অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী
…দ্বিতীয় উপকথা এখানে
সেমারগাঁও-র লিঙ্গো-পেন-এর জীবন ও তদসঙ্গে জড়িত বস্তারের গোণ্ড আদিবাসীদের দ্বারা ব্যবহৃত ১৮ রকমের বাদ্যযন্ত্রের উদ্ভবের কাহিনী শোনা যাক। ইতিহাসের গণনাতীত ধূসর পূরাকালে দণ্ডকবনের বস্তার অঞ্চলে থাকত সাত ভাই। সাত ভাই বড় হতে থাকল সেই গাঁয়ের বনে ঢাকা শান্ত ছায়ায়। বড় ছয় ভাই ছিল দামাল দুরন্ত অরণ্যসন্তান। ছোটটি ধীর-স্থির, শান্ত-শিষ্ট, জ্ঞানগম্ভীর। তার গভীর কাজলচোখে ছায়া পড়ে অরণ্যের, আকাশের ও মননের আয়নায় ফুটে ওঠে প্রজ্ঞাঋদ্ধ তারারাজি। আর তার রক্তে রক্তে বইত গানের তরঙ্গলহরী বুঝি। একসাথে বারো রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারত সে। বনের গাছপালা, পশুপাখি, পোকামাকড়েরাও বুঝি শান্ত হয়ে শুনত সেই বাজনা, ভেসে যেত সুরের প্রবাহে।
বাকি ছয়ভাই খেত-খামারের কাজ করতে লাগল দিনভর, বয়ঃক্রমে ঘর বাঁধল, বিয়ে করল। পড়ে রইল লিঙ্গো। অথচ তার গান-বাজনায় এতই মুগ্ধ ছিল তার দাদাবৌদিরা, যে তাকে ঘরের কাজ, বনের ফল-কাঠ-বীজ-শিকার জোগাড়, খেতি-বাড়ির কাজ, এমনকি রান্না-বান্নার কাজ করার জন্য বকুনি দিতে মন সইত না কারুরই। সে এ’সবের ধার ধারত না, শুধুই গাইত আর বাজাত। ক্রমে ক্রমে তিক্ত হয়ে উঠল তার ছয় দাদার গৃহী মন।
দাদারা যখন বনে যেত, ক্ষেতে যেত, ছোট ভাইটা তখন সারাদিন আপন খেয়ালে ডুবে যেতে যেতে সুরের অলীক ঝর্ণা বইয়ে চলত তারই নিজের হাতে বানানো সেই বারোটা বাজনা থেকে, আর সেই সুরের মুর্চ্ছনায় মুগ্ধ হতে থাকত তার ছয় বৌদি। দাদারা ক্রমে উঠল চটে। সারাদিন খেটেখুটে বন-ক্ষেতি থেকে ফিরে তারা দেখত নাওয়া নাই খাওয়া নাই পাগলা ভাইটা বাজিয়ে চলেছে, আর ঘরের সব কাজ ফেলে বউগুলো বাজনা শুনে চলেছে। তারা বউদের বলতে লাগল -– “তোমরাই লাই দিয়ে মাথায় তুলছ অপদার্থটাকে!” বাঁধল বিতণ্ডা ঘোর।
অনেক চেষ্টা-চরিত্র করেও তারা পারল না লিঙ্গোর গানবাজনা বন্ধ করে তার মন সংসারে ফেরাতে। তাই গোপনে ফন্দি আটল -– ‘শালাটাকে মেরেই ফেলা যাক’। প্ল্যানমাফিক, নিয়ে চলল তারা লিঙ্গোকে শিকার করা শেখাতে গভীর জঙ্গলের ভিতর। জঙ্গলের ভিতর ছিল এক শালপ্রাংশু বীজা গাছ। সেই গাছটা দেখিয়ে তারা লিঙ্গোকে বলল -– “ওই দ্যাখ, ওটার কোটরে তক্ষক লুকিয়ে আছে, উঠে গিয়ে ছুরি দিয়ে মার ব্যাটাকে, তোর বৌদিরা আচ্ছাসে ঝোল রেঁধে খাওয়াবে।” প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য তক্ষক বা গোসাপ (মনিটর লিজার্ড)-এর মাংস অত্যন্ত উপভোগ্য, এবং ফরেস্ট ডিপার্টমেণ্টের শিকার-বিরোধী উৎপাত ও তারপর পুলিশ-প্যারামিলিটারির আর্মস-অ্যাক্ট তথা নকশাল-কেসজনিত উপদ্রব আরম্ভ হওয়ার আগে বস্তারের ঘরে ঘরে এর মাংস রান্না হত এবং তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া হত। ফিরে আসি গল্পে।
তো, তক্ষক মারতে লিঙ্গো উঠে পড়ল সেই বীজা-গাছে, আর কোটরে কোটরে, ডালে-ডালে খুঁজতে লাগল তক্ষককে। ইতিমধ্যে ছয় ভাই তীর ধনুক তাক করে ঘিরে ফেলল গাছটাকে। ধনুকের ছিলা টেনে মারল এক তীর ভাইকে লক্ষ করে সটান! অথচ তীর গিয়ে লাগলো বীজা-গাছের ডালে। সেই গাছের আঠা হয় লাল রঙের। টুপটুপ করে গাছের লাল রস নীচে পড়তে দেখে দাদারা ভাবল “লক্ষ্যভেদ করেছি বটে!”
ভাইকে রেখে ছয় দাদা পত্রপাঠ চোঁ-চাঁ দে-দৌড় গ্রামের বাড়ির দিকে। বাড়ি পৌঁছে হাঁপ ছাড়ল -– ‘যাক! বাঁচা গেল! আপদ বিদেয় হয়েছে!’ তারপর বৌদের সামনে নাকিকান্না জুড়লো -–
‘অমন সোনার ভাইটা আমাদের গো! কোন জন্তু এসে নিয়ে গেলো গো!’
এদিকে বীজা গাছ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনও তক্ষকের দেখা মিলল না। সে একমনে শিকার খুঁজছিল, আর তীরটাও দাদারা ছুঁড়েছিল তার অগোচরেই। হঠাৎ লিঙ্গো দেখতে পেল, অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে; চারিদিক শুনশান, দাদাদের দেখা নেই, সাড়া নেই। অবাক হল সে। তড়তড় করে গাছ থেকে নেমে এসে মেঠোপথে হাঁটা দিল বাড়ির দিকে। কাছাকাছি এসে শোনে ঘরের ভিতর থেকে ভেসে আসছে কান্নার রোল।
পা টিপে টিপে খিড়কি দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল সে। নিঃসাড়ে কান পেতে শুনল সব কথা, বুঝল কারসাজি। রাগে দুঃখে বুঁজে এসেছে তার গলা। টুঁ শব্দটি করল না তবু। মাথা ঠাণ্ডা রাখল। চুপচাপ নিজের ঘরে এসে বসে থাকল সে। সহসা তাকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠল তার দাদাবৌদিরা। একঘর বাকরুদ্ধ ফ্যাল-ফ্যাল চোখের সামনে নির্বিকার লিঙ্গো তান দিতে লাগল তার বাদ্যযন্ত্রে, সুরের ঢেউ ছুটে চলল অন্ধকার বনের বুকে ঢেউ তুলে যে’মতো সেই।
দিন যায়, রাত যায়। ক্রমে লিঙ্গোর বিয়ে ঠিক হল এক ‘সিরহা’ বা তন্ত্রমন্ত্র জানা ম্যাজিক-হীলার তথা শামান পরিবারে। তার বউও জানত জাদুটোনার নানান উপায়-পন্থা, নানান বীজমন্ত্র। ঘরে মন টেঁকে না নতুন দম্পতির। রোজ দাদাদের গঞ্জনা, দৈনন্দিনের কলুর ঘানি -– তাতে কি আর সহজে মন টেঁকে সেই ভাবুক বাজনাদার বা তার যাদুকরী বউয়ের? দাদাদেরও কি আর তার অকর্মণ্য ভাইয়ের প্রতি খুনী রাগ সহজে মেটে? একদিন দাদারা মিলে বলেই বসল -–
‘তোমাদের আর পুষতে পারব না আমরা। তোমাদের জন্য সবার অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। তোমরা বাপু এই গ্রাম এই পরগণা ছেড়ে পাড়ি দাও ভিনমুলুকে। বিষয়সম্পত্তির বাটোয়ারা পাবে না, আগেই বলে রাখলাম। এই একটা চুম্বকের লকেট দিচ্ছি পরিবারের স্মৃতি হিসেবে। ব্যাস, আমাদের আর দায়দায়িত্ব খতম, নিজেদেরটা নিজে বুঝে নাও গে…’
সেই চুম্বক সম্বল করে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিল বর-বৌ। ক্রমে গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে, পরগণার সীমানা ছাড়িয়ে এগিয়ে চলল তারা বনের ভিতর দিয়ে। পথ যেন ফুরোতে চায় না। খিদে, তেষ্টায় জুড়িয়ে আসে শরীর, চলতে চায় না পা। তবুও, গাছের ফল-মূল খেয়ে, খড়কী নদীর, মেণ্ডকী নদীর জল, চাররে মাররে জলপ্রপাত ও অন্যান্য বুনো ঝোড়া ও কাঁদরের জল খেয়ে কোনওরকমে ভুখ-পিপাসা মেটাতে থাকল তারা। অবশেষে একটা শিমুলগাছের ছায়ায় ঢাকা গ্রামে এসে পৌঁছোল তারা। দেখল, একটা গোলায় পড়ে আছে অজস্র ধানের শীষ -– ঢেঁকিতে ঝাড়াই-মাড়াই করে অনেক আগেই চাল নিয়ে নেওয়া হয়েছে সেই সব শীষ থেকে।
সেই দেখে তারা সিদ্ধান্ত করল যে সেই শূন্য শীষ বা পোয়াল থেকেই ভিজিয়ে ভিজিয়ে কিছুটা হলেও চাল বের করে নিতে পারবে তারা। যে চাষীঘরের গোলায় তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেই চাষীকে গিয়ে বলল তাদের দুঃখের কাহিনী। সেই দুঃখ উথলে উঠলে শিমুলগাঁয়ের সেই চাষীর মন। বলল -– ‘তোমরা ঐ পোয়ালগুলো ভিজিয়ে নাও, যা চাল বেরোবে, সব তোমাদের।’
এই শুনে বরবৌ করল কি -– সেই গ্রামের মাটিতে বসাল তাদের সেই চুম্বক-লকেট। রেখে বলল -–
‘তুমি আমাদের একমাত্র অবশিষ্ট কুলচিহ্ন। যদি এই পোয়াল ভিজিয়ে পর্যাপ্ত চাল বের করতে পারি আমরা, তাহলে তোমাকে মানব, তোমার প্রতিষ্ঠা করব কুলদেবতা হিসেবে। নৈলে তোমার উপর হেগে মুতে ছুঁড়ে ফেলে দেব তোমাকে…’
এমন বলে ভেজাতে লাগল সেই শুকনো পোয়ালগুলো। ততক্ষণে সেইখানে জড়ো হয়ে গেছে গ্রামের বেশ কিছু কৌতূহলী মানুষ। সবার বিস্ফারিত চোখের সামনে -– পোয়াল থেকে চাল বের হতে লাগল। এত চাল এত চাল যে এক পাত্রে কুলোয় না। আরও বড় পাত্র আনা হল। তাও পড়ল উপচে! গাঁয়ের লোকে বলল -– ‘চমৎকার! চমৎকার! অদ্ভুত ক্ষমতাধারী এক দম্পতি এসেছে আমাদের মধ্যে!’
সেইদিন ধূমধাম করে সেই শুকনো পোয়াল থেকে বেরোনো চাল থেকে ভরপেট খেল গ্রামবাসী। শিমুল-গাঁ, মানে গোণ্ডভাষায় যা হল ‘সেমারগাঁও’ -– সেইখানেই প্রতিষ্ঠা হল সেই চুম্বক-লকেট -– লিঙ্গোর কুল-কৌলক টোটেম। যুগ-যুগান্ত ধরে প্রতিষ্ঠা পেয়ে, গোণ্ড আদিবাসীদের ভক্তির আদর পেয়ে, সেই টোটেম হয়ে উঠেছে সমস্ত গোণ্ড আদিবাসীদের আদি-পিতার চিহ্ন। আজও সেমারগাঁয়ে ধুমধাম করে পুজো হয় এই থানের -– রাখা হয় পূতপবিত্র আঙ্গা-পেন, মানে পেন-ইয়ায়া-দের নিয়ে যাওয়ার জন্য ছোট্টো কাঠের পালকি ‘আঙ্গা’।
লিঙ্গো-র অলৌকিক হয়ে ওঠার গল্প সেই চাল বের করার আখ্যান থেকেই শুরু। সেই গ্রামেরই প্রান্তে এক ছায়াঘন অঞ্চলে পর্ণকুটির বানিয়ে থাকা শুরু করল সেই আশ্চর্য দম্পতি। গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে যায় তাদের অলৌকিক কার্যকলাপের কথা, তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা করা শুরু করল রাওঘাট-অবুজমাড় ছাড়িয়ে আরও দূরদূরান্তের মানুষেরা। ক্রমে ক্রমে লিঙ্গো উদ্ভব করল আরও সব বাদ্যযন্ত্র, প্রচলন করল গোটুলপ্রথা। গোটুলের প্রথম গোণ্ড কৌমজ নৃত্যগীতি মানে ‘কোলাঙ’ -– ও তারপরের প্রথম শিকার-অভিযানের -– নেতৃত্ব দিলেন এই সাধক। সঙ্গে সঙ্গে চলল এক প্রমাণ সাইজের পোষা কেঁদোবাঘ।
এদিকে তার দাদাদের কানে পৌঁছোল এই সব কাহিনী। ঈর্ষা পরিণত হল দ্বেষে, চাগিয়ে উঠল সেই পুরোনো ভ্রাতৃঘাতী ইচ্ছাটা। ধেয়ে এল তারা লিঙ্গোকে মারতে। বারোটা গাড়িতে বলদ জুতিয়ে তারা সংগ্রাহ করল ঢালাও জ্বালানী কাঠ। অগ্নিসংযোগ করল তাতে। ইচ্ছা, ভাইকে ধরে বেঁধে এনে সেই আগুনে ফেলে পুড়িয়ে মারে। দেখতে দেখতে ধকধক করে বনের মাথা ছাপিয়ে উঠলো লেলিহান শিখা। কিন্তু ওমা! সেই আগুনের মাথায় নাচছে কে? ও যে তাদের ভাই লিঙ্গো। তাণ্ডব নাচছে যেন! অথচ কী ফূর্তি তার! ঐ দেখো! সে যে আঠারোটা বাদ্যযন্ত্র বানিয়েছিল, সবকটা একসাথে বাজিয়ে চলেছে নাচতে নাচতে!
সেই আঠারোটা বাজনা বস্তারের গোণ্ড আদিবাসীরা আজও বাজিয়ে চলে, সেই সব যন্ত্রে সুরসংযোগই যে তাদের আগুন-জয়ী লিঙ্গোবাবার সাধনা! যন্ত্রপগুলোর নামগুলো টুক করে জেনে রাখি আমরাও এই মওকায় -– ১) মাদল; ২) ঢুড্রা/কোটোড/টুডকা/কোটোডকা; ৩) বাঁশী; ৪) মাঁদরী (মন্দিরা); ৫) পরাঁগ; ৬) কচ টেহেণ্ডোর; ৭) চিটকোলী; ৮) পক টেহেণ্ডোর; ৯) ধুশীর/চিকারা; ১০) আকুম/তোড়ী; ১১) গুজ্রী-বর্গা/তিরডুড্ডী/ঝুমকা-বড়গী/ঝুমকা-বড়গা; ১২) হুলকি; ১৩) টুণ্ডোডী (ডুগডুগি); ১৪) ঢোল; ১৫) বিড়িয়া ঢোল; ১৬) কিরকিচা; ১৭) কীকিড়; ১৮) সুলুড।
এর সাথে সাথে, বিশ্বাসে, লিঙ্গো ‘পেন’ প্রাকৃতিক নির্দেশে নির্ণয় করেছেন দণ্ডকবনস্থ আদিবাসীদের ৩৬টি সুরধ্বনি। মহারাষ্ট্রের গঢ়চিরৌলি জেলার মুরুন্দু-গাঁও-কুলভট্টী আঞ্চলে গেলে শোনা যায়, জঙ্গল-পাহাড়ের গভীরে একটা গুহা থেকে অদ্ভুত প্রাকৃতিক আওয়াজ নির্গত হচ্ছে। এই আওয়াজকে লিঙ্গো ‘পেন’ নির্দিষ্ট এই আঠারো বাদ্যপযন্ত্র ছত্রিশ সুরধ্বনির সম্মিলিত প্রাকৃতগীত হিসেবে শ্রদ্ধা করেন বস্তার, গঢ়চিরৌলি, মালকানগিরি সহ সমস্ত দণ্ডকারণ্যের আদিবাসীরা।
এই ছয় ভাইয়ের নাম উত্তর-বস্তার-কাঁকের জেলার মুরাডোংরী গ্রামের প্যাটেল তথা ‘খাণ্ডা মুখিয়া’, অর্থাৎ উপরবর্ণিত আঙ্গা-পেন-এর পূজারী ধীরেসিং মাণ্ডাবীর মুখে শুনে লিখে রেখেছেন ডঃ কে আর মাণ্ডাবী তাঁর ‘পুস কোলাং পারক্কি’ নামের প্রবন্ধে -–
১) উসে মুদয়া; ২) পাটোয়ান ডোকরা; ৩) কণ্ডা ডোকরা; ৪) (?) ডোকরা; ৫) কুপারপাট ডোকরা এবং ৬) মুহ ডোকরা। তারপর এদের ছোট ভাই লিঙ্গো ডোকরা। এবং এদের এক বোন কোহলা কাসসো। একসাথে এদেরকেই সমগ্র গোণ্ড জনজাতির আট (পেট্রিয়ার্কাল মতান্তরে, বোনটিকে বাদ দিয়ে, সাত) আদিগুরু মানা হয়। আরও মানা হয় যে গোণ্ড জনজাতির বর্তমান ৭৫০টি গোত্র (টোটেম) এই আট ভাইবোনের আট পরিবার (অথবা, সাত ভাইয়ের সাত পরিবার) থেকেই এসেছে। জনজাতির সকল সদস্য এদেরই বংশধর।
আবার এই সাত বা আট পরিবারের মধ্যেও দুটি বিভাগ রয়েছে, এক একটি ভাগের বর্তমান বংশধরেরা নিজেদের ভাগের বংশধরদের সাথে বিয়ে করতে পারে বা, অপর ভাগের বংশধরদের সাথে পারে। নিজেদের বিভাগের মধ্যে বিয়ে করলে ক্ষতিপূরণ দিতে হয় -– মুরগি ইত্যাদির বলি চড়িয়ে।
এইখানে গোত্র ও টোটেম শব্দদুটি এক অর্থে ব্যবহৃত। ‘টোটেম’ শব্দের অর্থ ‘আত্মীয়’, অথবা ‘পূর্ব-পুরুষের আত্মা’। এই ধারণার সাথেই বস্তার তথা ভারত তথা দুনিয়ার আদিবাসী সমাজ বিষয়টিকে দেখে। বাকি দুনিয়ার আদিবাসীদের মতোই, বস্তারের গোণ্ড আদিবাসীদের ৭৫০টি গোত্রের মধ্যেও প্রতিটি পদবী-নির্দিষ্ট গোত্রের সাথে জড়িত রয়েছে বস্তার অঞ্চলে পাওয়া যায় বা যেত এ’রকম কোনও এক প্রজাতির পাখি, এক প্রজাতির জানোয়ার ও কোনও এক প্রজাতির গাছ -– যা সেই নির্দিষ্ট টোটেম-বংশীয়দের পরম পূজ্য, অবধ্য, এবং অবশ্য সংরক্ষণীয়। দুনিয়াভর আদিবাসী প্রাকৃত পরম্পরার সাথে তাল মিলিয়ে যেন দণ্ডকারণ্যের কৌমলোকও পেয়েছিল প্রকৃতিকে লালন করার ও প্রকৃতিতে লালিত হওয়ার গভীর, আদিম প্রজ্ঞা ও ধী -– যা ব্রাহ্মণ্যবাদ, বাণিজ্যবাদ, মালিকানাবাদ, জমিদারী, সাদা, বাদামী ও ফেয়ার অ্যাণ্ড হ্যাণ্ডডসাম-চর্চিত বাদামি সাহেবদের চাবুক, শিল্পায়িত বিকাশ, রাষ্ট্র, খোলাবাজার ও জি-ডি-পি-নির্দিষ্ট অপ্রাকৃত বিকাশাদির ক্রমাগত অগ্রাসনে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে গিয়েছে, যার একদা বিস্তীর্ণ বহতা চেতনা, অতিচেতনা, অবচেতনা ও নংচেতননা-মণ্ডিত লৌকিক যাপন নদীর দুই পারে জমেছে, জমে চলেছে, মূলধারা নামের অনুর্বর পলিমাটি।
তা লিঙ্গো পেনের কথা যখন হলই, তবে পরের সংখ্যা থেকে আমরা জেনে নিই বরং বস্তারের দেবদেবীদের।