Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ধর্ষকের পরিচয়

স্বাতী ভট্টাচার্য

 


সন্দেশখালি বা হাথরসে ধর্ষিত মেয়ে বা তাদের পরিবারের কথার সত্যতা যেভাবে পুলিশ-প্রশাসন নস্যাৎ করেছে, ভারতে তা ব্যতিক্রমী নয়, এমনই ঘটছে ধারাবাহিকভাবে। সেপ্টেম্বর ২২, ১৯৯২ তাঁর গণধর্ষণের ঘটনা পুলিশের কাছে যখন জানাতে গিয়েছিলেন ভাঁওরী দেবী, তখন পুলিশ প্রশ্ন করেছিল, “ধর্ষণ কাকে বলে, তুমি জানো?” যদিও ভাঁওরী তখন একাধিক সন্তানের মা, তবু ধর্ষণ কী, তা তাঁর জানার কথা নয় বলেই মনে করেছিল পুলিশ। এর কারণ, কোন যৌনমিলন সম্মতিতে সহবাস, আর কোনটি অসম্মতিতে ধর্ষণ, সেই অর্থ নিরূপণের শক্তি মেয়েদের হাতে দিতে চায় না পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। তাই ভাষার দখল, অর্থাৎ শব্দের অর্থ তৈরি করার ক্ষমতা, রাখে নিজের হাতে।

 

ধর্ষণের অভিযোগ যে মেয়েরা করে, আইনত তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই পুরুষেরও কি অধিকার নেই নাম-পরিচয় গোপন রাখার? তার সামাজিক সম্মান রক্ষা করার দায় কি আইনের নেই?

এই দাবি আদালতের কাছে এসেছে। দিল্লি হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন জমা পড়েছে ‘গাইডলাইন’ প্রার্থনা করে। কখন ধর্ষণে অভিযুক্তদের নাম প্রকাশ করা যাবে, সে-বিষয়ে নির্দেশ চাওয়া হয়েছে আদালতের কাছে। দিল্লি হাইকোর্ট এ-বিষয়ে দিল্লির সরকারের মতামত জানতে চেয়েছে। ৮ আগস্ট, ২০২৪-এর আগে হলফনামা পেশ করার কথা দিল্লি সরকারের।

কেরল হাইকোর্ট ইতিমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছে, আদালতের অনুমতি ছাড়া ধর্ষণে অভিযুক্তের নাম প্রকাশ করা যাবে না।

যে-সব ধর্ষণের অভিযোগ ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট তার ওয়েবসাইটে সে-সব মামলার নথিপত্রে অভিযুক্তের নাম প্রকাশ করা বন্ধ করেছে, ‘এক্স’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে অভিযুক্তকে।

তবে এ-বিষয়ে ভারতে এখনও কোনও আইন তৈরি হয়নি।

 

ধর্ষণে অভিযুক্তের নাম কি গোপন রাখা উচিত?

বিভিন্ন দেশের আইনসভায় এ বিষয়ে বিতর্ক হয়েছে, আইন হয়েছে, সে আইন খারিজও হয়েছে। ‘ইউকে পার্লামেন্ট’ ওয়েবসাইটে অনুসারে, ১৯৭৬ সালে সে দেশে সেক্সুয়াল অফেন্সেস (অ্যামেন্ডেড) অ্যাক্ট পাশ করা হয়, যাতে বলা হয়েছিল যে অভিযোগকারিণী এবং অভিযুক্তকে সমান গোপনীয়তা দেওয়া হবে, অভিযুক্তের নাম প্রকাশ করা হবে না। কিন্তু ১৯৮৮ সালে ‘ক্রিমিনাল জাস্টিস অ্যাক্ট’ পাশ করে পার্লামেন্ট আবার পুরুষদের নাম গোপন রাখার আইনি নির্দেশ বাতিল করে। এর ভিত্তি ছিল ১৯৮৪ সালে ‘ক্রিমিনাল ল’ রিভিশন কমিটি’-র রিপোর্ট। তাতে বলা হয়েছিল, ধর্ষণের অভিযোগকারিণী এবং অভিযুক্ত, দুজনের মধ্যে সাম্যের ধারণাটা যদিও আপাতদৃষ্টিতে আকর্ষণীয়, কিন্তু বস্তুত তা বৈধ নয়। বিচারপ্রার্থী এবং অভিযুক্তদের মধ্যে তুলনা করা উচিত নয়, তুলনা চলে ধর্ষণে অভিযুক্তের সঙ্গে অন্যান্য গুরুতর অপরাধে অভিযুক্তদের। যৌন অপরাধে অভিযুক্তদের নাম গোপন করা যদি উচিত হয়, তা হলে অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্তরাই বা নাম গোপনের সুবিধে পাবেন না কেন? শিশুহত্যাও সমাজে নিন্দিত, তা হলে কি শিশুহত্যাকারীর নামও গোপন রাখা উচিত?

যাঁরা অভিযুক্তের নাম গোপন রাখার পক্ষে সওয়াল করেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেছিলেন, অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত পুরুষদের কী ভয়ানক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। যাঁরা ধর্ষণের মামলা লড়ে নিরপরাধ প্রমাণিত হয়েছেন, তাঁরা জানিয়েছেন যে ধর্ষণের অভিযোগ তাঁদের জীবনকে কতখানি বিপর্যস্ত করেছে, কর্মজীবন এবং পারিবারিক জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। বিশেষ করে যাঁরা সমাজে সুপরিচিত, যাঁদের নাম ও মুখ সকলে চেনে, যৌন নিগ্রহের অভিযোগ উঠলেই মিডিয়ায় তাঁদের নিয়ে বিপুল চর্চা শুরু হয়। প্রায় রাতারাতি অভিযুক্ত ব্যক্তি সারা জীবনে অর্জিত সুনাম হারান। অথচ, দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর যদি তিনি নিরপরাধ প্রমাণিত হন, তখন কিন্তু সে খবরটা মিডিয়া অতখানি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে না। এটা কি অভিযুক্তদের প্রতি অন্যায় নয়?

যাঁরা অভিযুক্তের নাম গোপনের বিরোধিতা করেন, তাঁদের যুক্তির কয়েকটি স্তর রয়েছে।

প্রথমত, অপরাধী বলে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত যে কোনও অভিযুক্ত ব্যক্তি যে নির্দোষ, সেটা বিচারব্যবস্থার একেবারে গোড়ার কথা। অভিযুক্ত এবং দণ্ডপ্রাপ্তের পার্থক্য সাধারণ মানুষ যথেষ্ট ভাল বোঝেন।

দ্বিতীয়ত, কেবল ধর্ষণে অভিযুক্ত ব্যক্তিদেরই নাম গোপন করার এই দাবি কেন? অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে তো এ দাবি তোলা হয় না? প্রায়ই দেখা যায়, এই দাবির ভিত্তি হল এই ধারণা যে, ধর্ষণের অভিযোগের একটা বড় সংখ্যাই মিথ্যা। ধর্ষণে অভিযুক্তদের যদি আলাদা সুরক্ষা বা সুবিধা দেওয়া হয়, তা হলে প্রকারান্তরে এটাই বলা হয় যে ধর্ষণের অভিযোগ অন্যান্য অপরাধের অভিযোগের সমান নির্ভরযোগ্য নয়।

২০০৩ সালে ইউকে-র লেবার সরকার যখন ‘সেক্সুয়াল অফেন্সেজ় অ্যাক্ট’ পাশ করেছিল, তখন অভিযুক্তের নাম গোপনের দাবি ফের খারিজ করে। সে-সময়ে ওই দাবির বিপক্ষে যুক্তি দিয়ে টোনি ব্লেয়ারের সরকার বলেছিল যে, যৌন অপরাধের অভিযোগ সংশয়ের যোগ্য, বিশ্বাসের যোগ্য নয়, এমন ধারণা তৈরি করতে চায় না সরকার। এখনও অবশ্য বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক চলছে সে দেশে, কিন্তু আইন আর বদল হয়নি।

প্রায় একই রকম পরিবর্তন ঘটেছে অস্ট্রেলিয়াতেও। কুইন্সল্যান্ড প্রদেশে ১৯৭৮ সালে ‘ক্রিমিনাল ল (সেক্সুয়াল অফেন্সেস) অ্যাক্ট’ পাশ করে মামলা চলাকালীন ধর্ষণে অভিযুক্তের নাম প্রকাশ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু ২৫ মে, ২০২৩ সালে পাশ করা একটি সংশোধন অনুসারে অভিযুক্তের এই সুরক্ষা অপসারিত হয়েছে। অভিযুক্ত আদালতের কাছে আবেদন করতে পারেন, যাতে সংবাদের রিপোর্টে তাঁর নাম না নেওয়া হয়। সেই আবেদন বিবেচনা করার সময়ে আদালতকে সে-বিষয়ে অভিযোগকারিণীর বক্তব্যও শুনতে হবে, বলছে সংশোধিত আইন। ২০২১ সালের একটি ধর্ষণকাণ্ডে অভিযুক্ত সুপরিচিত এক ব্যক্তি ধর্ষণে অভিযুক্ত হয়ে, প্রথমে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে নাম প্রকাশ না করার নির্দেশ আদায় করেন। তাঁর আইনজীবীদের যুক্তি ছিল, নাম প্রকাশ করলে অভিযুক্তের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। কুইনসল্যান্ডের বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা, এবং অভিযোগকারিণী, এই আবেদনের বিরোধিতা করে। ২৬ অক্টোবর, ২০২৩ আদালত অভিযুক্তের আবেদন খারিজ করে দেয়। লিবারাল পার্টির প্রাক্তন কর্মী, আঠাশ বছরের ব্রুস লেরম্যান-এর নাম ধর্ষণে অভিযুক্ত হিসাবে প্রকাশ্যে আসে।

 

সাম্যের যুক্তি

ধর্ষণে অভিযুক্ত পুরুষেরও ধর্ষিত মেয়েদের সমান সুরক্ষা প্রাপ্য, এই দাবির বিপরীতে অনেকে মনে করিয়েছেন যে, সমাজে বস্তুত ক্ষমতার ভারসাম্য নেই। বহু প্রভাবশালী, বলগর্বী পুরুষ নিজের পদমর্যাদা ও সামাজিক অবস্থানের জোরে একের পর এক মেয়ের ওপর যৌন নিপীড়ন চালিয়ে যায়। তারা মনে যে, মেয়েটি ভয়ে-লজ্জায় অভিযোগ দায়ের করতে চাইবে না। অভিযোগ করলেও মেয়েটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাকে সহজেই অপদস্থ করা যাবে। বিশেষ করে একজন ক্ষমতাশালী পুরুষের বিপরীতে একটি অল্পবয়সী, অপরিচিত মেয়ের কথাকে নস্যাৎ করা সাধারণত কঠিন হয় না। সকলকে সহজেই বোঝানো যায়, মেয়েটি চাকরি (বা কাজের সুযোগ) পাওয়ার জন্য, কর্মক্ষেত্রে উন্নতির জন্য বা শাস্তি এড়ানোর জন্য যৌন সংসর্গে স্বেচ্ছায় রাজি হয়েছে, কিংবা নিজেই আগ্রহী হয়েছে।  এই সুযোগ-গ্রহণ কত দূর যেতে পারে, তার দৃষ্টান্ত হার্ভে ওয়েনস্টাইন। ধারাবাহিক ধর্ষণ-কাণ্ডের বিবরণ অসামান্য সংবেদনশীলতার সঙ্গে দেখানো হয়েছে ‘শি সেড’ (২০২৪) চলচ্চিত্রে, যা এখন নেটফ্লিক্স-এ দেখা যাচ্ছে। ভারতের দৃষ্টান্ত, সাংবাদিক এমজে আকবর বনাম প্রিয়া রামানি এবং অন্যান্য আরও আঠারোজন মহিলার মামলা। সাংবাদিক প্রিয়া রামানি সম্পাদক আকবরের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ প্রকাশ্যে আনার পরে, প্রিয়ার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা এনেছিলেন আকবর। দিল্লির অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট সেই মামলা খারিজ করে বলেছিলেন, একটি মেয়ের মর্যাদার মূল্যে আর একজনের সম্মান রক্ষা করা যায় না।

এই দুটি ঘটনাতে, এবং এই ধরনের অনেক ঘটনাতে দেখা গিয়েছে যে, প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম একজন বা দুজন মেয়ে প্রকাশ করার পরে আরও অনেক মেয়ে এগিয়ে এসেছে ওই ব্যক্তির দ্বারা নিজেদের নির্যাতনের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে। ‘মি টু’ আন্দোলন এভাবেই সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে। এমন ধরনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অনেকে দাবি করেছেন যে, ধর্ষককে নাম গোপনের নিরাপত্তা দিলে বস্তুত তাকে অপরাধ চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। অনেক মেয়েকে বিপন্ন করা হয়।

অনেকে এই যুক্তিও দিয়েছেন যে, ধর্ষণে অভিযুক্তকে নাম গোপনের আইন পাশ করার মানে এই দাঁড়াবে যে, ধর্ষণে অভিযুক্ত পুরুষ মাত্রেই ‘অপরাধের শিকার’। যা প্রকারান্তরে সব অভিযোগকারিণীকেই ‘সন্দেহভাজন’ বলে প্রতিষ্ঠিত করবে।

ধর্ষণে অভিযুক্ত সাবালক পুরুষের নাম প্রকাশকে  নিষিদ্ধ করেছে, এমন কোনও আইন এই প্রতিবেদক এখনও অবধি খুঁজে পাননি (অভিযুক্ত নাবালক হলে অবশ্য ধর্ষণ-সহ সব অপরাধে নাম প্রকাশ নিষিদ্ধ)। এই প্রতিবেদকের অনুরোধে আইনজীবী বন্ধুরা এ বিষয়ে খোঁজ করছেন। পাঠকদের কেউ তথ্য দিলে তা এই আলোচনায় আনন্দের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে, এবং আলোচনাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে।

তবে ভারত-সহ অনেক দেশে দেখা যাচ্ছে যে অভিযুক্ত আদালতের কাছে আবেদন জানাতে পারে, যাতে তার নাম গোপন রাখা হয়। আদালত সেই আবেদন অনেক ক্ষেত্রে মঞ্জুর করেছে, কখনও মঞ্জুর করার পরেও খারিজ করেছে। নিগৃহীত মেয়েটির নাম-পরিচয় গোপনের বিশেষ সুরক্ষা প্রায় সব দেশের আইন দিচ্ছে, কিন্তু ধর্ষণে অভিযুক্ত পুরুষ বিশেষ সুরক্ষার যোগ্য, সব ধর্ষণ-অভিযুক্তেরই নাম গোপন রাখা উচিত, এর সমর্থনে আইন দেখা যাচ্ছে না। যার অন্যতম কারণ, কোনও প্রাথমিক তদন্ত ছাড়াই একটি নিগৃহীত মেয়েদের কথাকে ‘সম্ভবত অসত্য’ বলে ধার্য করতে চায় না কোনও দেশ।

সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে (‘মেয়েদের কথার মূল্য’, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২ মে, ২০২৪) এই প্রতিবেদক দাবি করেছিলেন যে, কোনও মেয়ে ধর্ষণের অভিযোগ করলে তার কথার সত্যতা নিয়ে অভিযুক্ত ব্যতীত অপর কোনও তৃতীয় পক্ষ জনসমক্ষে সংশয় প্রকাশ করতে পারবে না। মেয়েটির দাবির সত্যতার বিপরীতে যা কিছু প্রমাণ তৃতীয় কোনও পক্ষের কাছে রয়েছে, তা পেশ করতে হবে পুলিশের কাছে, বা আদালতে।

 

আইন থেকে ভাষায়

সন্দেশখালি বা হাথরসে ধর্ষিত মেয়ে বা তাদের পরিবারের কথার সত্যতা যেভাবে পুলিশ-প্রশাসন নস্যাৎ করেছে, ভারতে তা ব্যতিক্রমী নয়, এমনই ঘটছে ধারাবাহিকভাবে। সেপ্টেম্বর ২২, ১৯৯২ তাঁর গণধর্ষণের ঘটনা পুলিশের কাছে যখন জানাতে গিয়েছিলেন ভাঁওরী দেবী, তখন পুলিশ প্রশ্ন করেছিল, “ধর্ষণ কাকে বলে, তুমি জানো?” যদিও ভাঁওরী তখন একাধিক সন্তানের মা, তবু ধর্ষণ কী, তা তাঁর জানার কথা নয় বলেই মনে করেছিল পুলিশ। এর কারণ, কোন যৌনমিলন সম্মতিতে সহবাস, আর কোনটি অসম্মতিতে ধর্ষণ, সেই অর্থ নিরূপণের শক্তি মেয়েদের হাতে দিতে চায় না পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। তাই ভাষার দখল, অর্থাৎ শব্দের অর্থ তৈরি করার ক্ষমতা, রাখে নিজের হাতে।

দু-ভাবে মেয়েটির কথার অর্থ নস্যাৎ করা হয়। এক, ধরে নেওয়া হয় যে মেয়েদের সম্মতি দান একটা কথার কথা। বিয়ের ভিতরে সে ‘হ্যাঁ’ বলবে, বিয়ের বাইরে ‘না’ বলবে। এর বাইরে আর কথা কী? (‘মেয়েদের কথার মূল্য’ প্রবন্ধটির উপর সমাজমাধ্যমে একজন মন্তব্য করেছেন, “ধর্ষণ একটি হোক্স” বা ওতা)। দুই, সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এমন একটা রীতি-অভ্যাস তৈরি করেছে, যেখানে মেয়েদের ‘না’-এর অর্থ আসলে ‘হ্যাঁ’ হয়ে দাঁড়ায়। মেয়েরা মুখে ‘না’ বললেও মনে ‘হ্যাঁ’ বলে, কারণ মুখে ‘হ্যাঁ’ তার বলার কথা নয়— এই হল সেই ধারণা। ‘পিঙ্ক’ (২০১৬) ছবিটির ‘নো মিন্স নো’ সংলাপটি যে এত ছড়িয়ে পড়েছিল, তা সমাজের সেই নিহিত ধারণাকে, এবং তার অন্যায়কে, সবার সামনে মেলে ধরেছিল বলে।

ভাষার অন্যতম উপযোগিতা এই যে, ভাষা সুরক্ষা দেয়। যে মূক, সে নিজের বিপদে অন্যের সহায়তা সহজে পায় না, কারণ নিজের আর্তি সে সহজে প্রকাশ করতে পায় না। আক্রান্ত ব্যক্তি যদি নীরব হয়, তা হলে পীড়ন সহজ, এমনকি অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। মেয়েদের ‘না’-এর প্রতি সমাজকে বধির করে দিলে (কিংবা সংশয় প্রকাশ করে মেয়েদের নিষেধাত্মক, অসম্মতিসূচক ‘না’-এর মূল্য হ্রাস করলে) কার্যত মেয়েদের নীরব করে দেওয়া হয়। সব মেয়ের বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ ঘটতে দেওয়ার পথ তৈরি করে দেওয়া হয়। কারণ তা ধর্ষণের বিশ্বাসযোগ্যতাকে খর্ব করে, প্রত্যেক ধর্ষিতার সামনে মিথ্যা বলার অভিযোগ খাড়া করে রাখা হয়। এই কারণেই একটি মেয়ের ‘না’ উচ্চারণকে প্রকাশ্যে নস্যাৎ করা কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয়। তার পরিপ্রেক্ষিতেই এই দাবি তোলা দরকার যে, মেয়েটির কথার সত্যতার বিচার পুলিশ-আদালতেই হোক। মামলা যখন বিচারাধীন, তখন সমাজ, বিশেষত জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ-প্রশাসনের আধিকারিক, সাংবাদিক ও অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কোনও নির্দিষ্ট ধর্ষণের অভিযোগের সত্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ যেন না করেন।

এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পরে অনেক পাঠক প্রশ্ন করেছেন, তা হলে কি ধরে নিতে হবে, মেয়েরা ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ করে না? মেয়ে মাত্রই সত্যবাদী, আর পুরুষ মানেই অপরাধী, এ কথা মেনে নিতে হবে?

 

চলবে