Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ওষুধের খরচ সামলাতে গিয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছি

রামকৃষ্ণ দাস

 


সাধারণ মানুষের আয় কমছে, খরচ বাড়ছে, জিনিসের দাম বাড়ছে, রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ছে। ওষুধের খরচা তো পাগল করে দিচ্ছে। শুধু আমারই নয়, আমার তো মনে হয় আমার মতো যাদেরই এরকম নিয়মিত ওষুধ খেতে হয় তাদের সবারই জেরবার অবস্থা

 

 

চার পুরুষ ধরে কলকাতায় বাস আমাদের। এই যাদবপুরে। পঁয়ষট্টি বছর বয়স হয়ে গেল। গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলাম সেই বিরাশি সালে— বামফ্রন্ট আমলে। যা পড়াশোনা করেছি একটা চাকরিবাকরি তো পেতেই পারতাম। পাইনি। তেল দিতে পারিনি বলেই বোধহয়। সব দল, সব সরকার তো দেখলাম এই এতটা জীবনে— সবাই ওই তেলা মাথায় তেল দেওয়া পার্টি। ধান্দাবাজি করতে পারলে ঠিক আছে, নইলে নেই।

যাদবপুর ইউনিভার্সিটির উল্টোদিকে এই চায়ের দোকানটা করাও হয়ে গেল বহুদিন। সেই যখন বুঝে গেছিলাম চাকরিবাকরি পাব না, তখনই এই দোকানটা করি। এটাই সম্বল। এর ভরসাতেই সংসার চালিয়েছি, দুটো ছেলেকে পড়াশোনা শিখিয়ে বড় করেছি। আমার দুই ছেলেই গ্র্যাজুয়েট হয়েছে। বড়টা একটা চাকরিও পেয়েছে। বিয়েও দিয়েছি ওর। বউমাও গ্র্যাজুয়েট। ওদের ছেলে হয়েছে একটা। এই এক বছর তিন মাস বয়স। এখনও এই দোকানের ভরসাতেই চালিয়ে যাচ্ছি। সংসার চালাতে বড় ছেলের টাকাপয়সা নিই না আমি।

তা চলেও যাচ্ছিল খারাপ না। কিন্তু শেষ করে দিয়েছিল কয়েক বছর আগের ওই লকডাউনটা। লকডাউনের পরেও এখনও পর্যন্ত আমার আগে যা আয় হত তার তিনভাগের একভাগ হচ্ছে কোনওরকমে। অত রোজকার হিসেব করা হয় না, কিন্তু ওই এখন দিনে ৫০০ থেকে ৭০০-র মধ্যে হচ্ছে রোজগার।

পাঁচজন লোক বাড়িতে। আমি, আমার বৌ, দুই ছেলে, বড়ছেলের বৌ আর নাতি। রোজগার খালি আমার এই দোকান। বড়ছেলে চাকরি করে, কিন্তু ওই যে বললাম সংসার চালানোর জন্য ওর টাকা নিই না আমি। ওর বৌ-বাচ্চার খরচাপাতি করে ও। টাকা তো কিছু জমাতেও হবে, বাচ্চাটাকে বড় করতে হবে। আমি যদ্দিন আছি, চালিয়ে যাই।

 

পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪

 

রেশন কার্ড, স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড, বৌ আর ছেলের বৌয়ের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের কার্ড আছে। জনধন অ্যাকাউন্ট নেই, এমনি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে একটা।

কিন্তু এসব থেকে লাভ যে কী হচ্ছে তা বুঝি না। আমার মূল খরচা হয় ওষুধে। পাগল হয়ে যাচ্ছি ওষুধের পেছনে খরচ করতে করতে। আমার আর আমার বৌয়ের দুজনেরই সুগারের ওষুধ লাগে, প্রেশারের ওষুধ লাগে, কোলেস্টেরলের ওষুধ লাগে। কী দাম এক-একটা ওষুধের! আমার মাসের ইনকামের অর্ধেক ওষুধের পেছনেই চলে যায়। এমনিতেই বললাম লকডাউনের পর থেকে ব্যবসাপাতি প্রায় তিনভাগের একভাগ হয়ে গেছে। তার মধ্যে এই ওষুধে এত খরচা। প্রতি মাসেই এর-ওর কাছে, ওষুধের দোকানে ধারদেনা করতে হয়। পেরে উঠছি না।

এবার আমার স্বাস্থ্যসাথী কার্ড আছে। কিন্তু আমি কখনও এটা ব্যবহার করিনি, তাই জানি না এতে কী সুবিধা আদৌ পাওয়া যায়। কেন্দ্রীয় সরকারের হেলথের একটা কার্ড আছে— আয়ুষ্মান ভারত— সেটাও আমার আছে। কিন্তু রাজ্য সরকার সেটা ব্যবহার করতে দেয় না। এদের এই রেষারেষিতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের নাজেহাল অবস্থা। যাদের আছে, তারা কিন্তু আরও পেয়েই যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে কিছু হচ্ছে না। ওই যে প্রথমেই বলছিলাম না, ধান্দাবাজি করতে পারলে টিকে থাকা যাবে, নইলে নয়।

ওষুধের খরচা সত্যি পাগল করে দিচ্ছে। শুধু আমারই নয়, ওষুধবিষুধের যা দাম, আমার তো মনে হয় আমার মতো যাদেরই এরকম নিয়মিত ওষুধ খেতে হয় তাদের সবারই জেরবার অবস্থা।

চারপাশে যা চলছে দেখি, মানে ওই যাকে দেশের অবস্থা বলে, তার মধ্যে এমন কিছুই তো দেখি না যেটাতে মনে হতে পারে এই জিনিসটা বেশ ভাল চলছে। কিছুই ভাল হচ্ছে না। চারিদিকে চুরি, ঘুষ, মারামারি, খাওয়াখাওয়ি, যাদের আছে, যারা ধান্দাবাজি করতে পারে, তারা আরও ফুলেফেঁপে উঠছে। এদিকে সাধারণ মানুষের আয় কমছে, খরচ বাড়ছে, জিনিসের দাম বাড়ছে, চিকিৎসার খরচা বাড়ছে, রান্নার গ্যাস-ট্যাস সবকিছুরই দাম বাড়ছে। সাধারণ মানুষ চলবে কীভাবে!

আর এক জিনিস শুরু হয়েছে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি। ঠাকুরদেবতা, ধর্ম— এসব কি রাজনীতি করার জিনিস? এগুলো তো মানুষের নিজের নিজের বিশ্বাস, ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমাদের তো একটা সংবিধান আছে, তাতে তো আমাদের একটা নাগরিক অধিকার আছে, সেই অধিকার তো এটা বলে, নাকি? সেখানে কেউ রামের নাম করে, রামমন্দির বানিয়েছে বলে ভোট চাইছে, তো কেউ বলছে ও ‘জয় শ্রীরাম’ বলল— ও বদমাশ লোক! এগুলো একদমই নোংরামো চলছে। আমার এসব একেবারেই পছন্দ হয় না। রাজনীতিতেও যেমন ও বিজেপি তাই খারাপ, ও তৃণমূল তাই খারাপ, বা ও সিপিএম তাই খারাপ— এরকম বলা ঠিক নয়, এটাও যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার— ধর্মও তাই।

এসবই চলছে দেশে। ভোট আসছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাল কদ্দূর কী হবে জানি না!


*সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পক্ষে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়