Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কেষ্ট-কথা ও শ্রেণিসংগ্রাম

কেষ্ট কথা

রৌহিন ব্যানার্জী

 

কেষ্ট কার ডাক নাম? আজকের দিনে কৌ ব ক-তে এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিলে (অপশন এ — রামকৃষ্ণ; বি — শ্রীকৃষ্ণ; সি — ঋতব্রত; ডি — অনুব্রত) আপনি বড়জোর এক হাজার টাকা জিতলেন। দু’হাজারের জন্য আপনাকে বলতে হবে কেষ্টর মাথায় কী কম যায়? অপশন এ — ধাতানি; বি — গুড় বাতাসা; সি — অক্সিজেন; ডি – দুধকুমার। আর যদি পাঁচ হাজার টাকা এখান থেকে জিতকেই যেতে হয়, তাহলে অবশ্যই আপনাকে বলতে হবে বীরভূম কার? উত্তর : এ — রবীন্দ্রনাথের; বি — কেষ্টর; সি — রামকিঙ্করের; ডি — জয়দেবের। কিন্তু এসব খুচরো প্রশ্ন ছাড়ুন — আপনি সত্যি সত্যিই কেবিসিতে চান্স পাননি — সুতরাং একেবারে কোটি টাকার প্রশ্নটা নিয়েই বরং আলোচনা শুরু করি — এই বঙ্গে চাড্ডি আগ্রাসন রুখতে হলে কি কেষ্ট বা কেষ্টদের উপস্থিতি জরুরি?

আদৌ জরুরি কিনা বা হলে কতটা, সেই প্রসঙ্গে আসার আগে কেষ্ট কী এবং কেন সেটা একটু সংক্ষেপে বুঝে নিই -– সংক্ষেপেই, কারণ আবাপ প্রমুখদের দৌলতে এটা এখন আমাদের প্রায় সবারই জানা বিষয়। আমরা জানি কেষ্ট তথা অনুব্রত হলেন বীরভূমের অলিখিত রাজা, তৃণমূলের জেলা সভাপতি -– যাঁর অঙ্গুলিহেলন ছাড়া বীরভূমে একটা পোকা ডিমও পাড়তে পারে না। আমরা এও জানি যে তিনি দিদির বিশেষ স্নেহভাজন এবং তাঁর মাথায় অক্সিজেন কম যায়, আমরা জানি তিনি তাঁর অতিথিদের দুইভাবে সৎকার করে থাকেন -– মুড়ি নারকেল দিয়ে অথবা গুড় বাতাসা দিয়ে -– অতিথি কোন রঙের, তার ওপরেই নির্ভর করে আতিথেয়তার রঙ। আজ্ঞে হ্যাঁ, অনুব্রত মণ্ডল সংক্রান্ত এইসব তথ্য আমরা জানি, পশ্চিমবঙ্গের একটা বাচ্চাও জানে।

যেটা আমরা জানি না, তা হল ২০১১ সালের আগে অনুব্রত ঠিক কী ছিলেন, কী করতেন, কেমন ছিলেন, তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান কী কী? আমরা জানি না, কিন্তু আন্দাজ করাই যায়, যদিও সে চেষ্টা আমরা কেউই করি না -– কারণ সেটা জরুরি নয়। অনুব্রতরা কেন এবং কীভাবে তৈরি হন সেটা আমাদের অজানা তো কিছু নয়। যখন দল ক্ষমতায় আসে তখন অনুব্রতদের প্রয়োজন হয়, ক্ষমতায় আসার আগে সেই পথ করতেও প্রয়োজন হয়। তার আগে তারা কী করতেন, ক্ষমতা চলে গেলেই বা কী করবেন, সেগুলো একেবারেই অবান্তর। কেউ কি জানেন লক্ষণ শেঠ এখন কী করছেন? অনুজ পাণ্ডের পরিবারের কী হল? অধীর চৌধুরী এখনও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি আছেন কি না? তপন, শুকুর জেলে নাকি বাইরে? এগুলো কোনওটাই এখন কৌবক-তে আসবে না, তাই আমাদের না জানলেও দিব্যি চলে যায়।

আবাপ এট আল যতই খিল্লি করুক না কেন, মমতা ব্যানার্জী প্রকাশ্যে ঘোষণা করে জানিয়েছেন তিনি “কেষ্ট”র পাশেই আছেন এবং “শেষ অবধি” থাকবেন। এবং তৃণমূল সমর্থকেরা অনেকেই মনে করেন যে অনুব্রতর মতো নেতাদের প্রয়োজন আছে ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে। এই ক্ষমতা “ধরে রাখা”র প্রশ্নে পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে বর্তমান তৃণমূল সরকারের খুব একটা ফারাক দেখি না। বাম নেতাদের অনেককেই এক সময় বলতে শুনেছি -– জনতা যদি নিজেদের ভালো না বোঝে তাহলে প্রয়োজনে তা বুঝিয়ে দিতে হবে -– এতে দোষের কিছু নেই। প্রায় একই লাইনে আরাবুল-অনুব্রতদের ব্যাপারেও তৃণমূল নেতৃত্ব “দোষের কিছু” খুঁজে পান না। এবং অনেক বামপন্থী, যারা মনে করেন বিজেপির উত্থান আটকাতে প্রয়োজনে মমতাকেও সমর্থন দেওয়া যায়, তারাও মনে করেন অনুব্রতরা “নেসেসারি ইভিল” -– যাদের ছাড়া এই যুদ্ধ জিতে ওঠা মুশকিল।

এত লোক যখন ভাবছেন, তখন আরও একটু খতিয়ে বোঝা অবশ্যই প্রয়োজন যে অনুব্রতর কার্যকলাপ ঠিক কী প্রকৃতির? তিনি কি রবিনহুডের মতন কেউ? এই সব “অপপ্রচারের” তোয়াক্কা না করে তিনি কি সত্যিই লড়াইটা লড়ছেন বীরভূমের মাঠেঘাটে? তাঁর জন্যই কি বীরভূমে বিজেপি আগ্রাসন আটকে গেছে? এগুলো বুঝে নেওয়া অবশ্যই দরকার কারণ ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা ভদ্রলোক সমাজের প্রতিভূ মেইনস্ট্রিম মিডিয়া, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, রাজনৈতিক বিরোধী এবং সর্বোপরি মধ্যবিত্ত শহুরে ভদ্রলোক -– এরা যখন কোনও কিছুর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে থাকেন সোচ্চারে তখন প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসাবেই মনে হয় সেটা সঠিক। কারণ ভারতীয় সমাজের প্রেক্ষিতে এই শ্রেণিগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই আর। এরা নিজেদের আদর্শের খাপে সব কিছুকে সেট করে নেন এবং তারপরে বিচার করতে বসেন। সুতরাং এটা বুঝে নেওয়া জরুরি যে অনুব্রত কি নেহাৎ এই নেক্সাসের শিকার না কি যথার্থই একজন ভিলেন? যেহেতু বিষয়টা বহুমুখী এবং জটিল, তাই একে ঠিকভাবে বোঝার জন্য আমরা একদম বেসিকে ফিরে যাব। প্রিন্সিপাল ডায়ালেক্ট – শ্রেণিদ্বন্দ্ব।

সম্প্রতি আরও একবার বোলপুর অঞ্চলে অনুব্রতর “সেনাবাহিনী” অ্যাকশনে নেমেছে -– জমি দখলের লড়াইয়ে। জমিটি সরকারের অধিগৃহীত -– বামফ্রন্ট সরকার অধিগ্রহণ করে ফেলে রেখেছিল -– শিল্পায়ন হয়নি। তৃণমূল সরকার আসার পরেও একই অবস্থা ছিল -– সম্প্রতি সেখানে ‘শিল্পায়ন’ হতে চলেছে। অর্থাৎ শিল্পায়ন বলতে তৃণমূল সরকার একমাত্র যা বোঝেন -– আবাসন শিল্প। এই অবস্থায় ওখানকার স্থানীয় কৃষকেরা প্রতিবাদ করেছেন -– শিল্পের জন্য অধিগৃহীত জমিতে যদি শিল্প না হয় (কী মুশকিল -– এরা আবার আবাসনকে শিল্পের মধ্যেই ধরছেন না) তাহলে সে জমি আবার ফিরিয়ে দেওয়া হোক -– যেমন সিঙ্গুরে হয়েছে। কিন্তু বোলপুর তো সিঙ্গুর নয়, সালটাও ২০১১ নয়, অতএব কেষ্ট নেমেছেন আসরে। কৃষকদের ওপর গুলি চলেছে, হুমকি চলছে “গ্রাম কে গ্রাম” জ্বালিয়ে দেবার। এখন এই সব জমি দখলের লড়াইতেই কে কোন পক্ষ, তা সবচেয়ে সহজে চিনে নেওয়া যায়। অনুব্রত সরকারের হয়ে, ক্ষমতার পক্ষে বন্দুক ধরেছেন।

শুধু এই ক্ষেত্রে নয় -– এর আগে যতবার অনুব্রতর নাম শিরোনামে এসেছে, আমরা কী দেখি? তিনি কাদের হুমকি দিচ্ছেন বা কারা তাঁর পোষ্যদের হাতে প্রাণ দিচ্ছেন? প্রত্যেকবার, বিনা ব্যতিক্রমে লক্ষ্য হয়েছেন গরিব গ্রামবাসী। কখনও বিরোধী দল করার “অপরাধে”, কখনও বা স্রেফ তাঁর অঙ্গুলিহেলনে উঠতে বসতে অস্বীকার করার অপরাধে। একবারও কি কোনও ক্ষমতাশালী ব্যক্তি তাঁর হুমকির কবলে পড়েছেন? পাঠক যেহেতু সব জানেন, বলতেই পারেন, তিনি পুলিশ অফিসারদের থ্রেট দিয়েছেন, ওসিকে থানায় ঢুকে ধমকেছেন, এঁরাও তো ক্ষমতারই প্রতিভূ। কিন্তু সত্যি কি তাই? রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্য মঞ্চে অনুব্রতর প্রতি তাঁর সহানুভূতি এবং পাশে থাকার বার্তা জানিয়ে গেছেন। যে সব পুলিশ অফিসারদের তিনি ধমকেছেন (বা চমকেছেন) তাঁরা প্রায় সবাই চাকরি বাঁচাতে ব্যস্ত ছিলেন। বীরভূমের ডিআইজি নিজে মুখে হাইকোর্টে স্বীকার করে এসেছেন যে অনুব্রত’র বিরুদ্ধে রিপোর্ট লিখতে সিট (বিশেষ তদন্তকারী দল)-এর অফিসারেরা ভীত বোধ করছেন। আজ্ঞে না, তিনি ক্ষমতাকে নয়, ক্ষমতাপিষ্টকেই ধমকেছেন এবং চমকেছেন, বারবার। তাই তাঁর শ্রেণি অবস্থান নিয়ে কোনওরকম ধোঁয়াশার জায়গা নেই।

কেউ কেউ বলেছেন অনুব্রতর এই “সাঙ্গোপাঙ্গ”রাও তো আসলে গরিব মানুষেরই প্রতিভূ। তারা তো কেষ্টদাকে তাদের নেতা হিসাবেই মেনে নিয়েছেন -– সেখানে শ্রেণি-চরিত্র কোথায় গেল? যারা এটা বলছেন, তাদের উইথ ডিউ রেসপেক্ট একটা প্রশ্ন করি -– এই “সাঙ্গোপাঙ্গ”দের, এবং তাদের সমভিব্যহারে কেষ্টদাকে কখনও দেখেছেন? সানগ্লাস পরা রাজাবাবু আসছেন, আগে পিছে উপর নীচে দেহরক্ষী। ফোনে ফোনে একে ওকে তাকে ধমকাচ্ছেন -– নিজের পার্টির লোক বা বিরোধী পার্টির, পুলিশ কিম্বা পঞ্চায়েৎ প্রধান -– সবাই তাঁর প্রজা। এবং বুর্জোয়া জমিদারদের মতোই তিনি রিক্রুট করেছেন প্রজাদের একাংশকেই -– ক্ষমতার লুটের সামান্য -– আজ্ঞে না, ভাগ ভুলেও ভাববেন না -– সামান্য একটু প্রসাদ দিয়ে। প্রলেতারিয়েত থেকে লুম্পেন প্রলেতারিয়েত — সেখান থেকে প্রতিক্রিয়ার হাতিয়ার। প্রতিক্রিয়াশীলের বীণার তার। এবং এভাবেই চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছে শ্রেণি-চরিত্র। এই সাঙ্গোপাঙ্গদের যারা এখনও বিপ্লবের হাতিয়ার ভাবছেন, তাদের জন্য সহানুভূতি রইল।

বীরভূমের রাজনীতির সঙ্গে যাদের মোটামুটি পরিচয় আছে তারা অনেকেই জানেন, বীরভূমে বিজেপি সমর্থকদের একটা বড় অংশ মুসলমান চাষি। অবাক হচ্ছেন? যদি একটু বিশ্লেষণ করেন, এর ব্যখ্যা পাওয়া খুব একটা কঠিন নয়। অনুব্রত এইসব গরিব কৃষিজীবি মানুষের নেতা নন -– এদের মধ্যে একদল তাঁকে সমর্থন করেন নেহাতই ভয়ে অথবা ক্ষুদ্র স্বার্থে। আর বাকিরা তাঁর বিরুদ্ধে লড়ার জন্য খড়কুটো যা পান, আঁকড়ে ধরেন। এই মানুষগুলোই আগে সিপিএম বা আর এস পি র সমর্থক ছিলেন। এই দলগুলির সংগঠন দীর্ঘদিন ধরেই ভিতরে ভিতরে ফোঁপরা হয়ে আসছিল -– গ্রামসভা ব্যাপারটা বহু গ্রাম পাঁচ-সাত বছরে একবারও হতে দেখেনি। ২০১১-তে পরিবর্তনের পরে এই বামদলগুলির সংগঠন সম্পূর্ণভাবে ধ্বসে পড়ে। অন্যদিকে তখন সীমান্তের ওপারে বিহার থেকে আসা শ্রমিকদের একাংশের সুবাদে বীরভূম জেলায় বিজেপির সংগঠন তৈরি হচ্ছে একটু একটু করে। নিজেদের বাঁচার তাগিদেই এই কৃষক মানুষগুলি গিয়ে ভিড়লেন বিজেপিতে। কারণ সর্বহারার রাজনৈতিক বিচারে ধর্মই প্রধান ফ্যাক্টর নয়।

অতএব দেখা যাচ্ছে, বীরভূম অঞ্চলে বিজেপির উত্থানের জন্য সিপিএম তথা বামফ্রন্ট অংশত দায়ী, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী স্বয়ং অনুব্রত। তাঁর শ্রেণিচরিত্র, তাঁর দলবলের কার্যকলাপই সাধারণ খেটে খাওয়া গরিব মানুষকে ঠেলে দিয়েছে বিজেপির দিকে -– কারণ অন্য কোথাও যাবার মতো অপশন যাতে না থাকে, সেটাও অনুব্রতই নিশ্চিত করেছেন। বামফ্রন্টকে শুধু হারিয়ে অনুব্রতর (বা তাঁর নেত্রীর) শান্তি হয়নি -– তারা যাতে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, বীরভূমকে (তথা পশ্চিমবঙ্গকে) বিরোধীশূন্য করার সবরকম চেষ্টা তিনি ও তাঁরা করেছেন, করে চলেছেন। এবং তারই ফাঁকে গজিয়ে উঠেছে সেই বিষবৃক্ষ -– যাকে সম্পূর্ণ কেটে ফেলা এখন “সর্বশক্তিমান” কেষ্টরও সাধ্যাতীত। বিজেপিকে রুখতে অনুব্রতদের প্রয়োজন, এই মিথটি ভেঙে ফেলার সময় এবার এসেছে। অনুব্রতরা শ্রেণিশত্রু ধ্বংস করেন না -– তৈরি করেন, ঐতিহাসিকভাবে।