পীযূষ দত্ত
শেষ কয়েক বছরে গোমাংসকে কেন্দ্র করে উত্তরপ্রদেশে যে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরি করা গিয়েছিল, তারপর সেই পরিস্থিতিকে হাতিয়ার করে 'হিন্দুধর্ম রক্ষার' নামে গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরি করে ভোট করানো সহজ হয়েছিল। এই নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের মানুষ কার্যত বিজেপির সেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে নাকচ করেছেন। ফলে, চোখ এখন মধ্যপ্রদেশের দিকে। এ মন্দার বাজারে যদি তারা বিজেপিকে সামান্য অক্সিজেন দিতে পারে
সদ্য শেষ হয়েছে লোকসভা নির্বাচন। দেশে তৈরি হয়েছে ‘মোদি ৩.০’ সরকার। তার সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই এগারোজনের ঘর ভেঙে দেওয়া হল মধ্যপ্রদেশে।
নবগঠিত এনডিএ সরকার তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসার পর থেকেই একাধিক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে দেশে। প্রথম, স্টক মার্কেট কেলেঙ্কারি, দ্বিতীয়, নিট কেলেঙ্কারি, তৃতীয়, পশ্চিমবঙ্গের ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা, চতুর্থ, অরুন্ধতী রায় এবং শেখ সওকাত হোসেনের উপর ইউএপিএ ধারায় মামলা রুজু করা, আর পঞ্চম, মধ্যপ্রদেশে এগারোজনের ঘর ভেঙে দেওয়া হল ফ্রিজে গরুর মাংস আছে— এই অনুমানের ভিত্তিতে।
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মোদি সরকার গোমাংস ভক্ষণ রুখতে বহুবার রাস্তায় নেমেছে। গোরক্ষা সমিতি, বজরং দলের মতো একাধিক সংগঠনের তৎপরতা তুঙ্গে উঠেছিল। লোকের বাড়ির ফ্রিজ অবধি পৌঁছে গিয়েছিল সেই তৎপরতা।
এবার মধ্যপ্রদেশের মান্দলা জেলায় এগারোজনের বাড়ি ভেঙে দেওয়া হলো। ‘মিন্ট’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুলিশ জানায়, ‘বেআইনি গোমাংসের ব্যবসা’ রুখতেই নাকি এহেন পদক্ষেপ।
মান্দলা জেলার পুলিশ সুপার রজত সাকলেচা পিটিআই-কে জানান, তাদের কাছে খবর আসে যে ওই বাড়িগুলিতে বেশ কিছু গরুকে ‘আটক’ করে রাখা হয়েছে। তাই কতকটা তামিল ছবির নায়কের ভঙ্গিমায় তাঁরা এগারোজনের বাড়ি ধসিয়ে দিলেন।
সেই বাড়িগুলির থেকে সর্বমোট ১৫০ খানা গরুকে ‘উদ্ধার’ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ঘরগুলিতে তল্লাশির পর ফ্রিজে গোমাংস পাওয়া গিয়েছিল, এমনটাও জানানো হয়েছে।
‘মিন্ট’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে পুলিশের যে বয়ান সামনে আসে তা কতকটা এমন, “১৫০টা গরুকে উদ্ধার করা হয়েছে। ভাঁইসওয়াহি অঞ্চল এই মুহূর্তে গোপাচারের কেন্দ্রতে পরিণত হয়েছে। মধ্যপ্রদেশে গোহত্যার জন্য সাত বছরের সাজা দেওয়া হয়।”
তাঁরা আরও যোগ করেন, “যারা এই কাজ করেছে তাদের ক্রিমিনাল রেকর্ড দেখা হচ্ছে। তারা সকলেই মুসলমান।”
আলোচনাটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু আদতে আলোচনার শুরুটাই এখান থেকে হওয়া উচিত।
আপনাদের দুটো ঘটনা স্মরণ করাই।
২০১৫ সালে, উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে, আখলাককে হত্যা করা হয়, কারণ হত্যাকারীরা অনুমান করে যে, আখলাক এবং তাঁর পরিবার গোমাংস খেয়েছিল ঈদ উপলক্ষে। এবং তাঁর ফ্রিজের ভিতর তারা মাংস পায়। যা দেখে তাদের গোমাংস বলে সন্দেহ হয়। পরবর্তীতে জানা যায় তা ছিল খাসির মাংস। স্রেফ তাদের সেই অনুমানের উপর ভিত্তি করে, ভিড় জমিয়ে তারা আখলাককে মেরে দিয়েছিল।
আরেকটা ঘটনা।
২০১৭ সাল, ট্রেনের মধ্যে জুনায়েদ নামক একটি ১৫ বছরের ছেলেকে হত্যা করা হয়। ট্রেনের ভিতর তর্ক বাধে সিট নিয়ে, সেই তর্ক কিছু দূর গড়াতেই উল্টোদিকে থাকা হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা জুনায়েদের দাড়ি, তার ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে কটাক্ষ করা শুরু করে। তাঁর জামাকাপড়ের ব্যাগের দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয় যে, তাতে গোমাংস রয়েছে। ভরা ট্রেনের মধ্যে জুনায়েদকে সেই অনুমানের উপর ভিত্তি করে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়।
গোরক্ষার অজুহাতে এমন কত শত সংখ্যালঘু ঘরের মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে, তার তালিকা দিতে গেলে এই এক আলোচনায় হয়তো শেষ করা যাবে না।
তবে এটা ‘একটা’ ভারতের গল্প বললাম আপনাদের।
এবার আরেকটা ভারতের দিকে চোখ ফেরাই।
নির্বাচনের প্রাক্কালে খবরের শীর্ষে ছিল ইলেকটোরাল বন্ড সংক্রান্ত আলোচনা। জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়েছিল নির্বাচনী দলগুলির অর্থ লেনদেনের তথ্য। সেই সময় একটি খবর সামনে এসেও আলোচনার পিছনের সারিতে চলে যায়, খবরটি জরুরি।
জানা যায়, দেশের অন্যতম বৃহৎ গোমাংস রপ্তানিকারী সংস্থা ‘অ্যালানা গ্রুপ’-এর থেকে বিজেপি দু কোটি টাকা ইলেকটোরাল বন্ড মারফত অনুদান নেয়। ১২ এপ্রিল ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি অবধি, বিজেপি অনুদান নিয়েছে মোট ছয় কোটির বেশি টাকা। আর তার মধ্যে রয়েছে এই গোমাংস রপ্তানিকারী সংস্থাও।
এই ‘দ্বিতীয়’ ভারতটিকে নিয়ে চর্চা করতে গেলে, আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ খবরের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
মণিপুরের জাতিদাঙ্গা-খ্যাত (কুখ্যাত) মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং, ২০১৭ সালে উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগরিকদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে একটি কথা বলেন।
৪ জুন, ২০১৭ সালে, ‘দ্য ইকোনমিক টাইমস’ পত্রিকায় খবরটি প্রকাশিত হয়। যেখানে বীরেন সিং উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগরিকদের গোমাংস খাওয়া নিয়ে বলেন, “গোমাংস এ-প্রান্তের মানুষের খাদ্যাভ্যাসের একটি অত্যন্ত জরুরি অঙ্গ। এখানে খ্রিস্টানরা, মূলত উপজাতির মানুষেরা গোমাংস খান। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মও খাচ্ছে। বিজেপি গোমাংস খাওয়ায় কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করছে না। খালি বেআইনি গোহত্যা বন্ধ করবার চেষ্টা করছে।”
তিনি আরও বলেন, “মানুষের খাদ্যাভ্যাস, মানুষ যা দীর্ঘদিন ধরে খেয়ে আসছেন, বিজেপি কোনোভাবেই তাতে কোনও আপত্তি করছে না।”
অর্থাৎ গোমাংসকে কেন্দ্র করে বিজেপির রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা স্পষ্ট।
একদিকে দেশের একপ্রান্তে গোহত্যার নাম করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর লাগাতার আক্রমণ চালানো হচ্ছে। অন্যদিকে উত্তর-পূর্ব ভারতের মতো অঞ্চলে, গোমাংস খাওয়াকে ‘খাদ্যাভ্যাস’ বলে চোখ সরানো হচ্ছে। দুটিই আসলে অঞ্চল ধরে রাখবার ফন্দি, ভোট আদায়ের মাধ্যম।
আসলে ধর্ম এবং ধর্মীয় উস্কানি চিরকালই মোদি সরকারের রক্ষাকবচের মতো কাজ করেছে। যখন, যেখানে, পায়ের তলার মাটি দুর্বল হয়েছে বিজেপির, ধর্মীয় উস্কানির আশ্রয় নিতে হয়েছে তাদের।
নির্বাচনের ফলাফল যে মোদি সরকারের দুর্দিনের ইঙ্গিত বহন করছিল তা আগেই প্রধানমন্ত্রী টের পেয়েছিলেন। তাই নির্বাচনী প্রচারের শেষ লগ্নে আর ‘৪০০ পার’, ‘বিকশিত ভারত’-এর গালভরা আওয়াজ না দিয়ে সোজাসরল অঙ্কে হিন্দু-মুসলিমের হিসেবে নেমে গিয়েছিলেন। কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে হিন্দু মহিলাদের মঙ্গলসূত্র নিয়ে ‘ঘুসপেটিয়া’-দের দিয়ে দেবে, এই জাতীয় সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে নেমে গিয়েছিলেন।
৪ জুনের ফলও সে-কথাই প্রমাণ করল। মোদির পায়ের তলার মাটি দুর্বল হল। তাঁদের তথাকথিত ‘গড়’ বলে পরিচিত উত্তরপ্রদেশেও এবার তাঁরা পিছনের সারিতে।
ফলে সেই হারিয়ে যাওয়া মাটি পুনরুদ্ধারের জন্যেই হয়তো এবার শেষ আশ্রয় মধ্যপ্রদেশ।
তবে শুধু মধ্যপ্রদেশ নয়, এখানে আরেকটা ঘটনার কথাও জানিয়ে রাখা জরুরি, সদ্য ওড়িশাতে সাফল্যের মুখ দেখেছে বিজেপি। এইবার সেখানেও দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি করতে তারা উদ্যত। জানা যায়, ওড়িশার উত্তরের দিকে একটি শহরে ঈদকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এ ১৮ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সে অঞ্চলের জল নাকি আচমকাই লাল হতে শুরু করে, যা দেখে কিছুজনের সন্দেহ হয় যে তা হয়তো রক্ত। গোহত্যার পরের রক্ত। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই গোলযোগ বাঁধানো হয়। দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
অর্থাৎ, সাম্প্রদায়িক উস্কানি-ই যে মোদির শেষ এবং একমাত্র কৌশল তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
অন্যদিকে মধ্যপ্রদেশে তারা ২৯টা আসনের সবকটাতেই জয়লাভ করেছে। ফলে, এবার মধ্যপ্রদেশকেই ‘হিন্দুত্ব’ ফেরানোর জন্য এক্সপেরিমেন্টের মাটি হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।
শেষ কয়েক বছরে গোমাংসকে কেন্দ্র করে উত্তরপ্রদেশে যে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরি করা গিয়েছিল, তারপর সেই পরিস্থিতিকেই হাতিয়ার করে ‘হিন্দুধর্ম রক্ষার’ নামে গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরি করে ভোট করানো সহজ হয়েছিল।
এই নির্বাচনের পর উত্তরপ্রদেশের মানুষ কার্যত বিজেপির সেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে নাকচ করেছেন। ফলে, চোখ এখন মধ্যপ্রদেশের দিকে। এ মন্দার বাজারে যদি তারা বিজেপিকে সামান্য অক্সিজেন দেয় আর কি…
খেয়াল করে দেখুন, বিজেপি নিজেদের ভোট ফেরাতে ঠিক কতটা মরিয়া। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাদের সবথেকে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক উস্কানিগুলির মধ্যে দুটি হচ্ছে, এক, সংখ্যালঘুদের কোণঠাসা করবার জন্য ‘গো রক্ষা’-কে নির্বাচনের বিষয়বস্তু করা, আর দুই, জেসিবি দিয়ে সংখ্যালঘুদের ঘর ভেঙে দেওয়া। যেমনটা আমরা উত্তরপ্রদেশে শেষ কয়েক বছরে হতে দেখেছি।
তবে এইবার তারা মরিয়া, অসহায়। তাই কেবল গোরক্ষার নামে ভিড় জমানো বা মারধর দিয়ে হল না, শুধু জেসিবি দিয়ে ঘর ভেঙে দেওয়ার উপরও আর ভরসা করা গেল না। এবার দুটি সাম্প্রদায়িক প্রক্রিয়ার একপ্রকার ‘মিশ্রণ’ দেখা গেল মধ্যপ্রদেশে। সেখানে গোরক্ষাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক হাওয়া তৈরি করা হল, এবং এগারোজনের বাড়ি ভেঙে দেওয়া হল।
এক্ষেত্রে আরেকটা জিনিস উল্লেখযোগ্য, সেটা হল, এবার আর বজরং দলের মতো কোনও ‘প্রাইভেট বাহিনি’ নয়, সোজা পুলিশকেই হিন্দুত্ববাদী বাহিনিতে পরিণত করে এ আক্রমণ করানো হল।
বোঝাই যাচ্ছে বিজেপি অসহায়। তাই, সর্বশক্তি দিয়ে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে। উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানার হারানো জমি ফেরাতে চাইছে। আর সে কারণেই হিন্দি ছবি ‘সূর্যবংশী’-র অক্ষয় কুমারের মতো নায়কোচিত কায়দায় পুলিশকে উর্দি গায়ে ১৫০টা গরুকে ‘উদ্ধার’ করতে যেতে হচ্ছে। আসলে, ১৫০টা গরু নয়, এটা বিজেপির হারানো জমি উদ্ধারের চেষ্টা মাত্র।
*মতামত ব্যক্তিগত