Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বাড়ি বদলে যায়

বাড়ি বদলে যায় | প্রবুদ্ধ বাগচী

প্রবুদ্ধ বাগচী

 

গত শতকের ষাটের দশকের গোড়ায় ভারতীয় নৃতত্ত্ব সর্বেক্ষন (অ্যানথ্রোপলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া)-র সর্বাধিনায়ক ছিলেন প্রখ্যাত গান্ধিবাদী পণ্ডিত অধ্যাপক নির্মল কুমার বসু। সুখ্যাত এই মানুষটি ছিলেন প্রথমে ভূগোল তারপরে ভূতত্ত্ব ও শেষে নৃতত্ত্বের মেধাবী ছাত্র। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পরে গান্ধিজির ডাকে সাড়া দিয়ে যোগ দেন স্বাধীনতার আন্দোলনে। পরে মহাত্মাজির ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে দীর্ঘদিন তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিলেন। বিয়াল্লিশের আন্দোলনের সময় ও পরে ছেচল্লিশের নোয়াখালি দাঙ্গার সময় গান্ধিজির সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন পথে পথে। আর লিখছিলেন সেই সময়ের দিনলিপি, পরে বই হয়ে বেরোয় তাঁর সেইসব অমূল্য ডাইরি। এ-হেন প্রজ্ঞাবান মানুষটি ষাটের দশকে নৃতত্ত্ব বিভাগের পুরোধা থাকাকালীন তৎকালীন কলকাতার একটি নিবিড় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমীক্ষা করিয়েছিলেন যা ১৯৬৪ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয়, আজ আর পাওয়া যায় না। সম্ভবত এই মাপের সমীক্ষা তাঁর পরে আর কেউ করানোর কথা ভাবেনইনি। ষাটের দশকের গোড়ায় কলকাতা পুরসভার ছিল আশিটি ওয়ার্ড— প্রতি আটটি ওয়ার্ড-পিছু নিয়োগ করা হয়েছিল একজন গবেষক তথা ক্ষেত্র-সমীক্ষক। প্রায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন তাঁরা।

এমনই এক ক্ষেত্র-সমীক্ষক ছিলেন শ্রদ্ধেয় শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। পার্কসার্কাস ও বালিগঞ্জ এলাকার আটটি এলাকার তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। বিচিত্র সেই সব তথ্য আর অভিজ্ঞতার কথা সম্প্রতি শুনিয়েছেন শমীকবাবু। বৈচিত্র্য তো বটেই, তাঁর কথায় ধরা পড়েছে এক ধরনের অনন্যতা বা ইউনিকনেস যা একটা শহরের জনবসতির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মানচিত্রকে অনেকটা ছুঁতে পারে। কলকাতার পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে এটা হয়তো জানা যায়, যে আজ পার্কসার্কাস এলাকায় যেখানে মডার্ন হাই স্কুল বা বিড়লা কারিগরি সংগ্রহশালা আগে সেখানেই এক বিরাট প্রাসাদে সস্ত্রীক থাকতেন রবীন্দ্রনাথের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি জ্ঞানদানন্দিনীকে নিয়ে বিকেলে ঘোড়ায় চড়ে হাওয়া খেতে যেতেন আজকের বালিগঞ্জ স্টেশন এলাকায়, তখন সেখানে ঘোর জঙ্গল। আজকের রবীন্দ্র সরোবরের পুবে যেখানে গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন বা তাদের লাগোয়া ‘বেদি ভবন’ সরকারি অতিথিশালা— আদপে ওই পুরো এলাকাটাই ছিল এক পঞ্জাবি ব্যবসায়ী জনৈক বেদি-র। লটারিতে একলপ্তে অনেক টাকা জিতে তিনি ওই জমি ও লাগোয়া প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন, তাঁর প্রাসাদে পোষা হত চিতাবাঘ। শোনা যায় ওই অবাঙালি সাহেব নাকি, পোষ্য চিতাবাঘের গলায় বকলেস বেঁধে  প্রাতঃভ্রমণে বেরোতেন। ইতিহাস বরাবরই রোমাঞ্চের উপাদান ছড়িয়ে যায়। আর, বিনয় ঘোষ মশায়ের কথা মানলে স্বীকার করতে হয়, কলকাতাই একমাত্র শহর যা অচিন গাঁ থেকে সাম্রাজ্যের মেট্রোপলিট্যান রাজধানী হয়েছিল, তাই এর বিন্যাসের বিবর্তন অন্য শহরের সঙ্গে মেলে না, মিলিয়ে দেখা উচিতও নয়।

কিন্তু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দিক থেকে তার চেয়েও বড় রোমাঞ্চ হল, এই ধরনের অনুসন্ধানে স্থানীয় একটি জনপদের চরিত্রের বদল আশ্চর্যভাবে টের পাওয়া যায়। যেভাবে বলছিলেন সেদিন শমীকবাবু। বালিগঞ্জ-পার্কসার্কাস এলাকার জলজঙ্গল কেটে কীভাবে গড়ে উঠছিল একটা এলাকা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশিষ্ট মানুষরা এসে বাসা বাঁধছিলেন সেখানে, তৈরি হয়ে উঠছিল এক বুধমণ্ডলী। শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতের দিকপালদের একসঙ্গে বেঁচে থাকা থেকেই সেখানে তৈরি হয়ে উঠল স্কুল, পরে কলেজ, সঙ্গীত শিক্ষাসত্র। বদলে গেল এলাকার সামাজিক সাংস্কৃতিক চিত্র, বাসিন্দাদের বিন্যাস। এসব ঘটনার পরে আরও ষাট বছর গড়িয়ে গিয়েছে— আজ হয়তো ওই এলাকার মুখচ্ছবি আদৌ আর তেমন নেই, ভিনপ্রদেশের বাসিন্দারা এসে হর্ম্য বানিয়েছেন, নিজেদের ধান্দার মতো করে গড়েপিটে নিয়েছেন তাদের নিজস্ব এলাকা। এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই বদলের ধারাবিবরণী জমিয়ে রাখার মতো উদ্যোগ আর শ্রম আজ বিরল। আর এইভাবেই বদলে বদলে গেল রাজ্যের কত জনপদ, কত শিল্পাঞ্চল, মফস্বল— বাসিন্দারাই পাল্টে গেলেন, আমূল চরিত্র খোয়াল সেই জনপদ। আমরা আর তার হিসেব রাখিনি।

 

দুই.

উত্তর শহরতলির দেড়শো বছরের প্রাচীন বরানগর পৌরসভার এমন একটি ওয়ার্ডের কথা মনে করতে ইচ্ছে হয়। বর্তমান সীমানা অনুযায়ী এই এলাকা পনেরো নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়ে। স্বাধীনতার পর পর যখন বাস্তুহারার স্রোত আস্তে আস্তে ঘন হতে শুরু করেছে শহর কলকাতার প্রান্তীয় এলাকাগুলোতে, তখনই সরকারের উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতর এই অঞ্চলে একটি বিরাট জমি অধিগ্রহণ করে। ধীরে ধীরে সরকারি উদ্যোগে সেই জমিতে তৈরি হয় অনেকগুলি ফ্ল্যাটবাড়ি, প্রতি বাড়িতে ছটি করে পরিবার বাস করতে পারে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের মধ্যে প্রচুর খোলা জমি, যেখানে এলাকার বাসিন্দাদের খেলার জায়গা, সঙ্কীর্ণ চায়ের গুমটি। পুরো এলাকাতেই পুনর্বাসন দেওয়া হয় ওপারের ছিন্নমূল বাসিন্দাদের। আয়তনে যে ফ্ল্যাটগুলি খুব বড় তা নয়, তেমন হওয়া সম্ভবও ছিল না। সরকারিভাবে কলকাতার ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট বা হাওড়ার ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট যেসব ফ্ল্যাট স্বল্পভাড়ায় নিম্নবিত্তদের দিতেন তাদেরও আয়তন খুব বড়, এমন আমার অভিজ্ঞতায় নেই। হাওড়ার কদমতলা এলাকায় বা দমদমে বা পদ্মপুকুরে যেসব সরকারি ফ্ল্যাট, সেগুলো নিতান্তই ছোট। এগুলোও তাই। ওরই মধ্যে দিন গুজরান করছিলেন বাসিন্দারা। যে যার মতো ছোটখাটো জীবিকায় লগ্ন হয়ে যাওয়া, অল্প আয়ের মধ্যে পরিবার পালনের সংস্থান, মিতায়ত স্বপ্নের আলোয় পা তোলা পা ফেলা।

নয়ের দশকের মাঝামাঝি ওই এলাকায় ঘুরে দেখেছি, বাসিন্দাদের সরকারি আবাসনে ঠিক ততটা হতশ্রী মালিন্যের ক্ষত নেই। ইতিমধ্যে উদ্বাস্তু সমস্যা রাজ্যের অগ্রাধিকার থেকে সরে গিয়েছে। কলকাতার বিখ্যাত উদ্বাস্তু কলোনি বিজয়গড়, যাদবপুর, রামগড়, নাকতলা এলাকায় আশির দশকের শেষের দিকেই দেখেছি বেশ সুশ্রী ও সম্পন্ন সব বাড়িঘর, ভাড়া নিতে গেলে বেশ চড়া দাম গুনতে হয়। তবে বোঝা যায়, একসময় টালির চালা থেকে আস্তে আস্তে নির্মিত হয়েছে এগুলি, তখনও তাদের অঙ্গে সেইসব পুরনো দিনের বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞান। তবে বরানগরের এই এলাকায় মূলত সরকারি আবাসন, তাই নিজেদের বাড়তি কিছু করার সুবিধা নেই। একেবারে নেই বললে ভুল হবে। যাঁরা একতলার বাসিন্দা তাঁরা অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দিয়ে নিজেরা বাড়িয়ে নিয়েছেন বসত। তারই পাশে বেড়ে উঠেছে পুঁইমাচা, ছোট লাউয়ের গাছ, গাঁদা বা সন্ধ্যামণি ফুলের ঝাড়। গোড়ার দিকে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এলাকার প্রাচীর বেশিটাই ভাঙা, যেটুকু আছে তার গায়ে গায়ে গড়ে উঠেছে হিসেব-বহির্ভূত গুমটি দোকান।

যে এলাকার কথা বলছি তার সামনেই এক প্রকাণ্ড জলাভূমি। মূলত মৎস্যজীবীদের আঞ্চলিক সমবায় এই জলাভূমির দেখাশোনা করে। মাছের চাষ হয়, মাছ ধরাও হয় প্রকাণ্ড জাল দিয়ে। এই জলা বা পরিভাষায় লেকের পশ্চিমপ্রান্তে সুপ্রাচীন ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র কলেজ, আরেকটু এগিয়ে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ কলেজ (পূর্বতন বনহুগলি কলেজ অফ কমার্স), আরেকপাড়ে পুবদিকে আছে সারদা গার্লস হাইস্কুল— মোটের ওপর সারস্বত পরিবেশে এলাকার গর্ব হওয়ার মতনই ব্যাপারস্যাপার। নয়ের দশকের মাঝামাঝি ওই প্রকাণ্ড লেকে নৌকাবিহারের ব্যবস্থাও চালু করেছিলেন নিয়ামক সমবায় সমিতি, গ্রীষ্মবিকেলে প্যাডেল বোট ভেসে বেড়াত গভীর সরোবরের জলে। তবে সব মিলিয়ে এই আয়োজনগুলি খুব যে জমকালো ছিল এমন নয়। লেকের চারপাশে যথেষ্ট আগাছা, একপাশে জমাট পানা, পাড়ের মাটি এবড়োখেবড়ো— আধুনিক লব্জে যাকে ‘সৌন্দর্যায়ন’ বলা হয় তার প্রবল আগ্রাসন আদৌ সেখানে ছিল না। লেকের দক্ষিণপাড়ে একটি সিনেমাহল তখনও বেশ গমগম করে চলত, স্বাভাবিকভাবে সিনেমার দর্শকদের মুখ চেয়ে দুয়েকটা চায়ের দোকান বা চপ কাটলেট রোল চাউমিনেরও বিক্রিবাট্টা হত। অবশ্য এই সব দোকানই তৈরি হয়েছিল স্থানীয় রাজনীতির প্রশ্রয়ে এবং লেকের জলরেখা আড়াল করে। আর লেকের উত্তরপ্রান্তে ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের রিহ্যাবিলেশন ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন বা আরআইসি-র কারখানা। পাশাপাশি দমদম-ডানকুনি রেললাইনের সীমানা পর্যন্ত বিছিয়ে ছিল নানা ছোটখাটো কারখানা যার ফলে এলাকার নামটাই হয়েছিল বনহুগলি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট। এলাকার সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক এসবিআই-এর আঞ্চলিক শাখার নাম-ই ছিল বনহুগলি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট শাখা— ছিল নয়, আজও তার একই নাম। কিন্তু কলকাতার খুব কাছেই এত বড় জলাভূমি এলাকার মানুষের হাঁফ ছাড়ার ফুসফুস, এ তো মস্ত পাওনা। অবশ্য তখন আর কে জানত এই স্থানীয় জলাভূমি বা লেক-ই হয়ে উঠবে এলাকার চরিত্র বদলের নিশানা!

 

তিন.

শতাব্দীর প্রথম দশকের মাঝামাঝি যখন রাজ্যে শিল্পায়নের বাদ্যি বেজে উঠল তখন তার একটা পরোক্ষ অভিক্ষেপ এসে পড়ল এলাকায়। যদিও তখন আরআইসি ধুঁকতে ধুঁকতে চলে, অন্যান্য শিল্পগুলিও খুব বলার মতো জায়গায় নেই— নতুন শিল্পায়নের তালিকায় এদের পুনরুজ্জীবনের কোনও দিশা ছিল না। আরআইসি যেহেতু কেন্দ্রীয় সংস্থা সুতরাং রাজ্য হাত ধুয়ে ফেলে, বাকিগুলি নিয়েও তেমন কথাবার্তা শোনা গেল না। পরিবর্তে শিরোনামে এল উদ্বাস্তু কল্যাণ দফতরের তৈরি ওই বিশাল আবাসন ও সংলগ্ন জমি। রাজ্যের সরকার স্থির করলেন ওই বিরাট জমিতে তাঁরা কর্পোরেট সংস্থার সঙ্গে জুটি বেঁধে আবাসন কমপ্লেক্স তৈরি করবেন। আগেই বলেছি, ওই এলাকার বাসিন্দারা ততদিনে নিজেদের উদ্বাস্তু পরিচয় ঘুচিয়ে অনেকটাই থিতু হয়েছেন। এমন অনেক পরিবারও ছিল যারা নিজেরা আর ওই সরকারি আবাসে থাকে না কিন্তু দখল ছাড়েনি। মনে পড়তে পারে সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণের সময়েও এমন অনেক জমির মালিক ছিলেন যারা সরাসরি জমি চাষ করতেন না— এঁদের বলা হত অ্যাবসেন্টি ল্যান্ডলর্ড। এখানে ব্যাপারটা তেমন নয় তবে অনেক বাসিন্দাই ওই সঙ্কীর্ণ পরিসর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তবু তাঁরা কিন্তু সংখ্যাগুরু নন। ফ্ল্যাট পাওয়া বেশিরভাগ পরিবার ওখানেই থাকতেন এবং খোঁজ নিয়ে দেখেছি ওই এলাকার ছোট চায়ের দোকান, দশকর্মা দোকান, ইলেকট্রিক সরঞ্জামের দোকান, মাছবিক্রেতা, জেরক্সের দোকান, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, গ্যারেজ মিস্ত্রি এইসব উদ্যোগের সঙ্গে যাঁরা জড়িয়ে তাঁদের আবাস ছিল ওইটাই।

সরকারপক্ষ যে এগুলো জানত না তা নয়। বিশেষ করে এলাকার স্থায়ী বাসিন্দাদের পুনর্বাসন না দিয়ে যে এত বড় প্রোজেক্ট সফল হবে না এটা তারা মেনেই নিয়েছে। বাসিন্দাদের কাছে দুটো বিকল্পের প্রস্তাব ছিল। হয় তারা সরকারের থেকে এককালীন মোটা টাকা নিয়ে নিজেদের দখল ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে যান অথবা যাঁরা এই আবাসনেই থাকতে চান তাঁরা আপাতত অন্যত্র ভাড়াবাড়ি নিয়ে থাকুন, প্রকল্প এলাকার মধ্যে সরকার তাঁদের জন্য একটা আলাদা বহুতল গড়ে দেবে, যতদিন না তা পাচ্ছেন সরকার তাঁদের ভাড়া বহন করবে। কিন্তু বিষয় হল, যে-কোনও স্থিতাবস্থাতেই সামান্য ঢেউ উঠলেই তা জোয়ারের চেহারা নেয়, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। এটা ঠিক, ওই বিশেষ যুগমুহূর্তে রাজ্যের সরকার শিল্পায়নের বিষয়ে যাকে বলে একটু হাইপার হয়ে উঠেছিলেন। আর এই মেজাজ দেখে একটা মহল সরকারের সামনে নানা নতুন নতুন প্রোজেক্টের আইডিয়া বিপণন করছিলেন। এমনই এক রিয়েল এস্টেট গোষ্ঠীর নজর পড়েছিল এই প্রকাণ্ড জমির ওপর— যাতায়াত বা আর সব দিক দিয়ে সুবিধেজনক এমন এক ভূখণ্ডে দামি আবাসন গড়তে পারলে যে লোহা সোনা হয়ে যাবে এটা হিসেব করতে তাদের অসুবিধে হয়নি। তাই সরকারি মহলে কথাচালাচালির মধ্যেই এলাকায় প্রচার হয়ে গেল ওই আবাসনের বাসিন্দাদের নাকি উচ্ছেদ করে দেওয়া হবে, দেওয়ালে সাঁটা হয়ে গেল ইতস্তত পোস্টার। এই প্রচারে সরাসরি ঘি ঢাললেন স্থানীয় আইনজীবী কাউন্সিলর যিনি ছিলেন সেই সময়ের বিরোধীদলের আঞ্চলিক নেত্রী। মনে রাখতে হবে, এটা সেই সময় যখন সারা রাজ্যেই জমিদখল-বিরোধী গণবিক্ষোভ ক্রমশ হয়ে উঠছে রাজনীতির মূল স্রোত। স্থানীয় মানুষের প্রতিরোধ ও প্রতিবাদকে গিলে নিচ্ছে রাজনীতির নিয়ামকরা, প্রচারমাধ্যম তুঙ্গ উৎসাহে ভাসিয়ে দিচ্ছে নানা গালগল্প এবং একইসঙ্গে একটি দুটি মুখের ওপর ফেলে রাখছে সুতীব্র আলো, এমনই সেই চোখধাঁধানো আলো যে জনগণ নামের এক বায়বীয় সত্তা সমস্ত অন্ধকার ভুলেও আঁকড়ে ধরতে পারে কোনও মোহিনী সম্মোহন।

এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। আদপে কী হল, সরকার কী বলল, কতটুকু বলল বা ভাবল জানাবোঝার আগেই একদল বাসিন্দাকে সন্ত্রস্ত করা হল খুব পরিকল্পিতভাবে। সন্ধে হলেই এলাকায় মিছিল বেরোয়, সেখান থেকে ‘উচ্ছেদ’ বাতিল করার আওয়াজ ওঠে, আবাসন প্রকল্প কিছুতেই গড়তে দেওয়া হবে না এই মর্মে শপথ নেওয়া হয়। স্থানীয় চায়ের দোকানে, কাপড়ের গুমটি বা চিকেনের দোকানের রবিবার সকালের কেনাকাটায় মৃদু আড্ডায় আলোচিত হতে থাকে এইসব কথাবার্তা। বাস্তবের হিসেবে এলাকায় বামপন্থী দলের ভোট বেশি, উদ্বাস্তু আবাসনের বেশিরভাগ মানুষই স্বাভাবিক বিবেচনায় রাজ্যের শাসক দলের সমর্থক— তবু তাঁদের মনে ইতিউতি প্রশ্নের ও সংশয়ের আনাগোনা। সত্যিই কি তাঁদের এতদিনের বাসস্থান থেকে উপড়ে ফেলা হবে? নাকি এই প্রচার শেষ পর্যন্ত বিভ্রান্তির? কিন্তু তখনকার বাস্তব প্রেক্ষিত এমনই যে রাজ্যের সাড়ে তিন দশকের কাছাকাছি ক্ষমতায় থাকা শাসকগোষ্ঠী ঘিরে মানুষের মনে দোলাচল— সিঙ্গুরে জমি আন্দোলনে তাদের বাড়াবাড়ি রকম প্রতাপ মানুষ দেখছেন টিভি চ্যানেলে, দেখছেন খেজুরি নন্দীগ্রামের এলাকা দখলের সশস্ত্র ‘লড়াই’। কতটুকু ঠিক কতটাই বা বেঠিক এই যুক্তিক্রম মানুষের কাছে ক্রমশ আবছায়া। ছোট্ট একটা এলাকার মূলত শ্রমজীবীবি মানুষও সেদিন নিজেদের অবস্থান নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়লেন। অবশ্য টানাপোড়েনের মধ্যেই আইনজীবী বিরোধী নেত্রী আদালতে মামলা করলেন এই ‘দখলদারি’ নিয়ে। কেউ কেউ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন, ভাবলেন আদা্লতের আওতায় চলে যাওয়া মানে এবার আন্দোলনের বিরতি— অন্তত মহামান্য আদালত এমন কিছু বলবেন না যাতে তাঁদের স্বার্থের হানি হয়। বেশ কিছুদিন সব থিতিয়ে গেল। আদালতের নিত্যদিনের শুনানি প্রকাশ্যে আসে না, তাই কী হয় আর জানা যায় না। তবে এই টানাপোড়েনে স্থানীয় মানুষের মধ্যে দুটো ভাগ হয়ে গেল— একদল ক্ষতিপূরণের এককালীন অর্থ নিয়ে নিজেদের মতো সরে যেতে চান আরেকদল তখনও ওই একই জায়গায় টিকে থাকতে বদ্ধপরিকর। সরকার থেকে বিদায় নেওয়ার আগে রাজ্যের পূর্বতন শাসকদল আরও একবার এই ‘ইচ্ছুক’ আর ‘অনিচ্ছুক’-দের খতিয়ান নিল। আশ্চর্য এই যে বেশ কিছু পরিবার সরকারের ডাকে সাড়া দিল। স্থানীয় এক মাছ-বিক্রেতা আমায় সেই সময় বলেন, আমরা লালপার্টির সমর্থক, সরকার যখন বলছে আমাদের কিছুদিনের জন্য অন্যত্র থাকার ভাড়া ও এককালীন ক্ষতিপূরণ দেবে আমরা তাদের বিশ্বাস করব। এই ধরনের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সমস্যা ছিল একটাই। এতদিন ধরে তাঁরা নিজেদের বাসস্থানের কাছেই জীবিকা অর্জন করেছেন, ফলে, নিজেদের স্থায়ী আবাস এলাকা থেকে দূরে চলে গেলে দৈনন্দিন কাজের কিছুটা ছন্দ কেটে যায়। তবু একটা অংশ মেনে নিলেন। যদিও বিরোধী দলের পক্ষে তাঁদের এটা নিয়ে ভয় দেখানোও হয়েছিল বলে খবর পাওয়া গেছিল। দলের ভিড় কমে গেলে আন্দোলনও বোধহয় গায়ে গতরে কমে যায়!

সে যাই হোক, অনেকেই চলে গেলেন এলাকা ছেড়ে। আমি যে পরিবারটির কথা বলছি তারা পঞ্চাশের দশক থেকে তিন পুরুষ ধরে মাছের ব্যবসা করত, তারা চলে গেল আগরপাড়ার এক ভাড়ার ফ্ল্যাটে আর সরকারিভাবে কুড়ি লক্ষ টাকাও পেয়ে গেল, ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচন ঘোষণার আগেই। ইতিমধ্যে এলাকার সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে গেছে, লেকের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট সমবায় সমিতি বেশ কিছুটা ম্লান, নৌকাবিহারের বন্দোবস্ত বন্ধ হয়ে গেছে। একই সঙ্গে লেকের পাড়ে গড়ে উঠেছে আরও নানা গুমটি দোকান— কাঠের গোলা, চুনসুরকির দোকান, মোটরসাইকেল গ্যারেজ ইত্যাদি ইত্যাদি। হই হই করে বিধানসভা নির্বাচন হয়ে গেল, পুরনো শাসকদল ক্ষমতা হারাল, তার কিছু আগে বরানগর পুরসভাতেই জিতে এসেছেন বিরোধীরা, এলাকার আইনজীবী নেত্রী এখন সেখানকার চেয়ারপার্সন। বলতে গেলে টইটম্বুর এক ক্ষমতার হস্তান্তর।

 

চার.

নতুন সরকার আসার এক বছরের মধ্যেই এলাকার মানুষ দেখলেন বড় রাস্তার মোড়ে বিটি রোডের ওপর একটা ইস্পাতের তোরণ নির্মাণ হতে। তার ওপর বিশাল আকারে লেখা হল একটি আবাসনের নাম যার মূল নির্মাণকারী ও বিপণন সংস্থা একটি দামি রিয়েল এস্টেট সংস্থা, নিচে রইল সরকারি উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতরের নাম যারা আসলে সহযোগিতা করছেন এই প্রকল্পে। সহযোগিতা মানে আর কিছুই নয়, অত বিরাট মাপের জমি বাজারের মূল্যে নির্মাতা সংস্থাকে কিনতে হল না, বিনিময়ে হয়তো তারা সরকারকে কিছু সুবিধে দেবে। খুব অল্প দিনের মধ্যেই ওই বিশাল এলাকা ঘেরার কাজ শুরু হয়ে গেল, রাস্তার দুদিকে নতুন আবাসনের নাম, বুকিং করার হাতছানি। এসে গেল জেসিবি, তৈরি হল শ্রমিকদের ছোট ছোট খুপরি, আকাশচুম্বী ক্রেন থেকে বিস্তর যন্ত্রপাতি বড় বড় লরি করে এসে জড়ো হল সেখানে। যাঁরা ওই আবাসনেই নিজেরা থেকে যাবেন বলে বুক বেঁধেছিলেন, তাঁরা কোথায় গেলেন জানি না— বছর খানেকের মধ্যেই দেখা গেল এলাকাটি আড়ে বহরে যথেষ্ট বড় কারণ ততদিনে সমস্ত পুরনো ফ্ল্যাটবাড়িগুলি ভ্যানিশ। ঘটনাচক্রে এই পুরো প্রকল্পে যিনি গোড়ায় বাধা দিয়ে জনস্বার্থ-র প্রসঙ্গ তুলেছিলেন, সেই নেত্রীর নিজের বাড়িটি একদম প্রকল্প এলাকার পাশেই। হয়তো ইতিমধ্যে তিনি এই প্রকল্পের মধ্যে বিপুল উন্নয়নের সুবাস আবিষ্কার করে থাকবেন সুতরাং এলাকার বাসিন্দাদের প্রায় নীরব সম্মতিই যেন মিলে গেল এইভাবে।

দিন যায় মাস গড়ায়। মূলত চারপাশের উদ্বাস্তু জনবসতির ভিতর থেকে মাথা তুলতে থাকে স্পর্ধিত চার-পাঁচটি টাওয়ার, প্রতিটি হয়তো বাইশ-পঁচিশ তলা হবে— যেভাবে চিত্রতারকাদের দিয়ে বিজ্ঞাপিত হতে থাকে আবাসনের ফ্ল্যাটগুলি তাতে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে এদের দামও বেশ চড়া। হবেই। কারণ আধুনিক জীবনের সবটুকু বলতে যা বোঝানো হয়— বাগান, সুইমিং পুল, কাফে, জিম এবং মন্দির সবই পাওয়া যায় এসব আবাসনের মধ্যে। কার্যত প্রকাণ্ড গেট দিয়ে সাঁই করে গাড়ি ক্যাম্পাসের মধ্যে একবার ঢুকে পড়তে পারলে বাকি পৃথিবী অবান্তর হয়ে যায়। সুউচ্চ বিশতলার ব্যালকনি থেকে দেখলে নিচের পৃথিবী বড় মায়াময় ঠেকে। তার ওপর সামনে অমন ছড়ানো জলাভূমি। হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি— গগনচুম্বী আবাসন যাঁরা বানিয়ে দিলেন তাঁরা কবুল করেই নিয়েছিলেন সামনের এই বারিধিরেখা তাঁরা ‘তাঁদের মতো করে’ সুন্দর করে দেবেন, তার একটা বড় কারণ তাঁদের আবাসনের যে বিজ্ঞাপিত নাম তার মধ্যে ঢুকে আছে ‘লেক’ শব্দটি। মানুষ তো শুধু শব্দ কিনবেন না, হাতে চাইবেন তার বাস্তব ব্যঞ্জনা তাই জলাভূমির দিকেই এগিয়ে এল উন্নয়নের জেসিবি। আবাসন সংলগ্ন লেকের পাড়ে পাথরের বেঞ্চি বসল, হল মার্বেল পাথরের এক মাঝারি মন্দির, আবাসিকরা সকালে বিকেলে সেখানে ঘণ্টা নেড়ে তাঁদের অস্তিত্বের জানান দেন— তার থেকেও সর্বনাশ হল ওই একটা পাড়ে জলের ধারে লাগানো হল সুতীব্র আলো। লেকের পাড় জুড়ে বড় বড় গাছ, সেখানকার পাখিদের রাতের ঘুম নির্বাপিত হল ‘জনস্বার্থে’।

এসব ঘটনার পরেও কেটে গেছে আরও কয়েকটা বছর। প্রথম আবাসনের সাফল্য দেখে পাশে পাশে তৈরি হচ্ছে আরও সব প্রকাণ্ড আবাসন, বাহারি তাঁদের নাম। এখন ওই এলাকায় গেলে আর মনেও পড়ে না ওই জীর্ণ ফ্ল্যাটবাড়িগুলিকে, তাঁদের লাগানো গাঁদা সন্ধ্যামণি লাউ পুঁই তলিয়ে গেছে কোথায় কোন বিস্মরণের অতলে, আর সেখানকার নাছোড় বাসিন্দাদেরই বা কী হল? তাঁরা কি ওইখানেই পুনর্বাসনের ফ্ল্যাট পেলেন? সম্ভবত নয়। কারণ বছর খানেক আগেই ওই এলাকায় ঘুরে দেখলাম আসলে জনবসতির চেহারাই বদলে গেছে ভিতরে ভিতরে। সব কিছু এত প্রকাণ্ড বিশাল ও ঝকঝকে যে ভয় করে। আবাসনের মূল গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতে গেলে আলাদা করে স্মার্টফোনে অ্যাপ ডাউনলোড করতে হয়, সেই অ্যাপবাহিত বার্তা বিপরীত প্রান্ত থেকে অনুমোদন পেলে তবেই আগন্তুক পৌঁছাতে পারবেন গন্তব্যে— যেন বা ফোর্ট উইলিয়াম বা লালবাজার! এইসব আবাসনের আবাসিকদের জীবন কতদূর অবধি দামি হতে পারে আমাদের ধারণাতেই আসে না।

বদলে গেছে এলাকা। ছোটখাটো খাওয়ার দোকান নেই। আবাসনের বাইরেই গড়ে উঠেছে একটা ফ্যামিলি রেস্তোরাঁ— নিচু আলোয় শীতল। সেখানে সন্ধেবেলা বার মিউজিকের আসর বসে। আমারই পরিচিত এক তরুণ সেখানে প্রতি সন্ধ্যায় মিউজিক কনসোলে কাজ করে দৈনিক রোজ পায়। বাবুবিবিরা আসেন শরীর মনের অবসাদ জুড়োতে। দীর্ঘদিন ধরে যাদের চিনতাম, সেই দোকানিরা আর প্রায় কেউই নেই। এলাকার পুরনো বাজারটি দীর্ণ, কারাই বা বাজার করবে সেখানে? কে কোথায় হারিয়ে গেছেন। সম্প্রতি লন্ড্রি ব্যবসায়ে ঢুকে পড়েছে কর্পোরেট হাউস, খুব ভেবেচিন্তে তাদের প্রথম আউটলেট তৈরি হয়েছে এখানেই। আসলে এগুলো একটা শৃঙ্খল যা অনেকটা ইকোসিস্টেমের মতোই স্তরে স্তরে সুবিন্যস্ত— কার পরে কে আসবে, এটা বলে দেওয়া যায়। সব মিলিয়ে এটা একটা ভিন্ন জীবন ভিন্ন মাত্রা। জীবনের সমস্ত শর্ত উজাড় করে প্রকাণ্ড এক পাওয়ার সামনে স্ফূর্ত দাঁড়িয়ে আছে এক বাসভূমি। সাবেকি বাস্তুহারাদের এখানে মানায় না, তাই তাঁরা আর নেই। তাঁদের সবার বাড়ি বদলে গেছে।