনাল ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রেই মেয়েদের পদবি বদল বেশ সমস্যার।
বিয়ের পরে স্বামীর পদবি গ্রহণ করা মানে সম্পূর্ণ আইডেনটিটি বদলে যাওয়া।

বিবাহের সার্টিফিকেট দেখিয়ে প্যান, আধার থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুতে পদবি পরিবর্তন করতে হয়। আগের দিন এসব ছিল না। বিয়ে হওয়া মানেই পদবি পাল্টে গেল। অস্তিত্বের সঙ্কট ইত্যাদি ব্যাপার যদি নাও মেনে নিই, এই আইনি ব্যাপারগুলো কিন্তু জরুরি। আবার ম্যাট্রিকুলেশন সার্টিফিকেটে এক পদবি, বিয়ের পরে পাল্টে যাওয়া প্যান, আধারে আর এক পদবি, এ কিন্তু বিস্তর ঝামেলার পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। সিবিএসই-র সার্টিফিকেটে পদবি পাল্টানো সম্ভব না। কিন্তু এমন আলাদা আলাদা পদবি প্রফেশনাল এনরোলমেন্টের পক্ষে বেশ জটিল পরিস্থিতি তৈরি করে।

পুরুষদের কখনও এইসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না। দিল্লি হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট একতা রাই অবশ্য বলছেন যে সিবিএসই-তে অন্য পদবিটা  ধর্তব্য হবে না, কিন্তু বিয়ের আইনি সার্টিফিকেট থাকতে হবে।

মেয়েরা নিজেদের বিবাহ-পূর্ববর্তী পদবি সগর্বে বজায় রেখে চলেছেন, এর প্রথম নিদর্শন আমি দেখেছিলাম কবি মল্লিকা সেনগুপ্তর ক্ষেত্রে। তারও আগে ছিলেন কবিতা সিংহ। নাট্যশিল্পী কেয়া চক্রবর্তী। কিন্তু মল্লিকার ক্ষেত্রে বিষয়টি বেশি করে চোখে পড়ত কারণ তাঁর স্বামীর নামটি তাঁর নামের সঙ্গেই উচ্চারিত হয়। প্রিয় কবি দেবারতি মিত্র কিন্তু স্বামী মণীন্দ্র গুপ্ত হওয়া সত্ত্বেও মিত্রই ছিলেন। তিনি প্রচারের আলোর বৃত্তের বাইরে বলে হয়তো এ-বিষয়ে আলোচিত হননি।

এমনকি আমাদের ছাত্রজীবনের রোলমডেল শিক্ষিকারাও যেখানে স্বামীর পদবি ব্যবহার করেছেন সেখানে মল্লিকার এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন উঠত মনে। মালিনী ভট্টাচার্য্য, কিটি স্কাউলার দত্ত, যশোধরা বাগচি তখন আমাদের শিক্ষিকা। নারীবাদের কিছুটা পাঠ তো তাঁদের কাছেও বটে। কিন্তু কেন এই পদবি পরিবর্তন? উপরন্তু যদি পিতৃপদবিতে মেয়ের নামে সম্পত্তি উইল করা থাকে তবে পরবর্তীতে ভিন্নপদবিযুক্ত হলে বেশ সমস্যা হবে। খুব পরিষ্কার আইনি ডকুমেন্টেশন দরকার হবে সেইক্ষেত্রে। এই পোড়া দেশে, যেখানে কন্যাজন্মই বাঞ্ছিত নয়, সেখানে অবশ্য ডকুমেন্টেশনের প্রসঙ্গই আসে না।

পরবর্তীতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সারা ভারতবর্ষে যখন মেয়েরা নিজেদের বিবাহ-পূর্ববর্তী পদবি বজায় রাখছেন, তখন এই আইনি নির্দেশ কি ভীষণরকম ধাক্কা দেয় না? যদি মেয়ে বিবাহপূর্ব পদবি ব্যবহার করতে চায় তবে তাকে স্বামীর কাছে এনওসি নিতে হবে! কী ভয়ানক পিতৃতান্ত্রিক আইন!

এ-দেশে রামরাজত্বের জয়গান শুরু হয়েছে। বিশ বছর আগে পাড়ায় পাড়ায় এত শিবপুজো, এত কীর্তনের ঢল দেখা যায়নি। ভয়ানকরকমের ধর্মবাই জনজীবনে ঢুকে পড়ছে যেখানে প্রভুত্বই প্রধান। রামসীতার জয়গান সেইরকম অসম অবস্থানের গল্পই বলে।

স্ত্রী এবং স্বামীর সম্পর্কে প্রভু ও অধস্তনের সম্পর্ক যুক্ত হওয়া কিছু নতুন বিষয় নয়। বরের কাছে এনওসি নিয়ে যদি স্ত্রীকে নিজের পদবি বজায় রাখতে হয় তাহলে এ বড় লজ্জার কথা। মেয়েদের আত্মসম্মান ধূলায় লুটিয়ে দেওয়ার প্রকৃষ্ট চেষ্টা। স্বামী প্রভু, তিনি অনুমতিদাতা। এই কনসেপ্টকে কত নতুন মোড়কে যে উপস্থিত করা হবে আর! মেয়েরা কি সে সম্পর্কে সচেতন? না।

প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক, মানসিকতার উন্নতির হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর যে-হারে প্রি-ওয়েডিং, পোস্ট-ওয়েডিং, সঙ্গীত, মেহেন্দির হিড়িক বাড়ছে তাতে মেয়েদের অবস্থান কোথায় সেও বোঝা দায়। এই অবস্থায় পদবি সংক্রান্ত আদেশনামাটি মেয়েদের নিজস্বতাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। ১৯১২-র সঙ্গে ২০২৪-এর যেমন তফাত খুঁজে পাই না, কিছু সৌন্দর্যচর্চা আর ওপেন-কিচেনের অগ্রগতি ছাড়া।