ধীমান বসাক
দিন ছয়েক আগের একটা খবর সবার নজরে এসেছে হয়তো। তথ্য জানার অধিকার আইনে (RTI) এক প্রশ্নের উত্তর আধার সংক্রান্ত কর্তৃপক্ষ UIDAI (Unique Identification Authority of India) জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারে প্রায় ২১০টি ওয়েবসাইটে আধার তথ্য (নাম, ধাম ইত্যাদিসহ আধার নাম্বার) দেওয়া হয়েছে। সংস্থাটি এটাও জানিয়েছে যে তথ্যগুলো ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এই তথ্যফাঁস UIDAI-এর তরফ থেকে হয়নি।
তো দাঁড়ালো এই যে, কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থার পক্ষ থেকেই এই তথ্য ফাঁস হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এই নিয়ে দেশজুড়ে লেখালেখি শুরু হয়েছে।
মুশকিলটা হল, এই আধার তথ্য তো তৈরিই করা হয়েছে ফাঁস করার জন্য!
বিশ্বাস না হলে চলুন দেখা যাক!
সাধারণভাবে আধার হল ১২ অঙ্কের একটি সংখ্যা যা দিচ্ছে ২০০৯ সালে গড়ে তোলা কেন্দ্রীয় সরকারের গড়ে তোলা UIDAI। কীসের ওপর ভিত্তি করে তারা এই নম্বর দিচ্ছে? না, আপনার নাম, বাবার নাম, জন্ম তারিখ বা বয়স, পুরুষ/স্ত্রী ইত্যাদি, ঠিকানা, দশ আঙুলের ছাপ, দুই চোখের স্ক্যান এবং মুখের ফোটো। এর সাথে মোবাইল নম্বর বা ইমেল আইডি হল ঐচ্ছিক।
সরকারের তরফ থেকে প্রথমে বলা হয়েছিল এটি ঐচ্ছিক এবং এটা করা হচ্ছে যাতে সরকারি সুযোগসুবিধা সঠিক গরিব মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, তার জন্য ভাঁওতা বা নকল বা ভুয়ো লোক এড়াতে সরকার এই ব্যবস্থা নিয়ে আসছে। কোনও আইন করে নয়, সম্পূর্ণ প্রশাসনিক নির্দেশ হিসেবে আধারের শুরু হয়েছিল, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন UPA সরকারের আমলে।
এরপরের ঘটনাপ্রবাহ অদ্ভুত। কোনও আইনের অনুমোদন ছাড়াই ভারত সরকার ব্যাপক আকারে এই কাজে নামে, UIDAI তৈরি করে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে সুদূর গ্রামাঞ্চলে, পাহাড়ে, মরুভূমিতে, জঙ্গলে শিবির করে মানুষের Demographic তথ্য (নাম, ঠিকানা, বাবার নাম, বয়স, লিঙ্গ এবং Biometric অর্থাৎ দশ আঙুলের ছাপ, দু’চোখের স্ক্যান, এবং মুখের ফটো) নেওয়ার কাজ শুরু হয়। এই কাজ প্রথম শুরু হয় প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয়। আমি নিজে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে হিমাচল প্রদেশের লাহুল-স্পিতির দুর্গম গ্রামগুলোতে এই শিবিরের সামনে লম্বা লাইন দেখেছি। তারপর ক্রমশ শহরের দিকেও এই কাজ চলতে থাকে, তারপর সর্বত্র।
কোনও আইনের অনুমোদন ছাড়া নাগরিকদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করা যায় কিনা, এই প্রশ্ন উঠতেই সরকার বারবার কঠোর এবং দুর্ভেদ্য সুরক্ষাকবচের কথা বলেছে। বলেছে এতে বহু অপচয় রোধ করা যাবে, প্রকৃত গরিবের উপকার হবে, তথ্য একেবারেই সুরক্ষিত।
ক্রমশ আধারের ব্যাপ্তি বেড়েছে। রান্নার গ্যাস, কেরোসিন, রেশনে আধার কার্ড যুক্ত করা হয়েছে। তারপর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, প্যান কার্ড, মোবাইল নম্বর। এখন আয়কর রিটার্ন, জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ রেজিস্ট্রেশন, অ্যাডমিশন, গবেষণাপত্র দাখিল, জি এস টি, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকার ‘আধার’কে বাধ্যতামূলক করার পদক্ষেপ নিচ্ছে ও নিয়েছে।
সরকারি সাহায্য সঠিক লোকের কাছে পৌঁছে দিয়ে অপচয় রোধ করার যুক্তি এখন আর দেওয়া হয় না। কারণ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, প্যান কার্ড, মোবাইল নম্বরের ক্ষেত্রে তা আর খাটে না। নতুন করে যুক্তি দিয়ে বলা হল কর ফাঁকি দেওয়া আটকাতে এগুলো দরকার। তাতেও না কুলোতে এক সন্ত্রাসবাদ রোখার যুক্তি।
আর এখন? এখন এটা পরিষ্কার যে সরকার সবকিছুতেই জোর করে আধার নম্বর বাধ্যতামূলক করতে চাইছে। একে আইনি মর্যাদা দেওয়ার জন্য এবং যাতে রাজ্যসভা বাধা না দিতে পারে (যেখানে মোদি সরকার সংখ্যালঘু) লোকসভার এক্তিয়ার অর্থবিলের মধ্যে ঢুকিয়ে আধার আইন পাশ করা হচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্টে একের পর এক মামলা হয়েছে এ নিয়ে। প্রাক্তন বিচারপতি, সমাজকর্মী, নাগরিক অধিকাররক্ষা সংগঠন, রাজনৈতিক কর্মীরা একের পর এক প্রশ্ন তুলে বলেছেন — এতে নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সরকার কর্ণপাত করেনি। সুপ্রিম কোর্ট তার নির্দেশে পরিষ্কার বলেছেন যে সরকার আধার সংযুক্তিকরণ করতে পারে যেখানে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে সেই জায়গাগুলোতে, কিন্তু সেটা হবে পুরোপুরি ঐচ্ছিক, কাউকে বাধ্য করা যাবে না, এমনকি আধার না থাকার জন্য যোগ্য কেউ যেন বাদ না পড়েন!
সরকার থোড়াই কেয়ার। সে একের পর এক ক্ষেত্রে আধারকে বাধ্যতামূলক করে চলেছে। কোর্টকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই। এমনকি সুপ্রিম কোর্ট-এর একটি কমসংখ্যক বিচারপতির বেঞ্চ তো আগের নির্দেশকে বিস্মৃত হয়ে বলে বসলেন — প্যান কার্ডে যাদের আধার আছে ইনকাম ট্যাক্স রিটার্নে তাদের আধার নম্বর দিতেই হবে, যাদের নেই তাদের আপাতত ছাড়! একটি বেঞ্চ তো কী বললেন তা পরিষ্কারই হল না — মনে হল যেন ভর্তুকি পাওয়ার ক্ষেত্রে আধার বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু বাকি ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক, এমনটাই হবে!
এর মাঝে ব্যক্তি-গোপনীয়তার অধিকার শুধু সুপ্রীম কোর্ট-এই নয়, বিচারপতিদের সম্মিলিত রায়ে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেল। কিন্তু আধার মামলার শুনানিকে ত্বরান্বিত করার কোনও লক্ষণ নেই, আর সেই অবসরে কেন্দ্রীয় সরকার সবকিছুতেই আধার-জাল ছড়িয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সরকারের এই পদক্ষেপে ক্ষতি কী? সরকার তো বলছে তথ্য সুরক্ষিত। ভালো কাজে ব্যবহার হলে আপত্তির কী আছে?
এর উত্তরের সাথেই লুকিয়ে আছে সরকার কেন আধারকে সর্বব্যাপী করতে এত উৎসুক, সে প্রশ্নেরও।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আধারের সংযুক্তি যে ঘটনার জন্ম দিচ্ছে তা হল, একটি ব্যক্তিমানুষের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ, আর্থিক লেনদেন, পণ্য ক্রয়বিক্রয়, বেড়াতে যাওয়া, ওষুধ কেনা, জামাকাপড় কেনা, করপ্রদান, সব সরকারের নখের ডগায়।
তার সাথে যুক্ত করুন ডিমনিটাইজেশন এবং ক্যাশলেশ ইকোনমির ঠেলা। একটি অর্থনীতি যত বেশি ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে আদানপ্রদান করবে, তার সাথে আধার, প্যান, জি এস টি, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, অ্যাডমিশন, মোবাইল নম্বর যুক্ত হতে থাকলে আমার আপনার জীবনের প্রতিটি তথ্য সরকারের আওতায় থাকবে, প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের প্রোফাইল তৈরি করে তার প্রতিটি চালচলন, ওঠাবসা, কথাবার্তা, বন্ধুবান্ধব, কেনাবেচা, দৈনন্দিন জীবন সবকিছুই রাষ্ট্রের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব। অর্থাৎ রাষ্ট্র সবজান্তা নজরদারি খবরদারি করার ক্ষমতা পাবে। আর ‘জনগণের দ্বারা’ নামক জনগণের সার্বভৌমত্বের খোলসটি ছেড়ে রাষ্ট্র হয়ে উঠবে সার্বভৌম — রাষ্ট্রের দ্বারা, রাষ্ট্রের প্রতি, রাষ্ট্রের জন্য।
এই বিপুল তথ্য — দেশের প্রায় ১২৫ কোটি মানুষ কী করে, কী কেনে, কী খায়, কী পরে — এই নিমেষে এই বিপুল তথ্য পেয়ে যাওয়াটা একটা সম্পদ ( asset, property)। সমস্ত কর্পোরেটদের কাছে তা ভীষণ লোভনীয় যা দিয়ে সে তার পণ্য তৈরি, বাজার, বিক্রি, খরিদ্দারের ইচ্ছেকে প্রভাবিত করা, এসবই অনেক সহজে করায়ত্ত করতে পারবে। রিলায়েন্স জিও-র ফ্রি দিয়ে আধার বাধ্যতামূলক — এই স্ট্র্যাটেজি এছাড়া কিছুই নয়।
কিন্তু এর চেয়েও বড় ব্যাপার হল যে সরকার নিজেই তার পলিসি ডকুমেন্টে ঘোষণা করে রেখেছে যে এই তথ্য একসময় বিক্রি করা হবে, এমনকি সরকারও তা কিনবে। অর্থাৎ একটা সময় UIDAI-র তথ্য National Information Utility নামক বা ঐ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে, যা সরকার এবং বেসরকারি সংস্থার মাঝামাঝি অবস্থান করবে এবং দুই পক্ষকেই তথ্য সরবরাহ করবে অর্থের বিনিময়ে!
২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি করা TAGUP বা Technology Advisory Group for Unique Projects-এর রিপোর্ট এবং UIDAI-এর Strategy Overview Document তাই-ই বলছে।
ডিমনিটাইজেশনের কিছুদিন আগে আমেরিকার সংস্থা USAID এবং ভারত সরকারের মধ্যে ক্যাশলেশ অর্থনীতি চালু করা নিয়ে একটি বোঝাপড়া স্বাক্ষরিত হয়। আধার কার্ডকে কাজে লাগিয়ে একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন সংস্থা Vakrangee ইতিমধ্যেই ব্যবসা শুরু করেছে এবং তার পুঁজি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, USAID-র প্রতিনিধিরা তার কাজ ঘুরে দেখেও গেছেন।
সমস্ত রাষ্ট্র অজ্ঞ জনসাধারণের ওপর নিশ্ছিদ্র নজরদারি চালাতে চায়। ফেসবুক, গুগলকে ব্যবহার করে, ইমেল হ্যাক করেও সে নজরদারি চলে। এডওয়ার্ড স্নোডেন তার প্রমাণ। তার সাথে এই বিপুল তথ্যভাণ্ডারের অমূল্য সম্পদ নিয়ে ব্যবসা!
সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র ও কর্পোরেট স্বার্থের এমন সুমধুর মিলন ‘আধার’ ছাড়া আর কেই বা পারবে!
তথ্য ফাঁস নয়, তথ্যের ফাঁস-ও!
প্রাসঙ্গিক তথ্যসূত্র :
১. https://en.wikipedia.org/wiki/TAGUP
২. https://uidai.gov.in/your-aadhaar/about-aadhaar.html
৩. https://broadbandforum.co/threads/64967/
৪. http://www.moneylife.in/article/aadhaar-private-ownership-of-uid-data-part-i/32430.html
৫. www.finmin.nic.in/sites/default/files/TAGUP_Report.pdf
৭. https://scroll.in/article/825049/data-is-the-new-gold-and-aadhaar-is-the-tool-to-get-it
৮. http://www.vakrangee.in/uidai-aadhaar-card.php
৯. www.vakrangee.in/…/Ambassador%20and%20ED%20of%20USAID%20Visit%20Va…
১০. https://www.usaid.gov/india/financial-inclusion-and-diaspora-engagement
১২. http://judis.nic.in/temp/494201232392013p.txt