নন্দন রায়
হিন্দু ও মুসলমানের সঙ্ঘাতের ভাষ্য যে মাঠে মারা যাচ্ছে, তা আসলে যে ভোটে জেতার কৌশল— এ-কথা যখন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তখন বোঝাই যাচ্ছে সন্দেশখালির রাজনৈতিক অর্থনীতি বুঝতে গেলে দ্বিতীয় পথটি অনুসরণ করে দেখা উচিত। অর্থাৎ, যে জবরদখল ও বঞ্চনার কথা আমরা গোড়াতেই বলেছি, তা কতটা পানি হালে পায়, এবারে আমরা তা দেখব। সারবস্তুতে সন্দেশখালিতে যা কিছু ঘটেছে সেটা আসলে মমতার দ্বারা অনুসৃত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মডেলের সঙ্কট। সেটাই এখন আলোচনা করব
অধুনা বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত সন্দেশখালির রাজনৈতিক পরিক্রমার দুটি ভাষ্য বাজারে চলছে। প্রথমটি হল, হিন্দু-মুসলমান বিভাজন, এবং দ্বিতীয়টি হল জবরদখল ও বঞ্চনার কাহিনি। প্রথম ভাষ্যের ভিলেন হচ্ছে তৃণমূল নেতা শেখ শাজাহান এবং তার শিকার হচ্ছে হিন্দু মহিলারা। এটি সেই প্রকারের এক ভাষ্য যা বহুকাল ধরে এদেশে চলে আসছে এবং নির্বাচনে প্রথম পর্ব শেষ হতে না হতেই রামমন্দির, চন্দ্রযান ইত্যাদি চুলোয় দিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী ফের সেই খেলায় মেতেছেন— যেখানেই হিন্দুরা দুর্বল অথবা সংখ্যালঘু, তা সে এদেশে কাশ্মির হোক অথবা বাংলাদেশ বা পাকিস্তান হোক অথবা সন্দেশখালি— সেখানেই মুসলমানরা ‘হতভাগ্য’ হিন্দুদের নিপীড়ন করে চলেছে। নবজাগ্রত একদল সুশীল-সুবোধ শুভেন্দু-সুকান্তরা ৭৫ বছর আগে ঘটে যাওয়া দেশভাগের স্মৃতিকাতরতায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছে। সমস্যা হল, সন্দেশখালির এহেন মুসলমানদের দ্বারা হিন্দু নারীর শ্লীলতাহানির কাহিনি কেবল আংশিক নয়, পুরোপুরি অসত্য। ‘শত শত’ নারীনির্যাতনের যে অপরাধের কথা এত ফলাও করে বলা হচ্ছে, তার প্রধান অপরাধী হিসেবে যাদের এখনও পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে তারা তৃণমূলের নেতাই বটে, তবে তাদের নাম হল উত্তম সর্দার, শিবপ্রসাদ হাজরা এবং অজিত মাইতি— কেউই মুসলমান নয়। (এখন তো আবার শোনা যাচ্ছে যে শুভেন্দু অধিকারীর নির্দেশে কয়েকজন মহিলাকে নির্যাতিতা সাজিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ পেশ করা হয়েছে!)।
ভিলেন-খ্যাত শেখ সাহেবের নজর সম্ভবত বালুবাবুর হিস্যেদারির দিকেই বেশি নিবদ্ধ ছিল। কিন্তু গ্রেফতারি এড়িয়ে তিনি যে প্রায় মাসখানেক এলাকাতেই গা ঢাকা দিয়েছিলেন, সেটা যে পার্টি, পুলিশ ও প্রশাসনের মদতে সম্ভব হয়েছিল সে-কথা সন্দেশখালির আপামর শিশুও অবগত ছিল। ফলে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে যে-অভিযোগ মুসলমান তোষণের আকারে উঠেছে, সেই অভিযোগ মোচন করা কঠিন। এসব কাণ্ডের পরে বিজেপি যে লাফালাফি করবে সেটা সহজেই অনুমেয়। শুধু তাদের ভ্রান্তি একটু শুধরে দেওয়া দরকার এই কথা বলে যে, সমস্ত দুষ্কৃতি তোলাবাজ এবং মাফিয়া সকলেই মমতার ছত্রছায়ায় থাকে ততক্ষণই যতক্ষণ মমতার পক্ষে পালটা রাজনৈতিক চাপ হজম করার শক্তি থাকে। তাপরে তিনি ঝাড়া হাত-পা হয়ে যান।
সন্দেশখালিতে এইরূপ অত্যাচারী মুসলমান বনাম সংখ্যালঘু ‘অসহায়’ হিন্দুদের ন্যারেটিভ হালে পানি পাবে না যদি আর একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়— সন্দেশখালি-১ ও সন্দেশখালি-২ ব্লকের ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক সংখ্যা যদি বিচার করি তাহলে দেখব ১ নম্বর এবং ২ নম্বর ব্লকের হিন্দু জনসংখ্যার পরিমাণ যথাক্রমে ৭০ এবং ৭১ শতাংশ! এরা মূলত দলিত এবং উপজাতি। বিজেপির বৃহৎ হিন্দুত্বের ছাতার তলায় এরা সকলে ‘হিন্দুভূত’ হয়ে গিয়েছে। এসব কথা কজন আর জানে? তাই সন্দেশখালি হয়ে উঠেছে চলতি নির্বাচনে তুরূপের তাস।
হিন্দু ও মুসলমানের সঙ্ঘাতের ভাষ্য যে মাঠে মারা যাচ্ছে, তা আসলে যে ভোটে জেতার কৌশল— এ-কথা যখন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তখন বোঝাই যাচ্ছে সন্দেশখালির রাজনৈতিক অর্থনীতি বুঝতে গেলে দ্বিতীয় পথটি অনুসরণ করে দেখা উচিত। অর্থাৎ, যে জবরদখল ও বঞ্চনার কথা আমরা গোড়াতেই বলেছি, তা কতটা পানি হালে পায়, এবারে আমরা তা দেখব। সারবস্তুতে সন্দেশখালিতে যা কিছু ঘটেছে সেটা আসলে মমতার দ্বারা অনুসৃত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মডেলের সঙ্কট। আমরা এখন তারই আলোচনায় প্রবেশ করব। কিন্তু তার আগে একটা বিষয় বলা দরকার। হিন্দু-মুসলমান সঙ্ঘাতের বিষয়টিকে আমরা গৌণ মনে করি বটে কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সেখানে কোনও সঙ্ঘাতই নেই। পশ্চিমবঙ্গ যেহেতু ভারতের বাইরে নয়, তাই দেশচালকদের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের অহর্নিশ ঢক্কানিনাদ সন্দেশখালি থেকে শোনা যায়নি এমনটা নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু মূলত হিন্দি বলয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যহীন এই ভাষ্য বঙ্গের সুদীর্ঘ ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত উত্তরাধিকার মোদি-শাহদের জগঝম্পে এত তাড়াতাড়ি আত্মসমর্পণ করবে বলে মনে হয় না— এমনকি মমতা-মার্কা এক যুগব্যাপী দুঃশাসন সত্ত্বেও।
বাম শাসনের শেষপর্ব এবং প্রতিবিপ্লব
দক্ষিণপন্থী ও অতি বামপন্থী যাবতীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির মধ্যে এক অনুক্ত সমঝোতা হয়েছিল যে ২০১১ সালের নির্বাচনে পরাজিত বামপন্থীরা যাতে আর কোনওদিনও ক্ষমতায় ফিরে আসতে না পারে তা সুনিশ্চিত করতে হবে। এর পেছনে ছিল নয়া উদারবাদের থিঙ্ক-ট্যাঙ্কের আশীর্বাদ। (তাদের এই স্বপ্ন সফল হয়েছে। শুধু আজকে কেন, অনতি ভবিষ্যতেও আরও একটি বাম সরকারের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের মার্গদর্শনের কাজটি অবশ্য বামপন্থীদেরই করতে হবে।)
তারও আগে, যখন বাম সরকার ক্ষমতায় আসীন ছিল, তখন সেই সরকারের প্রথমার্ধের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি যথা প্রাথমিক ভূমিসংস্কার এবং গ্রাম ও শহরের সাধারণ মানুষের স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে ক্ষমতায়ন ইত্যাদি মোটামুটি সম্পন্ন হওয়ার পরে যে দ্বিতীয় উল্লম্ফনের প্রয়োজন ছিল, ভারতে এবং গোটা দুনিয়ায় পুঁজিবাদের নয়া-উদারবাদী কর্মসূচি এমন জাঁকিয়ে বসেছে যে একটি অঙ্গরাজ্যে ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে আসা অর্থনৈতিক ক্ষমতায় তা ঘটানো সম্ভব ছিল না। নয়া-উদারবাদের অর্থনৈতিক এবং ফলত রাজনৈতিক দস্যুতা সম্পর্কে আমরা সবাই মোটামুটি অবগত, কিন্তু এর ফলে যে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব মানুষকে আচ্ছন্ন করে ফেলে তা কম ভয়ঙ্কর নয়। মানুষ সমষ্টির থেকে ব্যক্তিস্বার্থকে, নৈতিকতার অলঙ্ঘ্যনীয়তা থেকে মূল্যবোধহীনতায় কখন যে অধঃপতিত হয়, সে নিজেও জানে না। সূর্যকান্ত মিশ্র তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় দলীয় কর্মীদের সতর্ক করে দিতেন এই বলে যে, তাঁরা যেন ‘মগজের ওপর এই আক্রমণ’ প্রতিরোধে সচেতন থাকেন।
একটি বামপন্থী দল তার মতাদর্শের সচেতনতা দিয়ে অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান জনস্বার্থবিরোধী নয়া-উদারনীতিবাদের মনস্তাত্ত্বিক আগ্রাসনকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। তবুও দলের কর্মীরা যেহেতু সামাজিক জীব, তাই সমাজে প্রবলভাবে প্রবাহিত নয়া-উদারবাদী আগ্রাসনকে অগ্রাহ্য করা সবক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। ফলে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার যে মূল সাংগঠনিক নীতির দ্বারা একটি বামপন্থী দল চালিত হয়, তার প্রাণবন্ত প্রবাহ স্তিমিত হতে থাকে, যে-কর্মীদের ‘জলের মধ্যে মাছের মতো’ জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা, সেখানে অবসাদ আসে এবং এই ছিদ্র দিয়ে লখিন্দরের লৌহবাসরে প্রতিবিপ্লব ঢুকে পড়ে। নয়া-উদারবাদের দৌলতে দুনিয়াজোড়া প্রতিবিপ্লবের বাতাবরণে একদিকে যেমন এদেশে দীর্ঘস্থায়ী গণতান্ত্রিক বিপ্লবের খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলার কারণে কেন্দ্রীয় স্তরে এক সামাজিক প্রতিবিপ্লব সঙ্ঘটিত হয়ে চলেছে, অন্যদিকে আরও গভীরতর গণতান্ত্রিক পরীক্ষানিরীক্ষার গতিশীলতা স্তিমিত হয়ে যাওয়ার কারণে প্রতিবিপ্লবী সামাজিক শক্তিগুলি জোটবদ্ধ হয়ে বাম শাসনের অবসান ঘটাতে সমর্থ হয়েছে। মনে রাখতে হবে, এই প্রতিবিপ্লবের সফলতা কেবল সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনাবলি দিয়ে হঠাৎ ঘটে যাওয়া উৎপাত-বিশেষ নয়, জন্মলগ্ন থেকেই তৃণমূল প্রতিবিপ্লব সঙ্ঘটিত করার চেষ্টায় ছিল। প্রশ্ন হল আরও সচেতন প্রয়াসে বামপন্থীরা কি এই প্রতিবিপ্লব রুখতে পারত? বর্তমান নিবন্ধলেখকের মতে ইতিহাসের এই অনিবার্যতাকে একটি অঙ্গরাজ্যের বামপন্থীদের দ্বারা প্রতিহত করা সম্ভব ছিল না, বিশেষত গোটা দেশেই যখন বামপন্থীদের শক্তিক্ষয়ের কালবেলা চলছে।
প্রতিবিপ্লব বিষয়টি নিয়ে বঙ্গের বাম মহলে বিশেষ আলোচনা হয় না। প্রতিবিপ্লবকে এই কারণেই সম্যকভাবে বুঝতে হবে কারণ বিশেষ বিশেষ ঐতিহাসিক সঙ্কটমুহূর্তে যখন বিশ্ব-পুঁজিবাদী অর্থনীতি সঙ্কটের আবর্তে পড়ে, তখন প্রতিবিপ্লবই তার করাল মূর্তিতে দেখা দেয় যাকে ফ্যসিবাদ আখ্যা দেওয়া হয়। এই বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা গড়ে তুলতে উৎসাহীরা ইলিয়ানর মার্কস এভেলিং সম্পাদিত মার্কসের বিভিন্ন লেখার সঙ্কলনটি[1] পড়ে দেখতে পারেন। অবশ্য মার্কসের সময়ে ফ্যাসিবাদের ধারণা গড়ে ওঠার কোনও বস্তুগত পরিস্থিতি ছিল না, কারণ পুঁজিবাদ তখন বিকাশের মুখে।
মমতার রাজনৈতিক মডেল
ক্ষমতা করায়ত্ত করে মমতা প্রথম যে কর্মটি সম্পাদন করলেন, তা হল বদলার রাজনীতি। কিন্তু পাছে নির্বিচার বদলা জাতীয় স্তরে কোনও আলোড়ন তোলে, তাই নির্বিচার যথেচ্ছ বদলা নয়, যা করলে বামপন্থীদের মূল শক্তিকে পঙ্গু করে দেওয়া যাবে, সেই ধরনের হামলা সংগঠিত করা চাই— যেটা আলিমুদ্দিনে বোমা ছোঁড়া নয়, জেলাস্তর ও তার নিচের বাম সংগঠন এবং বিভিন্ন ফ্রন্টের বাম সংগঠনগুলির ওপরে আগ্রাসন। একদম প্রাণে মেরে দেওয়া নয়, এমন হামলা যা গ্রামের সক্রিয় কর্মীদের মেরে হাত-পা ভেঙে দেবে, জমি থেকে উৎখাত করবে, বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেবে, এলাকায় থাকার মাশুল হিসাবে জরিমানা দিতে হবে, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হবে ইত্যাদি।
স্বাধীনতার সময়কার তরুণ বামপন্থী কর্মীরা যে কঠোর ত্যাগস্বীকার, প্রায় সন্ন্যাসীদের মতো জীবনযাপন এবং আন্তরিক অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে বাম সরকারের ভিত্তিপ্রস্তর রচনা করেছিলেন এবং দৃঢ় হাতে সংগঠনের রাশ ধরে রেখেছিলেন, বাম শাসনের শেষ পর্বে তাঁদের বিদায় সম্পূর্ণ হয়েছিল। তাই তাঁদের পরের প্রজন্মের হাতে সংগঠনের দায়িত্ব অর্পিত হওয়ার পরেও কৃষির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নব্য ধনী, উদ্যোগী ও নয়া-উদারবাদের প্রসাদলুব্ধ একদল নীতিহীন মানুষ নেতাদের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে সংগঠনে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু তাদের সেই প্রচেষ্টা বিশেষ সফল হয়নি। পালাবদলের পরে তারা দল বেঁধে তৃণমূলে যোগদান করেছে। এই ঘটনাকে বিকৃত করে দু-একটা উদাহরণ সামনে সাজিয়ে “বামপন্থীদের দলে দলে তৃণমূলে যোগদান”-এর গল্প সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়েছিল। তা যদি হত তাহলে আজকে বামপন্থীদের যেমন অস্তিত্ব থাকত না, তেমনি ‘পরিবর্তন চাই’ স্লোগান তুলে তৃণমূলকে প্রথম দিন থেকেই ছাপ্পা ভোটের ওপরে নির্ভরশীল থাকতে হত না।
কিন্তু এ-কথা ঠিক যে মমতার মতো এক স্বৈরতন্ত্রীর পক্ষে বামপন্থীদের কায়দায় সংগঠন অথবা সরকার কোনওটাই চালানো সম্ভব ছিল না। কারণ বামপন্থীদের যে মতাদর্শগত প্রাধান্য ও তার ফলে যে জোরালো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ইন্টেলেকচুয়াল সম্পদ ছিল, মমতা তথা তৃণমূলের মতো দল, যাদের উদ্ভব হয়েছিল রাস্তায় গুন্ডামি এবং লুম্পেনবৃত্তির মধ্য দিয়ে, তাদের দিয়ে নেত্রীর জয়ধ্বনি তোলানো যেতে পারে, কোনও মুক্ত ও অগ্রণী চিন্তা-চর্চার অনুশীলন সম্ভব নয়। মতাদর্শ অথবা কর্মসূচি বলে মমতার দলের যদি কিছু থাকে, তবে তার একদিকে রয়েছে বামপন্থীদের নিধন আর অন্যদিকে রায়েছে অবাধ তস্করবৃত্তি। বামপন্থী সংগঠনগুলির প্রাথমিক নিধনপর্ব শেষ করে তাদের হস্ত প্রসারিত হল রাজকোষ লুন্ঠনের দিকে। এমতাবস্থায় সংগঠন ও সরকার পরিচালনা উভয়ক্ষেত্রেই অতএব আমূল পরিবর্তনের সূচনা হল।
মমতার দলে তিনি একাই যাবতীয় কর্তৃত্বের এবং ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার দরুণ দলে কোনও স্থায়ী অনুক্রম (hierarchy) নেই, কর্তৃত্বের ভাগবাঁটোয়ারা নেই। নেত্রীর নির্দেশই শেষ কথা। বুর্জোয়া সরকারি কাঠামো পরিচালনার জন্য বহুযুগ ধরে যেসব বিধি-নিয়ম ডান বাম নির্বিশেষে সবধরনের সরকারই মেনে এসেছে, ক্ষমতায় এসে মমতা এক ফুৎকারে সেইসব নিয়ম-কানুন উড়িয়ে দিলেন। এখন থেকে তাঁর কথাই আইন। তাঁকে ঘিরে রইল তুলনামূলকভাবে জমিজমাসম্পন্ন সেইসব উদ্যোগী কর্মতৎপর এবং কৃষির বাইরেও আয়ের ব্যবস্থা আছে এমন লোকজন যারা বাম আমলে সাংগঠনিক ক্ষমতা কব্জা করার তালে ছিল কিন্তু বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি। এরাই ভূমিসংস্কারের দরুণ সিলিংবহির্ভূত জমি হারিয়েছে। বাম আমলে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলের ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে তারা ধান্দার ধনতন্ত্রের মাধুর্য উপলব্ধি করেছে। এখন এরাই হয়ে দাঁড়াল মমতার দলের ক্ষমতার তল্পিবাহক। রাজনৈতিক ক্ষমতার পাশাপাশি তারা অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েও দাঁড়াল। মমতা যে এ-ব্যাপারে অনবহিত ছিলেন তা কিন্তু নয়, বরং সব ক্ষেত্রেই এদেরকেই মমতার প্রয়োজন হল। পদে পদে মুনাফার লেনদেন রাজনৈতিক কর্তৃত্ব এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার মানদণ্ড স্থির করে দিল।
মুঘল আমলে যেরকম মনসবদারি প্রথা চালু ছিল, মমতা প্রাথমিকভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করলেন তারই এক যুগোপযোগী আধুনিক রূপ যার মূলে রয়েছে মাফিয়াতন্ত্র। রাজ্যের জেলাগুলির শাসনভার তিনি তুলে দিলেন তার বিশ্বস্ত অনুচরবর্গের হাতে। কেউ কেউ আবার মন্ত্রিসভাতেও স্থান পেল। দলীয় ও প্রশাসনিক কর্তৃত্বের ভার কার হাতে কতটা অর্পিত হবে, পঞ্চায়েত ও পুরসভার নির্বাচিত আধিকারিকদের হাতেই বা কী কী ক্ষমতা থাকবে সেই বিষয়টি যতটা সম্ভব অস্পষ্ট ইচ্ছে করেই রাখা হল। এই অস্পষ্টতার উদ্দেশ্য ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে— প্রথমত, কাউকেই বেশি ‘বাড়তে’ দেওয়া হবে না। অন্যান্য আকাঙ্খীরা সবসময়ে শ্যেনদৃষ্টি রাখছে তাদের লুন্ঠনের ওপরে, ভাগ-বাঁটোয়ারার গোপন নির্দেশের ব্যত্যয় যেন না হয়। ওমনি খবর চলে যাবে কালিঘাটে। পরবর্তী ‘প্রশাসনিক’ বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্য সভায় তাকে নানা ছুতোয় অপদস্থ করবেন, এমনকি তৎক্ষণাৎ বরখাস্তের নির্দেশ মৌখিকভাবে জারি করবেন এবং তা সেদিন থেকেই কার্যকর হবে।
এই মনসবদারি প্রথা যতটা না সুষ্ঠুভাবে শাসন পরিচালনার স্বার্থে, তার চেয়েও বেশি তোলা আদায়ের স্বার্থে। প্রতিটি পয়সা তোলা আদায়ে যেহেতু সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ভাগীদারি ঈশ্বরদত্ত অধিকার, শাসক হিসেবে ব্যক্তিটি যতই অপদার্থ হোক না কেন, ‘আসল’ কাজে দক্ষ হতে হবেই। এই বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য আমরা দুটি প্রতিনিধিস্থানীয় উদাহরণ তুলে ধরব। প্রথম উদাহরণ একেবারে সাম্প্রতিক সন্দেশখালির ঘটনা। মনসব প্রথায় উত্তর ২৪ পরগণা জেলাটি বালুবাবু্র হাতে দেওয়া ছিল। (সেইসঙ্গে রেশনের চাল চুরির বাড়তি দায়িত্বও মন্ত্রী হিসাবে তার হাতে ন্যস্ত ছিল)। জেলার সন্দেশখালি ব্লকটিকে তিনি সঁপেছিলেন শেখ শাজাহানকে। শাজাহান তার মুৎসুদ্দি হিসাবে সন্দেশখালির ২নং ব্লকটি ‘সাব লেট’ করেছিল তার স্যাঙাৎ শিবু হাজরাকে এবং হাজরা সন্দেশখালি গ্রাম পঞ্চায়েতটি আবার ‘সাব লেট’ করেছিল উত্তম সর্দারকে। ক্ষমতা ও মুনাফার এইরূপ ‘জোগান-শৃঙ্খল’ই তৃণমূলের জীবনীশক্তির কম্যান্ড স্ট্রাকচার।
দ্বিতীয় উদাহরণটি আরও চমকপ্রদ। আসানসোল-রানিগঞ্জ কয়লা বেল্ট থেকে, বেআইনি খাদান থেকে কয়লা পাচারের ভাগের টাকা ঠিকমতো যথাস্থানে এসে পৌঁছচ্ছে কিনা এ-বিষয়ে সন্দেহ দেখা দেয় বিনয় মিশ্রের কাজকর্মে, যে কিনা এই বিশেষ পণ্যটির হিস্যেদারির দায়িত্বে ছিল। সেইজন্যেই তাকে যুব তৃণমূলের সম্পাদকের দায়িত্বে বসানো হয়। লেনদেনের ব্যবস্থা স্বচক্ষে তদারকি করতে কাকপক্ষী জেগে ওঠার আগেই নবজাগ্রত উত্তরাধিকারী নিজেই রওনা দেন আসানসোলের দিকে কারণ ‘মামলা’টি বহু কোটির। বাক্স বোঝাই টাকা নিয়ে ফেরার পথে মধ্যরাতে গাড়িটি দুর্ঘটনায় পতিত হয়, আরোহীর মুখমণ্ডল থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। সে-রাতে কলকাতায়, বর্ধমানে এবং আসানসোলের পুলিশকর্তাদের রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল। গোটা ঘটনাটি গোপন রাখতে হবে, আহত ভিভিআইপিকে হাসপাতালে নিতে হবে এবং ‘মাল’ দ্রুত অকুস্থল থেকে সরাতে হবে। দুর্ঘটনার আওয়াজ পেয়ে আশপাশের কিছু লোক, যারা জড়ো হচ্ছিল তাদের ভুজুংভাজুং দিয়ে সরিয়ে দেওয়া ইত্যাদি অত্যাবশ্যক কাজ সেরে ফেলা হল ভোরের পাখি ডাকার আগেই। তৃণমূল এভাবেই চলে।
হিস্যেদারির রাজনীতি অথবা ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেল
পণ্ডিতরা তৃণমূলের এই বিশেষ ধরনের রাজনীতির নাম দিয়েছেন ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেল অব পলিটিক্স। দুটি কথা এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার। প্রথমত, এই বিশেষ মডেলটি তৃণমূলের শাসনের প্রথম দিন থেকেই গড়ে ওঠেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মডেলটি বর্তমান আকার পেয়েছে। এতে কেবল দলীয় মন্ত্রী-সান্ত্রী-স্যাঙাৎরাই জড়িত নেই, যেহেতু ক্ষমতা, বিশেষ করে যে-ক্ষমতার সঙ্গে টাকা সাতপাকে বাঁধা, তার গন্ধ বহুদুর ছড়ায়, তাই সিস্টেমটিকে মসৃণভাবে চালানোর জন্য এর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে যুক্ত রয়েছে পুলিশ এবং সাধারণ প্রশাসনের আমলাবাহিনি। এ এক স্বেচ্ছাকৃত সুগঠিত রাজ্যব্যাপী বিপুল নেক্সাস যা গোটাটাই কালিঘাটের নিয়ন্ত্রণে চলে। থানার ওসি অথবা ব্লকের বিডিও, দলের অঞ্চল সভাপতি অথবা পঞ্চায়েতের প্রধান, যে-কারও বদলি অথবা অপসারণ কালিঘাটের গ্রিন সিগন্যাল ভিন্ন সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, তৃণমূলের নেতা-উপনেতারা কেবল যে সব অন্যান্য মানুষকে বঞ্চিত করে লুণ্ঠনে ব্যস্ত তা কিন্তু নয়। বরং লুণ্ঠনের পথকে নিরঙ্কুশ করতে হাতে থাকা চাই ক্ষমতা, আর ক্ষমতা ধরে রাখতে চাই জনবল। বুর্জোয়া ব্যবস্থায় রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং রজতখণ্ডের ঝনাৎকার একে অন্যের হাত ধরাধরি করে চলে। সুতরাং রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রসারিত করতে হলে এই মাফিয়া লুঠেরাদের ওপরে নির্ভরশীল এক বিরাট সংখ্যক মানুষকে সঙ্গে রাখা চাই। নয়া-উদারবাদের জমানার মতো তৃণমূলের রাজনীতিতে সবই যেহেতু পণ্যে পরিণত হয়েছে, তাই মানুষের আনুগত্যও টাকার লেনদেন-এ ক্রীত হয়। অসংগঠিত অর্থনীতিতে নেতার ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ, ভেড়িতে মাছের পরিচর্যার কাজ, সার ও কীটনাশক বিক্রির দোকানে অথবা রাইসমিলে মজুরের কাজ ইত্যাদি এবং অবশ্যই বিরোধী পেটানো, ভোটে ছাপ্পামারার ‘বিশেষ’ কাজ। ফলে গ্রামাঞ্চলে এক বিপুল সংখ্যার মানুষ নেতাদের মুখাপেক্ষী। তাই শেখ শাজাহানের বাড়িতে ইডির বাহিনি যখন পৌছল, তখন যে শত শত নারী-পুরুষ তাদেরকে বাধা দিল সে কেবল নেতাকে বাঁচাতে নয়, নিজেদের রুটি-রুজি নিশ্চিত করার জন্যেও বটে। কারণ নেতার জেলযাত্রা তাদের দিন-আনি-দিন-খাই জীবনকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেবে। তাই বলে এ-কথা ভাবার কোনও কারণ নেই যে এখানে বিনিময় প্রথা ক্রিয়াশীল নয়। ভোটের সময় তৃণমূলকে সমর্থন করার মধ্যে কোনও সামাজিক অথবা রাজনৈতিক মতাদর্শগত আবেগ কাজ করে না। বরং এর পেছনেও একটি মূল্য ধার্য করা থাকে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ইত্যাদি বিভিন্ন ‘সাথী’মার্কা খয়রাতির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া এই প্রান্তিক মানুষদের পক্ষে খুবই কঠিন। তবু মানুষের মধ্যে একটা অস্পষ্ট ধারণা আছে যে মমতার বদান্য স্বৈরতন্ত্রের অনুগ্রহ ভিক্ষার কিছু দাম তো দিতেই হয়। মতাদর্শ বলতে শুধুই এইটুকু। বিপরীতে বামপন্থী সমর্থকদের চেতনার মান অনেক উচ্চস্তরের। গত ১০-১৫ বছর ধরে এই নীতিহীন রাজনীতি একদিকে যেমন বঙ্গবাসীর নৈতিকতার অবনমন ঘটিয়েছে, অন্যদিকে তেমনই চেতনার বি-রাজনীতিকরণ ঘটিয়েছে। মানবিক মননের এইরূপ অবচেতনা হিন্দুত্ববাদের নিরন্তর ভ্রান্ত প্রচার এবং হতভাগ্য ‘অপর’ সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষের প্রচারে সাড়া দেয়। যাই হোক না কেন, এক ধরনের পরোক্ষ হলেও সামাজিক সম্মতি ব্যতিরেকে কোনও শাসনব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না।
পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪
তৃতীয়ত, এইভাবে তৃণমূল নেতারা ধান্দার ধনতন্ত্রের সর্বোচ্চ শিখর ছুঁয়েছে, অসৎ পথে সরকারি কন্ট্রাক্ট এবং টেন্ডার বাগিয়ে বিপুল মুনাফা করেছে, অথচ সংগঠিত পুঁজির (কর্পোরেট ক্যাপিটাল) অংশ হয়ে যায়নি, নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে অসংগঠিত পুঁজি (নন-কর্পোরেট ক্যাপিটাল) হিসেবে। এই নন-কর্পোরেট পুঁজি নিয়োজিত হয় অসংগঠিত শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রে, যেমন ইটভাটায়, কৃষি উপকরণের ডিলারশিপে, উপকূলীয় এলাকায় ভেড়িতে, বাজার এলাকায় শো-রুমে, তেজারতি কারবারে, রাইসমিলে ইত্যাদিতে যেখানে দৈনিক ভিত্তিতে মজুরের প্রয়োজন হয়, অথবা স্বল্প বেতনের খাতালিখিয়ে হিসেবরক্ষকদের। ফলে বিরাট এক অনুগৃহীত জনতাপুঞ্জ সবসময়ে হাতের কাছে মজুত থাকে। ধনী থেকে ধনীতর হয়ে ওঠা এই মাফিয়া সর্দার ওরফে তৃণমূল নেতারা নিজেদের সাম্রাজ্য রক্ষা করার তাগিদে এক গোষ্ঠীগত স্বার্থের ভাগীদার, কারণ প্রত্যেকের মুনাফার লভ্যাংশ ধাবিত হয় একটিমাত্র কেন্দ্রে। এটাই হিস্যেদারির রাজনীতি।
মাফিয়া নেতাদের মুনাফার বেশ কিছুটা ব্যয় হয় বিলাসব্যসনে, প্রাসাদোপম অট্টালিকায়, একাধিক দামী গাড়িতে এবং মৃত পুঁজি হিসেবে আলমারির লকারে অথবা বান্ধবী বিনোদনে। গরু পাচারে, চাল চুরিতে, চাকরি চুরিতে, পুরসভায়, পূর্ত দপ্তরে, কয়লা পাচারে ইত্যাদি কোথায় নেই এই হিস্যেদারির রাজনীতি?
চতুর্থত, তাহলে কি ধরে নিতে হবে একবার নেতা হতে পারলে জীবনটা কি এতটাই কুসুমাস্তীর্ণ? তা অবশ্যই নয়। দলের ‘বঞ্চিত’ উদ্যোগীদের আকাঙ্খার মোকাবিলা করতে হয়। এটাও তৃণমূলী জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে মমতা ব্যনার্জী বিশেষ ভাবিত নন, বরং অনেক ক্ষেত্রেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মদত থাকে। কেউ যেন ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী না হয়ে ওঠে, কেউ যেন নেত্রীর ‘আশীর্বাদ’কে “ফর গ্র্যান্টেড” ধরে না নেয়। এমনকি যুবরাজ যখন আইপ্যাক-এর উপদেশমতো দলের প্রবীণ প্রজন্মকে সরিয়ে নবীন প্রজন্মকে সামনের সারিতে আনার অভিযান শুরু করেছিলেন, মমতা কিন্তু দলের মধ্যে ‘দ্বিতীয় ক্ষমতাকেন্দ্র’ গড়ে ওঠা অঙ্কুরেই বিনাশ করেছিলেন।
শেষত, এই হিস্যেদারির রাজনীতি কি অনন্তকাল চলতে পারে? এর উত্তর অবশ্যই ‘না’। একদিকে লুণ্ঠন অন্যদিকে যেটুকু রাজস্ব পড়ে থাকে তাই দিয়ে এবং কেন্দ্রীয় সহায়তার টাকা দিয়ে ছিটেফোঁটা খয়রাতি। ইদানিং কেন্দ্রীয় সহায়তা মোদিরাজের প্ররোচনায় শুকিয়ে এসেছে। রাজ্য কোনওমতে চলছে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার দেনা মাথায় নিয়ে। হিস্যেদারির রাজনীতি থেকে মমতা যে বেরিয়ে আসবেন তারও উপায় নেই। তাহলে দলটাই উঠে যাবে। মমতা একা বসে থাকবেন লুন্ঠিত ঐশ্বর্যের বোঝা মাথায় নিয়ে। এই রাজনীতি ও অর্থনীতি তাঁরই নিজস্ব সৃষ্টি। যতই ব্যবস্থাটিকে নিখুঁত করার চেষ্টা হয়েছে, ততই তার ফাটলগুলি প্রকট হয়ে পড়েছে। কিন্তু তাই বলে এ-কথা ভাবার কোনও কারণ নেই যে ব্যবস্থাটি নিজের ভারেই ভেঙে পড়বে। এত লোক, পুলিশ ও সাধারণ প্রশাসন এত গভীরভাবে ব্যবস্থাটির দ্বারা এত বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েছে যে তারা তাদের স্বার্থেই একে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করবে। ফলে এর সমাপ্তি আপনাআপনি হবে না, এখুনি হবে না এবং রাজ্য জুড়ে একসঙ্গে হবে না যদি না বামপন্থীরা জনতাকে সংগঠিত করে ব্যবস্থাটির সামাজিক বৈধতা খতম করতে না পারে।
উপসংহার
নিবন্ধটি শুরু হয়েছিল সন্দেশখালির সাম্প্রতিক ঘটনা দিয়ে। তখন আমরা বলেছিলাম সন্দেশখালির তৃণমূল-বিরোধী বিক্ষোভের মূলে রয়েছে জবরদখল ও বঞ্চনার ইতিহাস। যদিও তৃণমূল ও বিজেপি উভয়ই মূল ক্ষোভের ঘটনাবলিকে ধামাচাপা দিয়ে নারীনির্যাতন হয়েছে কি হয়নি সেই নিয়ে নোংরা খেউর করে চলেছে। যে জবরদখল ও বঞ্চনা শেখ শাজাহানের সাঙ্গপাঙ্গরা এলাকার গরিবদের সঙ্গে করেছে তা হল বিনা ক্ষতিপূরণে বাম আমলে পাট্টায় পাওয়া গরিবদের চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকিয়ে সেই জমিগুলিকে মাছের ভেড়িতে পরিণত করা। ক্ষতিগ্রস্তরা প্রতিবাদ করতে এলে তাদের মারধোর করে হঠিয়ে দিয়েছে। এটা হল বাম সরকারের ভূমিসংস্কার কর্মসূচির অঙ্গ হিসেবে পাট্টা প্রদানের কর্মসূচির ঠিক বিপরীত ঘটনা। ইডির হানা উপলক্ষ্য মাত্র। অনেকের মনে পড়তে পারে মেদিনীপুরে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েক বছর আগেকার একটি ঘটনা। নান্টু প্রধান ছিল কুয়োর পাড় বাঁধানোর মজুর। ডাকাবূকো নান্টু তৃণমূলে যোগ দিয়ে প্রথমে পঞ্চায়েত সদস্য হয়, বিধানসভার ভোটে এলাকার সব বুথে দলবল নিয়ে ছাপ্পার বন্যা বইয়ে দেওয়ার কৃতিত্বে সে হয় গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান। বাড়ির অন্য লোকজন কেউ হয় পঞ্চায়েত সদস্য, কেউ হয় পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ। মাছের ভেড়ির ব্যবসা করে, জোর করে লোকের জমিতে বাঁধ কেটে নোনা জল ঢুকিয়ে দিয়েছিল। লোকজন জমি রক্ষা করতে সেই কাটা বাঁধ আবার বুজিয়ে দেয়। এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে নান্টূ বাইকবাহিনি নিয়ে গ্রামে হানা দেয়। মানুষজন আগে থেকেই তৈরি ছিল। প্রতিরোধের স্পর্ধায় বিস্মিত হয়ে হামলাকারীরা যখন পালাতে যায়, নান্টুর আর পালানো হয় না। পরদিন পুলিশ এসে ক্ষতবিক্ষত নান্টুর দেহ উদ্ধার করে। এতদিন পরে সন্দেশখালি কি সেই ঘটনার মহড়া দিল?
জেলে বসে প্রশ্নটা শিবু হাজরা উত্তম সর্দাররা যেন একটু তলিয়ে ভাবে।
ঋণ স্বীকার:
- ইলিয়নর মার্কস এভলিং সম্পাদিত ১৮৫০-৫১ সালে ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত মার্কসের লিখিত বিভিন্ন রচনার সঙ্কলন।
- দি হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের নিবন্ধ।
- আর্টিকল ১৪ নামক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত উক্ত লেখকের সাক্ষাৎকার।
[1] Marx, Karl. Revolution And Counter-Revolution Or Germany In 1848. Ed. Eleanor Marx Aveling. Lector House LLP.