দেবাশিস মিথিয়া
অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির বিচারে গত ৫ বছরে বিজেপি সরকার ইশতেহারী প্রতিশ্রুতির ধার দিয়েও যায়নি— পরিসংখ্যান তেমনই বলছে। তবে ১৮তম নির্বাচনের আগে ইশতেহার প্রকাশ করতে গিয়ে বিজেপি বলেছে গত ১০ বছরে তাদের দেওয়া সমস্ত প্রতিশ্রুতিই তারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে! অন্যদিকে, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের পর্যালোচনা বলছে, ২০০৪-২০১৪— এই ১০ বছর ইউপিএ সরকার অনেকটাই ইশতেহারমুখী ছিল, বিশেষ করে অর্থনীতির বিষয়গুলিতে
ভারতজুড়ে লোকসভা নির্বাচন শুরু হচ্ছে ১৯ এপ্রিল থেকে। তার আগে রাজনৈতিক প্রচারে, মিছিলে, জনসভায় রীতিমতো সরগরম গোটা দেশ। একসময় নির্বাচনী প্রচারের প্রধান হাতিয়ার ছিল ‘নির্বাচনী ইশতেহার’ বা ‘ইলেকশন ম্যানিফেস্টো’। দেশের সাধারণ নির্বাচন এলেই রাজনৈতিক দলগুলি ইশতেহার প্রকাশ করবে— এটাই রীতি। বিশেষ করে জাতীয় দলগুলি। নির্বাচনী ইশতেহার আসলে রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিশ্রুতিপত্র। কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে দেশের মানুষের জন্য আগামী দিনে তারা কী কী করবে সেটাই বলা থাকে ইশতেহারে। দারিদ্র্য দূরীকরণ, বেকার-সমস্যার সমাধান, কৃষি ও কৃষকের উন্নতি, স্বনির্ভরতার মধ্যে দিয়ে মহিলাদের ক্ষমতায়ন, শিল্প উন্নয়ন ও জিডিপি-র বৃদ্ধি— কমবেশি এইসব প্রতিশ্রুতিই থাকে নির্বাচনী ইশতেহারে। এছাড়াও সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা থাকে। উল্লেখ থাকে বৈদেশিক নীতি কী হবে, দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দল ক্ষমতায় আসীন হলে কী পদক্ষেপ নেবে। তবে বর্তমানে আঞ্চলিক দলগুলির বাড়বাড়ন্ত ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে কিছুটা এলোমেলো করে দিয়েছে। এই দলগুলি জাতীয় ইস্যু নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নয়, যেন-তেন প্রকারে নিজের রাজ্যে ক্ষমতা দখল করতে পারলেই দায়িত্ব শেষ। ফলে দেশের সমস্যা সমাধানে জাতীয় দলগুলির বাতলে দেওয়া উপায় অনেক সময়েই আঞ্চলিক স্তরে গিয়ে থমকে যাচ্ছে। যেমন পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে পাওয়া ১০০০ টাকার অনুদানকেই মহিলারা নিজেদের স্বনির্ভর হওয়ার মাপকাঠি বলে ধরে নিয়েছেন। তাঁদের বোঝানো কঠিন— এটা জীবনের চরম সত্যি নয়। তাই মহিলাদের ক্ষমতায়নে জাতীয় দলগুলি যে-প্রতিশ্রুতিই দিক না কেন পশ্চিমবঙ্গের মহিলাদের তা কোনওভাবেই প্রভাবিত করবে না।
আর একটি বিষয় যা ভারতীয় রাজনীতিতে সগৌরবে ফিরে এসেছে তা হল ব্যক্তিপুজো। দক্ষিণভারতের রাজ্যগুলিতে একসময় বিধানসভা নির্বাচনে জনপ্রিয় চিত্রতারকাদের মুখ ব্যবহার করা হত রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে। ভারতীয় রাজনীতিতে সেই ব্যক্তিপুজো নতুন করে ফিরে এল যেদিন থেকে রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনী কাজে ‘পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজিস্ট’দের সাহায্য নিতে শুরু করল। ব্যক্তিনির্ভর এই নির্বাচনী প্রচারে পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি সাধারণ মানুষকে রাজনীতিবিমুখ করে তুলেছে। আর এই ‘রাজনৈতিক কমিক’ দেখতে গিয়ে সাধারণ মানুষ ভুলে যাচ্ছেন সরকারের কাছ থেকে তাঁদের কী পাওয়ার ছিল আর প্রকৃতপক্ষে তাঁরা কী পেলেন। মানুষের চিন্তাভাবনাকে তালগোল পাকিয়ে দিতে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদলকে সাহায্য করছে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া।
বর্তমানের এই ব্যক্তিপুজো ও পারস্পরিক কুৎসার আবহে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে নির্বাচনী ইশতেহার। তবে ঐতিহ্য মেনে সমস্ত জাতীয় দলগুলি এখনও তা প্রকাশ করছে। নির্বাচনী ইশতেহারের গুরুত্ব তখনই বোঝা যায় যখন কোনও রাজনৈতিক দল সরকার গঠনের পরে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করে বা করার চেষ্টা করে। ভারতবর্ষ এই মুহূর্তে ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের দোরগোড়ায়। একদিকে বিজেপির নেতৃত্বে ৩৮টি দলের ‘এনডিএ’ জোট ক্ষমতা পুনর্দখলের লড়াইয়ে নেমেছে, অন্যদিকে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ২৬টি দলের ‘ইন্ডিয়া’ জোট বিজেপিকে দিল্লির মসনদ থেকে গদিচ্যুত করতে চাইছে।
ফেরা যাক নির্বাচনী ইশতেহারের প্রসঙ্গে। দেখে নেওয়া যাক, ১৮তম লোকসভা নির্বাচনে (২০২৪) বিজেপি অথবা তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস সরকারে এলে জনগণকে আগামী দিনে কী কী সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি বৈদেশিক নীতি ও দেশের নিরাপত্তার বিষয়েও বলা থাকে। তবে স্বল্প পরিসরে সবটা ধরা কঠিন। তাই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করছি মূলত অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতিতে।
কংগ্রেসের ইশতেহারে আর্থিক প্রতিশ্রুতি: ২০২৪
৭ এপ্রিল নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে ক্ষমতায় এলে তারা কোন কোন ক্ষেত্রে কী কী সংস্কার করবে। জাতীয় কংগ্রেসের অভিমত ১০ বছরের বিজেপি শাসনকালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের ন্যায়-ব্যবস্থা৷ তাই কংগ্রেস তাদের ইশতেহারের নাম দিয়েছে ‘ন্যায়পত্র’। এখানে গুরুত্ব পেয়েছে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধির ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রার ৫টি মূল স্তম্ভ— যুবসমাজ, কৃষক, মহিলা, শ্রমিক ও প্রান্তিক মানুষদের কথা। এই দলের ইশতেহারের মূল ভিত্তি— ‘কাজ’, ‘স্বাস্থ্য’ ও ‘জনকল্যাণ’। ইশতেহারে অর্থনীতি সংক্রান্ত যা বলা আছে:
- ভারতের ২৩ কোটি মানুষ আজও দারিদ্র্যসীমার নিচে। তাই কংগ্রেসের ‘ন্যায়’ প্রকল্পের লক্ষ্য এবার ‘গরিবি হঠাও’ নয়, ‘গরিবি মিটাও’। ক্ষমতায় এলে জাতীয় কংগ্রেস ১০ বছরের মধ্যে ২৩ কোটি মানুষের অভাব দূর করবে।
- কংগ্রেসের ম্যানিফেস্টোতে কর্মসংস্থান গুরুত্ব পেয়েছে। ৩০ লাখ সরকারি শূন্যপদে নিয়োগের পাশাপাশি শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্য পরিকাঠামো উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করবে তারা।
- মহিলাদের ক্ষমতায়নে ‘মহালক্ষ্মী প্রকল্প’ চালু করার কথা ঘোষণা করেছে কংগ্রেস। উপরন্তু ভারতের প্রতিটি অতি-দরিদ্র পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক মহিলাকে বার্ষিক ১ লাখ টাকা আর্থিক সাহায্য দেবে তারা।
- আয়ের অসমতা দূর করতে প্রতিটি দরিদ্র পরিবারের জন্য মাসিক ন্যূনতম আয় নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হবে।
- ফসল উৎপাদনকারী কৃষকদের স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) দেওয়ার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কৃষকদের দীর্ঘদিনের দাবি এমএসপি-র আইনি স্বীকৃতিকে মান্যতা দেওয়া হবে।
- অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারগুলির জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণ নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে৷
- ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ‘ক্যাশলেস স্বাস্থ্যবিমা’, মহিলাদের আর্থিক সহায়তা, এসসি, এসটি ও ওবিসিদের জন্য ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সংরক্ষণের ঘোষণা করা হয়েছে।
- ১৯৯০-৯১ থেকে জিডিপি-র বৃদ্ধি প্রতি ১০ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। এই হিসেবে জিডিপি-র পরিমাণ ২০২৩-২৪ সালে ২০০ লাখ কোটি টাকা হওয়ার কথা। অথচ তা ১৭৩ লাখ কোটি টাকায় এসে থেমে গেছে। কংগ্রেসের দাবি বিজেপির অদক্ষ পরিচালনার ফলে এমনটা হয়েছে। কংগ্রেস বৃদ্ধির হার বাড়িয়ে আগামী ১০ বছরে জিডিপি দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বিজেপি-র ইশতেহারে আর্থিক প্রতিশ্রুতি: ২০২৪
ভারতীয় জনতা পার্টির নির্বাচনী ইশতেহারের নাম ‘মোদির গ্যারান্টি’। মূলত সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে বিজেপি-র এবারের সঙ্কল্পপত্র। ১৪টি বিষয়ে তারা জোর দিয়েছে। বিকশিত ভারতের চারটি স্তম্ভ— নারীশক্তি, যুবশক্তি, কৃষক ও দরিদ্রদের উন্নতির লক্ষ্যে বিজেপি আগামীতে কাজ করবে বলে ঘোষণা করেছে। মানুষের আত্মমর্যাদা ও জীবনযাত্রার গুণগত মান বাড়াতে সরকার সব বাড়িতে পাইপযুক্ত গ্যাস এবং সৌরবিদ্যুৎ বিনামূল্যে পৌঁছে দেবে। ইশতেহারে আর্থিক সুবিধার যে বিষয়গুলি গুরুত্ব পেয়েছে তা হল:
- গরিবদের বাড়িতে বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ সরবরাহ।
- ৩ কোটি গ্রামীণ মহিলার ক্ষমতায়ন ঘটাতে তাদের লাখপতি দিদি করে তোলা।
- সেবাক্ষেত্রে মহিলা স্ব-নির্ভর গোষ্ঠী তৈরির পাশাপাশি স্ব-নির্ভর গোষ্ঠীর মহিলা উদ্যোক্তাদের জন্য বাজারকে প্রসারিত করা।
- কাজে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে মেয়েদের আগ্রহ বাড়াতে শিল্পাঞ্চল, বাণিজ্যিককেন্দ্রের কাছাকাছি মহিলা হোস্টেল এবং শিশুদের ক্রেশের ব্যবস্থা করা হবে।
- মহিলাদের স্বাস্থ্য ও সার্বিক উন্নতিতে জোর দেওয়া হবে।
- ক্ষতিগ্রস্ত চাষির কাছে পিএম ফসলবিমার সুযোগ দ্রুত পৌঁছে দিতে এই বিমাকে আরও বেশি প্রযুক্তিনির্ভর করে তোলা হবে।
- সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এমএসপি-র বৃদ্ধি ঘটানো হবে।
- কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কীটনাশক ব্যবহার, সেচ ব্যবহার, মাটি পরীক্ষা ও আবহাওয়ার পূর্বাভাসে ‘ভারত কৃষি স্যাটেলাইট’ নামের দেশীয় প্রযুক্তির প্রয়োগ করা হবে।
- ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও এমএসএমই-রা যাতে ব্যবসাকে প্রসারিত করতে পারে তার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
- ভারতীয় অর্থনীতিকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত করা হবে।
এ তো গেল আর্থিক প্রতিশ্রুতির দীর্ঘ তালিকা। আগামী দিনে দেশের জনগণ কোন সুযোগসুবিধাগুলি পেতে পারেন তা নির্ভর করছে কোন দল ক্ষমতায় আসবে তার উপর— যে-প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে ৪ জুনের পর। কিন্তু প্রতিশ্রুতি পূরণ হবে কিনা তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলির সদিচ্ছার উপর। এই প্রশ্নের উত্তর জানতে অপেক্ষা করতে হবে দীর্ঘ ৫ বছর।
পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪
২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশের সরকার চালাচ্ছে বিজেপি। অভিজ্ঞতা বলছে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির গুরুত্ব বিজেপির কাছে কখনওই তেমনভাবে ছিল না, যা স্পষ্ট হয়েছিল গত নির্বাচনের আগে। ২০১৯ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি তাদের ইশতেহার প্রকাশ করেছিল প্রথম পর্বের নির্বাচনের মাত্র ৩ দিন আগে। এবারেও তারা নির্বাচন শুরুর ঠিক ৫ দিন আগে ইশতেহার প্রকাশ করল। বিজেপির কাছে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির গুরুত্ব ঠিক কতখানি তা খুঁজতে ফিরে যেতে হবে ২০১৯ সালে। এবার দেখা যাক ১৭তম লোকসভা নির্বাচনের আগে তারা কী কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং তার কতটুকু রাখতে পেরেছে। এখানেও আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে শুধুমাত্র আর্থিক প্রতিশ্রুতি।
বিজেপি-র ইশতেহারে আর্থিক প্রতিশ্রুতি: ২০১৯
২০১৯ সালে বিজেপির ইশতেহারের নাম ছিল ‘সঙ্কল্পিত ভারত সশক্ত ভারত’। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে (২০২২ সাল) বিশেষ ৭৫টি মাইলফলক ছোঁয়ার প্রতিশ্রুতি ইশতেহারে আলাদা করে বলা থাকলেও বিজেপি প্রধানত জাতীয় নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। তাদের ইশতেহারে অর্থনীতির যে-বিষয়গুলি গুরুত্ব পেয়েছিল:
- ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করা।
- প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষকদের (২ হেক্টর পর্যন্ত জমির মালিক) আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে পিএম-কিসানের পরিধি বাড়ানো।
- ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য পেনশন প্রকল্প চালু করা।
- ১০০০০টি নতুন ‘এফপিও’ তৈরি।
- আগামী পাঁচ বছরে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের শতাংশকে এক অঙ্কে নামিয়ে আনা।
- কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্র যেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে সেগুলিকে অতিরিক্ত আর্থিক সহায়তা দেওয়া। প্রতিরক্ষা এবং ফার্মাসিউটিক্যালস-এর মতো ক্ষেত্রগুলিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যবহার করা।
- মহিলাদের নেতৃত্বে উন্নয়ন, মহিলাদের জন্য সমান অধিকার সুনিশ্চিত করা, ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ এবং সৌভাগ্যের মতো কর্মসূচির উন্নতিতে জোর দেওয়া হয়েছিল। পাঁচ বছরে মহিলাদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির পাশাপাশি গ্রামীণ ও আধা-গ্রামীণ এলাকায় মহিলাদের আর্থিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি ছিল। মহিলা উদ্যোক্তাদের জন্য দেওয়া ঋণের ৫০ শতাংশ গ্যারান্টির দায়িত্ব সরকার নেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
- উৎপাদন বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইশতেহারে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। কোম্পানি আইনকে শক্তিশালী করে একটি নতুন শিল্পনীতির প্রতিশ্রুতিও সেখানে ছিল— যার লক্ষ্য ছিল ‘ইজ অফ ডুয়িং’ বিজনেস সূচকে ভারতের স্থানকে উন্নত করা।
- দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা এনে আগের তুলনায় জিডিপি-র বৃদ্ধি। ২০২৫ সালের মধ্যে ভারতকে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করা।
বিজেপির ২০১৯-এর প্রতিশ্রুতি: বাস্তবে কী হল
এখন দেখা যাক ২০১৯ সালের বিজেপির এই প্রতিশ্রুতি কতটা পূর্ণ হল।
- ২০১৮-১৯ সালে, কৃষকের গড় মাসিক আয় ছিল ১০,২১৮ টাকা। ২০২২ সালে তা দ্বিগুণ হলে সেই পরিমাণ অন্ততপক্ষে কুড়ি হাজার হওয়ার কথা। তা হয়নি। যেটুকু আয় হয়েছে তার সিংহভাগ এসেছে মজুরি থেকে। এর অর্থ হল, কৃষকদের একটা ভাল অংশ দিনমজুরে পরিণত হয়েছেন। ২০২৩-২৪ সালের বাজেটে কৃষির বরাদ্দ আগের তুলনায় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম কমার ফলে এই আর্থিক বছরে সারের উপর ভর্তুকিও ২২.২ শতাংশ কমানো হয়। মার্কেট ইন্টারভেনশন স্কিম এবং প্রাইস সাপোর্ট স্কিমে বরাদ্দ নামমাত্র করা হয়েছে। এই সব কটি প্রকল্পই কৃষিপণ্যের সরকারি ক্রয় কর্মসূচির নির্ণায়ক— যা কৃষকের আয় বাড়াতে সাহায্য করে। অর্থাৎ, সামগ্রিক কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার লক্ষ্যটি সরকারের ভাবনা থেকে বেরিয়ে গেছে।
- ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি কৃষকদের এই বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তাঁরা সরকার গঠন করতে পারলে ন্যাশানাল ফার্মার্স কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য স্থির করবেন। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রাখা হয়নি।
- স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ কার্যকরী না হওয়ায় ২০১৫-১৬ থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত সরকার শুধুমাত্র ধানের ক্ষেত্রেই ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বাবদ কৃষকদের ২৩৭ হাজার কোটি টাকা কম দিয়েছে। একইভাবে, গমের ক্ষেত্রে কৃষকদের কম দিয়েছে ৫৮,৪৬০ কোটি টাকা। শুধু ধান ও গমেই কৃষকরা ২৯৬ হাজার কোটি টাকা কম পেয়েছেন। সরকার কৃষককে ফাঁকি দিয়ে যে তহবিল গড়েছেন সেই টাকায় কৃষকদের অনুদান দেওয়ার হচ্ছে। এ-থেকেই পরিষ্কার গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো করছে সরকার।
- ২০১৯-২০ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে কৃষকের আয় বাড়াতে নতুন ১০০০০টি এফপিও গঠন ও উন্নয়নের কথা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত নতুন ২২৫৭টি এফপিও গঠিত হলেও তা এখনও পুরোদমে কাজ শুরু করেনি। বর্তমানে দেশে নথিভুক্ত এফপিও-র সংখ্যা নতুন-পুরনো মিলিয়ে মোট ৭০৫৯টি।
- ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের পেনশনের বিষয়টিও বিশ বাঁও জলে। এমএসপি-র আইনি স্বীকৃতির দাবিতে সিঙ্ঘু সীমান্তে চাষিরা আন্দোলন করছেন। অন্যান্য দাবির সঙ্গে তাঁদের পেনশনের দাবিটিও আছে।
- কৃষক-কল্যাণে ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি না রাখলেও সংস্কারের নামে কৃষিকে কর্পোরেট হাতে তুলে দিতে সরকার কৃষি আইন চালু করেছিল। যদিও কৃষকদের আন্দোলনের চাপে তা প্রত্যাহার করে নিতে সরকার বাধ্য হয়।
- দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের শতাংশকে এক ডিজিটে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়িত হয়নি। ২০২৩ সালের শেষে এই হার ১১.২৮ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। মোট সংখ্যার হিসেবে ভারতে এখনও ২৩ কোটি মানুষ দরিদ্র।
- ইশতেহারে কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রকে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়েছিল যার হাত ধরে অর্থনীতির অগ্রগতি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কিন্তু ২০১৯ সালে বেকারত্বের হার যেখানে ৫.২৭ শতাংশ ছিল ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তা বেড়ে হল ৮.১১ শতাংশ। এর মধ্যে ২০-২৪ বছর বয়সীদের বেকারত্বের হার ৪৪.৪৯ শতাংশ এবং ২৫-২৯ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে এই হার ১৪.৩৩ শতাংশ। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে বলা হয়েছিল ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলির প্রসার ঘটিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। আজ জলের মতো পরিষ্কার কর্মসংস্থান নয়, ইলেকটোরাল বন্ডে টাকা আদায়ের জন্যই এদের বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়েছিল।
- মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে কর্মসংস্থান, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেশের অর্থনীতিকে রপ্তানি-নির্ভর করে তোলার প্রতিশ্রুতি ছিল নির্বাচনী ইশতেহারে। কিন্তু দুঃখের কথা এই যে ‘ইজ অফ ডুয়িং’ বিজনেসের ক্ষেত্রে যেখানে ২০১৯ সালে ভারতের স্থান ছিল ৬৩ নম্বরে ২০২৩ সালে তার বড় একটা হেরফের হয়নি।
- ২০২৫ সালের মধ্যে ভারতকে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত করার স্বপ্ন পূরণ হবে বলে মনে হয় না কারণ ২০২৩ সালের শেষে ভারতীয় অর্থনীতির আয়তন ছিল মাত্র ৩.৭৩২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
পড়ুন, গুজরাত গণহত্যার বিচার হয়নি
অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির বিচারে গত ৫ বছরে বিজেপি সরকার ইশতেহারী প্রতিশ্রুতির ধার দিয়েও যায়নি— পরিসংখ্যান তেমনই বলছে। তবে ১৮তম নির্বাচনের আগে ইশতেহার প্রকাশ করতে গিয়ে বিজেপি বলেছে গত ১০ বছরে তাদের দেওয়া সমস্ত প্রতিশ্রুতিই তারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে!
ইশতেহার: কংগ্রেসের অতীত সাফল্য
প্রশ্ন হল, কংগ্রেসের দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির গ্রহণযোগ্যতা কতখানি? ২০০৪ ও ২০০৯-এ কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি আমজনতার স্মরণে থাকার কথা নয়। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের পর্যালোচনা বলছে, ২০০৪-২০১৪— এই ১০ বছর ইউপিএ সরকার অনেকটাই ইশতেহারমুখী ছিল, বিশেষ করে অর্থনীতির বিষয়গুলিতে।
- গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা বাড়াতে মহাত্মা গান্ধি ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট-এর সফল রূপায়ণ কংগ্রেস ইশতেহারের বড় সাফল্য। এই প্রকল্প অনুযায়ী কোনও আর্থিক বছরে প্রতিটি গ্রামীণ পরিবারের একজন প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য কমপক্ষে ১০০ দিনের কাজ পাবেন। ২০১৫ সালে এনসিএইআর-এর সমীক্ষায় দেখা গেছে যে মনরেগা তে ২০০৪-০৫ সাল থেকে ২০১২-১৩ সালের মধ্যে ১৪ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যের হাত থেকে নিস্তার পেয়েছেন। ২০০৬ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পে ২০১২-১৩ পর্যন্ত প্রায় ৪.৯৮ কোটিরও বেশি গ্রামীণ পরিবারের কর্মসংস্থান হয়েছে।
- কংগ্রেস সরকারের আরও একটি সাফল্য খাদ্য নিরাপত্তা আইন পাশ। খাদ্য নিরাপত্তা আইনে অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনার মাধ্যমে দরিদ্রতম পরিবারগুলিকে মাসে ৩৫ কেজি খাদ্যশস্য ভর্তুকিমূল্যে দেওয়া হয়েছে এবং অন্যান্য দরিদ্র পরিবারকে ভর্তুকিযুক্ত হারে জনপ্রতি মাসিক ৫ কেজি খাদ্যশস্য পাওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। ইউপিএ আমলে খাদ্যে ভর্তুকি তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এতে গ্রামীণ জনগণের ৭৫ শতাংশ ও শহুরে মানুষের ৫০ শতাংশ ‘লক্ষ্য নির্ধারিত সরকারি গণবণ্টন ব্যবস্থায়’ ভর্তুকিতে খাদ্যশস্য পেয়েছেন।
- গর্ভবতী ও সদ্য মা হওয়া মহিলাদের খাবার এবং মাতৃত্বকালীন সুযোগসুবিধার জন্য ন্যূনতম ৬০০০ টাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
- কৃষক কল্যাণে ২০০৪ সাল থেকে গম এবং ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দ্বিগুণ করা হয়েছিল। ২০১২-১৩ সাল পর্যন্ত ৬৫০ লক্ষ্যের বেশি কৃষককে ব্যাঙ্ক ঋণ দেওয়া হয়েছিল।
- ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে মাথাপিছু আয় প্রায় তিনগুণ বেড়েছিল। বিশ্বব্যাপী দুটি মন্দা সত্ত্বেও ইউপিএ সরকারের আমলে দেশে গড় জিডিপি-র বৃদ্ধি হয়েছিল ৭.৭ শতাংশ।
- দারিদ্র্যের হার গড়ে বার্ষিক দুই শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল।
- ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের বিনা পয়সায় বাধ্যতামূলক শিক্ষার আওতায় আনতে চালু হয়েছিল রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট। এর ফলে বিদ্যালয়শিক্ষায় ড্রপ-আউটের হার কমেছে এবং শিক্ষার প্রসার অনেকটাই হয়েছে।
- জনস্বাস্থ্যে ধারাবাহিক বিনিয়োগ শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়েছে।
এখন অপেক্ষা মানুষ কার প্রতিশ্রুতিতে ভরসা করেন। বিজেপি-র ‘মোদির গ্যারান্টি’তে না কংগ্রেসের ‘ন্যায়পত্রে’। মোদির গ্যারান্টি আসলে ব্যক্তিপূজন। অন্যদিকে ন্যায়পত্র অনেকটাই দলীয় প্রতিশ্রুতি। আগামী ৪ জুন যদি দেখা যায় মানুষ ব্যক্তিপুজোয় রায় দিয়েছেন তাহলে বুঝতে হবে ইশতেহারের মৃত্যুঘন্টা বাজল। আর দলীয় প্রতিশ্রুতির জয় হলে ভারতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাবে নির্বাচনী ইশতেহার বা ম্যানিফেস্টো।
*মতামত ব্যক্তিগত