জয়তী ঘোষ
ভাল মানের কাজের সুযোগ তৈরি করতে মোদি সরকারের সেরকম কোনও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। তার পরিবর্তে সরকারের আর্থিক নীতি কেন্দ্রীভূত হয়েছে কিছু বাছাই করা কর্পোরেট পুঁজিপতিদের ওপর, সরকার করদাতাদের টাকায় তাদের নানা ভর্তুকি এবং ইনসেনটিভ দিয়ে চলেছে, তাদের সুবিধার জন্য আইনকানুন বানাচ্ছে বা পরিবর্তন করছে। অন্যদিকে দেশের বেশিরভাগ শ্রমশক্তি যে-সমস্ত উদ্যোগগুলির ওপর নির্ভরশীল, সেই মাইক্রো, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোগগুলির চাহিদা প্রায়শই উপেক্ষিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সরকারের বেশ কিছু ভুল নীতির মাসুল দিতে গিয়ে এই ধরনের উদ্যোগগুলি বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে
এখন ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির গল্প বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সরকারি তথ্য-পরিসংখ্যান সম্পর্কে অনেক ন্যায্য সংশয় থাকলেও ২০২৪ সালে ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির পূর্বাভাস ৬.৩ শতাংশ[1]— যদি মনে রাখি দেশের জিডিপি ৪.১ ট্রিলিয়ন ডলার ছাপিয়ে যাবে,[2] তবে এ যে এক উল্লেখযোগ্য কীর্তি তাতে সন্দেহ নেই। ভারত এখনও এক নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ, আমাদের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ৩০০০ ডলারেরও কম (মার্কেট এক্সচেঞ্জ রেট অনুযায়ী), কিন্তু দেশের এই দ্রুত বৃদ্ধি দেখিয়ে দেয় যে আমাদের আর্থিক শক্তি যেমনটা ভাবা হয় তার চেয়েও বেশি মজবুত।
কিন্তু ভারতের অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদী হওয়ার আগে অর্থনীতি-সম্পর্কিত দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তার ব্যর্থতার কথা অবশ্যই মাথায় রাখা প্রয়োজন। প্রথম, এই অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সুফলের এক বিসদৃশ অসম বণ্টন। তথ্য বলছে, এই বৃদ্ধির সুফল কেন্দ্রীভূত হচ্ছে মূলত উপরিতলার ১০ থেকে ২০ শতাংশ মানুষের মধ্যে।
প্রসঙ্গত, ২০১১-১২ সালের পর থেকে ভারত দেশের নাগরিকদের গড় ব্যয় সম্পর্কে কোনও তথ্য দিতে পারেনি।[3] ফলে দেশে অসাম্য এবং দারিদ্র্য ঠিক কী হারে বেড়েছে, এ-বিষয়ে কোনও ঠিকঠাক তথ্য দাখিল করা বেশ কঠিন। এই বিষয়গুলি সাধারণভাবে পাঁচ বছর অন্তর হওয়া মানুষের ব্যয়-সমীক্ষার উপর খুবই নির্ভরশীল। কিন্তু যেহেতু সরকারের পছন্দসই বয়ানের সঙ্গে মানানসই হয়নি, তাই নরেন্দ্র মোদির সরকার ২০১৭-১৮ সালের সমীক্ষাটি বাতিল করে দেয়।[4] শুধু তাই নয়, সরকার আর পরবর্তী সমীক্ষাগুলি হতেই দেয়নি, অথচ সুষ্ঠু নীতি নির্ধারণের জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয় হল হাতের কাছে হালনাগাদ তথ্য থাকা।
এর ওপরে আমাদের যে দশকওয়াড়ি জনগণনা, যেটা হওয়ার কথা ছিল ২০২১-এ, সেটাও স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য।[5] ফলত ভারতের জনসংখ্যা ঠিক কত, তারা কোথায় থাকে, কীভাবে থাকে, তাদের জীবনযাত্রা এবং কাজকর্মের হালহকিকত কী— সে-সব সম্পর্কে দেশের সরকার কি দেশের মানুষ কেউই অবগত নয়। তবুও বিভিন্ন সূচক থেকে এটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না যে উচ্চকোটির মানুষদের আয় দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং বেশিরভাগ খেটেখাওয়া মানুষ, বিশেষত যাঁদের অবস্থান আর্থিক পিরামিডের নিচের তলায়, তাঁদের আয় হয় একই জায়গায় আটকে, নয় কমে গেছে।[6]
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি হল, জিডিপির এই দ্রুতলয়ে বৃদ্ধি কিন্তু দেশের যুবসমাজের জন্য যথেষ্ট কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারছে না। প্রতি বছরই কয়েক কোটি উচ্চশিক্ষিত যুবক-যুবতী কর্মজগতে প্রবেশ করছে, কিন্তু তাদের প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না, সামাজিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে অতএব, পরিণতিতে, দেশের বহু-বিজ্ঞাপিত “জনসম্পদের সুফল” (demographic dividend)[7] আদতে এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে।
কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে ভারত বেশ কিছুদিন ধরেই— বিশেষ করে বিগত এক দশক ধরে— ব্যর্থ। সরকারের নিজস্ব বিভিন্ন শ্রম-সমীক্ষা থেকেই দেখা যাচ্ছে ২০১১-১২ সালে যেখানে দেশের জনসংখ্যায় শ্রমশক্তির অনুপাত ছিল ৩৮.৬ শতাংশ, ২০২২-২৩-এ সেটা নেমে দাঁড়িয়েছে ৩৭.৩ শতাংশে। নারী শ্রমজীবীদের সংখ্যাটা আরও ভয়ানক— মাত্র ২০.৮ শতাংশ— এবং এ-ও সরকারি পরিসংখ্যান।[8] আরও মনে রাখতে হবে, এই সংখ্যাও আসলে বাড়িয়ে বলা— কারণ, সরকারের পরিসংখ্যান পরিবারের বেতনহীন শ্রমদাতাদেরও শ্রমজীবী-দের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে।
শ্রম-পরিসংখ্যানের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ অভিনব। আন্তর্জাতিকভাবে শ্রম-পরিসংখ্যানের যে-সমস্ত মান্য মানদণ্ডগুলি স্বীকৃত, তাতে পরিষ্কার করে দেওয়া আছে যে কর্ম বলতে সেগুলিকেই ধরতে হবে যেগুলির বিনিময়ে অর্থ উপার্জন হয়। সে অর্থ মজুরি হতে পারে বা বেতন বা স্বনিযুক্তির মাধ্যমে উপার্জন। কিন্তু ভারত অ-বেতনভোগী কর্মসহায়কদের, তারা কোনও অর্থ উপার্জন না করলেও, “স্বনিযুক্ত” বলে চালিয়ে দেয়। আবার অ-বেতনভোগী অন্যান্য কাজ, যেমন গৃহকর্ম বা বয়স্ক ও শিশুদের দেখভাল, সেই সমস্ত কাজগুলিকে ‘কর্ম’ বা এমপ্লয়মেন্ট হিসেবে গণ্য করা হয় না। ফলে বিপুল সংখ্যক মহিলা যাঁরা মূলত গেরস্থালি সামলান, তাঁরা আমাদের দেশে কর্মশক্তি হিসেবে বিবেচিত হন না।
কাজের বিনিময়ে যাঁরা অর্থ উপার্জন করেন না, আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী আমরা যদি সেই অংশটিকে হিসেবের বাইরে রাখি তবে স্বাভাবিকভাবেই দেশের শ্রমশক্তির আনুপাতিক হার সরকারি তথ্যের চেয়ে অনেকটাই কমে যাবে। ২০২২-২৩-এ ৪৮ শতাংশ ভারতীয় পুরুষ এবং মাত্র ১৩ শতাংশ ভারতীয় মহিলা এমন কাজে যুক্ত ছিলেন যাতে অর্থোপার্জন হয়।[9] মহিলা শ্রমশক্তির এই লজ্জাজনক হার বিশ্বের নিরিখে একদম তলানিতে পড়ে থাকা দেশগুলির মধ্যে আমাদের দেশকে নিয়ে ফেলেছে।
এখানেই ভারতের বহু-বিজ্ঞাপিত আর্থিক বৃদ্ধি মডেলের সবচেয়ে শূন্যগর্ভ অংশটি চিহ্নিত হয়: এই আর্থিক বৃদ্ধি কাজের সুযোগ তৈরি করতে অপারগ। জিডিপি যতই চড়চড়িয়ে বাড়ুক তাতে এমনকি কম গুণমানের এবং নিম্ন-আয়ের কাজের সুযোগও তৈরি করা যাচ্ছে না। এবং এর পরে এতেও আর আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, প্রকৃত মজুরিও গত এক দশক ধরে প্রায় একই জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।[10]
এমনকি কৃষি-শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও— যাঁদের প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি (যদিও সেই হারটা মাত্রই বার্ষিক ০.৯ শতাংশ)— হরিয়ানা, কেরল, পাঞ্জাব, রাজস্থান এবং তামিলনাড়ুর মতো বড় রাজ্যগুলিতে প্রকৃত মজুরি আসলে হ্রাস পেয়েছে।[11] অন্যদিকে, ভারতের শ্রমশক্তির অর্ধেকই কাজ করছে কম-উৎপাদনশীল ক্ষেত্রগুলিতে যে-সমস্ত ক্ষেত্র থেকে জাতীয় আয়ের মাত্র এক-পঞ্চমাংশ আসে।[12]
এইসবের ফলেই জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বা ব্যয় করার ক্ষমতাও কমেছে বা একই জায়গায় আটকে রয়েছে। সরকার যে এই সমীক্ষাটি করতে চাইছে না তার ব্যাখ্যা এটাই। যার জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগও হ্রাস পেয়েছে ব্যাপকভাবে— ২০০৬-০৭-এ যা ছিল জিডিপির ৪২ শতাংশ, ২০২২-২৩-এ সেটা এসে দাঁড়িয়েছে ৩১ শতাংশের কাছাকাছিতে।[13] স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক সুরক্ষার মতো ক্ষেত্রগুলিতে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ ক্রমশ কমছে, ফলে মানবোন্নয়ন সূচকগুলি, বিশেষত যেগুলি জনসাধারণের পুষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সেগুলির এক ব্যাপক অধঃপতন লক্ষ করা যাচ্ছে।
দুঃখজনকভাবে ভাল মানের কাজের সুযোগ তৈরি করতে মোদি সরকারের সেরকম কোনও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। তার পরিবর্তে সরকারের আর্থিক নীতি কেন্দ্রীভূত হয়েছে কিছু বাছাই করা কর্পোরেট পুঁজিপতিদের ওপর, সরকার করদাতাদের টাকায় তাদের নানা ভর্তুকি এবং ইনসেনটিভ দিয়ে চলেছে, তাদের সুবিধার জন্য আইনকানুন বানাচ্ছে বা পরিবর্তন করছে। অন্যদিকে দেশের বেশিরভাগ শ্রমশক্তি যে-সমস্ত উদ্যোগগুলির ওপর নির্ভরশীল, সেই মাইক্রো, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোগগুলির চাহিদা প্রায়শই উপেক্ষিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সরকারের বেশ কিছু ভুল নীতির মাসুল দিতে গিয়ে এই ধরনের উদ্যোগগুলি বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেমন, ২০১৬ সালের বিমুদ্রাকরণ— যাতে দুম করে দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ নোট বাতিল ঘোষিত হয়;[14] যেমন, ২০১৭ সালে একটি দুর্বল, ভুলে ভরা এবং তাড়াহুড়ো করে কার্যকরী হওয়া গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স বা জিএসটি।[15]
ভারতের এখন সুদূরপ্রসারী কর্মমুখী আর্থিক সংস্কারের দিকে মনোযোগ দিতে হবে, যে-সংস্কারের লক্ষ্য হবে প্রচুর কাজের সুযোগ তৈরি করা এবং কাজ থেকে আয় যেন যথেষ্ট হয় তার নিশ্চয়তা দেওয়া। এ-ছাড়া প্রকৃত আর্থিক সাফল্য পাওয়া সম্ভব নয়। ভারতীয় ভোটারদের সামনে দেশের অর্থনীতিকে একটি সুস্থিত এবং সুষম লক্ষ্যে পুনর্বিন্যস্ত করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছে সামনের সাধারণ নির্বাচন। কোনওভাবেই তাঁদের এই সুযোগ হারানো চলবে না।
[1] MacDonald, Margaux and Spray, John. India can balance curbing emissions and economic growth. IMF Country Focus. Mar 7, 2023.
[2] India Datasets. IMF. Oct, 2023.
[3] Felman, Josh. et al. Is India’s consumption really falling? CGD. Dec 19, 2019.
[4] CEA has asked NSC to release 2017-18 Consumer Spending data: Report. The Wire. Dec 7, 2020.
[5] Munjal, Diksha. The delay in the decennial Census. The Hindu. Jan 9, 2023; Updated: Jan 26, 2023.
[6] India among top countries with high income, wealth inequality: UNDP report. Mint. Nov 6, 2023.
[7] Malin, Sophie & Tyagi, Ashima. India’s demographic dividend: the key to unlocking its global ambitions. S&P Global. Aug 3, 2023.
[8] Chandrasekhar, C.P. & Ghosh, Jayati. The unpaid workers who are described as “employed”. IDEAs. Jan 9, 2024.
[9] পূর্বোক্ত।
[10] Dreze, Jean. Wages are the worry, not just unemployment. The Indian Express. Apr 13, 2023.
[11] পূর্বোক্ত।
[12] Damodaran, Harish. What India’s labour force and national income data tell us about jobs shifting from agriculture. The Indian Express. Mar 7, 2023.
[13] India: Capital investment, percent of GDP. The Global Economy.com.
[14] Rowlatt, Justin. Why India wiped out 86% of its cash overnight. BBC News. Nov 14, 2016.
[15] Brief history of GST. Goods and Services Tax Council.
*নিবন্ধটি প্রোজেক্ট সিন্ডিকেট-এ গত ১১ জানুয়ারি ইংরেজিতে প্রকাশিত