বিমল দাস
দেশের যা অবস্থা, ভাল কিছু তো চোখে পড়ে না। জিনিসপত্রের দাম তো আমাদের মতো গরিব মানুষের জানের ওপর হয়ে যাচ্ছে। এক কিলো আলুর দাম ৩০ টাকা, পেঁয়াজ ৪০ টাকা। গরিব মানুষ খাবে কী
আমরা মালদার ইংরেজবাজারের বাসিন্দা। আমি, আমার স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বৌ আর এক নাতি— এই নিয়ে আমাদের পাঁচজনের সংসার। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। সংসারে উপার্জন করি আমি আর আমার ছেলে। আমার স্ত্রীরও একটা রোজগার অবশ্য আছে। ও লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা পায় মাসে মাসে। আর আমাদের দুজনের মধ্যে ছেলেই এখন মূল রোজগেরে। আমি আমার মাইনের টাকাটা থেকে মুদিখানার টাকা দিই। আর বাদবাকি টাকা ছেলের হাতে তুলে দিই। ও-ই সংসার চালায়।
তা না করে উপায়ও নেই। আমার এখন রোজগার মাসে মাত্র ৩০০০ টাকা। সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করি। একটা ফ্ল্যাটবাড়িতে। তাতে এই মাইনে পাই আমি। এর থেকে মুদিখানার দোকানে যায় ১৫০০ টাকা। আর ১৫০০ টাকা দিতে পারি ছেলের হাতে।
ছেলের রোজগার হয় মাসে ওই ৭-৮০০০ টাকা। ও ইলেকট্রিকের কাজ করে। কন্ট্রাক্ট নেয়, নিয়ে কাজ করে। তাতে ওরকমই থাকে। মানে আমাদের পরিবারের সাকুল্যে রোজগার ওই মাসে ১০-১১০০০ টাকা।
অথচ আমার অবস্থাটা বিশেষ করে এরকম ছিল না। আমি বাসে খালাসির কাজ করতাম। তাতে আমার মাসে ছেলের মতোই ৭-৮০০০ টাকা রোজগার হত। কিন্তু এই লকডাউনে সব শেষ হয়ে গেল। লকডাউনের সময়ে বাসমালিক সব স্টাফদের ছাড়িয়ে দিল, আমারও কাজ গেল। লকডাউনের পর থেকে তাই বাধ্য হয়ে এই গার্ডের কাজ করছি। পেট তো চালাতে হবে।
এই যে, যে-টাকাটা রোজগার করি তার পুরো টাকাটাই সংসারে দিয়ে দিই, ফলে ধার তো আমাকে করতেই হয়। প্রতি মাসেই করতে হয়। আমারও তো কিছু হাতখরচা লাগে। বৌ লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে যে-টাকাটা পায় তার থেকে ২-১০০ টাকা দেয় আমায় হাতখরচার জন্য। কিন্তু যদি কোনও মাসে ওষুধবিষুধ কিনতে হয়, তখন বেশ কিছু টাকাই ধার হয়ে যায়। গত মাসেই যেমন যে-ফ্ল্যাটবাড়িতে গার্ডের কাজ করি সেখানকার এক ম্যাডামের কাছ থেকে ১২০০ টাকা ধার করতে হয়েছিল। দিয়ে দিয়েছি এ-মাসে টাকাটা। কিন্তু তার জন্য আবার মুদিখানার দোকানে ধার রাখতে হল।
পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪
সরকারের থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা যেটা পাই সেটা হল ওই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। আর সরকারের ওপর আমার মূল ক্ষোভের জায়গাটা হল আমার বয়স্ক ভাতাটা কিছুতেই দিচ্ছে না ওরা। আমার বয়স এখন ৫৮ পেরিয়ে গেছে। অনেকবার দরবার করেছি। বলছে ৬০ বছর বয়স না হলে নাকি পাওয়া যাবে না। অথচ আমাদের পাশের ওয়ার্ডের একজনের ৬০ বছর বয়স হতে এখনও দু-বছর বাকি, তার বয়স্ক ভাতা করে দিয়েছে। আমার তো মাত্র দেড় বছর বাকি। এই ভাতাটা পেয়ে গেলে আর এই হাতখরচের জন্য এর-ওর কাছে হাত পাততে হত না।
আমার বাড়ির ছাদটাও ভেঙে গেছে। সরকার থেকে বাড়ির ছাদ করে দেয়, সেটাও আমি পাইনি। কাউন্সিলারকে বলাতে আমায় বলল, তোমরা তো দুজন রোজগার করছ, তোমাদের আবার সরকারের টাকা লাগবে কেন! এই তো অবস্থা!
এমনিতে দেশের যা অবস্থা, ভাল কিছু তো চোখে পড়ে না। আমার অত খবর-টবর শোনা বা দেখা হয় না, কিন্তু চলাফেরা করি তো, দেখতে পাই। জিনিসপত্রের দাম তো আমাদের মতো গরিব মানুষের জানের ওপর হয়ে যাচ্ছে। এক কিলো আলুর দাম ৩০ টাকা, পেঁয়াজ ৪০ টাকা। গরিব মানুষ খাবে কী!
ভোট দেব। ভোটের আগে সব দলই তো অনেক কিছু দেওয়ার, করার কথা বলে। তাই যারা কখনও সুযোগ পায়নি তাদের একবার দেখা যায় যে তারা এলে সত্যি কিছু করে নাকি। আমার নিজের চাওয়া বলতে, ছেলেটার কাজকর্মে উন্নতি হোক, আমার বয়স্ক ভাতাটা চালু হোক, জিনিসপত্রের দাম কমুক…
*সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পক্ষে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অরিন্দম বিশ্বাস