Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মানুষের বিশ্বাসঘাতকতার জবাব দিতে শুরু করেছে প্রকৃতি

আশিস গুপ্ত

 


প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গ্লাসগোতে 'কপ ২৬' সম্মেলনে ঘোষণা করেছিলেন ২০৭০ সালের মধ্যে ভারতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করা হবে। অথচ এই প্রধানমন্ত্রীর দলের সরকার ছত্তিশগড়ের হাসদেও ঘন বনাঞ্চলে কয়লা উত্তোলনের জন্য আদানির সংস্থাকে লাইসেন্স দিয়েছে। ছত্তিশগড়ের পারসা ইস্ট এবং কান্তা বসন (পিইকেবি) কয়লা ব্লকের জন্য হাসদেওতে জীববৈচিত্র্য-সমৃদ্ধ বনের ১৩৭ হেক্টরের বেশি এলাকা থেকে হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। পিইকেবি এবং পারসা কয়লা ব্লকগুলি আদানি গ্রুপ দ্বারা পরিচালিত রাজস্থান রাজ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন নিগমকে বরাদ্দ করা হয়েছে। জাতীয় রাজধানী দিল্লির ডেভলপমেন্ট অথরিটিকে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট তীব্র ভর্ৎসনা করে শাস্তির হুঁশিয়ারি দিয়েছে, রাস্তা তৈরির নামে সংরক্ষিত জঙ্গলের গাছ কেটে ফেলার জন্য। খুব গভীরভাবে খতিয়ে দেখলে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছতে হয়, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে তৃতীয় শর্তটি হল বিশ্বনেতাদের দ্বিচারিতা বন্ধের দাবিতে জোরদার আওয়াজ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা

 

অত্যাচারিত লাঞ্ছিত প্রকৃতি পাল্টা মার দিতে শুরু করেছে। অথবা বলা যেতে পারে যুগ যুগ ধরে প্রকৃতির সঙ্গে ‘আধুনিক সমাজ উন্নয়নের’ নামে মানুষের যে বিশ্বাসঘাতকতা, তার জবাব দিতে শুরু করেছে প্রকৃতি। যার পোশাকি নাম জলবায়ু পরিবর্তন। পাল্টা মার্ বা জবাব, যাই বলি না কেন, প্রকৃতির রোষ আমাদের সমাজজীবনে আছড়ে পড়ছে কখনও তীব্র দাবদাহ হয়ে, কোথাওবা সে বিধ্বংসী বন্যা বা সামুদ্রিক ঝড় হয়ে। এই ভারতবর্ষেই সাম্প্রতিক দিগুলিতে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতির অদ্ভুত বৈপরীত্য। হিমালয়-সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গের একাংশ-সহ গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতে তুমুল বর্ষণে যখন বিধ্বংসী বন্যা, ঠিক সেই সময় উত্তর ভারত জুড়ে তীব্র তাপপ্রবাহ। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে বিষয়, উত্তরভারতের পাহাড় অঞ্চলের জঙ্গল এবার পুড়ছে তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে। বিশেষ করে উত্তরাখণ্ডে। এই পাহাড়ি রাজ্যের পৌরি-গাড়োয়াল জেলার কালজিখাল ব্লকের প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রাম থাপলি-র মধ্যবয়স্ক অজয় পটোয়াল বলেছেন, “জীবনে এত গরম কখনও পাইনি। গরমে পাহাড়ের জঙ্গলগুলিতে আগুন লেগে যাচ্ছে, গাছ পুড়ছে আর আগুনের তাপে আমরা ঝলসে যাচ্ছি। এ আগে কখনও হয়নি।”

উত্তরাখণ্ড

 

দেশের অনেক অংশে তাপমাত্রা অভূতপূর্ব মাত্রায় বেড়েছে। দিল্লি-সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে ৪৫ ডিগ্রি থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে। দিল্লি, মুম্বাই, হায়দ্রাবাদ এবং চেন্নাইয়ের মতো শহরগুলি প্রচণ্ড গরমের সম্মুখীন হয়েছে, যা দৈনন্দিন কাজকর্মকে ব্যাহত এবং স্বাস্থ্যের ঝুঁকি তৈরি করেছে, বিশেষ করে বয়স্ক, শিশু এবং খোলা আকাশের নিচে কর্মরত কর্মীদের মতো জনগোষ্ঠীর জন্য। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী ২০ জুন পর্যন্ত দেশে হিটস্ট্রোকে মৃত্যু হয়েছে ১৪৩ জনের। যদিও রাজ্যগুলি থেকে ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র সংগৃহিত তথ্য দেখায় যে সাম্প্রতিক তাপপ্রবাহের কারণে নিশ্চিত মৃত্যুর সংখ্যা ২০৯ জন, ২৩৯টি সন্দেহভাজন মৃত্যুর পাশাপাশি, এই মরসুমে মোট ৪৪৮টি নিশ্চিত এবং সন্দেহজনক মৃত্যু হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রকের ডেটা দেখায় যে উত্তরপ্রদেশে এই জাতীয় মৃত্যু সর্বোচ্চ সংখ্যক ৩৫ রেকর্ড করা হয়েছে, তারপরে দিল্লিতে ২১ জন মারা গেছে। রাজস্থান এবং ওড়িশায় হিটস্ট্রোকের কারণে ১৭ জন মারা গেছে। অন্যদিকে, টাইমস অফ ইন্ডিয়া পত্রিকার তথ্য অনুসারে, দিল্লিতে এখনও পর্যন্ত ৭৬টি তাপজনিত মৃত্যুর রেকর্ড করা হয়েছে, যা দেশের সর্বোচ্চ নিশ্চিত মৃত্যু চিহ্নিত করেছে। রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল থেকে এই পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের ত্রাণ কমিশনার কার্যালয় ৫১ জন নিশ্চিত তাপজনিত মৃত্যুর খবর দিয়েছে। এছাড়া গাজিয়াবাদ জেলায় ৫১ জন এবং নয়ডা জেলায় ১৪ জন সন্দেহভাজন তাপজনিত মৃত্যু নথিভুক্ত করা হয়েছে।

দিল্লি

 

মৃতের সংখ্যা নিয়ে ভারতে সরকারি ও বেসরকারি তথ্যের মধ্যে গরমিল একটা সর্বকালীন সমস্যা। আমরা সেই সমস্যার মধ্যে ঢুকছি না। কিন্তু এই সংখ্যাগুলি থেকে পরিস্থিতির গভীরতা উপলব্ধি করা যায়। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য বলছে যে ভারতে ২০১২ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে হিট স্ট্রোকের কারণে ১১,০০০ জনেরও বেশি লোক মারা গেছে। শুধুমাত্র ভারতবর্ষেই নয়, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রকৃতির এই ক্রোধপ্রকাশ বিশ্বের সর্বত্র। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত রাষ্ট্রসঙ্ঘের আন্তঃসরকারি প্যানেল, সংক্ষেপে আইপিসিসি-র মতে, মানব-সৃষ্ট উষ্ণতা ছাড়াই প্রতি ১০ বছরে একবার হওয়া তাপপ্রবাহগুলি এখন ২.৮ গুণ বেশি (বা প্রতি ৩.৬ বছরে একবার) ঘটতে পারে এবং লাগামহীন জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উষ্ণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, সংক্ষেপে নাসার তথ্য অনুসারে, ১৮৮০ সালের দিকে আধুনিক রেকর্ড-কিপিং শুরু হওয়ার পর থেকে ২০২৩ ছিল পৃথিবীর উষ্ণতম বছর, এবং গত ১০ বছরে রেকর্ডে সবচেয়ে উষ্ণতম দশক। জুলাই ২০২৩ ছিল সর্বকালের উষ্ণতম মাস এবং ৬ জুলাই ছিল সর্বকালের উষ্ণতম দিন। তারপর থেকে, গত ১২ মাসের প্রত্যেকটি সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা তাদের আগের মাসিক রেকর্ড ভেঙেছে। ২০২৩ রেকর্ডে উষ্ণতম ক্যালেন্ডার বছর হিসেবে ২০১৬-কে প্রতিস্থাপন করেছে। ইআরএ৫ হল ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর মিডিয়াম-রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্ট-এর পঞ্চম প্রজন্মের বায়ুমণ্ডলীয় পুনর্বিশ্লেষণ। যা জানুয়ারি ১৯৪০ থেকে বৈশ্বিক জলবায়ুর বর্তমান সময়কালকে কভার করে। ইআরএ৫ ডেটাসেট অনুসারে, ২০২৩ সালের বিশ্ব-গড় তাপমাত্রা ছিল ১৪.৯৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০১৬-এর রেকর্ডের চেয়ে ০.১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি।

 

২০২১ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘের আন্তঃসরকারি প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-র একটি রিপোর্ট হাইলাইট করেছে যে মানুষের কৃতকর্মের প্রভাব জলবায়ুকে এমন হারে উষ্ণ করেছে যা অন্তত গত ২০০০ বছরে নজিরবিহীন। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে ১৮৫০-১৯০০ সালের তুলনায় ২০১১-২০২২-এর দশকে বিশ্বপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১.০৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। তাপতরঙ্গ, অস্বাভাবিকভাবে উচ্চ তাপমাত্রার দীর্ঘ সময়ের অবস্থান, একটি অভিনব ঘটনা নয়। তাদের ফ্রিকোয়েন্সি, সময়কাল এবং তীব্রতা মানুষসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বারা প্রসারিত হয়েছে। জলবায়ুবিজ্ঞানীরা ক্রমবর্ধমান গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন এবং বিশ্বব্যাপী তাপতরঙ্গের বর্ধিত ঘটনার মধ্যে একটি স্পষ্ট যোগসূত্র স্থাপন করেছেন৷ ইউরোপ ২০২২ সালে রেকর্ডে তার সবচেয়ে উষ্ণ গ্রীষ্ম অনুভব করেছিল। স্পেন এবং ফ্রান্সের মতো দেশে তাপমাত্রা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছিল। ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি কিছু অঞ্চলে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ) জানিয়েছিল যে ২০২১ সালে রেকর্ড-ব্রেকিং তাপতরঙ্গ দেখা গিয়েছিল। প্রশান্ত মহাসাগরীয় উত্তর-পশ্চিম, তার নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর জন্য পরিচিত, তাপমাত্রা ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে, যার ফলে শত শত মৃত্যু এবং ব্যাপক অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। জলবায়ুবিজ্ঞানী এবং পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির আর্থ সিস্টেম সায়েন্স সেন্টারের পরিচালক ডাঃ মাইকেল মান বলেছেন, “জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর দূরের হুমকি নয়; এটি একটি বর্তমান বাস্তবতা। তাপপ্রবাহের ক্রমবর্ধমান ফ্রিকোয়েন্সি এবং তীব্রতা একটি উষ্ণ গ্রহের স্পষ্ট সূচক। এই প্রভাবগুলি প্রশমিত করতে এবং দুর্বল জনসংখ্যাকে রক্ষা করার জন্য আমাদের এখনই কাজ করতে হবে।”

ইউরোপ

 

তাপপ্রবাহে স্বাস্থ্যের প্রভাবগুলি গভীর এবং বিস্তৃত। চরম তাপের দীর্ঘায়িত এক্সপোজার তাপজনিত ক্লান্তি, হিটস্ট্রোক এবং কার্ডিওভাসকুলার এবং শ্বাসযন্ত্রের রোগের মতো দীর্ঘস্থায়ী অবস্থার বৃদ্ধি ঘটাতে পারে। দ্য ল্যানসেট প্ল্যানেটারি হেলথ-এ প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুমান করেছে যে ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী ৩৫৬,০০০-এরও বেশি মৃত্যু তাপের এক্সপোজারের জন্য দায়ী ছিল। দ্য গ্লোবাল বার্ডেন অফ ডিজিজ স্টাডি অনুসারে তাপপ্রবাহ শুধুমাত্র ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী ৯৩,০০০ কার্ডিওভাসকুলার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিকতম একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বের সমস্ত অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চরম তাপের সংস্পর্শে আসা মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ২০০০-২০০৪ এবং ২০১৭-২০২১ -এর মধ্যে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের জন্য তাপজনিত মৃত্যুর হার প্রায় ৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০০-২০১৯ সালের মধ্যে গবেষণায় দেখা যায় যে প্রতি বছর প্রায় ৪৮৯,০০০ তাপজনিত মৃত্যু ঘটে, যার মধ্যে ৪৫ শতাংশ এশিয়ায় এবং ৩৬ শতাংশ ইউরোপে। শুধুমাত্র ইউরোপে ২০২২ সালের গ্রীষ্মে, আনুমানিক ৬১৬৭২ জনের তাপ-সম্পর্কিত অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটেছে। তীব্র তাপপ্রবাহের ঘটনা উচ্চহারে মৃত্যু আনতে পারে। ২০০৩ সালে, জুন-আগস্টে তাপপ্রবাহের ফলে ইউরোপে ৭০,০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল। ২০১০ সালে, রাশিয়ান ফেডারেশনে ৪৪ দিনের তাপপ্রবাহের সময় ৫৬,০০০ জনের মৃত্যু ঘটেছিল। শারীরিক স্বাস্থ্যের বাইরে, তাপপ্রবাহ মানসিক সুস্থতার উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগের সঙ্গে মিলিত চরম উত্তাপ দ্বারা প্ররোচিত মনস্তাত্ত্বিক চাপ প্রভাবিত সম্প্রদায়ের মধ্যে উচ্চতর উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা তৈরির ক্ষেত্রে অবদান রাখে। তাপপ্রবাহের পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া সমানভাবে উদ্বেগজনক। উচ্চ তাপমাত্রার দীর্ঘ অবস্থান বাস্তুতন্ত্রকে ব্যাহত করে, যার ফলে পরিবর্তিত অভিবাসনের ধরন, জীববৈচিত্র্য হ্রাস এবং কৃষির ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাপের চাপ ফসল ধ্বংস করতে পারে, খাদ্যনিরাপত্তা হ্রাস করতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা বাড়িয়ে তুলতে পারে। এছাড়াও তাপপ্রবাহের প্রসার মেরু-বরফের আচ্ছাদন গলে যাওয়া এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি করতে অবদান রাখে, উপকূলীয় বন্যা এবং নিচু এলাকায় প্লাবনের আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে।

 

তাপপ্রবাহের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন যা প্রশমন এবং অভিযোজন উভয় কৌশলকে অন্তর্ভুক্ত করে। পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎস গ্রহণের মাধ্যমে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন রোধ করার প্রচেষ্টা, শক্তির দক্ষতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলির প্রশমনে নীতিগত হস্তক্ষেপ অপরিহার্য। তাপপ্রবাহের ক্রমবর্ধমান হুমকির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সমন্বিত বৈশ্বিক পদক্ষেপ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের দাবি জরুরি। জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধিতে, সর্বোত্তম অনুশীলনগুলি ভাগ করে নেওয়ার জন্য এবং তাপতরঙ্গ দ্বারা অসমভাবে প্রভাবিত দুর্বল অঞ্চলগুলিকে সমর্থন করার জন্য সংস্থানগুলিকে একত্রিত করার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য। বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ-কথা জানেন এবং তা মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেন, অন্তত কাগজে-কলমে। জলবায়ু পরিবর্তন বা উষ্ণায়ন রোধে প্রাথমিক একটা শর্ত হল সবুজের আচ্ছাদনকে বিস্তৃত করা। বনাঞ্চল রক্ষা ও তার প্রসার ঘটানো। অথচ গোটা বিশ্ব জুড়েই চলছে ধংসযজ্ঞ। আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের (জিএফডব্লিউ) তথ্য অনুসারে আমাদের দেশেই ২০০২ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত, ভারত আর্দ্র প্রাথমিক বনাঞ্চল হারিয়েছে ৪১৪ কিলোহেক্টর ভূমি। একই সময়ের মধ্যে মোট গাছ নষ্ট হয়েছে ১৮ শতাংশ। এই সময়ের মধ্যে ভারতে আর্দ্র প্রাথমিক বনের মোট এলাকা ৪.১ শতাংশ কমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে ৪.১ শতাংশ বনাঞ্চল হারিয়ে গেল তা ৮১.৯ মেট্রিকটন কার্বন নির্গমন প্রতিরোধ করতে পারত। অসমে ধ্বংস হয়েছে ৩.২৩ লাখ হেক্টর বনভূমি। যদিও সরকারি তথ্য এই পরিসংখ্যানকে স্বীকার করে না, কারণ তাদের হিসেবে তুলসিও বৃক্ষ। গত ৪ এপ্রিল জিএফডব্লিউ-র সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বস্তরে ২০২৩ সালে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রাথমিক বনাঞ্চলের ক্ষতি হয়েছে মোট ৩.৭ মিলিয়ন হেক্টর, যা প্রতি মিনিটে প্রায় ১০টি ফুটবল মাঠের সমপরিমাণ বনভূমি হারানোর সমতুল্য। এটি ২০২২ থেকে ৯ শতাংশ হ্রাস চিহ্নিত করে। এই সমস্ত বনের ক্ষতি ২০২৩ সালে ২.৪ গিগাটন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন প্রতিরোধকে ব্যর্থ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক জীবাশ্ম জ্বালানি নির্গমনের প্রায় অর্ধেকের সমান ২.৪ গিগাটন কার্বন। অর্থাৎ, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বিশ্বনেতারা যে প্রতিশ্রুতিই দিন না কেন বাস্তবে তার কোনও প্রতিফলন নেই। জলবায়ু পরিবর্তন রোধের আর একটি শর্ত হল বহুলব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে কার্বন নির্গমন পুরোপুরি বন্ধ করা। এই বিষয়টি নিয়ে এখানে আলোচনা করছি না, কারণ লেখাটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকবে। তবে একটা কথা বলে লেখাটা শেষ করছি। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ করার জন্য বিশ্বনেতারা নানারকমের সময়সীমা ঘোষণা করেছেন। যেমন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গ্লাসগোতে ‘কপ ২৬’ সম্মেলনে ঘোষণা করেছিলেন ২০৭০ সালের মধ্যে ভারতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করা হবে। অথচ এই প্রধানমন্ত্রীর দলের সরকার ছত্তিশগড়ের হাসদেও ঘন বনাঞ্চলে কয়লা উত্তোলনের জন্য আদানির সংস্থাকে লাইসেন্স দিয়েছে। ছত্তিশগড়ের পারসা ইস্ট এবং কান্তা বসন (পিইকেবি) কয়লা ব্লকের জন্য হাসদেওতে জীববৈচিত্র্য-সমৃদ্ধ বনের ১৩৭ হেক্টরের বেশি এলাকা থেকে হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। পিইকেবি এবং পারসা কয়লা ব্লকগুলি আদানি গ্রুপ দ্বারা পরিচালিত রাজস্থান রাজ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন নিগমকে বরাদ্দ করা হয়েছে। জাতীয় রাজধানী দিল্লির ডেভলপমেন্ট অথরিটিকে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট তীব্র ভর্ৎসনা করে শাস্তির হুঁশিয়ারি দিয়েছে, রাস্তা তৈরির নামে সংরক্ষিত জঙ্গলের গাছ কেটে ফেলার জন্য। খুব গভীরভাবে খতিয়ে দেখলে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছতে হয়, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে তৃতীয় শর্তটি হল বিশ্বনেতাদের দ্বিচারিতা বন্ধের দাবিতে জোরদার আওয়াজ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

 

তথ্যসূত্র:

  1. NASA. (2021). 2020 Tied for Warmest Year on Record, NASA Analysis Shows.
  2. IPCC. (2021). Climate Change 2021: The Physical Science Basis.
  3. European Space Agency. (2022). Europe’s Hottest Summer on Record.
  4. NOAA. (2021). Record-Breaking Heat Waves in 2021.
  5. The Lancet Planetary Health. (2020). Global Mortality from Heat Exposure in 2019.
  6. European Commission. (2019). Economic Impact of the 2018 Heat Wave in Europe.
  7. NASA. (2021). 2020 Tied for Warmest Year on Record, NASA Analysis Shows.
  8. Dr. Michael Mann. Personal communication.
  9. World Health Organization. (2021). Heat Waves and Health.

*মতামত ব্যক্তিগত