অরিন্দম
নিট পরীক্ষাটি ৭২০ নম্বরে হয়, ১৮০টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়, প্রতিটি চার নম্বর। অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন হয়। মাঝেমধ্যে কোনও বছরে ২-৩ জন পুরো নম্বর ৭২০ পেয়ে যায়। কিন্তু এবারে সেই সংখ্যাটি ৬৭ জন। শুধু তাই নয়, ৭২০ না পেলে যেখানে ৭১৬-র উপর কেউ পেতে পারে না সেখানে এইবারে অনেকে ৭১৮/৭১৯ পেয়েছে যা অসম্ভব। একটি উচ্চমানের পরীক্ষায় ন্যূনতম উত্তীর্ণ মান প্রতি বছর ২-৩ নম্বরের ফারাক হতে পারে, এবারে সেটা ২০২৩-এর তুলনায় পার্থক্য প্রায় ৫৪ নম্বরের যা এককথায় অবিশ্বাস্য। অভিযোগ, এই দুর্নীতি চাপা দেওয়ার জন্যই লোকসভার নির্বাচনী ফল ঘোষণার দিনই ‘নিট’-এর ফল ঘোষণা করা হয় নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য। এবং প্রথম থেকেই কেন্দ্রীয় সরকার ও পরীক্ষা পরিচালক সংস্থা সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিল
২০২৪ ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষা ‘নিট’-এ জালিয়াতি নিয়ে সারা দেশে হইচই চলছে। হওয়াই উচিত। দুর্নীতির চরিত্রটি গভীর, জটিল ও বিস্তৃত। এখন ডাক্তারি পড়বার চাহিদা এত বেশি যে এক-একটি নিম্নমানের বেসরকারি কলেজের ছাত্রপিছু ভর্তির খরচা প্রায় এক কোটি টাকা। সেখানে বিশ-ত্রিশ লাখ টাকা খরচা করে যদি বেআইনিভাবে ‘নিট’-এ ভাল ফল করে সরকারি কলেজ বা সরকারি সংরক্ষণে বেসরকারি কলেজে ভর্তি হওয়া যায় তাহলে অসুবিধে কী? এই প্রবেশিকা পরীক্ষাটি ৭২০ নম্বরে হয়, ১৮০টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়, প্রতিটি চার নম্বর। অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন হয়। মাঝেমধ্যে কোনও বছরে ২-৩ জন পুরো নম্বর ৭২০ পেয়ে যায়। কিন্তু এবারে সেই সংখ্যাটি ৬৭ জন। শুধু তাই নয়, ৭২০ না পেলে যেখানে ৭১৬-র উপর কেউ পেতে পারে না সেখানে এইবারে অনেকে ৭১৮/৭১৯ পেয়েছে যা অসম্ভব। এই পরীক্ষাটি পরিচালনা করে জাতীয় পরীক্ষা সংস্থা (এনটিএ)। শুধু তাই নয় একটি উচ্চমানের পরীক্ষায় ন্যূনতম উত্তীর্ণ মান প্রতি বছর ২-৩ নম্বরের ফারাক হতে পারে, এবারে সেটা ২০২৩-এর তুলনায় পার্থক্য প্রায় ৫৪ নম্বরের যা এককথায় অবিশ্বাস্য। এবং অভিযোগ এই দুর্নীতি চাপা দেওয়ার জন্যই লোকসভার নির্বাচনী ফল ঘোষণার দিনই ‘নিট’-এর ফল ঘোষণা করা হয় নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আজকের দিনে এরকম একটি জনপ্রিয় পরীক্ষার কেলেঙ্কারি চাপা পড়ে থাকার কথা নয়। থাকেওনি। কিন্তু প্রথম থেকেই কেন্দ্রীয় সরকার ও পরীক্ষা পরিচালক সংস্থা সর্বোচ্চ আদালতের ২০১৮ সালের একটি রায়কে ঢাল করে সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিল। সর্বোচ্চ আদালতের অন্য প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রেক্ষিতে দেওয়া এই অতিরিক্ত নম্বরের রায়, যেখানে পরিষ্কার বলে দেওয়া আছে ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষায় এই রায় প্রযোজ্য নয়। ফলে পরিচালক সংস্থার কথা অনুযায়ী তারা ১৫৬৩ জনকে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে পরীক্ষায় কম সময় পাওয়ার জন্য অতিরিক্ত নম্বর দিয়েছে। স্বভাবতই এই কাজ ভুল প্রমাণিত হয় ও সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে তাদের পরীক্ষা বাতিল হয়। আরও অভিযোগ আছে যে বারবার পরীক্ষার নথিভুক্তিকরণের আন্তর্জাল জানালার সময় বিভিন্ন অজুহাতে পরিবর্তন করা হয়। এবং যেখানে কম সময় পাওয়ার অভিযোগ উঠছে সেই বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নাকি বলছে যে সেখানে এই ধরনের ঘটনাই ঘটেনি। তাহলে এনটিএ-র দেওয়া এই ১৫৬৩ জনের তালিকাও প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগও আছে। এরকমও নাকি দেখা যাচ্ছে বিশেষ বিশেষ কেন্দ্রে বিশাল সংখ্যক পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে। এবং বেশ কিছু পরীক্ষার্থী নিজের বাড়ির থেকে বহু দূরে পরীক্ষাকেন্দ্রের আবেদন করেছে। অর্থাৎ পুরো পরীক্ষাটি নিয়েই সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। এই সন্দেহ আরও বেড়েছে বিশাল বিশাল বেসরকারি কোচিং সেন্টারের শাসক দলের সঙ্গে সখ্য, হাজার হাজার কোটি টাকার শিক্ষাব্যবসার রমরমা এই ফলের উপর নির্ভরশীল বলে। শুধু তাই নয় মোদি সরকার প্রথমেই সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করায়। এবং এত বড় কেলেঙ্কারির অভিযোগের পরও যিনি পরীক্ষা কী করে দিতে হবে বলে বই লেখেন, ‘মন কি বাত’ করেন, সেই প্রধানমন্ত্রীর নীরবতার ফলে সন্দেহ গভীরতা পেয়েছে ও কেলেঙ্কারি জনমনে ন্যায্যতা পেয়েছে। নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি ও পরীক্ষাপ্রক্রিয়া পরিবর্তনের দাবিও উঠেছে।
চিৎকার চেঁচামেচি হইচই— কী বলতে চায়?
কিন্তু চিৎকার চেঁচামেচি দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটি এমন যেন এই প্রথম এই পরীক্ষায় দুর্নীতি হচ্ছে, বা কোনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় আগে দুর্নীতি হয়নি। পাল্টা যুক্তি দেওয়া হবে যে মোটেই তা নয়। এই পরীক্ষা দেশের ভবিষ্যৎ ডাক্তারদের মান নির্ধারিত করে। তেইশ লক্ষ ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে। তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পড়াশুনো করেছে। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। তার প্রতিবাদ হবে না! একদম ঠিক কথা।
তবে এখানেই কি শ্রেণির প্রশ্নটি চলে আসে না? সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে এসএসসি-র সঙ্গে পিএসসি-র চাকরি দুর্নীতি ফাঁস হয়েছে। আসাম, রাজস্থান— কোন জায়গায় চাকরি দুর্নীতি হয়নি? সব জায়গায় হয়েছে। মধ্যপ্রদেশের ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে তো বহু খুন হয়েছে। কিচ্ছু বেরোয়নি। আর উত্তরপ্রদেশ তো সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে চাকরি দুর্নীতিতে। এই বছরের গত ফেব্রুয়ারি মাসে কনস্টেবলের চাকরির পরীক্ষায় আটচল্লিশ লক্ষ পরীক্ষার্থী ছিল। পরীক্ষা দেওয়ার পর জানা যায় প্রশ্নপত্র আগেই ফাঁস হয়ে গেছে, তাই পরীক্ষা বাতিল। আমরা জানি কারা বা কোন আর্থিক শ্রেণিভুক্ত মানুষ এই পরীক্ষাতে বসেন এবং ওই পরীক্ষাকেন্দ্রে তাঁরা কী অবর্ণনীয় কষ্ট করে পৌঁছন। কিন্তু কতটুকু হইচই হয়েছে? তেমন কিছু হয়নি। এখানেই ‘নিট’ পরীক্ষার কেলেঙ্কারির কৃতিত্ব। খবর হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলি রাস্তায় নামছে। প্রতিবাদ হচ্ছে।
এই আলোকে ‘নিট’ পরীক্ষার এই কেলেঙ্কারিকে সার্বিকভাবে বেহাল শিক্ষাব্যবস্থার নিরিখে বিচার করতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে নয়। কিন্তু আমাদেরকে সুকৌশলে বিচ্ছিন্নভাবে ভাবানো হচ্ছে। যেমন ‘নিট’ পরীক্ষা কত কঠিন পরীক্ষা, ডাক্তারদের পেশা মহান পেশা, দেশের ভবিষ্যৎ ইত্যাদি ইত্যাদি বলে। আসলে ‘নিট’-এর মতন পরীক্ষাগুলির মাধ্যমে ডাক্তারি আজ বিত্তবান তথা মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণিদের কব্জায়। এসসি, এসটি-দের একটি অংশ বাদ দিলে বর্তমানের ডাক্তারি পড়ুয়াদের মধ্যে নিম্নবিত্ত পরিবারের পড়ুয়াদের দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হবে। বিত্তবানদের একটা বড় অংশ লাখ লাখ টাকা খরচা করে কোচিং সেন্টারে ট্রেনিং দিয়ে ছেলেমেয়েদের প্রায় নিখরচায় সরকারি কলেজে ডাক্তারি পড়াতে চায়। সেখানে আঘাত লেগেছে। এবং সমাজে এরা যথেষ্ট প্রভাবশালী, মতামত তৈরি করবার ক্ষমতা রাখে। তাই এই চিৎকার। কিন্তু এই শ্রেণিটি চায় নিজেদের সমস্ত সুবিধা টিকিয়ে রেখে খালি এত বড় মাত্রায় দুর্নীতি যেন না হয়। ‘নিট’ পরীক্ষায় কিন্তু প্রতিবারই দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এইবার ব্যপারটি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। তাই আমাদের এই আলোচনাটি ‘হইচই’-এর স্রোতে গা না ভাসিয়ে একটু আলাদাভাবে শিক্ষার সার্বিক যে চেহারা সেটিকে যে গতিপথে প্রবাহিত করানোর চেষ্টা চলছে সেই আলোকে বুঝবার চেষ্টা করব।
এত পরীক্ষা থাকতে সবাই ‘নিট’ দেয় কেন
আজ থেকে ৪০ বছর আগে মেডিক্যাল কলেজ অনেক কম ছিল। মূলত সরকারি মেডিক্যাল কলেজ। ডাক্তারের সংখ্যাও কম ছিল। বড় বড় বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিংহোম অনেক কম ছিল। আর মানুষ চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালের উপর নির্ভর করত। সমাজে ডাক্তারবাবুদের বরাবরই বিশাল সম্মান ছিল। মাস্টারদের শেষে ‘মশাই’ জুড়লেও ‘ডাক্তার’রা বরাবরই ‘বাবু’ ছিলেন। কিন্তু যতটা সম্মান ছিল, ব্যক্তিগত পসার ও চাকরির মাইনে বাদ দিলে বিশাল কিছু রোজগারের সুযোগ ছিল না। আমার এক বন্ধুর বাবা সরকারি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। ওঁকে দেখেছি সকালে বাজার করে তরিতরকারি কাটতে মাসিমাকে সাহায্য করে তারপর কলেজে যেতে। ফেরার পথে চেম্বার করে বাড়ি ফিরে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে, তাস খেলতে চলে যেতেন।
এই ডাক্তারবাবুদের চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেল নয়া অর্থনীতি কার্যকর হওয়ার কুড়ি বছরের মধ্যে। ডাক্তারি পড়ুয়াদের পরিবারের চেহারা পালটে গেল। বড় বড় বেসরকারি হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ তৈরি হল। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে সরকার দায় অস্বীকার করতে শুরু করল। যেরকমভাবেই হোক না কেন সমাজতান্ত্রিক শিবির আর নেই, সরকারি কমিউনিস্ট দল পুঁজিবাদী উন্নয়নের কাছে মাথা বিকিয়ে বসে আছে। বামপন্থীরা বিভ্রান্ত। আর তথাকথিত বিপ্লবী ছাত্রদলরা যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি, জেএনইউ-এর মতন দ্বীপগুলি টিকিয়ে রাখতেই হাঁসফাঁস করছে। এইটা হচ্ছে ভারতে পুঁজিবাদী সংস্কৃতি বিস্তারের ‘স্বর্ণযুগ’। সবাই বলতে শুরু করল ‘মুফতে কিছু পাওয়া যায় না’। ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’। সরকার তাহলে শিক্ষা স্বাস্থ্য আর বিনিপয়সায় কেন দেবে। এটাও তো ব্যবসার জায়গা। গত কয়েক বছরে উচ্চশিক্ষায় খরচা প্রায় চারগুণ বেড়ে বছরে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকায় পৌঁছেছে। আমরা পরিচিত হতে শুরু করলাম উচ্চশিক্ষায় ‘শিক্ষাঋণ’-এর সঙ্গে। বুর্জোয়ারা বোকা নয়। তারা জানে কজন উচ্চশিক্ষায় যাবে, তাদের কতজনের ক্ষমতা আছে এই ঋণ নেওয়ার, আর ব্যাঙ্ক এত সহজে ঋণ দেয় না। তাই পড়াশুনোর খরচও বাড়ল, সঙ্গে ‘শিক্ষাঋণের’ গাজরও রইল। আর সঙ্গে এল গরিব পড়ুয়াদের জন্য নিম্ন পরিকাঠামোযুক্ত সরকারি বিদ্যালয়ের ‘দুপুরের খাবার’, সাইকেল, জুতো, ড্রেস, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু ওই অবধিই। রাষ্ট্রের যেটুকু ‘জনকল্যাণমূলক’ প্রকল্প ছিল তা উদারবাদী অর্থনীতির তৃতীয় ধাপে এসে মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার সরাসরি বাতিল করবার প্রক্রিয়া চালু করল। তারপর বারো ক্লাসের পর থেকেই চলে এল বিভিন্ন রকমের প্রবেশিকা পরীক্ষা। যদিও সেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় সবাই বসতে পারলেও এমন কঠিন ও কোচিং সেন্টার-ভিত্তিক ব্যবস্থা করা হল যে নিম্নবিত্তদের, যারা প্রথাগত বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আসছে, তারা ওই পরীক্ষার তথাকথিত মেধাবী নির্মাণপ্রক্রিয়ার মাধ্যমেই ছাঁটাই হয়ে যাবে। ‘নিট’, ‘জেইই মেনস/অ্যাডভ্যান্স’, ‘জ্যাম’, ‘ক্যাট’, ‘ক্ল্যাট’ এই ধরনের বিভিন্ন পরীক্ষা। অর্থাৎ উচ্চবিত্তদের জন্য উচ্চস্তরের শিক্ষা আর নিম্নবিত্তদের জন্য নিম্নস্তরের শিক্ষা। যেমন গরিবদের জন্য ‘ভোকেশনাল’, আইটিআই, পলিটেকনিক, স্কিল ট্রেনিং আর উচ্চবিত্তদের জন্য এমবিবিএস, ইঞ্জিনিয়ারিং, এমবিএ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে উচ্চবিত্তদের মধ্যেও আইআইটি-তে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়েও ‘নিট’ পরীক্ষায় বসবার চাহিদা কেন? আপনি নিশ্চয়ই বলবেন না জনগণের সেবার জন্য (সেই সংখ্যাটা নেই তা নয়, কিন্তু অতি নগণ্য)। তাই এই শর্তটিকে আমরা কুলুঙ্গিতে তুলে রেখে আলোচনা করব। সোজা কথায় বিশাল সামাজিক সম্মানের সঙ্গে দায়হীন কালো টাকা রোজগারের অঢেল সুযোগ। ভারতের মানুষের অশিক্ষা, অসহায়তার সুযোগে পলিক্লিনিকে রোগী দেখে কোনও রসিদ দিতে হয় না, ওষুধ কোম্পানি, পরীক্ষাগার, বেসরকারি হাসপাতালের রোগী পাঠানোর কমিশন আর বেসরকারি হাসপাতাল খুলে ফেললে তো কথাই নেই। পাশে রয়েছে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ মদত আর দুর্বল আইন। এই প্রক্রিয়ায় ঢুকতে গেলে দরকার খালি এমবিবিএস/এমডি ডিগ্রি। আর এই চাহিদার কথা মাথায় রেখে সব জায়গায় কেন্দ্র, রাজ্য সরকারের সহায়তায় ও আইএমএ-এমসিআই-এর মদতে খুলে চলেছে কোটি টাকা বেতনের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ। সেখানে মেধার গল্প শুনলে ঘোড়ায় হাসবে। মেধা খালি সরকারি কলেজ আর নিম্নবিত্তদের জন্য। আর বড়লোকেরা জন্মসূত্রেই মেধাবী। অভিযোগ আছে ভারতে অন্যতম চরম দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা হচ্ছে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (এমসিআই)। সুতরাং যে প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের অংশ হওয়াটাই লক্ষ্য, সেই পরীক্ষায় দুর্নীতি হবে না!
শেষ কথা— তাহলে কী হবে
আগে এই ধরনের প্রবেশিকা পরীক্ষাগুলি পরিচালনা করত রাজ্য সরকারগুলি। কারণ শিক্ষা যৌথ তালিকাভুক্ত বিষয়। কিন্তু ফ্যাসিস্ট বিজেপি তথা মোদি সরকার আসবার পরপরই কায়দা করে যৌথ তালিকাভুক্ত বিষয়গুলিতে কেন্দ্র সরাসরি হস্তক্ষেপ শুরু করে। আরএসএস-এর কায়দা অনুযায়ী চরম কেন্দ্রীভবনের পরিকল্পনায় তারা ‘এক দেশ-এক আইন-এক ভাষা-এক পরীক্ষা’-র মতন বিভিন্ন উগ্র জাতীয়তাবাদী স্লোগান হাজির করে। এবং শহুরে হিন্দু বিত্তবানদের প্রভূত সমর্থন লাভ করে। কিন্তু এরা ভুলে গিয়েছিল যে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার আরেক যমজ সন্তান কেন্দ্রীভূত চরম দুর্নীতি। মোদি সরকার রাজ্য সরকারগুলির সমস্ত প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে বিচারব্যবস্থার সমর্থনে ২০১৬ সালে ‘নিট’ পরীক্ষা চালু করে। ২০১৮ সালে এনটিএ তৈরি হয় ২০১৯ সাল থেকে তারা এই ‘নিট’ পরীক্ষা-সহ বিভিন্ন সর্বভারতীয় পরীক্ষা পরিচালনা করে থাকে। এবং একটা ঘটনা পাশাপাশি ঘটতে থাকে। সারা দেশ জুড়ে তীব্র গতিতে বিশাল বিশাল আর্থিক ক্ষমতাসম্পন্ন কোচিং সেন্টার গড়ে ওঠে। ‘বাই জু’-র মতন কোচিং স্টার্ট আপ কোম্পানি তো ইতিহাস তৈরি করছে। এই কোচিং কোম্পানিগুলির ‘কালীঘাট’ হচ্ছে কোটা শহর। সেই শহরও ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে। সারা দেশ থেকে অধিকাংশ ‘নিট’-‘জেইই মেনস’ পড়ুয়ারা পাড়ি জমায় এই শহরে। একা থাকা তারপর এই তীব্র প্রতিযোগিতায় পেরে না ওঠার হতাশায় সামাজিকভাবে তথাকথিত অযোগ্য পড়ুয়ারা আত্মহত্যা করতে থাকে। খবর হয়। আমরা আহা উহু করি কারণ আমাদের বলা হয়েছে যে যত চাপ সহ্য করতে পারবে সে তত যোগ্য। কিন্তু ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করিনি। প্রসঙ্গত এই ‘কোটা’র এমপি হচ্ছেন প্রাক্তন স্পিকার বিজেপির ওম বিড়লা। কোচিং সেন্টারগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। প্রতি বছর বিভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষার ফল বেরোনোর পর সফল/অতিসফল পড়ুয়াদের নিয়ে সেন্টারগুলি রাস্তায় মিছিল করে, কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়। অতিসফল পড়ুয়াদের মা-বাবারা ঘুরপথে এই সেন্টারগুলির থেকে বিজ্ঞাপন বাবদ অর্থ বা অন্যকিছু আদায় করে। এবং এই পড়ুয়াদের আবার প্রথাগত বিদ্যালয়ে যেতে হয় না। একটি থোক টাকা বা ঘুষ দিয়ে নাম ওঠানো থাকে। তারা খালি বছর-শেষে এগারো/বারো ক্লাসের পরীক্ষা দেয়। অর্থাৎ পুরোটাই একটি দুর্নীতি চক্র। তারা অনেকে দুর্নীতি নিয়ে সরব হচ্ছে এটা বড় ব্যপার। এবারে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দুর্নীতির তদন্ত করে ‘নিট’ পরীক্ষা নিয়ে অবিলম্বে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকার ও বিচারব্যবস্থার সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। আর ভবিষ্যতে ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষায় দুর্নীতি কম করতে হলে—
- কেন্দ্রীভূত ‘নিট’ পরীক্ষা তুলে রাজ্যগুলির হাতে প্রবেশিকা পরীক্ষা ফিরিয়ে দিতে হবে।
- প্রবেশিকা পরীক্ষার বদলে ক্রমশ প্রথাগত বারো ক্লাসের পরীক্ষার গুরুত্ব ফিরিয়ে আনতে হবে। বারো ক্লাসের নম্বরই এমবিবিএস-এর যোগ্যতামান হবে
- ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষার সিলেবাস সেই রাজ্যের বারো ক্লাসের সিলেবাস অনুযায়ী হবে।
- আইন করে ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষার কোচিং ক্লাস বন্ধ করে দিতে হবে।
- লোকসভা, বিধানসভার সদস্য, সিনিয়র আইএএস/আইপিএস/আইএফএস/এমসিআই সদস্যরা নিজেরা বা তাদের পরিবারের কোনও ঘনিষ্ঠ সদস্য বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবে না।
- সরকারি বেসরকারি সব কলেজে কোনও ম্যানেজমেন্ট কোটা থাকবে না।
- ভর্তুকি দিয়ে নিম্নবিত্ত পরিবারের পড়ুয়াদের বিনামূল্যে এবং উচ্চবিত্তদের পরিবারের রোজগার/আয়কর রিটার্ন/জমির পরিমাণ অনুযায়ী মাইনে নির্ধারিত হবে।
- প্রতি ২০ লক্ষ জনসংখ্যা পিছু একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ গড়ে তুলতে হবে।
- স্বাস্থ্যখাতে ১০ শতাংশ খরচা করতেই হবে।
- দুর্নীতির মূল কেন্দ্র বেসরকারি মেডিক্যাল শিক্ষা বন্ধ করে দিতে হবে।
এতেও দুর্নীতি বন্ধ হবে না। কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দুর্নীতি হচ্ছে ভিত্তি। তবু রাজ্যের হাতে থাকলে, বিকেন্দ্রীকরণ হলে, দুর্নীতির প্রতিবাদ ও ভারসাম্য বজায় থাকে।
*মতামত ব্যক্তিগত