Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্রাগের শীতে এক প্রাজ্ঞ ত্রুবাদুর

দেবব্রত শ্যামরায়

 

কুয়াশায় উড়ে যায় অপরূপ দুটি হাত
প্রজ্জ্বলিত ইলেকট্রন আঁকা ছিল তাতে।
মেপলের পাতা ঝরে, শিরশিরে হাওয়া বয়,
প্রাগে শীত আসিবে এবার।।

মননে পর্যটনে, আক্ষরিক অর্থেই এক প্রাজ্ঞ ত্রুবাদুর, অগ্রজ কবি নিরুপম চক্রবর্তী। ত্রুবাদুরের বদলে বিশ্বপথিক বিশেষণটি অনায়াসে বসানো যেত, বরং তা আরও বেশি সুপ্রযুক্ত হত, কিন্তু ‘বিশ্বপথিক’ শব্দটিতে যে প্রাচীন রাবীন্দ্রিক দ্যোতনা আছে, আজ এই নষ্ট ন্যাসপাতির পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে তাকে খানিক দূর‍তর বলে মনে হয়। অতএব ও অগত্যা! অবশ্য ‘ত্রুবাদুর’ অর্থাৎ চারণকবি বিশেষণটি নিরুপমের বিশেষ প্রিয় ও যথাযথ, তাঁর মনের কাছাকাছি, যা বইটির শেষ কবিতা ‘আত্মজৈবনিক সেস্টিনা’-য় কবির বিপন্ন আত্মপরিচয় ধারণ করে আছে।

সুতীব্র আতঙ্কে দ্যাখো বিপর্যস্ত মানুষেরা ছোটে রাজপথে
এ কোন বিদ্বেষ বিষে কারা ভরে দিল আজ পৃথিবীর দেহ
ত্রুবাদুর বলে দিও কোন রাস্তা আজও খোলা আমাদের কাছে
সুবাসিত দিন চাই এইসব ধর্মগ্রন্থী উল্লাস পেরিয়ে
দু-হাত বাড়িয়ে আমি ত্রুবাদুর, কেবলই হিংস্রতা দেখো ভাসে
বলো কবে আলো হবে, ত্রুবাদুর, একমুঠো আলো এনো আজ।

—’আত্মজৈবনিক সেস্টিনা’; পঞ্চম স্তবক

যে-কথা বলছিলাম, অধ্যাপনার সূত্রে নিরুপম দীর্ঘ সময় ধরে পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। দেশ থেকে বহুদূরে গিয়ে দেশে দেশে তৈরি করেছেন নিজের ঘর, সাধারণ-অসাধারণ মানুষজনের সঙ্গে মিশেছেন, আর সেই নতুন-দেখা ভূপ্রকৃতি ও মানবপ্রকৃতির সংস্পর্শে ও সংশ্লেষে গড়ে উঠেছে তাঁর প্রণীত গ্রন্থগুলির অভিনব কাব্যশরীর। কলকাতায় বসে, এক বসন্ত অতিক্রমণের দিনে, কবির নবতম বই, ‘প্রাগে শীত আসিবে এবার!’ হাতে তুলে নিয়ে আগের বাক্যে ‘অভিনব’ শব্দটিকে বোল্ড ও আন্ডারলাইনড করে দিতে ইচ্ছে হল।

প্রাগে শীত আসিবে এবার!
নিরুপম চক্রবর্তী
প্রথম সংস্করণ: ডিসেম্বর, ২০২৩
প্রকাশক: সৃষ্টিসুখ
প্রচ্ছদের ফোটোগ্রাফ: Jaromir Chalabala
বইয়ে ব্যবহৃত ফোটোগ্রাফ: নিরুপম চক্রবর্তী
মূল্য: ২৪৯ টাকা/১৪.৯৯ ডলার

 

‘প্রাগে শীত আসিবে এবার!’ অনেক কারণে অভিনব৷ প্রথমত ও প্রধানত, এর কবিতা। বাংলা কবিতার কথা ভাবলে যে বিপুল বিস্তৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তারও বাইরে দাঁড়িয়ে এই বই। ভ্রমণ-কবিতার কোনও জঁর কি আমাদের সাহিত্যে নির্দিষ্ট? কবি নিরুপম চক্রবর্তী দীর্ঘ কবিতার অলস আলাপে বিশ্বাসী। দীর্ঘ কবিতাগুলির শরীরে ভর করে থাকে প্রাগ শহরে একাকী চারণকবির ভ্রমণকাহিনি। প্রাগ শহরের অলিগলিতে, হোটেলে, সেলুনে, রেলস্টেশনে, মিউজিয়ামে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কবি প্রায়শই পা ফেলেন ইউরোপের ইতিহাসে।

ইতিহাস ও অভিনবত্বে ভ্রমণ শুরু হয়ে যায় পাতা উল্টোলেই। কয়েকটি উদাহরণ তুলে নেওয়া যাক।

বইয়ের শুরুতে ‘প্রাগ-কথন’ অংশের (নামকরণটি লক্ষ করুন, প্রিয় পাঠক!) প্রথম কবিতাটি, নাম ‘মাসারিকোভা হোটেল: প্রাগ’। কবিতাটি আসলে এক মধ্যযুগীয় অট্টালিকা, নাট্যকার ভাতস্লাভ হাভেলের শেষতম নাটকের স্টেজ, বর্তমানে মাসারিকোভা হোটেলের প্রাচীন সিঁড়ি ও করিডর বেয়ে নিগূঢ় সঙ্কেত খুঁজে খুঁজে একটি গভীর গথিক রহস্য উন্মোচনের মতো কবির নিজের রুম খুঁজে নেওয়ার গল্প। ‘এ কোন নাটক তুমি রচিয়াছ হোটেলের নামে? লাল পথ দৃশ্যমান নয় আর; মেঝেতে রক্তবর্ণ চিহ্ন কিছু তবু রাখা আছে। এ কি শোণিতের ফোঁটা? জানা নাই। যেহেতু এ রক্তবর্ণ আমাকে দিয়াছে ওই স্বর্ণকেশী বালিকাটি, আমি সেই চিহ্নগুলি খুঁজে চলি, ক্রমশ হারায়ে যাই ছমছমে অন্ধকারে সুবিশাল অট্টালিকাটিতে।’ কবিতা, গদ্য, রহস্যগল্প যেন বেড়া ভেঙে একাকার হয়ে যায়। লেখার ছত্রে যেন পলকে উঁকি মেরে যান ঔপন্যাসিক উমবের্তো একো। কবিতাপাঠকে আরও স্বাদু করে তুলতে যোগ্য ও অভিনব সঙ্গত করে মাসারিকোভা হোটেলের লে-আউট প্ল্যানের ছবি।

‘প্রাগ শহরের রবীন্দ্রনাথ’ কবিতায় কবির সহযাত্রী হয়ে ২০ নম্বর ট্রামে চেপে আমরা পৌঁছে যাই ঠাকুরোভা, যেখানে এক হরিৎ উদ্যানে স্থাপিত আছে রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি। ১৯২১ সালে ভিয়েনা থেকে ট্রেনে চেপে প্রাগে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আমরা জানতে পারি ও জেনে পুলকিত হই, ১৯২১, ১৮ জুন প্রাগের চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিপূর্ণ সভাঘরে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বক্তৃতার পরিবর্তে সেদিন গান গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘বিপুল সমুদ্রে দ্যাখো, ঝড় উঠে, রোমাঞ্চিত ছাত্রবৃন্দ নৃত্য করে, রোমহর্ষ জাগে। বিপুল তরঙ্গরোলে ভেসে যায় ডিনেদের কোট-প্যান্ট-টাই!’

প্রতিটি কবিতার কথা উল্লেখ করা সম্ভব নয়, কিন্তু ইচ্ছে করে। ‘প্রাগের গবলিনের গল্প’ কবিতায় শার্লক হোমস সঙ্গী ওয়াটসনকে নিয়ে প্রাগের অলিতেগলিতেপ্রান্তরে এক বিদেশিকে খোঁজেন, খুঁজতে খুঁজতে কোনও এক নিরুপম চক্রবর্তীর কবিতার রেফারেন্স দেন, বিদেশিকে খুঁজে পান না, শুধু তুষারের স্তূপে সেই বিদেশির পায়ের ছাপ দেখা যায়, যার পায়ের বুট বাটার তৈরি।

কবির হাত ধরে প্রাগ শহর ঘুরে বেড়াচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি, সেখানে বাসে ট্রামে ও মেট্রোতে অনেকেই বই পড়েন। কখনও কবি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন এক বিস্তীর্ণ প্রান্তরে রাখা ফলকের সামনে, যেখানে লেখা ন-জন শহিদের নাম, আরও লেখা— ‘ইহাদের মৃত্যু আজ আমাদের বাঁচায়ে রেখেছে’। সময়টা ১৯৩৮-৪৫, অর্থাৎ প্রাগ তখন নাৎসিকবলিত। আরেকটি ফলকে লেখা— ‘৯-১৯ মে ১৯৪৫/ লালফৌজ এ শহর মুক্ত করিয়াছে’। এভাবেই আট দশক আগের একের একের শিহরণ সুদূর কলকাতায় এক বাংলাভাষী পাঠকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন কবি। কবির চোখ দিয়ে দেখছি কোজাগরীর রাতের প্রাগ, হলোইন, অথবা লেলন-দেওয়ালের গ্রাফিত্তি। কিন্তু নিরুপম কবিতা লিখছেন, কোনও ভ্রমণকাহিনি নয়, ইতিহাস গ্রন্থও নয়। তাই প্রাগের সন্ধ্যায় এক মায়াবী সেলুনে চুল কাটানোর সরস বিবরণী আমাদের পৌঁছে দিচ্ছে অন্য কোনও কোয়ান্টাম স্টেটে, যেখানে স্লোভাকিয়া থেকে আসা সেলুন-বালিকার ইলেকট্রন আঁকা উত্তোলিত দুই বাহু থেকে বলয়িত বহ্নিশিখা জ্বলে। ‘প্রাগ ক্রনিকল’ কবিতায় কবি ও এক প্রাচীন রাজা দেখেন, টাইকো ব্রাহে ও জোহান কেপলার এক মহাজাগতিক আলাপচারিতায় বসেছেন, আর ফ্রানজ কাফকার সৃষ্ট চরিত্ররা হেঁটে বেড়াচ্ছে অদূরে।

কবিতার অন্য সমস্ত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে প্রায়শই উঁকি মারছে হিউমর, যা সাধারণত কতিপয় কবিকে বাদ দিলে বাংলা কবিতায় সুলভ নয়। হে পাঠক, বলে হেঁকে কবি পরমুহূর্তেই বন্ধনীর মধ্যে লিখছেন— (যদি বা পাঠক কেহ থাকো!)! এ-বই পাঠক না পেলে সে ক্ষতি পাঠকেরই। আবার সেই নির্জন পাঠকের ঠোঁটেই মুচকি হাসি ও বিষাদ একইসঙ্গে খেলে যায় যখন নিরুপম লেখেন আহ্লাদিত তিন মাতালের কথা, যারা চলন্ত ট্রামের নিচে একটু হলেই কাটা পড়েছিল। ‘প্রাগের ওই তিনটি মাতাল,/খুব হাসে, তারপরে বলে:/’ট্রামে কাটা পড়লেই কবি হতে হত, আরে শালা কী যে বেঁচে গেছি।’’ আশা করি, মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক মননকে ধারণ করে আছে এই প্রকৃত আন্তর্জাতিক মানের কবিতাগ্রন্থটি। এ-বইয়ের কবিতা নাগরিক, আদ্যন্ত স্মার্ট, কিন্তু একইসঙ্গে সংবেদী ও হৃদয়বান। বইয়ের প্রকাশক সৃষ্টিসুখের কর্ণধার রোহন কুদ্দুস নিজেও প্রাগে কাটিয়েছেন কিছু বছর। প্রকাশক ও কবি, উভয়ের প্রাগ-প্রেম ফুটে উঠেছে অতি যত্নে তৈরি এই টেবিলবুক-প্রায় গ্রন্থে৷ ঝকঝকে কাগজে ছাপা কবিতাগুলির সঙ্গে সঙ্গত করেছে কবির ক্যামেরায় তোলা বহুবর্ণ আলোকচিত্রগুলি, যা প্রাগ শহরকে বাঙালি পাঠকের আরও কাছে নিয়ে এসেছে। প্রাগে শীতের এই আবাহন বাঙালি পাঠকের কাছে বসন্তের আনন্দ-নির্ঘোষ।