Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গুজরাত গণহত্যার বিচার হয়নি: রাহুল শর্মার কথা

প্রদীপ দত্ত

 


২০০২ সালের ফেব্রুয়ারির ২৭ থেকে ৪ মার্চ পর্যন্ত মোবাইল ফোনের যে কলরেকর্ড তিনি সংগ্রহ করেছিলেন তা থেকে বোঝা যায়, গণহত্যা চলাকালীন দাঙ্গাকারীদের সঙ্গে পুলিশ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোর্ধন জাডাফিয়া এবং মুখ্যমন্ত্রীর অফিসের কথাবার্তা হয়েছিল। দাঙ্গার সময় বহু নিরীহ মুসলমানের প্রাণ বাঁচিয়েছেন বলে তিনি অনেকের কাছেই হিরো হয়ে উঠেছিলেন। ২০০২ সালে গুজরাতের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান জিসি রায়গড় রাণা আয়ুবকে বলেছিলেন, মুসলমানদের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন এবং শাসক দলের লোককে গ্রেফতার করেছিলেন বলে রাহুলকে নাজেহাল করা হয়েছিল

 

পূর্ব-প্রসঙ্গ: সতীশচন্দ্র ভার্মার কথা

রাহুল শর্মা ২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের ২৬ পর্যন্ত ভাবনগর জেলার এসপি ছিলেন। গুজরাত দাঙ্গার তৃতীয় দিন, ২ মার্চ প্রায় দশ হাজার দাঙ্গাকারী ভাবনগরের শহরতলির এক মাদ্রাসায় আগুন লাগাতে আসে। সেখানে ৪৫৫ জন আবাসিক ছাত্রছাত্রী ছিল। রাহুল গুলি চালানোর আদেশ দেন। চারজনের মৃত্যু, কয়েকজন আহত হওয়ার বিনিময়ে নাবালক-নাবালিকা ছাত্রছাত্রীদের প্রাণ বাঁচে। এরপর তাদের শহরের নিরাপদ স্থানে তুলে আনা হয়।

সেদিনই দুষ্কৃতিরা এক মসজিদ আক্রমণ করলে ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য প্রবল চাপ তৈরি হলেও রাহুল গ্রেফতার করা সঙ্ঘ পরিবারের ২১ জনকে আক্রমণকারীকে মুক্তি দেননি, তারা পুলিসের হেফাজতেই ছিল। রাহুলের কঠিন পদক্ষেপের জন্যই ভাবনগরে দাঙ্গা পরিস্থিতি শান্ত হয়।

সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এলকে আদবানি লোকসভায় রাহুলের সপ্রশংস উল্লেখ করেন। তবে নরেন্দ্র মোদি খুশি হননি। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার সাংবাদিক কিংশুক নাগকে তিনি বলেন, রাহুল সস্তার প্রচার চায়, তাই হিরোসুলভ পদক্ষেপ করেছে। গুজরাতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোর্ধন জাডাফিয়া বলেন, পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর অনুপাত ঠিক ছিল না। এর অর্থ, ভাবনগরে মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুরাই মারা গেছে বেশি। স্থানীয় গুজরাতি পত্রিকাও আক্ষেপ করে, ভাবনগরে হিন্দুরা গোধরায় ট্রেন জ্বালানোর প্রতিশোধ নিতে পারেনি।

এরপর মার্চের শেষদিকে রাহুলকে ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) হিসেবে আমেদাবাদের কন্ট্রোল রুমে স্থানান্তর করা হয়। তাঁকে ক্রাইম ব্রাঞ্চের গুলবার্গ সোসাইটি এবং নারোদা পাটিয়া, নারোদা গাম মামলায় সাহায্য করতে বলা হয়। সবক্ষেত্রেই দাঙ্গাকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের মদতের অভিযোগ ছিল। আমেদাবাদের পুলিশ কমিশনার পিপি পান্ডে তখন ক্রাইম ব্রাঞ্চের প্রধান। রাহুল প্রস্তাব দেন, দাঙ্গার সময়ে আমেদাবাদ ও তার আশপাশের অঞ্চলের মোবাইল ফোনে কথা বলার রেকর্ড পরীক্ষা করা দরকার। কারণ তিনি বুঝেছিলেন এই উপায়েই কারা দাঙ্গায় মদত দিয়েছে, মন্ত্রী, পুলিশ অফিসার ও আমলারা কতটা জড়িত বোঝা যাবে। সেই অনুযায়ী স্থানীয় ফোন কোম্পানি এটিঅ্যান্ডটি ওয়্যারলেস এবং সেলফোর্সের কাছে মোবাইল ফোনকলের রেকর্ড চাওয়া হয়। পুলিশ কমিশনার পিপি পান্ডে ওই তথ্যপরীক্ষার ভার দেন রাহুলকে। সেই কাজের জন্য রাহুল নিজের বাড়ির কম্পিউটারে ফোনকলের সিডি কপি করে নেন। সিডি হাতে পাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে, ফোনকলের তথ্য বিশ্লেষণ শেষ করার আগেই জুলাইয়ের গোড়ায় তাঁকে সুরাটের কাছে ভব শহরে স্থানান্তরিত করা হয়।

পরের বছর আগস্ট মাসে তিনি সিআইডি (ক্রাইম) বিভাগে যোগ দেন। আমেদাবাদের ক্রাইম ব্রাঞ্চ গণহত্যার তদন্তে সংখ্যালঘু-বিরোধী অবস্থান নিলে তিনি তার প্রতিবাদ করেন। এরপর ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে তাঁকে সিবিআইয়ের এসপি হিসাবে ডেপুটেশনে পাঠানো হয়। তিন বছর সিবিআই-এ থাকার পর তাঁকে এসআরপিএফের কমান্ডান্ট পদে স্থানান্তর করা হয়। পরে ডিআইজি (সশস্ত্র বাহিনি) হিসেবে রাজকোটে ছিলেন। ২০১৫ সালে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে তিনি গুজরাত হাইকোর্টে আইনজীবীর পেশা বেছে নেন।

 

পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪

 

তিনি আমেদাবাদ থেকে চলে আসার পর সিআইডি (ক্রাইম) বিভাগের সিডিগুলি ‘হারিয়ে যায়’। রাহুল জানান, বেয়ারার মারফত নির্ধারিত সিডিগুলি তিনি পিপি পান্ডেকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কয়েক বছর পর ক্রাইম বিভাগ দাবি করে যে, রাহুল সিডিগুলো জমা করেননি। ২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে নিজের কম্পিউটারে রাখা সেই তথ্য দুটি সিডিতে কপি করে তিনি নানাবতী কমিশনের প্যানেলে জমা দেন, যা কমিশন সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করে। এই ঘটনায় সাড়া পড়ে যায়। পরে তিনি সুপ্রিম কোর্ট-নিযুক্ত সিট-কেও (স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম) সিডি-বন্দি মোবাইল ফোনকলের রেকর্ড জমা দেন। গোধরা ট্রেন জ্বালানো বিষয়ে তদন্তকারী বিচারপতি ইউসি ব্যানার্জি কমিশনেও[1] সেই সিডি জমা দেন। মন্ত্রী, পুলিশ অফিসার ও আমলাদের মোবাইল ফোনকলের রেকর্ড সাক্ষ্য হিসাবে জমা দেওয়ার পর থেকেই সরকার তাঁকে নানাভাবে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে।

গুজরাত সরকার ২০১১ সালের আগস্ট মাসে রাহুলকে চার্জশিট দেয়। রাহুলের অপরাধ, প্রশাসনকে না জানিয়ে নানাবতী-মেহতা কমিশনে ফোনকল রেকর্ড জমা দিয়েছেন। চার্জশিটে বলা হয়, রাহুলকে ২০০২ সালের ২৮ মে নারোদা গণহত্যার তদন্তে পুলিশ কমিশনারকে সাহায্য করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু বলার আগেই তিনি ১৪ থেকে ২৫ মে-র ফোনকলের রেকর্ড সংগ্রহ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অননুমোদিত তথ্য সংগ্রহের অভিযোগ আনা হয়, সঙ্গে তদন্তকারী অফিসারকে না জানিয়ে ফোনকলের রেকর্ড কপি করার অভিযোগ। ওদিকে সরকারের শোকজ নোটিসের উত্তর দিতে কাজে লাগবে এমন কিছু রেকর্ড তাঁকে দেওয়া হচ্ছে না বলে তাঁর রিট পিটিশন গুজরাত হাইকোর্ট বাতিল করে। এরপর ওই তথ্য পাওয়ার জন্য তিনি আরটিআই করেন।

ডিটেকশন ক্রাইম ব্রাঞ্চ সিট-এর কাছে রাহুল, শ্রীকুমার ও তিস্তা শেতলওয়াড়ের বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করলে সিট তাঁদের ডেকে পাঠায়। রাহুলের সঙ্গে তিস্তার কতটা যোগাযোগ রয়েছে তা নিয়ে সিট তিন ঘন্টার বেশি জেরা করে।

সরকারের চেষ্টা ছিল গণহত্যার সঙ্গে পুলিশ, রাজনীতিক ও সরকারের যোগের কথা যেন বাইরে প্রকাশ না পায়। তাই সরকার ওই সিডির নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এরই মধ্যে ডিআইজি হিসাবে রাহুলের ভাদোদরায় পোস্টিং হয়। ২০১৩ সালে ডেঙ্গুতে স্ত্রীবিয়োগের পর রাহুল বাড়িতে তাঁর শিশুপুত্র ও অসুস্থ মা-র কথা ভেবে আমেদাবাদ অথবা গান্ধিনগরে স্থানান্তরিত হতে চাইলেও তা মঞ্জুর হয়নি। শেষে ২০১৪-র নভেম্বরে চাকরি থেকে স্বেচ্ছাবসরের জন্য ৩ মাসের নোটিস দেন। পরের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার তাঁর ইস্তফা মঞ্জুর করে। অবসরের পরও গুজরাত সরকার তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনে। রাহুল তাঁর ড্রাইভার ও দেহরক্ষীকে তিন হাজার টাকা মহার্ঘ্য ও ভ্রমণ ভাতা দিয়েছেন, সরকারি গাড়িতে ব্যাক্তিগত ভ্রমণের হিসাব দিতে তিন মাস দেরি করেছেন— এইসব অভিযোগে শোকজ নোটিস পেলেন।

ওদিকে রাহুল জানান, সিডি অস্থানে রেখেছেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক বিভাগীয় প্রক্রিয়া শুরু করে সরকার যে চার্জশিট দিয়েছিল, ২০১৬ সালের ২২ জানুয়ারি সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবুনাল (সিএটি বা ক্যাট) তা বাতিল করেছে এবং জানিয়েছে যে তাঁর বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের মামলাটি “অবৈধ, স্বেচ্ছাচারিতায় রঙিন, ক্ষতিকর আচরণে কলঙ্কিত, বিদ্বেষ এবং বিদ্বেষ দ্বারা রংচড়ানো।” কারণ সিডিতে মোবাইল ট্র্যাকিং রেকর্ডস চেপে গেলে আসল অপরাধীদের সুবিধা হয়, রাহুলের নয়। ক্যাটের ওই রায়ের পর রাজ্য সরকার তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকটি শোকজ নোটিস তুলে নেয়।

এই পর্ব নিয়ে রাণা আয়ুব তাঁর ‘গুজরাত ফাইলস: অ্যানাটমি অফ কভার আপ’ বইটিতে লিখেছেন: গুজরাত সরকার সিনিয়র আইপিএস অফিসার রাহুল শর্মাকে নোটিস জারি করে, কেন তিনি অনুমোদন ছাড়াই সিনিয়র রাজনীতিবিদ ও আমলাদের ফোনের রেকর্ড তদন্ত কমিশনের হাতে তুলে দিয়েছেন। দাঙ্গার ন-বছর পর সেই নোটিসে বলা হয় কেন তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে না। রাণা আয়ুব আবাক হয়ে লিখেছেন, অথচ সিট নিজেই অভিযোগ করেছে যে মোদি সরকার দাঙ্গার সময় গুরুত্বপূর্ণ মিটিঙের রেকর্ড বা মিনিটস রাখেনি।

২০০২ সালের ফেব্রুয়ারির ২৭ থেকে ৪ মার্চ পর্যন্ত মোবাইল ফোনের যে কলরেকর্ড তিনি সংগ্রহ করেছিলেন তা থেকে বোঝা যায়, গণহত্যা চলাকালীন দাঙ্গাকারীদের সঙ্গে পুলিশ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোর্ধন জাডাফিয়া এবং মুখ্যমন্ত্রীর অফিসের কথাবার্তা হয়েছিল। অথচ সরকার অভিযোগ করে যে, কিছু নথি সঠিক নয়, তদন্তকারী প্যানেলকে রাহুল যে সিডি দিয়েছিলেন তাতে ভেজাল রয়েছে।

দাঙ্গার সময় বহু নিরীহ মুসলমানের প্রাণ বাঁচিয়েছেন বলে তিনি অনেকের কাছেই হিরো হয়ে উঠেছিলেন। রাণা আয়ুবের বইয়ে তার উল্লেখ রয়েছে। ২০০২ সালে গুজরাতের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান জিসি রায়গড়[2] আয়ুবকে বলেছিলেন, মুসলমানদের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন এবং শাসক দলের লোককে গ্রেফতার করেছিলেন বলে রাহুলকে নাজেহাল করা হয়েছিল।

বিপদের কথা মাথায় রেখেও গুরুত্বপূর্ণ ফোনকলের রেকর্ড নানাবতী-মেহতা কমিশন-সহ কয়েক জায়গায় জমা দেওয়াটা বিরাট দুঃসাহসিক কাজ। সরকার ওই কাজের জন্যই অবসর নেওয়ার পরও বার বার শোকজ নোটিস দিয়েছে, মামলা করেছে, নাজেহাল করেছে। কিন্তু আইনটাও তাঁর ভালই জানা ছিল, সরকারের আক্রমণ অবলীলায় সামলেছেন। অবসর নিয়ে আইনজীবী হিসাবে তিনি গুজরাত হাইকোর্টকেই বেছে নিয়েছেন।

 

Reference:

 

 

[পরের পর্ব – সঞ্জীব ভাট-এর কথা]


[1] ২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সবরমতি এক্সপ্রেসের ৬ নম্বর কোচে আগুন ধরার কারণ নিয়ে ২০০৬ সালে ইউসি ব্যানার্জি কমিশন প্যানেল রিপোর্টে জানায় আগুন ধরার কারণ কোনও পরিকল্পনা নয়, দুর্ঘটনা।
[2] পরে অতিরিক্ত ডিআইজি হয়েছিলেন।