রিয়াজুল ইসলাম
আসানসোলে এমনিতে গরম ছাড়া আর কোনও সমস্যা নেই। এবার রামনবমী, হনুমানজয়ন্তীতে কোনও ঝামেলা হয়নি। মাঝে কয়েকবার খুব পরেসানি হয়েছিল, আবার হবে, টের পাই। তবে আমরা যারা স্ট্যান্ডে গাড়ি চালাই কোনও সাতে-পাঁচে থাকি না। বাল-বাচ্চা নিয়ে থাকি। ঝামেলা এড়িয়ে চলি। আমাদের নিজেদের মধ্যে কোনও ঝামেলা নেই। সারাদিন গাড়ি চালিয়ে রাতে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে চায় সবাই। আসল ঝামেলা করে বাইরের লোক। ভোট চলছে। বাইরের লোকও এসে ঢুকছে। তবে ভোটে যেই জিতুক, আমাদের অবস্থা বদলাবে না
আমি আসানসোলে থাকি। গাড়ি চালাই। আগে অ্যামবাসাডর চালাতাম। কোভিডের সময় গাড়িটা একেবারে বসে গেল। অ্যামবাসাডর বন্ধ হয়ে গেছিল। গোটা একটা বছর যে কী কষ্ট করে কেটেছে। ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিয়ে দু-বছর আগে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনেছি। সেকেন্ড হ্যান্ড, কিন্তু আমার কেনার আগে খুব বেশি কিলোমিটার চলেনি। সুবিধায় পেলাম। আরও চার বছর ইএমআই দিতে হবে। সেটা মাথার ওপর বড় চাপ আমার। গাড়ি চালিয়ে আগের মতো পয়সা নেই আর। কিন্তু কী করব? গাড়ি চালানোই একটা কাজ যা আমি পারি। আব্বাও ড্রাইভারি করতেন। ইসকো বার্নপুরে সাহেবদের গাড়ি চালাতেন। সরকারি চাকরি না। কন্ট্রাক্টে। মানে গাড়ি চালানোটা আমার ফ্যামিলি বিজনেস। একমাত্র আমিই এসেছি ফ্যামিলি বিজনেসে। বড়ভাই মজফফরপুরে থাকেন। তাঁর মুদিখানার দোকান আছে। ছোটভাইয়ের মোবাইলের দোকান। আব্বা কিছুটা সময় আসানসোলে থাকেন, কিছুটা সময় মজফফরপুরে। আমার নানা মানে আব্বার আব্বা মজফফরপুর থেকেই আসানসোল এসেছিলেন অনেক বরস আগে। আব্বা তখন অনেক ছোট। নানার দুটো বিয়ে। আব্বা দ্বিতীয় পক্ষের। আমাদের অনেক আত্মীয়স্বজন ছড়িয়ে আছে বিহার বাংলা ইউপি-তে।
যা বলছিলাম, কোভিডের সময় গাড়িটা একদম বসে গেছিল। দুটো ছেলে আর বউকে নিয়ে খুব মুশকিলে পড়েছিলাম। আব্বা তখন বিহারে ছিল, দাদার কাছে। সে-সময় আব্বা এখানে থাকলে চাপ হত। পুরো একটা বছর ছেলেদের আগে খাইয়ে নিজেরা কম খেয়ে থেকেছি। রেশনের চাল-আটা বড় ভরসা ছিল তখন। গাড়িটা না চালিয়ে চালিয়ে সেই যে বসে গেল আর চালাতে পারলাম না। আবার কোনওদিন উঠে দাঁড়াতে পারব ভাবতে পারিনি। আমার ছোট ছেলে ক্লাস ফোর। বড় ছেলে বারো ক্লাস পাশ করেছে। লেখাপড়ায় মোটামুটি ভালই। আমার ইচ্ছা ও পলিটেকনিক করুক। চেষ্টা করছে। না হলে অন্য কোনও কাজ শিখবে। অন্য কিছু করতে হবে ওকে, গাড়ির লাইনে আর আনব না। গাড়ি চালিয়ে আর পয়সা নেই। ওলা, উবের, র্যাপিডো, সব চালু হয়ে গেছে আসানসোল-দুর্গাপুরে। তারাও যে সবাই খুব কামাচ্ছে তা নয়, মাঝেমধ্যেই হরতাল করে। আর এখন কলকাতা থেকে রাস্তাও খুব ভাল। আরও ভাল হয়ে যাবে এক-দু-বছর পর। অনেকেই কলকাতা থেকে নিজের গাড়ি নিয়ে চলে আসেন। কাজ সেরে গাড়ি করে ফিরে যান। ড্রাই গাড়িতে আমাদের রেট আট ঘণ্টায় আটশো টাকা। তেল লিটারপ্রতি দশ কিলোমিটার। যত কিলোমিটার হবে সেই অনুযায়ী প্যাসেঞ্জার টাকা দেবে। প্রতিদিন সকালে স্ট্যান্ডে স্ট্যান্ডে দাঁড়াই। চেষ্টা থাকে রোজ অন্তত একটা ভাড়া পাওয়ার। গাড়ির খরচ, ইএমআই সরিয়ে রেখে তারপর ঘর চালানোর খরচ তুলতে হয়। এখনও অবধি চলে যাচ্ছে। কতদিন এভাবে টানতে পারব জানি না। কোনও সেভিংস নেই আমার। বউ লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পায়। বউ খুব ভোগে, ওর ওষুধের পেছনেই অনেক টাকা চলে যায়। বড় অসুখবিসুখ হলে কী হবে জানি না। বড় ছেলে লায়েক হচ্ছে। আর দু-পাঁচ বছরে একটু-আধটু কামাই শুরু করলে…।
পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪
আমাদের আসানসোলে গরম ছাড়া আর কোনও সমস্যা নেই। না, এবার রামনবমী, হনুমানজয়ন্তীতে কোনও ঝামেলা হয়নি। মাঝে কয়েকবার খুব ঝামেলা হয়েছিল, আবার হবে, টের পাই। তবে আমরা যারা স্ট্যান্ডে গাড়ি চালাই কোনও সাতে-পাঁচে থাকি না। বাল-বাচ্চা নিয়ে থাকি। ঝামেলা এড়িয়ে চলি। আমার গাড়ির স্ট্যান্ডে অনেকেই তৃণমুলকে ভোট দেয়, কেউ বিজেপিকে ভোট দেয়, কিন্তু আমাদের নিজেদের মধ্যে কোনও ঝামেলা নেই। সারাদিন গাড়ি চালিয়ে রাতে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে চায় সবাই। আসল ঝামেলা করে বাইরের লোক। ভোট চলছে। বাইরের লোকও এসে ঢুকছে। এমপিও তো বাইরের লোক। শত্রুঘ্ন সিনহা। ভোটের কদিন আগে এসে আসানসোলেই পড়ে আছেন। আগেরবার জিতেছিলেন, এবারও জিতবেন। তবে যেই আসুক, আমাদের অবস্থা বদলাবে না। খেটে খেতে হবে। শুধু কোভিড যেন আর ফিরে না আসে। আর আল্লাহ দোয়ায় শরীরটা যেন ঠিক থাকে।
*সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত