Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তিতে বিপ্লব আনতে চলেছে ইন-ভিট্রো গ্যামেটোজেনেসিস

নূপুর রায়চৌধুরী

 


মানবসভ্যতার উন্নয়নের কাজে বিজ্ঞানের প্রয়োগ সবসময়ই ভাল কিন্তু মানুষ যখন তা খারাপভাবে ব্যবহার করে, তার নেতিবাচক প্রভাব আমাদের ভয়ার্ত করে তোলে। যেমন পারমাণবিক বোমা। বন্ধ্যা রোগীদের জন্য এবং ট্রান্সলেশনাল মেডিসিনের গবেষণার জন্য, আইভিজি অবশ্যই আমাদের সহায়তা করতে পারে, কিন্তু সমাজ এবং নীতিনির্ধারকদের জন্য এটা মাথাব্যথার গভীর কারণও হয়ে উঠতে পারে

 

আচ্ছা, ধরুন, এমন একটা সময় এল যে, সন্তান হওয়ার জন্য, সম্ভাব্য পিতামাতাদের কয়েক ডজন ভ্রূণ থেকে তাঁদের পছন্দের ভ্রূণটি বেছে নিতে বলা হল, প্রতিটি ভ্রূণের জেনেটিক তথ্য অবশ্য তাঁদেরকে দিয়ে দেওয়া হল, ভাবী সন্তানের রং-রূপ বাছাবাছির সুবিধার জন্য আর কি! কি, কথাটা শুনেই অবিশ্বাসে ভুরু কুঁচকে উঠল নাকি? তাহলে সব খুলেই বলি শুনুন: এই সেদিন মানে ২০২৩-এর এপ্রিল মাসের ১৯-২১ তারিখে ওয়াশিংটন ডিসি-র ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড মেডিসিন এবং ব্রাউন ইউনিভার্সিটি-র রিপ্রোডাক্টিভ বায়োলজি বিশেষজ্ঞ ডক্টর এলি আদাশি একটা অভূতপূর্ব সমাবেশের সূচনা করেন: এটার শিরোনাম ছিল “ইন-ভিট্রো ডিরাইভড হিউম্যান গ্যামেটস অ্যাজ এ রিপ্রোডাক্টিভ টেকনোলজি”। এটা অ্যাকাডেমির প্রথম কর্মশালা, যেখানে একজন ব্যক্তির শরীরের যে-কোনও কোষ থেকে ইন-ভিট্রো[1]— চাহিদা-মাফিক মানব গ্যামেটস বা যৌন কোষ তৈরির পন্থা হিসাবে ইন-ভিট্রো গ্যামেটোজেনেসিস, বা সংক্ষেপে আইভিজি নিয়ে তিন দিন ধরে অন্বেষণ করা হল। কয়েক ডজন বিজ্ঞানী, জৈব-নীতিবিদ, ডাক্তার এবং অন্যান্যরা আইভিজি-র সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি বর্ণনা করলেন এবং এই উদীয়মান প্রযুক্তির সম্ভাব্য সুদূরপ্রসারী সামাজিক, নৈতিক, আইনি এবং নিয়ন্ত্রক প্রভাবগুলির সন্ধান করলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী অমৃতা পান্ডে জোর গলায় বললেন, “একটা ‘নিখুঁত’ জাতি, ‘নিখুঁত’ শিশু, ‘নিখুঁত প্রজন্মের’ অনুসন্ধান আর কিন্তু বিজ্ঞানে কল্পকাহিনি নয়।” মানুষের অগ্রগতির জন্য আইভিজি-র উপলব্ধি সম্ভবত এখনও কয়েক বছর দূরে, তবে বিজ্ঞানীদের মধ্যে এ নিয়ে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে।

বহুকাল ধরে আমরা জেনে এসেছি যে, মানুষের মতো স্তন্যপায়ী জীবের প্রজননের জন্য যৌনকোষ অত্যাবশ্যক। এগুলো কিন্তু বিশেষ ধরনের কোষ যা সোম্যাটিক বা দেহকোষ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। পুরুষের অণ্ডকোষ থেকে উৎপন্ন যৌনকোষকে বলা হয় শুক্রাণু, আর মহিলা যৌনকোষের নাম ডিম্বাণু যা ডিম্বাশয়ে তৈরি হয়। প্রাকৃতিকভাবে জননকালে, একটা শুক্রাণু যখন একটা ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলিত হয়, তখন নিষেক সম্পন্ন হয় এবং একটা জাইগোট তৈরি হয়। এই জাইগোট শেষ পর্যন্ত ভ্রূণে পরিণত হয়। জাইগোটে সন্তানের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত জেনেটিক তথ্য ডিএনএ-তে সঞ্চিত থাকে। অর্ধেক ডিএনএ আসে মায়ের ডিম্বাণু থেকে আর অর্ধেক আসে বাবার শুক্রাণু থেকে। মানবপ্রজনন সম্পর্কে আমাদের এই চিরাচরিত ধ্যানধারণা আমূল বদলে গেল ২৫ জুলাই ১৯৭৮। ওইদিন উত্তর-পশ্চিম ইংল্যান্ডের ওল্ডহামে, ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (আইভিএফ)-এর মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম ‘টেস্ট-টিউব বেবি’, লুইস ব্রাউন জন্ম নেয়। আইভিএফের সময়, মহিলার ডিম্বাশয় থেকে একটা ডিম্বাণু অপসারণ করা হয় এবং পরীক্ষাগারে একটা শুক্রাণু দিয়ে সেটাকে নিষিক্ত করা হয়। নিষিক্ত ডিম্বাণু, বা ভ্রূণটিকে তারপরে বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য মহিলার গর্ভে রোপন করা হয়। সেই থেকে আজ অবধি নাটকীয়ভাবে উন্নত হয়েছে আইভিএফ; ৩৫ বছরের কম বয়সি মহিলাদের ক্ষেত্রে, আইভিএফ-এর সাফল্যের হার এখন প্রায় ৫০ শতাংশ। সুতরাং, এই সহায়ক প্রজনন কৌশল নিয়ে আমাদের লাফালাফির কোনও অন্ত নেই, যেখানে যৌনতা ছাড়াই, মানবসন্তান বানানো সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু এবার আইভিজি সেই চমককেও ছাড়িয়ে যেতে চলেছে, কারণ এতে যৌনকোষেরই কোনও প্রয়োজন হবে না; দেহকোষ থেকেই একটা নতুন মানবশিশু তৈরি করা যাবে। বন্ধ্যা নারী এবং পুরুষ আইভিজি-র মাধ্যমে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুদাতাদের জিনের পরিবর্তে নিজস্ব ডিএনএ ব্যবহার করেই সন্তানধারণ করতে সক্ষম হবেন।

দীর্ঘদিন ধরেই মানব-জীববিজ্ঞান এবং স্বাস্থ্য-সমস্যা বুঝতে এবং তা উন্নত করতে সাহায্য করার জন্য গবেষণায় অ-মানব প্রাণী ব্যবহার করা হচ্ছে, কারণ মানুষের মধ্যে পাওয়া জৈবিক প্রক্রিয়ার দিকগুলোকে প্রাণী-মডেলে সহজেই নকল করতে পারেন গবেষকরা। আর এই কাজে বিজ্ঞানীদের পছন্দের প্রাণীপ্রজাতি হল ইঁদুর। কারণ? শারীরবৃত্তীয় এবং জেনেটিক্সের দিক থেকে মানুষের সঙ্গে ইঁদুরের প্রচুর মিল; তাছাড়া এদের ছোট আকার, রক্ষণাবেক্ষণের সহজতা, সংক্ষিপ্ত জীবনচক্র এবং প্রচুর জেনেটিক সম্পদ পাওয়ার সুবিধা— এগুলোও যুক্ত হয়েছে তার সঙ্গে। স্বাভাবিকভাবেই তাই ইঁদুরের আইভিজি দিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা শুরু হতে চলেছে।

 

পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪

 

সালটা ২০১২, খবর এল জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী কাতসুহিকো হায়াশি, মিতিনোরি সাইতো এবং আরও কয় বিজ্ঞানী মিলে আইভিজি-র মাধ্যমে ইঁদুরের স্টেমকোষ থেকে উর্বর ডিম্বাণু তৈরি করেছেন, এবং তা ব্যবহার করে সুস্থ ইঁদুরবাচ্চার জন্ম হয়েছে। দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠল বিশ্বের বিজ্ঞানমহল। এই প্রথম কোনও স্তন্যপায়ী প্রাণীর স্টেমকোষ থেকে ডিম্বাণু তৈরি করা সম্ভব হল। নিশ্চয়ই জানতে কৌতূহলী হচ্ছেন হাতেকলমে ঠিক কীভাবে এই পুরো পরীক্ষাটা করেছিলেন জাপানি বিজ্ঞানীর দল। সেটা জানার আগে মানবদেহের স্টেমকোষ সম্বন্ধে কিছু তথ্য জেনে রাখলে আমাদের বুঝতে প্রভূত সুবিধে হবে।

স্টেমকোষগুলো হল বিশেষ কোষ যারা অন্য বিভিন্ন ধরনের কোষে বিকশিত হতে সক্ষম, এইজন্য তাদের প্লুরিপোটেন্ট বলা হয়। এরা দু-রকমের— এমব্রায়োনিক বা ভ্রূণীয় স্টেমকোষ এবং অ্যাডাল্ট বা পরিণত স্টেমকোষ। ভ্রূণীয় স্টেমকোষগুলো শুক্রাণু দ্বারা ডিম্বাণুর নিষেকের পর চতুর্থ থেকে সপ্তম দিন পর্যন্ত বিকাশমান মানবভ্রূণের, বা আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, প্রি-ইমপ্লান্টেশন ব্লাস্টোসিস্টের অভ্যন্তরীণ কোষপুঞ্জের একটি প্রাথমিক স্তর হিসাবে বিরাজ করে, এবং সপ্তম দিনের পরেই অদৃশ্য হয়ে যায় কারণ ততক্ষণে তারা ভ্রূণের তিনটি টিস্যু-স্তর গঠন করতে শুরু করে দেয়। অপরদিকে, পরিণত স্টেমকোষগুলো নির্দিষ্ট টিস্যু বা অঙ্গের জন্য বিভিন্ন ধরনের কোষ তৈরি করতে পারে, যেখানে তারা বসবাস করে। পরিণত স্টেমকোষগুলো আবার দুই প্রকারের হয়; একপ্রকার সম্পূর্ণরূপে বিকশিত টিস্যু যেমন মস্তিষ্ক, ত্বক এবং অস্থিমজ্জা থেকে পাওয়া যায়; এরা সংখ্যায় অল্প থাকে এবং শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ধরনের কোষ তৈরি করতেই সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, লিভার থেকে আসা একটা স্টেমকোষ শুধুমাত্র আরও লিভারকোষই তৈরি করতে পারে। দ্বিতীয় প্রকার হল ইন্ডিউসড প্লুরিপোটেন্ট স্টেমসেল (আইপিএস) বা প্ররোচিত প্লুরিপোটেন্ট স্টেমকোষ। এগুলি হল সেইসব পরিণত স্টেমকোষ যেগুলোকে পরীক্ষাগারে এমনভাবে পরিবর্তিত করা হয়েছে যাতে তারা ভ্রূণীয় স্টেমকোষের মতোই দেখতে হয় ও অনুরূপ আচরণ করে। এদের নিয়ে গবেষণা করার দারুণ সুবিধে কারণ ভ্রূণ থেকে আসার পরিবর্তে, দেহকোষ যেমন ত্বক বা রক্তকোষ থেকে তৈরি করা হয় বলে, ভ্রূণকোষ-সংশ্লিষ্ট নৈতিক বিতর্কের ঝড় এদেরকে মোটেই স্পর্শ করতে পারে না। তদুপরি, ভ্রূণীয় স্টেমকোষ ব্যবহার করলে যেসব ইমিউনোলজিক সমস্যার সম্মুখীন হবার সমস্যা থাকে, আইপিএস কোষের ক্ষেত্রে সেসব উদ্বেগের কোনও কারণ নেই, তাই কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের বন্ধ্যাত্ব অতিক্রমের কাজে এটাই আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিশ্রুতি প্রদান করে।

ভ্রূণীয় এবং পরিণত স্টেমকোষ

 

আসুন ফিরে যাওয়া যাক আবার আইভিজি-র তত্ত্বতালাশে। প্রযুক্তিগতভাবে, এতে দুটি ধাপ রয়েছে: প্রথমে দেহকোষ থেকে আইপিএস তৈরি করা হয় এবং তারপর রি-প্রোগামিং-এর মাধ্যমে আইপিএসকে যৌনকোষে পরিবর্তিত করা হয়। জাপানি বিজ্ঞানীদের দল ইঁদুরের লেজের ত্বককোষ থেকে আইপিএস তৈরি করেন এবং সেগুলোকে শুক্রাণু বা ডিম্বাণুতে রূপান্তরিত হতে প্ররোচিত করেন। এখানেই ক্ষান্তি দেননি গবেষকরা, তাঁরা সেই শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুগুলোকে পরীক্ষাগারে আইভিএফ-এর দ্বারা ভ্রূণ তৈরি করতে ব্যবহার করেছেন এবং সর্বশেষে ভ্রূণগুলোকে স্ত্রী ইঁদুরের গর্ভে রোপন করেছেন, যা দৃশ্যত সুস্থ বাচ্চা ইঁদুরের জন্ম দিয়েছে। কম হ্যাপার কাজ নয় এটা, নেহাত ডক্টর হায়াশি, ডক্টর সাইতো এঁরা সব ইঁদুরের আইভিজি-তে রীতিমতো হাত পাকিয়ে ফেলেছিলেন, তাই না এই চমৎকারিত্ব!

এবার আসি পরের চমকে— ডক্টর সাইতো জানিয়েছেন যে, তাঁর দল এখন এই প্রযুক্তিগুলোকে মানুষের মধ্যে অনুকরণ করার পথে রয়েছে৷ কি এইবার নির্ঘাত দ্বিধান্বিত হয়ে ভাবছেন: ইঁদুরকে কেন্দ্র করে এই যে পরীক্ষা, সেগুলো কি মানুষের বেলায় করা সম্ভব? ঠিকই ধরেছেন, কাজটা অত সহজ নয়, জটিলতার কারণ রয়েছে— এক নয়, বহু রকমের। কিন্তু বিজ্ঞানীরা তো আর থেমে থাকার পাত্র নয়, অতএব মানুষের আইভিজিকে বাস্তবায়িত করার দিকে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে গোটা পৃথিবী জুড়ে৷ তো ইঁদুর-মডেলে সার্থক আইভিজি-র পথপ্রদর্শক হিসাবে জাপানি গবেষকদল যে এবার মানবপ্রকল্পের পিছনে জান লড়িয়ে দেবেন তাতে আর আশ্চর্যের কী? স্বনামধন্য ডক্টর হায়াশি-র নেতৃত্বে মুরাকামি ও অন্যান্যরা এই বছরের মার্চ মাসেই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ইঁদুরের ত্বকের কোষকে সুস্থ-সবল ডিম্বাণুতে রূপান্তরিত করেছেন৷ শুধু ওঁরা নয়, বিশ্বের বহু ল্যাবই দৌড়াচ্ছে এই প্রকল্পের পিছনে। এর মধ্যে একটা ল্যাবের অন্দরমহলের খবর যে আপনাদের সকলকে দারুণ নাড়া দেবে, সে সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত। সেটা হল ক্যালিফোর্নিয়া-র সান ফ্রান্সিসকো-স্থিত, বায়োটেক স্টার্টআপ ‘কনসেপশন’। কোম্পানির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ম্যাট ক্রিসিলফ বলেছেন যে, তিনি সমকামী এবং সেইজন্যই ব্যক্তিগতভাবে প্রথম থেকেই তিনি আইভিজি সম্বন্ধে আগ্রহী কারণ, এই প্রযুক্তি সমকামী দম্পতিদের দুজনেরই সঙ্গে জেনেটিক্যালি বা জৈবিকভাবে সম্পর্কিত সন্তান জন্ম দেওয়া সম্ভব করে তুলবে। কনসেপশন-এর চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার পাবলো হুরতাডোও একজন সমকামী পুরুষ। আইভিজি প্রয়োগ করে তিনি তাঁর মতো সমকামী দম্পতিদের সন্তানলাভে সাহায্য করতে বদ্ধপরিকর। আইভিজি হুরতাডোর রক্ত-কোষ থেকে ডিম্বাণু তৈরি করতে পারে যা তার সঙ্গীর শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত হতে পারে। একজন সারোগেট মা তারপরে ভ্রূণটিকে গর্ভে ধারণ করতে পারেন এবং শেষে শিশুর জন্ম দিতে পারেন। সান ফ্রান্সিসকোতে কনসেপশন-এর কাছাকাছিই রয়েছে ‘আইভি নাটাল’ নামে আরেকটা স্টার্টআপ। আয়তনে যদিও ছোট, ‘ক্রিসপার’ নামে পরিচিত জিন-এডিটিং কৌশল ব্যবহার করে এবং স্টেমকোষ থেকে আরও দ্রুত এবং নিরাপদে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু তৈরি করে কনসেপশন-কে টেক্কা দিতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে  তারা। ব্যাপারগুলো খুব উত্তেজনাপূর্ণ, তাই না? ক্রিসিলফরা বলছেন যে কনসেপশন আইভিজিকে বাস্তবায়িত করার যতটা কাছাকাছি পৌঁছেছে, অন্য কেউই সেখানে নেই— তাঁরা ফলিকল তৈরি করতে সফল হয়েছেন যা ডিম্বাশয়ের অভ্যন্তরীণ এক কাঠামো এবং ডিম্বাণু পরিপক্ক হওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। “যতদূর জানি, আমরাই বিশ্বের প্রথম, যারা এটা করতে সক্ষম হয়েছি,” বলেছেন ক্রিসিলফ। ক্রিসিলফ এবং তাঁর সহকর্মীরা আশা করেন, এক বছরের মধ্যে তাঁরা প্রমাণ করবেন যে, ক্ষুদ্রকায় ডিম্বাশয়ের ফলিকলগুলো অপরিণত ডিম্বাণুগুলোকে ভ্রূণ এবং মানবশিশু তৈরির জন্য নিষিক্ত হতে সক্ষম করে গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু সব বিজ্ঞানীরাই যে এটা মেনে নিয়েছেন তা কিন্তু নয়। এই ধরুন না আমান্ডার ক্লার্ক, আইভিজি নিয়ে কাজ করছেন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে। তিনি বলেছেন যে, দুটি মাত্র বায়োমার্কারের উপর ভিত্তি করে কনসেপশন তাদের এত বড় দাবি করছে— একটা ফলিকল কোষের জন্য এবং একটা ডিম্বাণুর জন্য। এটা যথেষ্ট নয়, ওগুলো যে সত্যি ফলিকল তা নিশ্চিত করার জন্য আরও অনেক প্রমাণের দরকার। জাপানি বিজ্ঞানীরাও সতর্ক করেছেন যে, আইভিজি-র মাধ্যমে তৈরি কৃত্রিম ভ্রূণগুলো কিন্তু বিপজ্জনক— জেনেটিক বা এপিজেনেটিক মিউটেশন বহন করতে পারে, তাই সেসবের ভালমতো বিচার করা অত্যাবশ্যক এবং সেই কাজ করতে বেশ কয়েক বছর সময় লাগবে, তাড়াহুড়োয় সেসব মোটেই সম্ভব নয়।

আইভিজি-র প্রযুক্তিগত দিক নিয়ে তো অনেক নাড়াঘাঁটা হল, এবার আসুন এক ঝলক দেখে নিই প্রজনন জীববিজ্ঞান উন্নয়নের ক্ষেত্রে এর সম্ভাবনা এবং সমাজব্যবস্থার উপর সম্ভাব্য প্রভাব। আজকের একুশ শতকের সমাজে মানুষের চিরাচরিত যৌন ভূমিকা ও লিঙ্গধারণায় অনেক বিবর্তন এসেছে। আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁদের বাহ্যিক শরীর-গঠন, লিঙ্গপরিচয় এবং লিঙ্গ-অভিব্যক্তি বাঁধাধরা পুরুষ ও নারীর লিঙ্গ-বাইনারির সঙ্গে মেলে না। এছাড়াও আছেন সংসার গঠনে ইচ্ছুক বহু একলা মানুষ। এঁদের সকলের পরিবার তৈরির বিকল্পগুলোকে বাস্তবে রূপায়িত করবার ক্ষমতা নিহিত রয়েছে আইভিজি-তে। যে-কোনও ব্যক্তিকে জৈব সম্পর্কিত শিশুর জন্ম দিতে সাহায্য করবে আইভিজি— সে তিনি একক মহিলা অথবা পুরুষ, বিষমকামী বা সমকামী, বাইনারি বা নন-বাইনারি, সিস-জেন্ডার বা ট্রান্সজেন্ডার, যাই হোন না কেন৷ আইভিজি এমন সিস-জেন্ডার মহিলাদের বন্ধ্যাত্বের নিরাময় প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়, যাঁরা হয়তো ক্যান্সারের চিকিৎসায় তাঁদের ডিম্বাণু হারিয়েছেন, কোনও দুরারোগ্য অসুখের কারণে কখনও স্বাস্থ্যকর ডিম্বাণু উত্পাদন করতে সক্ষম হননি, অথবা ঋতুজরার জন্য তাঁদের ডিম্বাণু আর কার্যকর হয় না।

 

পড়ুন, গুজরাত গণহত্যার বিচার হয়নি

 

মানবসভ্যতার উন্নয়নের কাজে বিজ্ঞানের প্রয়োগ সবসময়ই ভাল কিন্তু মানুষ যখন তা খারাপভাবে ব্যবহার করে, তার নেতিবাচক প্রভাব আমাদের ভয়ার্ত করে তোলে। যেমন পারমাণবিক বোমা। বন্ধ্যা রোগীদের জন্য এবং ট্রান্সলেশনাল মেডিসিনের গবেষণার জন্য, আইভিজি অবশ্যই আমাদের সহায়তা করতে পারে, কিন্তু সমাজ এবং নীতিনির্ধারকদের জন্য এটা মাথাব্যথার গভীর কারণও হয়ে উঠতে পারে। দু-একটা উদাহরণ এখানে দেওয়া যাক। আইভিজি ব্যবহার করে একজন একক মানুষ যখন নিজের বাচ্চা তৈরি করবেন, তখন যে-প্রশ্নটা নিয়ে সমাজ প্রথমেই শোরগোল তুলবে তা হল, সেই বাচ্চার মা কে? আর বাবাই বা কে? তো এই অবস্থা কি একটা সামাজিক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবে না? মানবভ্রূণ তৈরি করার জন্য চুল বা ত্বক-কোষের মতো জৈবিক উপাদানের অননুমোদিত, এমনকি গোপন-ব্যবহারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে আইভিজি। এটা যে শুধুমাত্র নৈতিক সমস্যার জন্ম দেবে তা নয়, শিশুর অভিভাবকত্ব নিয়ে উদ্বেগজনক আইনি প্রশ্নও উত্থাপন করবে। জৈবনীতিবিদরা আশঙ্কিত হচ্ছেন যে, আইভিজিকে ঘিরে মানবভ্রূণের অপব্যবহার, প্রজননের বাণিজ্যিকীকরণ এবং জেনেটিক তথ্য ম্যানিপুলেট করে ‘ডিজাইনার বেবি’ তৈরির প্রবণতা গড়ে ওঠা অসম্ভব নয়।

তাই এই বিজ্ঞান-সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার আগে আমাদের সামনে একটাই মূল কাজ— জনসাধারণের জন্য আইভিজি-র প্রভাব খুঁটে খুঁটে বিবেচনা করা, একবার নয়, বারবার, আর তা শুরু করার আজ, এখনই, উপযুক্ত সময়।

 

তথ্যসূত্র:


[1] জীবিত প্রাণীর শরীরের বাইরে অন্য কোথাও সঞ্চালিত বা সংঘটিত। যেমন, পরীক্ষাগারে, টেস্টটিউবে অথবা কালচার ডিশে।