Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

‘হিন্দুরাষ্ট্র’ নয়, ধর্মীয় সহাবস্থানই চান অধিকাংশ ভারতবাসী

শ্রীরূপা বন্দ্যোপাধ্যায়

 


সত্যিই কি দেশে ধর্মীয় সহনশীলতা আজ বিপন্ন? সত্যিই কি 'হিন্দুরাষ্ট্র'-এর স্লোগানে সোচ্চার হয়ে উঠতে চাইছেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ? সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা জোর গলায় উত্তর দিচ্ছে— না। তাদের রিপোর্ট বলছে, আজও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভারতকে শুধু হিন্দুদের নয়, সমস্ত ধর্মের মানুষেরই দেশ বলে মনে করেন। সমীক্ষা-রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ৭৯ শতাংশই মনে করেন ভারত শুধু হিন্দুদের নয় সমস্ত ধর্মের মানুষেরই দেশ

 

হেথায় আর্য, হেথা অনার্য
হেথায় দ্রাবিড়, চীন—
শক-হুন-দল পাঠান মোগল
এক দেহে হল লীন।

‘ভারততীর্থ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ এই ভাষাতেই ফুটিয়ে তুলেছিলেন ভারতের হৃদয়ভূমির স্বরূপ। শত সহস্র বছর ধরে ভারত নানা দেশ থেকে আসা নানা ধর্মের মানুষের আশ্রয়ভূমি, কালক্রমে যা হয়ে উঠেছে তাদের প্রিয়তম স্বদেশ। সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির হাজারো উত্থান-পতন, ঝড়-ঝাপটা সহ্য করে ভারতীয়রা যুগের পর যুগ পাশাপাশি বাস করে এসেছেন। প্রতিবেশী-বন্ধুর ভূমিকা পালন করে গেছেন। একে অপরের উৎসবে যেমন আনন্দে মেতেছেন, আপদে-বিপদেও পরস্পরের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত। এর অসংখ্য প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে ভারতের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সমস্ত ক্ষেত্রে।

কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে উগ্র হিন্দুত্ববাদের আঘাত-আস্ফালন বারবার যেন চিড় ধরাতে চাইছে ধর্মীয় সহাবস্থানের সেই চিরচেনা ছবিটিতে। সংবিধানে ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় প্রকল্প উদ্বোধন থেকে শুরু করে নানা সরকারি কার্যকলাপে স্বাধীন ভারতে বহুবারই সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মটির রীতিনীতি পালিত হতে দেখা গেছে। কিন্তু কেন্দ্রে বিজেপি সরকার গঠিত হওয়ার পর সেই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রাবল্য বড় বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাঁর গোটা সরকারকে নিয়ে মেতে উঠছেন হিন্দু মন্দির প্রতিষ্ঠায়! কে কী খাবে, কী পরবে— সে-সব নিতান্ত ব্যক্তিগত বিষয়েও জারি হতে দেখা যাচ্ছে সরকারি ফতোয়া। বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে গোমাংস রাখার অজুহাতে যখন তখন স্রেফ সন্দেহের বশে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা তো আকছার ঘটছে! পুলিশ-প্রশাসনের সহযোগিতায় অবাধে পার পেয়ে যাচ্ছে দাঙ্গাবাজ হিন্দুত্ববাদী নেতা। অন্যদিকে স্রেফ সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষ হওয়ার অপরাধে পুলিশ-প্রশাসনের কোপে পড়তে হচ্ছে নিরীহ মানুষকে। প্রকাশ্য সমাবেশে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভারতকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বানিয়ে তোলার হুঙ্কার যত্রতত্র শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এ-দেশের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সুপরিচিত সুদীর্ঘ ঐতিহ্যে কোথায় যেন একটা ফাটল ধরানোর অপচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। আশঙ্কা আতঙ্ক কুরে কুরে খাচ্ছে গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন ধর্মনিরপেক্ষ শান্তিপ্রিয় ভারতীয়দের।

 

পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪

 

কিন্তু সত্যিই কি দেশে ধর্মীয় সহনশীলতা আজ বিপন্ন? সত্যিই কি ‘হিন্দুরাষ্ট্র’-এর স্লোগানে সোচ্চার হয়ে উঠতে চাইছেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ? সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা জোর গলায় উত্তর দিচ্ছে— না। তাদের রিপোর্ট বলছে, আজও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভারতকে শুধু হিন্দুদের নয়, সমস্ত ধর্মের মানুষেরই দেশ বলে মনে করেন।

এই সমীক্ষাটি করা হয়েছে লোকনীতি-সিএসডিএস-এর তরফ থেকে। সমীক্ষা-রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ৭৯ শতাংশই মনে করেন ভারত শুধু হিন্দুদের নয় সমস্ত ধর্মের মানুষেরই দেশ। তাঁরা জানিয়েছেন, সমস্ত ধর্মের মানুষের নিজের নিজের ধর্ম পালন করার অধিকার অবশ্যই রয়েছে এ দেশে।

সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী মানুষদের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কারও মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তাঁরা ভাবতে পারেন, সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষের কাছে এই উত্তরই তো প্রত্যাশিত! তাঁদের জানানো যেতে পারে, মুসলমান বা অন্য সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষই শুধু নয়, হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী অধিকাংশ মানুষও জানিয়েছেন এ-দেশ সব ধর্মের মানুষের বাসভূমি। দেখা যাচ্ছে প্রতি ১০ জনে ৮ জন হিন্দুই ভারতের ধর্মীয় সহনশীলতায় প্রবলভাবে বিশ্বাসী। মাত্র ১১ শতাংশ হিন্দু ধর্মের মানুষ জানিয়েছেন, তাঁরা মনে করেন ভারত শুধু হিন্দুদেরই।

 

পড়ুন, গুজরাত গণহত্যার বিচার হয়নি

 

এই সমীক্ষায় আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, প্রবীণদের তুলনায় তরুণরা আরও বেশি বেশি করে ভারতের ধর্মীয় সহনশীলতায়, বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সহাবস্থানে আস্থা রাখেন। ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সি তরুণ-তরুণীদের ৮১ শতাংশই বিশ্বাস করেন ভারত সমস্ত ধর্মের মানুষের দেশ। আবার ৫৬ বছর ও তার বেশি বয়সের ৭৩ শতাংশ মানুষও এই ভাবনাতেই আস্থাশীল।

আরও দেখা যাচ্ছে, স্কুলে যাওয়ার সুযোগ মেলেনি যাঁদের, তেমন ৭২ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন ভারত কখনও শুধু হিন্দুদের দেশ হতে পারে না। আর যাঁরা পড়াশোনার এবং উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁদের ৮৩ শতাংশই মনে করেন, ভারত সব ধর্মের মানুষের নিরাপদ বাসভূমি।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামায় সাধারণত শহরগুলিকেই আক্রান্ত হতে দেখা যায় বেশি। তা সত্ত্বেও এই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, গ্রামের তুলনায় শহর এবং বড় শহরগুলির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দেশের ধর্মীয় সহনশীলতায় বেশি করে ভরসা রাখেন। রিপোর্ট বলছে, গ্রামগুলির ৭৬ শতাংশ এবং শহর ও বড় শহরগুলির যথাক্রমে ৮৫ ও ৮৪ শতাংশ মানুষ ভারতকে সমস্ত ধর্মের মানুষের দেশ বলে মনে করেন।

দেশের রাজনীতির অঙ্গনে আজ যখন ধর্মের নামে অন্ধতার প্রবল দাপাদাপি, ক্ষমতার নেশায় উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিষগাছে যখন প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণে সার-জল ঢালা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি-মূল্যবোধ তো দূর, যখন মানবিক অনুভূতিগুলিকেও গলা টিপে মারতে চাইছে মতলববাজ একদল উগ্রবাদী, তখন লোকনীতি-সিএসডিএস-এর এই সমীক্ষা প্রাণে আশা জাগায়। ভরসা হয়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে সম্পৃক্ত ভারতের উদারবাদী, বিরোধী-মতসহিষ্ণু সামাজিক বুননে উল্টো ফোঁড় তোলা হিটলারের জাতভাইদের পক্ষে সহজ কর্ম নয়।

 

তথ্যসূত্র: দ্য হিন্দু, ১২ এপ্রিল, ২০২৪


*মতামত ব্যক্তিগত