প্রদীপ দত্ত
মোদির রাজনীতি বুঝতে গেলে তাঁর রাজনীতির আঁতুড়ঘর গুজরাতের দিকেই নজর ফেরাতে হবে। মোদি সেখানে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পাঁচ মাসের মধ্যে ভয়ানক সাম্প্রদায়িক গণহত্যা হয়েছিল। দেখতে হবে সেখানে তাঁর ভূমিকা কী ছিল। সেইরকম কাণ্ড আগেও হয়েছে, শিখ রক্ষীর গুলিতে ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যুর পর শিখ গণহত্যা হয়েছে। কংগ্রেসের তিন নেতা তাতে জড়িত ছিলেন। তবে আদালতে ছাড় পেলেও বলতেই হয় মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্য সরকার ও প্রশাসন সরাসরি জড়িয়ে আছে এমন গণহত্যা গুজরাতেই প্রথম
তখনও নরেন্দ্র মোদি রাজনীতিতে আসেননি, মনোবিজ্ঞানী আশিস নন্দী তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একেবারে চমকে গিয়েছিলেন। স্বৈরশাসক হিসাবে একজন মানুষের যে-সব লক্ষণ থাকার কথা নরেন্দ্র মোদির কথাবার্তা, ধরন-ধারণ খাপে খাপে মিলে গিয়েছিল। সে-কথা তিনি পরে লিখেছেন। তবে আরেক অনুসন্ধানী সাংবাদিক বিনোদ কে জোস দশ-বারো বছর আগে বলেছিলেন, মোদি ইংরেজির একটাই অ্যালফাবেট বোঝেন, সেটা হল ‘আই’। তাতেও বিপদের গন্ধ ছিল। আমিত্ব-সর্বস্ব রাষ্ট্রশক্তি কেমন হয় ভারতবাসী, গত দশ বছর ধরে তার সাক্ষী। এখন তো ভারতীয় সেনাবাহিনিকেও বলা হচ্ছে ‘মোদির সেনা’। রাজনীতিতে আমিত্বের কদর্য প্রচার আমাদের সংস্কৃতিও বদলে দিচ্ছে, যা দশ বছর আগেও ছিল না। তা থেকেই উঠে আসছে একনায়কতন্ত্রের আতঙ্ক। ওদিকে বেশ কয়েকবছর ধরে দেশে নানা ঘটনা, মাপকাঠি এবং কেন্দ্রের নানা পদক্ষেপে আমরা দেখছি গণতন্ত্র চরম বিপন্ন। সাম্প্রদায়িকতাকেও চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
তাই মোদির রাজনীতি জানা-বোঝা খুবই জরুরি। বুঝতে গেলে তাঁর রাজনীতির আঁতুড়ঘর গুজরাতের দিকেই নজর ফেরাতে হবে। মোদি সেখানে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পাঁচ মাসের মধ্যে ভয়ানক সাম্প্রদায়িক গণহত্যা হয়েছিল। দেখতে হবে সেখানে তাঁর ভূমিকা কী ছিল। সেইরকম কাণ্ড আগেও হয়েছে, শিখ রক্ষীর গুলিতে ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যুর পর শিখ গণহত্যা হয়েছে। কংগ্রেসের তিন নেতা তাতে জড়িত ছিলেন। তবে আদালতে ছাড় পেলেও বলতেই হয় মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্য সরকার ও প্রশাসন সরাসরি জড়িয়ে আছে এমন গণহত্যা গুজরাতেই প্রথম। শুধু তাই নয় গণহত্যা বা দাঙ্গার সময় যে-সব পুলিশকর্তারা চোখ বন্ধ করেছিলেন পরবর্তীকালে তাঁরা নানাভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন। আর যাঁরা অপরাধ প্রমাণ করতে সক্রিয় হয়েছিলেন তাঁদের হয়রান করা হয়েছে, জেলে ভরা হয়েছে।
২০০৭ সালে বিজেপি-ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের সংবাদমাধ্যম কিনে নেওয়া চালু হয়নি এবং শক্তিশালী সংবাদমাধ্যমের মালিক বিজেপির সাংসদ হননি। বছর ছয়েক হল নরেন্দ্র মোদি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। খবরের কাগজ বা অন্য গণমাধ্যমের সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেন কম। কদাচিৎ টেলিভিশন চ্যানেলে ইন্টারভিউ দেন। সিএনএন-আইবিএনের সাংবাদিক করণ থাপার মোদির সাক্ষাৎকার পাওয়ার জন্য প্রায় প্রতি সপ্তাহেই চিঠি লিখতেন। দেড় বছর এইরকম চলার পর তিনি প্রয়াত অরুণ জেটলিকে ধরলেন। জেটলিই শেষ পর্যন্ত মোদিকে করণের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে রাজি করান। সিএনএন-আইবিএন-এ করণের সঙ্গে মোদির নির্ধারিত তিরিশ মিনিটের সাক্ষাৎকার মাত্র তিন মিনিট স্থায়ী হয়েছিল। অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রশাসক হিসাবে মোদির ভূয়সী প্রশংসা করে করণ বলেন, এসব সত্ত্বেও মানুষ আপনাকে গণহত্যাকারী বলে, তাদের অভিযোগ আপনি মুসলমানবিদ্বেষী। আপনার কি এই ইমেজ নিয়ে কোনও সমস্যা আছে? এই কথা শুনে মোদি খুবই রেগে যান। থেমে থেমে কয়েকটি বাক্যে বলেন, আপনি এখানে এসেছেন, বন্ধুত্ব করেছেন, আপনার কিছু ধারণা রয়েছে, তাই বার বার বলছেন। এরপর তিনি সাক্ষাৎকারে বিরতি চান। এবার কুর্তা থেকে ল্যাপেল মাইক্রোফোন খুলে রেখে সাক্ষাৎকার শেষ করছেন বলে বেরিয়ে যান।
সেই অসম্পূর্ণ অনুষ্ঠান বা শেষ না-হওয়া সাক্ষাৎকার থেকে মোদির হেঁটে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা সিএনএন-আইবিএন বারবার দেখায়। তেত্রিশবার দেখানোর পর মোদি করণকে ফোন করেন, আপনি কি আমার কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি চালাচ্ছেন? করণ বলেন, আমি কি বলিনি যে সাক্ষাৎকার শেষ করে যাওয়াই ভাল? উত্তরে এটা-ওটা বলে শেষে মোদি বলেন, এরপর তিনি দিল্লিতে গেলে রাতে করণকে সঙ্গে নিয়ে ডিনার করবেন। এ-ও বলেন যে পরে আরেকটি সাক্ষাৎকার দেবেন। বলেন, আই লাভ ইউ। করণের মনে হয়েছিল ফোনে কথাবার্তার পর মোদি ঠান্ডা হয়েছেন। কিন্তু পরের পাঁচ বছর প্রতি ছ-সপ্তাহ অন্তর চিঠি লিখেও কোনও উত্তর পাননি।
প্রশ্ন হল গণহত্যা বা দাঙ্গা নিয়ে কথা বলায় মোদির এমন ভীতি কেন? গুজরাত গণহত্যার পরে কয়েকজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক তা নিয়ে আলোকপাত করেছেন। সে সব পড়লে বোঝা যায় তাঁর এবং তাঁর প্রশাসনের ভূমিকা কতটা কদর্য।
পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪
অনেকেই বলেন, সঙ্ঘ পরিবারের কাছে গুজরাত হল হিন্দুত্বের গবেষণাগার। ১৯৯৮ সালে গুজরাত বিধানসভার দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জিতে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু এরপর ২০০০ সালে যে ৬টি পৌরসভা, ২৫টি জেলায় পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল প্রায় সবকটাতেই বিজেপি হেরেছিল। ৬টি পৌরসভার ৪টিতে জিতলেও আমেদাবাদ ও রাজকোটে হেরেছিল। অথচ ওই দুই জেলা ছিল সঙ্ঘ পরিবারের সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি। আমেদাবাদ পৌরসভায় ১৫ বছর এবং রাজকোটে ২৫ বছর ধরে বিজেপি ক্ষমতায় ছিল।
২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুটি বিধানসভা উপনির্বাচন হলে দুটিতেই বিজেপি কংগ্রেসের কাছে হারে। মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই পটেলের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও দুর্বল প্রশাসন নিয়ে অভিযোগ ছিলই। এর সঙ্গে ভুজ ভূমিকম্পের পর ত্রাণের অব্যবস্থা নিয়ে কথা ওঠে। তাই জাতীয় নেতৃত্ব অক্টোবর মাসে তাঁকে সরিয়ে নতুন মুখ্যমন্ত্রী করলেন নরেন্দ্র মোদিকে।[1] অটলবিহারী বাজপেয়ি-সহ কেন্দ্রীয় নেতারা মোদির খবর কিছুটা রাখতেন। তাই গুজরাতের বিজেপি বিধায়করা যেন মোদির বিরোধিতা না করে তা নিশ্চিত করতে দিল্লি থেকে গুজরাতে যাওয়ার সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরএসএস নেতা ও বিজেপি সভাপতি কুশাভাউ ঠাকরে এবং বাজপেয়ি সরকারের ওজনদার মন্ত্রী মদনলাল খুরানা। মোদির মুখ্যমন্ত্রী হওয়াটা আরএসএসের কাছে ছিল বিরাট সাফল্য। সেই প্রথম আরএসএসের কোনও প্রচারক মুখ্যমন্ত্রী হলেন। তারপরও ২০০২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিজেপির যে তিনটি জেতা বিধানসভা আসনে ভোট হয়, দুটিতেই তারা কংগ্রেসের কাছে বড় ব্যবধানে হারে। রাজকোটের আসনে মোদি নির্বাচিত হন, তবে আগের চেয়ে অনেক কম ব্যবধানে।
১৯৯৮ সালের পর থেকে এইরকম ধারাবাহিক পতনের পর মোদি ক্ষমতায় আসার আসার পাঁচ মাস পর গুজরাত গণহত্যা হয়। হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের জন্য, হিন্দু ভোট এককাট্টা করতে আগেও সেখানে দাঙ্গা হয়েছে। তবে হত্যার ব্যাপকতা ও ভয়াবহতায় ২০০২-এর গণহত্যার সঙ্গে কোনওভাবেই তুলনীয় নয়। মোদি বিধানসভার ভোটে সেই গণহত্যার ফায়দা তুলতে চাইছিলেন। রাজ্যের অবস্থা থিতু হওয়া এবং সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সরকার ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করার জন্য দরবার করেছিলেন। বিভাজন ও হিংসার রাজনীতিকে ব্যবহার করে তিনি মানুষের রায় চাইছিলেন। তবে রাজ্য গোয়েন্দা বিভাগের কাছ থেকে খবর নিয়ে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জে এম লিংডো রাজ্যের ওই প্রতিকূল অবস্থা নির্বাচন করার উপযোগী মনে করেননি। জুলাই মাসে মোদির পদত্যাগ ও বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার পরও সে রাজ্যে নির্বাচন হয়েছিল ডিসেম্বর মাসে।
Reference:
- जोस, विनोद के। केशुभाई पटेल को हटवा कर नरेन्द्र मोदी कैसे बने गुजरात के मुख्यमंत्री। The Caravan. Oct 30, 2020.
[পরের পর্ব- গোধরার ঘটনা]
[1] আরএসএসে নরেন্দ্র মোদি দ্রুত উপরে উঠে আসছিলেন। ১৯৮৭ সালে তিনি গুজরাতের সংগঠন সচিব হন। আরএসএস-এর সংগঠন সচিবের কাজ গোপন থাকে, পিছন থেকে তিনি বিজেপিকে চালান। দুইয়ের মধ্যে যেন এক সেতু। আট বছর তিনি ওই পদে ছিলেন। ওই সময়ই গুজরাতে বিজেপির অভূতপূর্ব বিকাশ হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে বিজেপির বিধায়কের সংখ্যা ছিল ১১, এক দশক পরে তা বেড়ে হয় ১২১। একই সময় রাজ্যে তিনিটি বড় দাঙ্গা হয়। দাঙ্গায় ১৯৮৫ সালে ২০৮ জন মারা যায়, ১৯৯০ সালে ২১৯ জন, ১৯৯২ সালে ৪৪১ জনের মৃত্যু হয়। দাঙ্গা হলে, সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা বাড়লে বিজেপির লাভ হয়, তাদের ঝুলিতে হিন্দু ভোট বাড়ে। বিজেপি দুটি রোড শো-র আয়োজন করেছিল, দুটিতেই মোদি পিছন থেকে মূল ভূমিকায় ছিলেন। ১৯৮৭ সালের প্রথমটি ছিল ‘ন্যায় যাত্রা’। ১৯৮৯ সালে দ্বিতীয়টির নাম ছিল ‘লোকশক্তি রথযাত্রা’। ১৯৯০ সালে বিজেপির অধ্যক্ষ এলকে আদবানির নেতৃত্বে অযোধ্যা রথযাত্রা হয়েছিল। গুজরাতের সোমনাথ মন্দির থেকে সেই যাত্রা শুরু হয়, দায়িত্বে ছিলেন মোদি। দু-বছর পরেই বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়। তার আগের বছর, ১৯৯১ সালে বিজেপির অধ্যক্ষ মুরলি মনোহর জোশির নেতৃত্বে দক্ষিণের কন্যাকুমারী থেকে শ্রীনগর ‘একতা যাত্রা’র পথ ঠিক করা এবং নানা স্থানে মিটিঙের আয়োজন করার দায়িত্বে ছিলেন মোদি। ধীরে ধীরে মোদি গুজরাতে ক্ষমতার এক নতুন কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ান। সেই সময় রাজ্য বিজেপিতে ছিলেন কেশুভাই পটেল এবং শঙ্কর সিং বাঘেলা। দুজনেই বিজেপির অধ্যক্ষ হন।
১৯৯৮ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদি বিজেপির জাতীয় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরের বছর কার্গিল যুদ্ধের পর বাজপেয়ি এবং পাকিস্তানের পারভেজ মুশারফের কথাবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে মোদি কয়েকবার প্রেস কনফারেন্স করে টিভিতে দর্শকদের চোখে নজর কাড়েন। এক টিভি বিতর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, পাকিস্তানকে কেমন জবাব দেওয়া দরকার? তিনি বলেন, চিকেন বিরিয়ানি নয়, বুলেটের জবাব হল বোমা (পরমাণু)।
জাতীয় সম্পাদক হয়ে দিল্লিতে এসেও গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী পদটি পাওয়ার জন্য ক্রমাগত তদ্বির করছিলেন। তিনি জানতেন গুজরাতের নেতাদের মধ্যে সঞ্জয় জোশি, গোর্ধন জাডাপিয়া ও হরেন পান্ড্য তাকে পছন্দ করেন না, তাই তাঁরা মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁকে বেছে নেবেন না। কাজটা তাই কেন্দ্রের বড় কাউকে দিয়ে করাতে চাইছিলেন। গুজরাতে শঙ্কর সিং বাঘেলা সরকারের পতনের পর কেশুভাই পটেল মুখ্যমন্ত্রী হলে বিজেপি কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচন এবং ২০০১ সালে বিধানসভার দুটি উপনির্বাচনে হেরে গিয়েছিল। দিল্লিতে মোদি পার্টির নেতাদের কাছে কেশুভাইয়ের নিন্দা করতেন এবং বলতেন কেশুভাই হিন্দুত্বের বিকাশ নিয়ে নয় শুধুই অর্থনৈতিক বিকাশের কথা ভাবেন। জাতীয় নেতারা খবর রাখতেন, কেশুভাইয়ের বিরুদ্ধে খবর করার জন্য তিনি দিল্লিতে একাধিক পত্রিকার সম্পাদকদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। নেতারা গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নতুন মুখ খুঁজছিলেন। আদবানি কেশুভাইয়ের নির্বাসন চাইছিলেন না, আবার মোদির সরকার চালানোয় অনভিজ্ঞতা নিয়েও চিন্তিত ছিলেন। এইসময় অটলবিহারী বাজপেয়ি হঠাৎই মোদিকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচন করেন।