Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কিছুটা স্পেস অন্তত পাওয়া গেল— সামগ্রিকভাবে, এবং মেয়েদের জন্যও

আইরিন শবনম

 


নারীকে সঙ্ঘীরা মানুষ বলেই মনে করে না। মানে না সংবিধান এবং ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা। কারণ তারা ভারতের বিশাল এবং সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে না। সে বৈচিত্র্য ভাষা, ধর্মবিশ্বাস বা সংস্কৃতি যাই হোক না কেন। ১৯৯৩ সালের পয়লা জানুয়ারি সঙ্ঘ পরিবার এক শ্বেতপত্র প্রকাশ করে ভারতীয় সংবিধানকে হিন্দুবিরোধী বলে নিন্দা করে। ভারতের জনগণকে স্যালুট, তারা এই স্বেচ্ছাচারী রথচক্রকে নিঃশব্দে আটকে দিয়েছে। পুরোপুরি না হলেও অনেকটা

 

এবারের লোকসভা নির্বাচন আগের সমস্ত নির্বাচনের থেকে ছিল সম্পূর্ণ আলাদা; কারণ এবারে বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে প্রথমেই হাত দিত সংবিধানে, এবং সংবিধানের কোন কোন জায়গায় তারা বদল আনত তারও একটা আভাস পাওয়া গেছিল। জোরালো আভাস ছিল বিপুল সংখ্যা নিয়ে পুনরায় বিজেপি ক্ষমতায় আসছে— অনেকের কাছেই যা ছিল জীবন-মরণ সমস্যা। চরম বিজেপি-বিরোধী মানুষও বিশ্বাস করতে পারেননি যে, এবারের নির্বাচনে বিজেপি তথা মোদি কোথাও ধাক্কা খেতে পারে। (শুধু কিছু ‘গোঁয়ার-গোবিন্দ’ মানুষ এটা মেনে নিতে পারছিলেন না। উল্টো কথা বলছিলেন।) যার পেছনে প্রধান ভূমিকা ছিল নির্লজ্জ-মিথ্যাচারী এবং সরাসরি পক্ষপাতদুষ্ট মিডিয়ার। অনেকে মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছিলেন আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার— বিশেষ করে একটি সম্প্রদায়ের মানুষ। কার্যত তাঁরা ছিলেন দিশেহারা। শুধু রামমন্দিরের আস্ফালন নয়, তাঁদের রুটি-রুজি, ধর্মাচার, খাদ্যাভ্যাস এমনকি ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা পড়েছিল চরম সঙ্কটের মুখে।

কিন্তু শুধুই কি একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের সঙ্কট ছিল এই নির্বাচন? বোধহয় না। যেহেতু তাঁরা সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়েছিলেন তাই তাঁরাই উঠে এসেছিলেন ‘সারফেসে’। ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ কিংবা ধর্মহীন যুক্তিবাদীরা, মানবাধিকার কর্মীরা, নিরপেক্ষ সাংবাদিকরা, গণতন্ত্রের পক্ষে সোচ্চার বুদ্ধিজীবীরা কি কম বিপদে পড়েছিলেন? কোথাও ‘আরবান নকশাল’, কোথাও মাওবাদী কিংবা অন্য কোনও নামে তাঁদের কয়েদ করা হয়েছে, কোথাও বা ক্রমাগত থ্রেটের মধ্যে রাখা হচ্ছে। সম্প্রতি চোদ্দ বছর আগের কেস খুঁচিয়ে তুলে লেখিকা অরুন্ধতী রায়কে UAPA দেওয়া হয়েছে। আসলে ওরা তো ভয় পায় এঁদেরকে-ই, কারণ মুক্তবুদ্ধি, যুক্তিবোধ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা তাদের প্রধান শত্রু। তাদের বুলডোজার শুধু ভিন্নধর্মীদের বাড়িঘর, দোকানপাট গুঁড়িয়ে দেয়নি, গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছে গণতন্ত্রকে, মুক্তচিন্তাকে, সাহসকে, মনোবলকে, দলিতকে, নারীকে…………।। এবং এখানেই তারা সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর।

 

হাথরাসের ঘটনা আমরা সবাই জানি। কী বীভৎস! কী ভয়ঙ্কর! এই একটি ঘটনাই যথেষ্ট শূদ্র ও নারীদের প্রতি সঙ্ঘীদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে। অবশ্য এ-ব্যাপারে তাদেরকে খুব দোষ দেওয়া যায় না, তারা কেবল শাস্ত্রবাক্য (বেদ, মনুসংহিতা) শিরোধার্য করেছেন। যেখানে নারী ও শূদ্রকে বারবার এক পংক্তিতে বসানো হয়েছে, যাদেরকে দান করা যায়, বিক্রি করা যায়, এমনকি হত্যাও করা যায়। হাথরাসের মেয়েটি একে তো নারী, তার উপর শূদ্র, তার আবার বাঁচার অধিকার আছে না-কি! না-কি অধিকার আছে নিজের দেহের উপর! সে তো উচ্চবর্ণ ও উচ্চশ্রেণির পুরুষদের জন্য বলিপ্রদত্ত। সুতরাং তাকে ধর্ষণ করার, তার জিভ কেটে নেওয়ার, পুড়িয়ে মারার এমনকি তার পরিবারকেও ধনে-প্রাণে শেষ করে দেওয়ার ‘অধিকার’ তাদের আছে বৈকি! বিশেষ করে যখন শাসক দল তাদের পাশে থাকে! কোনও সাংবাদিককে সেখানে পৌঁছতে দেওয়া হয় না, কেউ সত্যি খবর বের করে আনতে গেলে তাঁকে (সিদ্দিক কাপ্পান) UAPA দিয়ে দীর্ঘদিন জেলে পুরে রাখা হয়! যাঁরা মনে করেন বিজেপি হিন্দুদের বন্ধু, তাঁরা ভুলে যাবেন না হাথরাসের এই মেয়েটিকে, ভুলে যাবেন না সুধা ভরদ্বাজ, সোমা সেন, জিএন সাঁইবাবা, স্ট্যান স্বামী, কবি ভারভারা রাও-এর কথা। ভুলে যাবেন না শিশু আসিফার কথাও; যার ধর্ষণকারীদের মধ্যে একজন ছিল বিজেপির সাংসদ এবং এই ধর্ষণকারীর মুক্তির দাবিতে বিজেপি মিছিল বের করে। এমন ঘটনা ভারত কেন পৃথিবীর ইতিহাসেই বোধহয় বিরল।

আসলে নারীকে এরা মানুষ বলেই মনে করে না। মানে না সংবিধান এবং ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা। কারণ তারা ভারতের বিশাল এবং সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে না। সে বৈচিত্র্য ভাষা, ধর্মবিশ্বাস বা সংস্কৃতি যাই হোক না কেন। ১৯৯৩ সালের পয়লা জানুয়ারি সঙ্ঘ পরিবার এক শ্বেতপত্র প্রকাশ করে ভারতীয় সংবিধানকে হিন্দুবিরোধী বলে নিন্দা করে। মুখবন্ধে বলা হয়— “বর্তমান সংবিধান ভারতীয় সংস্কৃতির, চরিত্রের, পরিবেশের এবং অবস্থার বিরোধী। এটা বিদেশিভাবাপন্ন। … বর্তমান সংবিধানকে বাতিল করেই আমাদের কাজ করতে হবে।” সেখানে আরও বলা হয়েছে— “এই সংবিধান আমাদের যে ক্ষতি করেছে তার তুলনায় দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের ক্ষতি সামান্যই।”

তাহলে এই সংবিধান বাতিল করে কী নিয়ে আসা হবে? স্বাধীনতার পরপর-ই আরএসএস-এর মুখপত্র অর্গানাইজার[1]-এ লেখা হয় যে, সংবিধানের পরিবর্তে ‘মনুস্মৃতি’কে দেশের আইনে পরিণত করতে হবে। আরএসএসের প্রধান পথপ্রদর্শক শ্রীগোলওয়ালকার বা গুরুজি বলেছেন, “মানবজাতি এতাবৎকাল যতজন আইনপ্রণেতাকে পেয়েছে, তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন ভগবান মনু।”

তা কী আছে এই মনুসংহিতায়? দু-একটা উদাহরণ দিচ্ছি—

১। স্ত্রীলোক কখনওই স্বাধীনভাবে অবস্থান করবে না। (৫/১৪৮)
২। নারীহত্যা বা অব্রাহ্মণ হত্যা পাপ নয়। (১১/৬৬-৬৭)
৩। উত্তম জাতির সকামা কন্যাকে অধম জাতির পুরুষ যদি ভজনা করে তবে ওই পুরুষের দণ্ড হবে শারীরিক বধ…। (৮/৩৬৬)
৪। ধন অর্জনে সমর্থ হলেও শূদ্রকে কিছুতেই ধন সঞ্চয় করতে দেওয়া যাবে না, কেননা ধন সঞ্চয় করলে ব্রাহ্মণদের কষ্ট হয়। শাস্ত্রজ্ঞানহীন শূদ্র ধনমদে মত্ত হয়ে ব্রাহ্মণদের পরিচর্যা না করে অবমাননা করতে পারে। (১০/১২৯)
৫। সেখানে আরও বলা হয়েছে চণ্ডাল, শ্বপচ প্রভৃতি জাতির বাসস্থান হবে গ্রামের বাইরে। কুকুর এবং গাধা হবে তাদের ধন-স্বরূপ।

মহর্ষি মনু ‘কোনও অভিযোগ না করে উচ্চ তিন বর্ণের দাসত্ব করে যাওয়াকে শূদ্রের কর্তব্য বলে বর্ণনা করেছেন।’ কিন্তু তাঁর সমাজে নারী যেন অলিখিত শূদ্র। কোনও বর্ণেই তার মর্যাদা নেই, স্বাধীনতা নেই। পতিসেবাই তার একমাত্র ধর্ম। এবং পুত্রর্থে ক্রিয়তে ভার্যা। নারী সম্পর্কে আর যা যা বলা হয়েছে এখানে তা উল্লেখ করতেও আমার রুচিতে বাধছে। এই সমস্ত কারণেই বোধহয় আম্বেদকর মনুসংহিতা প্রকাশ্যে পুড়িয়েছিলেন। নারীকে কোনও ধর্মেই মর্যাদা দেওয়া হয়নি, তবে নারী ও শূদ্রকে এখানে যেমনভাবে অবমাননা করা হয়েছে, তেমনটা আর কোথাও না। শুধু ধর্মীয় গ্রন্থ হিসেবে যদি এটি থাকত, তাহলে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলত, কিন্তু সঙ্ঘীরা যে একেই সংবিধান করতে চায়! আপত্তিটা সেখানেই। অথচ মজার ব্যাপার এই শূদ্ররাই আজ তাদের বড় ভোটব্যাঙ্ক।

‘মনুবাদীরা রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসার পর মনুসংহিতাকে গ্রহণীয় করে তোলার জন্য সোশাল মিডিয়া, সংবাদপত্র, টিভি সিরিয়াল, সিনেমা আর নানা প্রচারযন্ত্র সূক্ষ্ম-স্থূল নানা কায়দায় কাজ করে চলেছে। তাই নারীবিদ্বেষী সংস্কৃতির (sexism-এর) আজ এত রমরমা।’ তার নানা বহিঃপ্রকাশও আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে শুরু করেছিলাম। যেমন ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাককে দায়ী করা, রান্নাঘরকে-ই নারীর সর্বোচ্চ স্থান বলে দেগে দেওয়া, জনসংখ্যা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে হিন্দু নারীদের অন্তত চারটি সন্তানের জন্ম দেওয়ার নিদান, ইত্যাদি। আর, কে না জানে— “ইয়ে তো সির্ফ ঝাঁকি হ্যায়/পিকচার আভি বাকি হ্যায়।” সত্যিই তাই, এ তো কেবল ট্রেইলার। এবারে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে যে তা কোথায় গিয়ে ঠেকত, বলা মুশকিল। ইতিমধ্যেই কোর্টের আদেশে পশ্চিমবঙ্গে ২০১০ সালের পরের OBC সার্টিফিকেট বাতিল হয়েছে। অর্থাৎ মুসলিমদের সংরক্ষণের তালিকা থেকে পুরোপুরি বাদ দেওয়ার আগাম সতর্কতা। এটা জেনে যাঁরা খুশি হচ্ছেন চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা কিছুটা কমল ভেবে, তাঁদের বলি এখানেই কিন্তু এই যাত্রা সমাপ্ত হবে না। এরপর আসবে SC-ST এবং তারপরেও যখন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না তখন প্রথম কোপটা পড়বে মেয়েদের উপর। মেয়েদের চাকরি করার কী দরকার! তারা সংসার সামলাবে, সন্তানপালন করবে, পতিসেবা করবে, এগুলোই তো তাদের কাজ! এভাবে নারীকে পুরোপুরি গৃহে আবদ্ধ করে তারা মনুমহারাজকে খুশি করবে।

নারী ভাববে কেন? সৃজন করবে কেন? মুক্ত আকাশে ডানা মেলার আকাঙ্ক্ষা তার কেন থাকবে! ‘ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি।’ এই সংস্কৃতি তাই মাতৃত্বকে মহীয়ান করে, নারীকে মাতৃরূপে পূজা করে, কিন্তু মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায় না।

 

গণতন্ত্রের কোনও ধার ধারে না এরা। কৌশলে পার্লামেন্টকে প্রায় বিরোধীশূন্য করে একের পর এক জনবিরোধী বিল যেভাবে পাশ করাতে শুরু করেছিল তাতে আশঙ্কা হচ্ছিল, চরম স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদের দাঁত-নখ বের করাটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। ভারতের জনগণকে স্যালুট, তারা এই স্বেচ্ছাচারী রথচক্রকে নিঃশব্দে আটকে দিয়েছে। পুরোপুরি না হলেও অনেকটা। আমরা তাঁদের আন্ডার-এস্টিমেট করেছিলাম। অযোধ্যার পরাজয়ও একটা বার্তা দিয়েছে। উত্তরপ্রদেশের মানুষদের সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা— তারা ধর্মান্ধ, জাত-পাত ছাড়া কিছু বোঝে না, তারাও দেখিয়ে দিয়েছে— ‘পেটের টানটা-ই বড় টান।’

একদিকে নীতীশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইডুর দ্বিমুখী অঙ্কুশ অন্যদিকে একটা শক্তিশালী বিরোধীপক্ষ— হয়তো কিছুদিনের জন্য আটকে দিল ফ্যাসিবাদের উত্থানকে, কিন্তু আত্মতুষ্টির কোনও জায়গা নেই। এখনও আমাদের সমাজে তাদের মতাদর্শগত প্রভাব প্রবল এবং এই মতাদর্শ মানুষের মনে গেঁথে দেওয়ার ব্যাপারে সঙ্ঘীদের নিষ্ঠা এবং ধৈর্য অবিসংবাদিত। তাই এগিয়ে থাকা মতাদর্শকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ অবিরত করে যাওয়া দরকার। ওদের বিষাক্ত ঘৃণার মতাদর্শের বিপরীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে মানুষের রুটি-রুজি-চাকরি আর অধিকারের প্রশ্ন। এ ব্যাপারে কাজ করার কিছুটা স্পেস অন্তত এই নির্বাচন আমাদের দিয়েছে।

 

ঋণ:


[1] ১৯৪৯-এর নভেম্বর এবং পরের ২৫ জানুয়ারি সংখ্যা।